ভূমিকা : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতকে অনুসরণ করার কারণে আমাদের অনেক দ্বীনী ভাই-বোনকে সমাজে নির্যাতিত হতে হয়। তাদেরকে লা-মাযহাবী, ইয়াহূদীদের দালাল আখ্যায়িত করা হয়। বিভিন্নভাবে তাদেরকে কোণঠাসা করার যাবতীয় কলা-কৌশল প্রয়োগ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বগুড়ার একটি প্রসিদ্ধ মাদরাসার জনৈক মুফতীর লিখিত একটি লিফলেট আমাদের হস্তগত হয়েছে। এখানে তিনি ১৩টি মাসআলা উদ্ধৃত করেছেন। যেগুলোতে তিনি অগ্রহণযোগ্য কিছু হাদীছ এনে আহলেহাদীছ ভাইদের ফেতনায় পতিত করার অপচেষ্টা করেছেন। নিম্নে এ বিষয়ে তাহক্বীক্বসহ আলোকপাত করা হলো।-
(১) তাকবীরে তাহরীমার সময় কান বরাবর হাত উত্তোলন করা : এ বিষয়ে লেখক একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। সেটি হলো- ওয়ায়েল ইবনু হুজর রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, رَأَيْتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِينَ افْتَتَحَ الصَّلاَةَ رَفَعَ يَدَيْهِ حِيَالَ أُذُنَيْهِ ‘আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ছালাত সূচনার প্রাক্কালে কান বরাবর হাত তুলতে দেখেছি’।[1]
তাহক্বীক্ব : এ হাদীছটি ছহীহ। আমরা এ হাদীছের উপর আমল করি। তাহলে এ হাদীছটি কেন আমাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হলো বিষয়টি বোধগম্য নয়! তবে ছালাত শুরুর সময়ে কান স্পর্শ করার কোনো হাদীছ নেই। এ আমলের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। এক্ষণে কেউ যদি কান স্পর্শ বা ধরার কোনো হাদীছ পেশ করতে পারেন, তাহলে ইনশা-আল্লাহ আমরা সেটির জবাব প্রদান করব। উল্লেখ্য, আহলেহাদীছগণ কান বরবার কিংবা কাঁধ বরাবর উভয় আমলই করে থাকেন। উভয়ের পক্ষে ছহীহ হাদীছ বিদ্যমান।[2]
(২) বার বার নয়;শুধু তাকবীরে তাহরীমার সময় হাত উঠানো : এ শিরোনামে মুফতী ছাহেব একটি হাদীছ পেশ করেছেন। সেটি হলো- আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِصَلاَةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ فَقَامَ فَرَفَعَ يَدَيْهِ أَوَّلَ مَرَّةٍ ثُمَّ لَمْ يُعِدْ ‘আমি কি তোমাদেরকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছালাত বলে দিব না? অতঃপর তিনি দাঁড়িয়ে প্রথমবার (তাকবীরে তাহরীমার সময়) দুহাত উত্তোলন করলেন এবং আর হাত উঠাননি’।[3]
তাহক্বীক্ব : প্রথম জবাব : এ হাদীছটি সনদ ও মতন উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই যঈফ। ইমামগণ বলেন—
(১) শায়খুল ইসলাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ১৮১ হি.) বলেছেন, لَمْ يَثْبُتْ حَدِيثُ ابْنِ مَسْعُودٍ ‘ইবনু মাসঊদের (নামে বর্ণিত) হাদীছটি প্রমাণিত নয়’।[4]
(২) ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ২০৪ হি.) রফউল ইয়াদায়েন না করার হাদীছগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।[5]
(৩) ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ২৪১ হি.) এই বর্ণনার উপর বিরূপ মন্তব্য করেছেন।[6]
(৪) আবূ হাতেম আর-রাযী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ২৭৭ হি.) বলেছেন, ‘এটি ভুল। বলা হয়, সুফিয়ান ছাওরী রাহিমাহুল্লাহ এতে (হাদীছটি সংক্ষেপে বর্ণনায়) ভ্রমে পতিত হয়েছেন’।[7]
(৫) ইমাম দারাকুত্বনী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৩৮৫ হি.) একে ‘গায়রু মাহফূয’ (যঈফ হাদীছের একটি প্রকার) বলেছেন।[8]
(৬) স্বয়ং ইমাম আবূ দাঊদ রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ২৭৫ হি.) বলেছেন,هَذَا حَدِيْثٌ مُخْتَصَرٌ مِنْ حَدِيْثٍ طَوِيْلٍ وَلَيْسَ هُوَ بِصَحِيْحٍ عَلَى هَذَا اللَّفْظِ ‘এই হাদীছটি একটি দীর্ঘ হাদীছের সংক্ষিপ্ত রূপ। আর এই শব্দে হাদীছটি ছহীহ নয়’।[9]
দ্বিতীয় জবাব : এই হাদীছটি সুফিয়ান ছাওরী রাহিমাহুল্লাহ-এর উপর ভিত্তিশীল, যা এর (হাদীছটির) তাখরীজ হতে স্পষ্ট হয়। সুফিয়ান ছাওরী ছিক্বাহ, হাদীছের হাফেয, ইবাদতগুযার হওয়ার পাশাপাশি তিনি মুদাল্লিসও ছিলেন।[10] তাকে নিম্নোক্ত হাদীছের ইমামগণ মুদাল্লিস বলেছেন—
(১) ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল-কাত্তান।[11]
(২) ইমাম বুখারী।[12]
(৩) ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন।[13]
(৪) আবূ মুহাম্মাদ আল-মাক্বদেসী।[14]
(৫) ইবনুত তুরকুমানী হানাফী।[15]
(৬) ইবনু হাজার আসক্বালানী।[16]
(৭) যাহাবী।[17] তিনি বলেন,أنه كان يدلس عن الضعفاء ولكن له نقد وذوق ولا عبرة لقول من قال: يدلس ويكتب عن الكذابين ‘সুফিয়ান যঈফ রাবীদের হতে তাদলীস করতেন। কিন্তু তার হাদীছ সমালোচনা ও গবেষণার যোগ্যতা আছে। তিনি তাদলীস করতেন ও কাযযাবদের (মিথ্যুকদের) থেকে হাদীছ লিপিবদ্ধ করতেন— যারা এই কথা বলেছেন তাদের এ বক্তব্য মোটেও গণনার যোগ্য নয়। তিনি আরো বলেছেন, وَرُبَّمَا دَلَّسَ عَنِ الضُّعَفَاءِ ‘তিনি কখনো কখনো যঈফ রাবী থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন’।[18] তিনি আরো বলেছেন, لِأَنَّهُ كَانَ يُحَدِّثُ عَنِ الضُّعَفَاءِ ‘কেননা তিনি যঈফ রাবীদের থেকে হাদীছ বর্ণনা করতেন’।[19]
হাফেয যাহাবীর সাক্ষ্য দ্বারা প্রতীয়মান হলো, সুফিয়ান রাহিমাহুল্লাহ যঈফ লোকদের হতে তাদলীস করতেন। মনে রাখতে হবে, যে যঈফ রাবীদের থেকে তাদলীস করে তার عَنْ ‘হতে’ শব্দযোগে বর্ণনা সাধারণত যঈফ হয়।
(৮) ছালাহুদ্দীন আল-আলাঈ বলেছেন,من يدلس عن أقوام مجهولين لا يدرى من هم كسفيان الثوري ‘যে সুফিয়ান ছাওরীর মতো ঐ সকল মাজহূল রাবী থেকে তাদলীস করে যাদের ব্যাপারে জানা যায় না যে তারা কারা?’।[20]
(৯) হাফেয ইবনু রজব রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘সুফিয়ান ছাওরী এবং অন্যরা ঐ সকল রাবী হতেও তাদলীস করেছেন, যাদের থেকে তারা হাদীছ শ্রবণ করেননি’।[21]
(১০) আলী ইবনুল মাদীনী।[22]
(১১) বদরুদ্দীন আইনী হানাফীও বলেছেন,وسُفْيَان من المدلسين والمدلس لَا يُحْتَجُّ بعنعنته إِلَّا أَن يثبت سَمَاعه من طَرِيق آخر ‘সুফিয়ান ছাওরী অন্যতম মুদাল্লিস রাবী। আর মুদাল্লিস রাবীর আনআনাহ দ্বারা দলীল পেশ করা যাবে না। যদি অন্য সনদে ‘শ্রবণের’ বিষয়টি পাওয়া যায়, তাহলে দলীল হিসাবে গৃহীত হবে’।[23]
এছাড়াও কিরমানী,[24] ইবনু হিব্বান,[25] সুয়ূতী,[26] হালাবী[27]সহ অনেক ইমামই তাকে মুদাল্লিস রাবী বলেছেন।
(১২) ‘যুগের স্বর্ণ’ খ্যাত শায়েখ আব্দুর রহমান আল-মুআল্লিমী আল-ইয়ামানীও এই বর্ণনাকে সুফিয়ান ছাওরীর আনআনার (عَنْ-দ্বারা বর্ণনা) কারণে ত্রুটিযুক্ত বলেছেন।[28]
সারাংশ : সুফিয়ান ছাওরী মুদাল্লিস রাবী ছিলেন। সুতরাং তার মুআনআন বর্ণনা মুতাবাআতের অনুপস্থিতিতে যঈফ হয়।
তৃতীয় জবাব : সুফিয়ান ছাওরীর এই হাদীছে রুকূর আগে ও পরে রফউল ইয়াদায়েন উল্লেখ নেই। সুতরাং এই বর্ণনাটির ভাষা অস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত। যদি একে عام ‘সর্বজনীন মর্মবাহী’ ধারণা করা হয়, তাহলে আমাদের প্রশ্ন—
(১) বিতর ছালাতে তাকবীরে তাহরীমার পরে রুকূর আগে রফউল ইয়াদায়েন কেন করা হয়? (২) দুই ঈদের ছালাতে তাকবীরে তাহরীমার পরে রফউল ইয়াদায়েন কেন করা হয়?
চতুর্থ জবাব : এই হাদীছে রুকূর আগে ও পরে রফউল ইয়াদায়েন উল্লেখ নেই। ইমাম, ফক্বীহ, মুহাদ্দিস আবূ দাঊদ রাহিমাহুল্লাহ এই যঈফ হাদীছের উপরে অনুচ্ছেদ বেঁধেছেন,بَابُ مَنْ لَمْ يَذْكُرِ الرَّفْعَ عِنْدَ الرُّكُوعِ ‘যারা রুকূর সময় রফউল ইয়াদায়েন উল্লেখ করেননি তার অনুচ্ছেদ’।[29]
ইবনুত তুরকুমানী হানাফী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৭৪৫ হি.) বলেছেন,ومن لم يذكر الشيء ليس بحجة على من ذكره ‘যে কোনো বস্তুকে উল্লেখ করেনি; তা ঐ লোকের উপর দলীল নয়, যে কোনো বিষয়কে উল্লেখ করে’।[30] প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৮৫২ হি.) বলেছেন,وَلَا يلْزم من عدم ذكر الشَّيْء عدم وُقُوعه ‘কোনো বস্তুর অনুল্লেখ থাকা উক্ত বস্তুর অস্তিত্ব না থাকাকে আবশ্যক করে না’।[31]
সুতরাং ইমাম সুফিয়ান ছাওরীর (রুকূর রফউল ইয়াদায়েনের) উল্লেখবিহীন এই যঈফ হাদীছ দ্বারা রুকূর আগে ও পরে রফউল ইয়াদায়েন বর্জন করা প্রমাণিত হতে পারে না।
পঞ্চম জবাব : সুফিয়ানের হাদীছে ‘না-বোধক’ ভাষা রয়েছে। আর রফউল ইয়াদায়েনের পক্ষের হাদীছগুলোতে ‘হ্যাঁ-বোধক’ ভাষা আছে। আর এই বিষয়টি সাধারণ ছাত্ররাও জানেন যে, ‘হ্যাঁ-বোধক’ (বক্তব্য) ‘না-বোধক’ (الْمُثْبِتُ مُقَدَّمُ عَلَى النَّافِي)-এর উপরে প্রাধান্য পায়।
আল্লামা নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, রফউল ইয়াদায়েন করার হাদীছসমূহ মানার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। কারণ এগুলো ‘হ্যাঁ-বোধক’ হাদীছ। আর সুফিয়ানের রফউল ইয়াদায়েন না করার যঈফ হাদীছটি ‘না-বোধক’।[32] আল্লামা কারখী হানাফীও রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৩১৭ হি.) ‘হ্যাঁ-বোধক’-কে ‘না-বোধক’-এর উপর আমলের অধিক উপযুক্ত বলেছেন।[33] এছাড়াও নাছবুর রায়াহ[34] ও ফাতহুল বারী[35] দেখুন ।
ষষ্ঠ জবাব : এই হাদীছটির উদ্দেশ্য এই যে, ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকবীরে তাহরীমার সময় কেবল একবার রফউল ইয়াদায়েন করেছেন, বারবার করেননি।[36] নববী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৬৭৬ হি.) বলেছেন, ‘আমাদের সাথীগণ উল্লেখ করেছেন, যদি এ হাদীছটি ছহীহ হতো, তবে তার সারমর্ম এই হতো যে, ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ছালাতের শুরুতে ও অবশিষ্ট রাকআতের শুরুতে দ্বিতীয়বার রফউল ইয়াদায়েন করতেন না। এই তাবীল দ্বারা সকল হাদীছের উপরে আমল করা হয়ে যায়’।[37]
সপ্তম জবাব : এই হাদীছটি ছহীহ হলেও তা মানসূখই হতো। ইমাম আহমাদ ইবনুল হুসাইন আল-বায়হাক্বী বলেছেন,وَقَدْ يَكُونُ ذَلِكَ فِي الِابْتِدَاءِ قَبْلَ أَنْ يُشْرَعَ رَفْعُ الْيَدَيْنِ فِي الرُّكُوعِ، ثُمَّ صَارَ التَّطْبِيْقُ مَنْسُوخًا، وَصَارَ الْأَمْرُ فِي السُّنَّةِ إِلَى رَفْعِ الْيَدَيْنِ عِنْدَ الرُّكُوْعِ، وَرَفْعِ الرَّأْسِ مِنْهُ، وَخَفِيَا جَمِيعًا عَلَى عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ ‘(হতে পারে) শুরুতে রফউল ইয়াদায়েনের আমল অব্যাহত ছিল। যে সময় রফউল ইয়াদায়েন শরীআতভুক্ত ছিল না। তারপরে ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর তাত্ববীক্ব করা রহিত হয়ে গেছে। অতঃপর রুকূর আগে ও পরে রফউল ইয়াদায়েন করার সুন্নাত আরম্ভ হয়ে যায়। আর এ বিষয় দুটিই ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে গোপন থেকে গিয়েছিল’।[38]
জ্ঞাতব্য : এটি ইলযামী জবাব। নতুবা বাস্তবতা এই যে, এই হাদীছটি ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে প্রমাণিতই নয়।
শেষ কথা : উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হলো, জনৈক মুফতীর প্রদত্ত হাদীছটি দুটি কারণে গ্রহণযোগ্য নয়— ১. এটি ছহীহ নয়। ২. ছহীহ মেনে নিলেও এর দ্বারা রুকূর আগে ও পরে রফউল ইয়াদায়েন করা বাতিল হবে না। কেননা এখানে শুধু একবারের কথা উল্লেখ রয়েছে, যা দ্বারা রুকূর আগে ও তাকবীরে তাহরীমার মধ্যবর্তীতে একবার হাত তোলা বুঝানো হয়েছে। রুকূর আগে ও রুকূ হতে মাথা তোলার পরের হাত তোলার সাথে এ হাদীছের কোনোই সম্পর্ক নেই।
(৩) নাভির নিচে হাত বাঁধা : ওয়ায়েল ইবনু হুজর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَضَعَ يَمِينَهُ عَلَى شِمَالِهِ فِي الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ ‘আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ছালাতে বাম হাতের উপর ডান হাত নাভির নিচে রাখতে দেখেছি’।[39]
তাহক্বীক্ব : হাদীছটির সনদ ছহীহ। তবে এখানে ইচ্ছাকৃত বা ভুলক্রমে ‘নাভির নিচে’ শব্দদয় অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে। মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা-এর দুটি হাদীছ দেখলেই বিষয়টি বুঝা যাবে। যেমন—
হাদীছ-১ :
حَدَّثَنَا وَكِيعٌ عَنْ مُوسَى بْنِ عُمَيْرٍ عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَضَعَ يَمِينَهُ عَلَى شِمَالِهِ فِي الصَّلَاةِ.
‘ওয়ায়েল ইবনু হুজর তার পিতা হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, ‘আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ছালাতে তাঁর ডান হাতকে বাম হাতের উপর বাঁধতে দেখেছি’।[40] ‘মাকতাবা শামেলা’-তে এ হাদীছটি এভাবেই রয়েছে। এখানে নাভির নিচে সংক্রান্ত কোনো আলোচনাই নেই। আর এটাই সঠিক। উল্লেখ্য, এটি মারফূ‘ হাদীছ।
হাদীছ-২ :
حَدَّثَنَا وَكِيعٌ عَنْ رَبِيعٍ عَنْ أَبِي مَعْشَرٍ عَنْ إِبْرَاهِيمَ قَالَ يَضَعُ يَمِينَهُ عَلَى شِمَالِهِ فِي الصَّلَاةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
‘ইবরাহীম নাখাঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘তিনি ছালাতে তার ডান হাতকে বাম হাতের উপর নাভির নিচে বাঁধতেন’।[41]
দ্বিতীয় হাদীছে ‘নাভির নিচে’ শব্দ বলা হয়েছে। এটি মাক্বতূ‘ বর্ণনা। তবে তা যঈফ। কিন্তু হানাফী বিদ্বান শায়খ আওয়ামার তাহক্বীক্বকৃত কপিতে প্রথম হাদীছটি এভাবে আছে—
حَدَّثَنَا وَكِيعٌ عَنْ مُوسَى بْنِ عُمَيْرٍ عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَضَعَ يَمِينَهُ عَلَى شِمَالِهِ فِي الصَّلَاةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
ওয়ায়েল ইবনু হুজর তার পিতা হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, ‘আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ছালাতে তাঁর ডান হাতকে বাম হাতের উপর নাভির নিচে বাঁধতে দেখেছি’।[42]
অর্থাৎ শায়খ আওয়ামা মারফূ‘ হাদীছটির মধ্যে ঐ শব্দগুলো অনুপ্রবেশ করিয়েছেন, যেগুলো মাক্বতূ‘ বর্ণনাটির মধ্যে রয়েছে। একটি যঈফ মাক্বতূ‘ বর্ণনা থেকে কিছু শব্দ নিয়ে তা অন্য একটি ছহীহ মারফূ‘ হাদীছের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়েছে।
এটি স্পষ্ট বিকৃতি। এটা যে বিকৃতি তা সর্বপ্রথম পাকিস্তানের মুহাক্কিক উস্তাদ ইরশাদুল হক আছারী t ধরিয়ে দেন। তিনি ‘আল-মুছান্নাফ গ্রন্থে বিকৃতি সাধন : শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামার দুঃসাহস’ শিরোনামে একটি বৃহৎ প্রবন্ধ রচনা করেছেন, যা গবেষকদের অধ্যয়নযোগ্য।[43] তবে এখানে কয়েকটি বিষয় পাঠকদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে—
(১) দুনিয়ার বুকে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের করাচীস্থ ‘ইদারাতুল কুরআন ওয়াল-উলূমিল ইসলামিয়া’ নামক একটি হানাফী প্রকাশনী ওয়ায়েল ইবনু হুজর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মারফূ‘ হাদীছটির মধ্যে ‘নাভির নিচে’ অংশটুকু সংযোজন করে।
(২) আব্দুল খালেক আফগানীর তাহক্বীক্বকৃত নুসখা যা হায়দরাবাদের ‘আবুল কালাম আযাদ একাডেমী হিন্দুস্তান’ হতে প্রথম মুদ্রিত (১৩৮৬ হি./১৯৬৬) হয়েছিল, তাতে ওয়ায়েল রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীছের মধ্যে ‘নাভির নিচে’ অংশটুকু নেই।
(৩) ‘আদ-দারুস সালাফিয়া মুম্বাই হিন্দুস্তান’ হতে মুদ্রিত (১৩৯৯ হি./১৯৭৬) ইবনু আবী শায়বা-এর নুসখাটিও এই সংযোজনমুক্ত।
(৪) ইমাম নাছিরুদ্দীন আলবানীর কট্টর বিরোধী হানাফী দেওবন্দী আলেম হাবীবুর রহমান আযামী কর্তৃক তাহক্বীক্বকৃত ইবনু আবী শায়বার নুসখাটি ১৪০৩ হিজরীতে ‘মাকতাবা ইমদাদিয়া মক্কা মুকাররমা’ প্রকাশ করে। সেটিও এই সংযোজন হতে খালি।
(৫) ১৪০৯ হিজরীতে বৈরূতের দারুত তাজ প্রকাশিত ও কামাল ইউসুফ আল-হূত তাহক্বীক্বকৃত নুসখাতেও এই সংযোজন নেই।
(৬) ১৪০৯ হিজরীতে দারুল ফিকর হতে মুদ্রিত ও সাঈদ আল-লাহহাম কর্তৃক তাহক্বীক্বকৃত নুসখাতেও এটি নেই।
(৭) ১৪১৬ হিজরীতে বৈরূতের দারুল কুতুবিল ইলমিয়া হতে মুদ্রিত মুছান্নাফের নুসখাতেও এটি নেই, যেটি তাহক্বীক্ব করেছেন মুহাম্মাদ আব্দুস সালাম শাহীন।
(৮) ১৪২৫ হিজরীতে রিয়াদের মাকাতাবা রুশদ হতে হামদ আল-জুমুআ ও মুহাম্মাদ লুহাইদান কর্তৃক তাহক্বীক্বকৃত মুছান্নাফের নুসখাতেও নেই।
(৯) ১৪২৯ হিজরীতে মিসরের দারুল ফারূক হতে মুদ্রিত ও উছামা ইবনু ইবরাহীমের তাহক্বীক্বকৃত নুসখাতেও নেই।
(১০) ১৪৩৬ হিজরীতে রিয়াদের দারু কুনূযি ইশবীলিয়া হতে মুদ্রিত ও সা‘দ ইবনু নাছের আশ-শাতরীর তাহক্বীক্বে প্রকাশিত ইবনু আবী শায়বার নুসখাতেও এই সংযোজনটি নেই।
কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানেই ক্ষান্ত হতে হচ্ছে। নতুবা এভাবে অসংখ্য দলীল দেওয়া যাবে, যা দ্বারা প্রমাণিত হবে যে, ওয়ায়েল ইবনু হুজর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বর্ণিত মারফূ‘ হাদীছে ‘নাভির নিচে’ শব্দদ্বয় মূল হাদীছে ছিল না। বরং পরবর্তীতে সর্বপ্রথম একটি হানাফী প্রকাশনী হতে এটি জোর করে হাদীছের মধ্যে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল (নাঊযুবিল্লাহ)।
অতএব, জনৈক ওই মুফতী ছাহেবের দেওয়া লিফলেটে থাকা হাদীছটির সনদ ছহীহ হলেও তাতে এই সংযোজনের লেশমাত্রও প্রমাণিত নয়।
আহমাদুল্লাহ
সৈয়দপুর, নীলফামারী।
[1]. আবূ দাঊদ, হা/৭২৮।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩৬; আবূ দাঊদ, হা/৭২৮।
[3]. সুনানে নাসাঈ, হা/১০২৫।
[4]. সুনানে তিরমিযী, হা/২৫৬, ‘সনদ ছহীহ’।
[5]. কিতাবুল উম্ম, ৭/২০১, ‘ছালাতে রফউল ইয়াদায়েন করার অনুচ্ছেদ’।
[6]. জুযউ রফইল ইয়াদায়েন, হা/৩২; মাসায়েলে ইমাম আহমাদ, আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদের বর্ণনা, ১/২৪০, অনুচ্ছেদ-৩২৬।
[7]. ই‘লালুল হাদীছ, হা/২৫৮।
[8]. দারাকুত্বনী, আল-ই‘লাল, মাসআলা-৮০৪।
[9]. সুনানে আবূ দাঊদ, (হিমস কপি), হা/৭৪৮; বায়তুল আফকার আদ-দাওলিয়াহ’র কপি, পৃ. ১০২; নুসখা মাকতাবাতুল মাআরিফ, (রিয়াদ), পৃ. ১২১; মিশকাতুল মাছাবীহ, হা/৮০৯।
[10]. তাকরীবুত তাহযীব, জীবনী নং ২৪৪৫।
[11]. আহমাদ, কিতাবুল ই‘লাল ওয়া মারিফাতুর রিজাল, ১/২০৭, নং ১১৩০; খত্বীব আল-বাগদাদী, আল-কিফায়া, পৃ. ৩৬২।
[12]. তিরমিযী, আল-ই‘লালুল কাবীর, ২/৯৬৬।
[13]. আল-জারহু ওয়াত-তা‘দীল, ৪/২২৫।
[14]. ক্বাছীদা ফিল মুদাল্লিসীন, পৃ. ৪৭, ২য় কবিতা।
[15]. আল-জাওহারুন নাকী, ৮/২৬২।
[16]. ত্ববাকাতুল মুদাল্লিসীন, পৃ. ৩২; তাকরীবুত তাহযীব, জীবনী নং ২৪৪৫।
[17]. মীযানুল ই‘তিদাল, ২/১৬৯।
[18]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৭/২৪২।
[19]. প্রাগুক্ত, ৭/২৭৪।
[20]. জামেউত তাহছীল ফী আহকামিল মারাসীল, পৃ. ৯৯।
[21]. শারহু ইলালিত তিরমিযী, ১/৩৫৮।
[22]. আল-কিফায়া, পৃ. ৩৬২।
[23]. উমদাতুল ক্বারী, ৩/১১২।
[24]. শারহু ছহীহিল বুখারী, হা/২১৩, ৩/৬২।
[25]. আল-ইহসান, (নতুন মুদ্রণ), ১/৬১।
[26]. আসমাউ মান উরিফা বিত তাদলীস, রাবী নং ২৪।
[27]. আত-তাবঈন ফী আসমা আল-মুদাল্লিসীন, পৃ. ২৭।
[28]. আত-তানকীল বিমা ফী তা’নীবিল কাওছারী মিনাল আবাত্বীল, ২/২০।
[29]. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৭৪৮, ১/৪৭৭।
[30]. আল-জাওহারুন নাকী, ৪/৩১৭।
[31]. আদ-দিরায়া, হা/২৯২, ১/২২৫, ‘পানি চাওয়া’ অনুচ্ছেদ।
[32]. আল-মাজমূ‘ শারহুল মুহাযযাব, ৩/৪০৩।
[33]. নূরুল আনওয়ার, পৃ. ১৯৭।
[34]. নাছবুর রায়াহ, ১/৩৫৯।
[35]. ফাতহুল বারী, ১/৩৩৩।
[36]. মিশকাতুল মাছাবীহ, হা/৮০৯।
[37]. আল-মাজমূ‘, ৩/৪০৩।
[38]. মা‘রিফাতুস সুনান ওয়াল-আছার, পাণ্ডুলিপি ১/২২০; ইমাম হাফেয গোন্দালবী, আত-তাহক্বীক্ব আর-রাসেখ ফী আন্না আহাদীছা রফইল ইয়াদায়েন লায়সা লাহা নাসিখ, পৃ. ১১৮।
[39]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/৩৯৫৯।
[40]. প্রাগুক্ত, হা/৩৯৩৮।
[41]. প্রাগুক্ত, হা/৩৯৩৯।
[42]. মুহাম্মাদ আওয়ামা, তাহক্বীক্ব মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/৩৯৫৯, ৩/৩২০-৩২২।
[43]. মাক্বালাতে আসারী, ৩/২৮৫-৩১২।