কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

প্রসঙ্গ : ছফর মাসকেন্দ্রিক জাহেলিয়াত, অশুভত্ব, কুসংস্কার এবং আখেরী চাহার শোম্বা বিষয়ক বিদআত

post title will place here

ছফর মাস হলো হিজরী বর্ষের দ্বিতীয় মাস। ‘ছিফর’ মূল ধাতু থেকে উদ্ভূত হলে ‘ছফর’ মানে হবে শূন্য, রিক্ত। আর ‘ছাফর’ ক্রিয়ামূল থেকে উৎপন্ন হলে অর্থ হবে হলুদ, হলদেটে, তামাটে, বিবর্ণ, ফ্যাকাশে, পান্ডুবর্ণ, ফিকে, ঔজ্জ্বল্যবিহীন, দীপ্তিহীন, রক্তশূন্য ইত্যাদি। আরবরা এককালে সৌরবর্ষ হিসাব করত; চান্দ্রমাস গণনা করলেও ঋতু ঠিক রাখার জন্য প্রতি তিন বছর অন্তর বর্ধিত এক মাস যোগ করে ১৩ মাসে বছর ধরে সৌরবর্ষের সঙ্গে সমন্বয় করত। সুতরাং মাসগুলো মোটামুটিভাবে ঋতুতে স্থিত থাকত। ঋতু ও ফল-ফসলের সঙ্গে আরবদের জীবনের সব ক্রিয়াকর্ম পরিচালিত হতো। আরব দেশে সে সময় ছফর মাসে খরা হতো এবং খাদ্যসংকট, আকাল দেখা দিত। মাঠঘাট শুকিয়ে চৌচির, বিবর্ণ ও তামাটে হয়ে যেত। ক্ষুধার্ত মানুষের চেহারা রক্তশূন্য ও ফ্যাকাশে হতো। তাই তারা বলত ‘আছ-ছাফারুল মুছাফফার’, অর্থাৎ ‘বিবর্ণ ছফর মাস’। আরবের জাহেলরা এই মাসকে দুঃখ-কষ্টের মাস মনে করে চাঁদ দেখা থেকেও বিরত থাকত এবং দ্রুত মাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা করত।[1]

ছফর মাস মূলত মুহাররম মাসের জোড়া মাস ছিল। জাহেলী যুগে মুহাররম ও ছফর এই দুই মাসের নাম ছিল— ‘আছ-ছফরুল আউয়াল’ ও ‘আছ-ছফরুছ ছানী’, অর্থাৎ ‘প্রথম ছফর’ ও ‘দ্বিতীয় ছফর’। বছরের প্রথম মাস তথা ‘আছ-ছফরুল আউয়াল’, যা বর্তমানে ‘মুহাররম’। এ মাসে যুদ্ধবিগ্রহ তখনো নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু আরবের লোকেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের সুবিধামতো অনৈতিকভাবে এ মাস দু’টি আগে-পরে নিয়ে যেত। তাই পরবর্তী সময়ে তাদের এ অপকৌশল নিরসনের জন্য প্রথম মাসের নামকরণ করা হয় মুহাররম (নিষিদ্ধ); সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় মাসের বিশেষণ ‘আছ-ছানী’ বা ‘দ্বিতীয়’ শব্দটিও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। ফলে এ দুই মাসের নাম পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান ‘মুহাররম’ ও ‘ছফর’ রূপ লাভ করে। এ দুই মাস মিলে একই ঋতু।

ছফর মাসকে কেন্দ্র করে অনেক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা বিশেষ করে ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়েছে। এমনকি এদেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও এই মাসের ‘ফযীলতের’ মনগড়া-বানোয়াট ও মিথ্যা কথা যেমন লেখেন, তেমনি এ মাসের শেষ বুধবার স্পষ্ট বিদআতী দিবস আখেরী চাহার শোম্বা নামে সরকারি ছুটির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়।

ছফর মাসকেন্দ্রিক জাহেলিয়াত এবং বিদআতকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়: (১) ছফর মাসের ‘অশুভত্ব’ ও ‘বালা-মুছীবত’-বিষয়ক জাহেলিয়াত, (২) ছফর মাসের প্রথম তারিখ বা অন্য সময়ে বিশেষ ছালাতকেন্দ্রিক বিদআত ও (৩) আখেরী চাহার শোম্বা বা ছফর মাসের শেষ বুধবারবিষয়ক বিদআত।

ছফর মাসের ‘অশুভত্ব’ ও ‘বালা-মুছীবত’ কোনো স্থান, সময়, বস্তু বা কর্মকে অশুভ, অযাত্রা, বা অমঙ্গলময় বলে মনে করা ইসলামী বিশ্বাসের পরিপন্থী একটি কুসংস্কার। আরবের মানুষরা জাহেলী যুগ থেকে ছফর মাসকে অশুভ ও বিপদ-আপদের মাস বলে বিশ্বাস করত। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এই কুসংস্কারের প্রতিবাদ করে বলেন, ‘কোনো অশুভ অযাত্রা নেই, কোনো ভূতপ্রেত বা অতৃপ্ত আত্মা নেই এবং ছফর মাসের অশুভত্বের কোনো অস্তিত্ব নেই’।[2]

অথচ এরপরও মুসলিম সমাজে অনেকের মধ্যে পূর্ববর্তী যুগের এ সকল কুসংস্কার থেকে যায়। শুধু তাই নয়, এ সকল কুসংস্কারকে উস্কে দেওয়ার জন্য অনেক বানোয়াট কথা হাদীছের নামে বানিয়ে বানিয়ে সমাজে প্রচার করেছে এক শ্রেণির জালিয়াতীচক্র। তারা জালিয়াতী করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে যে সকল মিথ্যাচার করেছে, সেগুলোর মধ্যে কতগুলো নিম্নরূপ—

(১) এই মাস বালা-মুছীবতের মাস। এই মাসে এত লক্ষ এত হাজার... বালা নাযিল হয়।

(২) এই মাসেই আদম আলাইহিস সালাম ফল খেয়েছিলেন।

(৩) এ মাসেই হাবীল তার সহোদর ভাই কাবীল দ্বারা নিহত হন।

(৪) এ মাসেই নূহ আলাইহিস সালাম-এর ক্বওম ধ্বংস হয়।

(৫) এ মাসেই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে আগুনে ফেলা হয়।

(৬) এ মাসের আগমনে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যথিত হতেন। এই মাস চলে গেলে খুশী হতেন।

(৭) রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে ছফর মাস অতিক্রান্ত হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করবে, আমি তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করার সুসংবাদ প্রদান করব’।

এছাড়াও আরো অনেক কথা জালিয়াতরা বানিয়েছে। আর অনেক আলেম-বুজুর্গ আর সরলপ্রাণ মুসলিমরা তাদের এ সকল জালিয়াতী বিশ্বাস করে ফেলেছেন। মুহাদ্দিছগণ একমত যে, ছফর মাসের অশুভত্ব ও বালা-মুছীবতবিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও বানোয়াট।

উপরিউক্ত মিথ্যা কথাগুলোর ভিত্তিতেই একটি ভিত্তিহীন ‘ছালাতের’ উদ্ভাবন করা হয়েছ ছফর মাসের প্রথম রাতে। এ ছালাত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, কেউ যদি ছফর মাসের প্রথম রাত্রিতে মাগরিবের পরে বা এশার পরে চার রাকআত ছালাত আদায় করে, অমুক অমুক সূরা বা আয়াত এতবার পাঠ করে, তবে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবে, এত পুরস্কার পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা, যদিও অনেক সরলপ্রাণ আলেম-বুজুর্গ ব্যক্তিও এগুলো বিশ্বাস করেছেন আর তাদের লিখিত বইয়ে ও ওয়াযে এ সকল মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ফযীলত উল্লেখ করেছেন।[3]

ছফর মাসের শেষ বুধবারকে বিভিন্ন জাল হাদীছে বলা হয়েছে অশুভ এবং যে কোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন। আর ছফর মাস যেহেতু অশুভ, সেহেতু ছফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে অশুভ দিন এবং এই দিনে সবচেয়ে বেশি বালা-মুছীবত নাযিল হয়। নাঊযুবিল্লাহ। এসব ভিত্তিহীন কথাবার্তা অনেক সরলপ্রাণ মুসলিমরা বিশ্বাস করেছেন। একজন লিখেছেন, ‘ছফর মাসে ১ লাখ ২০ হাজার ‘বালা’ নাযিল হয় এবং সব দিনের চেয়ে বেশি আখেরী চাহার শোম্বাতে (ছফর মাসের শেষ বুধবার) নাযিল হয় সবচেয়ে বেশি। সুতরাং ঐ দিনে যে ব্যক্তি নিম্নবর্ণিত নিয়মে চার রাকআত ছালাত আদায় করবে আল্লাহ তাআলা তাঁকে ঐ বালা হতে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাঁকে হেফাযতে রাখবেন।[4]

এগুলো সবই ভিত্তিহীন কথা। তবে আমাদের দেশে বর্তমানে ‘আখেরী চাহার শোম্বা’-এর প্রসিদ্ধি এই কারণে নয়, অন্য কারণে। প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছফর মাসের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি ছফর মাসের শেষ বুধবারে কিছুটা সুস্থ হন এবং গোসল করেন। এরপর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এই অসুস্থতাতেই তিনি পরের মাসে ইন্তেকাল করেন। এজন্য মুসলিমরা এই দিনে তাঁর সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন।

এ বিষয়ে প্রচলিত কাহিনীর সারসংক্ষেপ প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করা হলো, ‘হজরত নবী করিম (সাঃ) দুনিয়া হইতে বিদায় নিবার পূর্ববর্তী সফর মাসের শেষ সপ্তাহে ভীষণভাবে রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। অতঃপর তিনি এই মাসের শেষ বুধবার দিন সুস্থ হইয়া গোসল করতঃ কিছু খানা খাইয়া মসজিদে নববীতে হাজির হইয়া নামাজের ইমামতি করিয়াছিলেন। ইহাতে উপস্থিত সাহাবীগণ অত্যন্ত আনন্দিত হইয়াছিলেন। আর খুশীর কারণে অনেকে অনেক দান খয়রাত করিয়াছিলেন। বর্ণিত আছে হজরত আবু বকর (রাঃ) খুশীতে ৭ সহস্র দিনার এবং হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) ৫ সহস্র দিনার, হজরত ওসমান (রাঃ) ১০ সহস্র দিনার, হজরত আলী (রাঃ) ৩ সহস্র দিনার এবং হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) ১০০ উট ও ১০০ ঘোড়া আল্লাহর ওয়াস্তে দান করিয়াছিলেন। তৎপর হইতে মুসলমানগণ সাহাবীগণের নীতি অনুসরণ ও অনুকরণ করিয়া আসিতেছে। নবী করীম (সাঃ) এর এ দিনের গোসলই জীবনের শেষ গোসল ছিল। ইহার পর আর তিনি জীবিতকালে গোসল করেন নাই। তাই সকল মুসলমানের জন্য এই দিবসে ওজু গোসল করতঃ ইবাদত বন্দেগী করা উচিত এবং নবী করীম (সাঃ) এর প্রতি দুরুদ শরীফ পাঠ করতঃ সওয়াব রেছানী করা কর্তব্য’।[5]

উপরের এই কাহিনীটিই কমবেশি সমাজে প্রচলিত এ বিভিন্ন গ্রন্থে লেখা রয়েছে। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেও কোনো ছহীহ বা যঈফ হাদীছে এই ঘটনার কোনো প্রকার উল্লেখ পাইনি। হাদীছ তো দূরের কথা, কোনো ইতিহাস বা জীবনীগ্রন্থেও আমি এ ঘটনার কোনো উল্লেখ পাইনি। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সমাজে ‘ছফর মাসে শেষ বুধবার’ পালনের রেওয়াজ বা এই কাহিনী প্রচলিত আছে বলে আমার জানা নেই।

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সর্বশেষ অসুস্থতা : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছফর বা রবীউল আউয়াল মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কত তারিখে ইন্তেকাল করেন সে বিষয়ে হাদীছে কোনোরূপ উল্লেখ বা ইঙ্গিত নেই। অগণিত হাদীছে তাঁর অসুস্থতা, অসুস্থতাকালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ, তাঁর ইন্তেকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনোভাবে কোন দিন, তারিখ বা সময় বলা হয়নি।

তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে অনেক মত প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলেছেন, ছফর মাসের শেষ দিকে তাঁর অসুস্থতা শুরু। কেউ বলেছেন, রবীউল আউওয়াল মাসের শুরু থেকে তাঁর অসুস্থতা শুরু। দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবেঈ ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক্ব রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অসুস্থতায় ইন্তেকাল করেন, সেই অসুস্থতার শুরু হয়েছিল ছফর মাসের শেষ কয়েক রাত থাকতে, অথবা রবীউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে’।[6]

কয়দিনের অসুস্থতার পরে তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ১০ দিন। কেউ বলেছেন, ১২ দিন। কেউ বলেছন, ১৩ দিন। কেউ বলেছেন, ১৪ দিন। তিনি কোন তারিখে ইন্তকাল করেছেন সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, পহেলা রবীউল আউয়াল; কেউ বলেছেন, দোসরা রবীউল আউয়াল আবার কেউ বলেছেন, ১২ই রবীউল আউয়াল তিনি ইন্তেকাল করেন।

সর্বাবস্থায় কেউ কোনোভাবে বলছেন না যে, অসুস্থতা শুরু হওয়ার পরে মাঝে কোনোদিন তিনি সুস্থ হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই, ইন্তেকালের কয়েকদিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমার গৃহে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার উপরে সাত মশক পানি ঢালো, যেন আমি আরাম বোধ করে লোকদের নির্দেশনা দিতে পারি। তখন আমরা এভাবে তাঁর দেহে পানি ঢাললাম। এরপর তিনি মানুষদের নিকট বেরিয়ে যেয়ে তাদেরকে নিয়ে ছালাত আদায় করলেন এবং তাদেরকে খুৎবা প্রদান করলেন বা ওয়ায করলেন’।[7]

এখানে স্পষ্ট যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অসুস্থতার মধ্যেই অসুস্থতা ও জ্বরের প্রকোপ কমানোর জন্য এভাবে গোসল করেন, যেন কিছুটা আরাম বোধ করেন এবং মসজিদে যেয়ে সবাইকে প্রয়োজনীয় নছীহত করতে পারেন।

এই গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কী বারে ঘটেছিল তা হাদীছের কোনো বর্ণনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে আল্লামা ইবনু হাজার আসক্বালানী রহিমাহুল্লাহ ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমের অন্যান্য হাদীছের সাথে এই হাদীছের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এই গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তেকালের আগের বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ ইন্তেকালের পাঁচ দিন আগে।[8] ১২ই রবীউল আউয়াল ইন্তেকাল হলে তা ঘটেছিল ৮ই রবীউল আউয়াল।

উপরের আলোচনা থেকে আমাদের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, ছফর মাসের শেষ বুধবার রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুস্থ হওয়া, গোসল করা এবং এ জন্য ছাহাবীগণের আনন্দিত হওয়া ও দান-ছাদাক্বা করার এ সকল কাহিনীর কোনোরূপ ভিত্তি নেই। আল্লাহই ভালো জানেন।

যেহেতু মূল ঘটনার তারিখ নির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত নয়, সেহেতু সেই ঘটনা উদযাপন করা বা পালন করার প্রশ্নই উঠে না। এরপরও আমাদের বুঝতে হবে যে, কোনো আনন্দের বা দুঃখের ঘটনায় আনন্দিত ও দুঃখিত হওয়া এককথা, আর প্রতি বছর সেই দিনে আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশ করা বা ‘আনন্দ দিবস’ আ ‘শোক দিবস’ উদযাপন করা সম্পূর্ণ অন্য কথা। উভয়ের মধ্যে আসমান-যমীনের পার্থক্য।

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে অনেক আনন্দের দিন বা মুহূর্ত এসেছে, যখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন, শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য আল্লাহর দরবারে সাজদাবনত হয়েছেন। কোনো কোনো ঘটনায় তাঁর পরিবারবর্গ ও ছাহাবীগণও আনন্দিত হয়েছেন ও বিভিন্নভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরের বছর বা পরবর্তী কোনো সময়ে সেই দিন বা মুহূর্তকে তারা বাৎসরিক ‘আনন্দ দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেননি। এজন্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ বা ছাহাবীদের কর্ম ছাড়া এইরূপ কোনো দিন বা মুহূর্ত পালন করা বা এইগুলোতে বিশেষ ইবাদতকে বিশেষ ছওয়াবের কারণ বলে মনে করার কোনো সুযোগ নেই।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, ছফর মাসের শেষ বুধবারের কোনো প্রকার বিশেষত্ব হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। এই দিনে ইবাদত-বন্দেগী, ছালাত-ছিয়াম, যিকির-দু‘আ, দান-ছাদাক্বা ইত্যাদি পালন করলে অন্য দিনের চেয়ে বেশি বা বিশেষ কোনো ছওয়াব বা বরকত লাভ করা যাবে বলে ধারণা করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। এমন ভিত্তিহীন বানোয়াট দিনকেন্দ্রিক যেকোনো আমল-ইবাদত স্পষ্ট বিদআত।

মূলত মানুষ শরীআতের অনুসৃত হয়ে যদি পুরো মাস ও বছর নেক আমল বা ভালোকর্ম করে, তখন তার সকল দিন, মাস, বছর সবই মহান রাব্বুল আলামীনের নিকট ফযীলতপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্যময় হয়ে যায়, তখন তাতে অশুভত্ব আর অমঙ্গল ইত্যাদি বলতে কিছুই থাকে না। আর যদি তারা মহান আল্লাহ ও তাঁর দেওয়া বিধান, দ্বীনকে ছেড়ে নিজেদের মনমতো জীবনযাপন করে, তখন দিন, মাস, বছর কেন তার পুরো জীবনটাই অশুভ ও অমঙ্গল হয়ে দাঁড়ায়। বর্বর জাহেলিয়াতের যুগের মতো আজ আমরা মুসলিমরা কুরআনুল কারীম ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশুদ্ধ হাদীছ হতে দূরে সরে নিজেদের বিভিন্ন মনগড়া মতবাদ উপস্থিত করে সময় ও মাসকে ফযীলতপূর্ণ বা বৈশিষ্ট্যময় মনে করে এমন সব আমল বা কর্মদিবস উদযাপন করে থাকি, যার বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যের কথা কুরআনুল কারীম ও বিশুদ্ধ হাদীছ গ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায় না।[9]

আবার দেখা যায়, অনেকে কোনো কোনো মাস ও সময়কে অশুভ-কুলক্ষণ ধারণা পোষণ করে তাতে বিয়ে-শাদী, আনন্দ-উৎসব, কোনো স্থানে যাওয়া, ভ্রমণ করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকে, যেমন ধারণা করত জাহেলিয়াত যুগের জাহেলরা। অথচ সময়, মাস সবই মহান আল্লাহর সৃষ্ট, যা মানুষের কল্যাণের জন্যই তিনি সৃষ্টি করেছেন। ওসবে কোনো অশুভ বা কুলক্ষণ হওয়ার বর্ণনা কোথাও নেই। না কুরআনুল কারীমে আর না হাদীছে বরং এ ধরনের ধারণা পোষণ শিরকেরই অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহ আমাদের সকলকে সর্বপ্রকার শিরক ও বিদআত থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

[প্রবন্ধটিহাদীসেরনামেজালিয়াতি’বই থেকে সংগৃহীত ও পরিমার্জিত।]


[1]. ইবনু মানযূর রহিমাহুল্লাহ, লিসানুল আরাব, ৪/৪৬২-৪৬৩।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৪৬, ৫৭০৭, ৫৭৫৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৫৬৮৩-৫৬৯০।

[3]. খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতুল কুলূব, পৃ. ১৩৮-১৩৯; মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফজীলত, পৃ. ১৪।

[4]. রাহাতুল কুলূব, পৃ. ১৩৯।

[5]. বার চান্দের ফজীলত, পৃ. ১২।

[6]. ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, ৪/২৮৯।

[7]. ছহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৪৪২, ৫৭১৪, ৪০৯৮।

[8]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাতহুল বারী, ৮/১৪২।

[9]. যদিও অনেকে ‘বার চান্দের ফজীলত’ নাম দিয়ে বই-পুস্তক লিখেছে, আর তাতে তারা অনির্ভরযোগ্য অনেক কথার অবতারণা করেছে। -লেখক

Magazine