ভূমিকা : আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো ই‘তিকাফ। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের পাপ মোচনের জন্য বিশেষ কিছু সুযোগ দিয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রামাযান মাসের শেষ দশকের বরকতময় রজনি ‘লায়লাতুল ক্বদর’, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সেই রজনি পাবার জন্য ই‘তিকাফ এক বিশেষ ব্যবস্থা। আলোচ্য নিবন্ধে ই‘তিকাফ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু আলোকপাত করা হলো—
ই‘তিকাফেরপরিচয় : اعتكاف শব্দটি عكف শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ: নিজেকে কোনো স্থানে বদ্ধ রাখা। পরিভাষায় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে মসজিদে ইবাদত ও তেলাওয়াতের মধ্যে বদ্ধ রাখা।[1]
ই‘তিকাফের শারঈ হুকুম : ই‘তিকাফ শরীআত নির্দেশিত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। মহান আল্লাহ বলেন,﴿وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ﴾ ‘আর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ই‘তিকাফকারী ও রুকূকারী-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো’ (আল-বাক্বারা, ২/১২৫)। আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রামাযানে শেষ ১০ দিন ই‘তিকাফ করতেন। এমনকি যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ই‘তিকাফ করেন। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانٍ عَشْرَةَ أَيَّامٍ فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রামাযানে ১০ দিন ই‘তিকাফ করতেন। যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ই‘তিকাফ করেন’।[2]
উল্লেখ্য, আমাদের দেশে মনে করা হয় যে, সমাজের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তিকে অবশ্যই ই‘তিকাফে বসাতে হবে, তা না হলে সবাই গুনাহগার হবে। কিন্তু এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। বরং এটি ব্যক্তিগত ইবাদত।
ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য : ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, গুনাহ মাফ এবং লায়লাতুল ক্বদরকে অন্বেষণ করা। আবূ সাঈদ খুদরী রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্বদরের রাত অন্বেষণ করার উদ্দেশ্যে তাঁর কাছে স্পষ্ট হবার পূর্বে রামাযানে মধ্য ভাগের ১০ দিন ই‘তিকাফ করলেন। ১০ দিন অতিবাহিত হবার পর তিনি তাঁবু তুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তা গুটিয়ে ফেলা হলো। অতঃপর তিনি জানতে পারেন যে, তা শেষ ১০ দিনের মধ্যে আছে। তাই তিনি পুনরায় তাঁবু খাটানোর নির্দেশ দিলেন। তাঁবু খাটানো হলো। এরপর তিনি লোকদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে লোক সকল! আমাকে ক্বদরের রাত সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল এবং আমি তোমাদের তা জানানোর জন্য বের হয়ে এলাম। কিন্তু দু’ব্যক্তি পরস্পর ঝগড়া করতে করতে উপস্থিত হলো এবং তাদের সাথে ছিল শয়তান। তাই আমি তা ভুলে গেছি। অতএব তোমরা তা রামাযান মাসের শেষ ১০ দিনে অন্বেষণ করো’।[3]
ই‘তিকাফের স্থান : ই‘তিকাফের জন্য মসজিদ হওয়া শর্ত। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস এবং হাসান রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত হাদীছে এসেছে যে, ‘ছালাত (তথা জামাআত হয়), এরূপ মসজিদ ব্যতীত ই‘তিকাফ হবে না’।[4]
ই‘তিকাফের সময়সীমা : ২০ রামাযান অতিবাহিত হওয়ার পর মাগরিবের পর ই‘তিকাফে প্রবেশ করবে। কেননা শেষ দশক আরম্ভ হয় ২০ রামাযানের সূর্য ডুবার পর থেকে।[5] আর ২১ তারিখ ফজরের পর হতে ই‘তিকাফকারী সম্পূর্ণ একাকী ইবাদতে মশগূল থাকবে।[6] আর ঈদের আগের দিন বাদ মাগরিব ই‘তিকাফকারী ই‘তিকাফ হতে বের হবে।
মহিলাদের ই‘তিকাফের বিধান : মহিলাদের জন্য ই‘তিকাফ শরীআতসম্মত। মহিলারা বাড়িতে ই‘তিকাফ করতে পারবে না। বরং মহিলা-পুরুষ সবাইকে মসজিদে ই‘তিকাফ করতে হবে (আল-বাক্বারা, ২/১৮৭)। উল্লেখ্য, মহিলারা মসজিদে ই‘তিকাফ করতে চাইলে অবশ্যই স্বামীর অনুমতি থাকতে হবে এবং মসজিদে পর্দার ব্যবস্থা ও ফেতনার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হওয়ার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মৃত্যুবরণ করলেন, তারপর তাঁর স্ত্রীগণ ই‘তিকাফ করতেন।[7] এই হাদীছ প্রমাণ করে যে, মহিলারা ই‘তিকাফ করতে চাইলে জুমআ মসজিদেই করবে। আর যদি মসজিদে করা সম্ভব না হয়, তাহলে ই‘তিকাফ করবে না।
যেসব কাজ করলে ই‘তিকাফ বাতিল হয় :
(ক)স্ত্রী সহবাস : স্ত্রী সহবাস করলে ই‘তিকাফ বাতিল হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ ‘আর তোমরা স্ত্রীগমন করো না, যখন তোমরা মসজিদে ই‘তেকাফ অবস্থায় থাকো’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৭)।
(খ) শারঈওযর ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হওয়া : ই‘তিকাফকারী কোনো অবস্থাতেই মসজিদ থেকে বের হবে না। তবে পানাহার, প্রস্রাব-পায়খানা এবং শারঈ কোনো ওযর থাকলে বের হতে পারবে। আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,اَلسُّنَّةُ عَلَى المُعْتَكِفِ اَنْ لاَ يَعٌوْدَ مَرِيْضًا ولاَ يَشْهَدَ جَنَا زَةً وَلاَ يَمَسَّ إِمْرَأَةً وَلا يُبَاشِرَهَا وَلَا يَخْرُجَ لِحَاجَةٍ اِلاًّ لمَا لَابُدَّ مِنهُ وَلَا اِعْتِكَافَ اِلَّا بِصَوْمٍ وَلَا اِعْتِكَافَ اِلَّافِى مَسْجِدٍ جَامِعٍ ‘ই‘তিকাফকারীর জন্য সুন্নাত হচ্ছে, সে কোনো রোগীর সেবা করতে মসজিদ থেকে বের হবে না। কোনো জানাযায় উপস্থিত হবে না। স্ত্রীর সাথে সহবাস করবে না। (শারঈ) প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হবে না। ছিয়াম ব্যতীত কোনো ই‘তিকাফ নেই। জামে‘ মসজিদ ব্যতীত কোনো ই‘তিকাফ নেই’।
পরিশেষে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ই‘তিকাফের মাসআলা-মাসায়েল যথাযথভাবে উপলব্ধি করত তা মেনে চলার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মো. দেলোয়ার হোসেন
অনার্স ১ম বর্ষ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. ফিক্বহুস সুন্নাহ, (শতাব্দী প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ : ২০১০ খ্রি.), ১/৩৮৮।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৪৪।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/২০১৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭।
[4]. বায়হাক্বী, হা/৮৩৫৫।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭২; ফাতাওয়া ইবনু উছায়মীন, ২০/১২০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[6]. মিশকাত, হা/২১০৪; ফাতাওয়া ইবনু উছায়মীন, ২০/১৭০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/২০২৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭২; মিশকাত, হা/২০৯৭।
[8]. আবূ দাঊদ, হা/২৪৭৩, হাসান ছহীহ; মিশকাত, হা/২১০৬।