ইসলামই একমাত্র শাশ্বত, আল্লাহ মনোনীত জীবনবিধান। মহান আল্লাহ সবদিক থেকে ইসলাম নামক জীবনবিধানকে পরিপূর্ণ ও পরিপূরক হিসেবে নির্বাচন করেছেন। যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু তালাশ করলেও তা গ্ৰহণযোগ্য হবে না বলেও তিনি বহু পূর্বেই ঘোষণা দিয়েছেন। আবার তিনি এটাও বলেছেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো। আর শয়তানের পদাঙ্কসমূহের অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (আল-বাক্বারা, ২/২০৮)।
উক্ত আয়াত প্রমাণ করে যে, আপনি আপনার চিন্তা, চেতনা, কথাবার্তা, লেনদেন, দৃষ্টিভঙ্গি, খাওয়া-দাওয়া প্রভৃতি বিষয় ছাড়াও জীবনের সকল দিক ও বিভাগে ইসলামে পরিপূর্ণ প্রবেশ না করা পর্যন্ত প্রকৃত মুসলিম ও মুমিন হতে পারবেন না। ইসলামকে নিছক ধর্ম মেনে নিয়ে জীবনকে পরিচালিত করবেন এই সুযোগ ইসলাম আদৌ কাউকে দেয়নি। বরং ইসলাম একটি স্বকীয়, পরিপূর্ণ জীবনবিধানের নাম। অর্থনৈতিক জীবন থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক, বাৎসরিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উৎসব উদযাপনের নীতিমালাসহ ইসলামের অনুসরণ ব্যতিরেকে জীবনকে পরিচালিত করলে তা হবে নেহায়েত নির্বুদ্ধিতা। যদি আপনি ইসলামের এই নীতিমালা অনুসারে জীবন না সাজান তাহলে আপনি নিশ্চিত থাকুন জীবনের কোনো না কোনো দিক থেকে বিজাতীয়দের অনুসরণ করছেন আর তা হয়তো আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। এজন্য ইসলামের অনুসরণ আবশ্যক। এটা ছাড়া দুনিয়া, পরকাল, ব্যক্তি, রাষ্ট্র কোনো কিছুরই কল্যাণ ও সফলতা সম্ভব নয়। আজকের প্রবন্ধটি মূলত বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব উদযাপনে মুসলিমরা কীভাবে বিজাতীয়দের বিরোধিতা করেছে সেই সম্পর্কে। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে ছহীহ সুন্নাহর আলোকে বিজাতীয়দের বিরোধিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশা-আল্লাহ।
ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা হারাম হওয়ার দলীল সুন্নাহ থেকে : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত’।[1] ইবনু কাছীর রাহিমাহুল্লাহ এই আয়াত,وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لاَ يَهْدِى الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ ‘আর যে ব্যক্তি তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না’-এর ব্যাখ্যায় বলেন, এটি প্রমাণ করে কাফের-মুশরেকদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা খুবই মারাত্মক বিষয়, সেটা কথার মাধ্যমে সাদৃশ্য হোক কিংবা কর্মের মাধ্যমে, পোশাকের মাধ্যমে হোক কিংবা অভ্যাস, অনুষ্ঠান বা উৎসবের মাধ্যমে। যেটা আমাদের জন্য শরীআতসম্মত নয় তা আমরা স্বীকৃতি দিব না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا لاَ تَشَبَّهُوا بِالْيَهُودِ وَلاَ بِالنَّصَارَى ‘ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত (উম্মত) নয়, যে আমাদের ছাড়া অন্য কারো সাদৃশ্য অবলম্বন করে। তোমরা ইয়াহূদী এবং খ্রিষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন করো না’।[2]
এছাড়া বহু আয়াত ও হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইয়াহূদী-খ্রিষ্টান, অমুসলিমদের অনুসরণ ও তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হারাম। বিভিন্ন অভ্যাস, কর্ম, অনুষ্ঠান, উৎসব উদযাপনে ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বনে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতা পোষণের কয়েকটি নমুনা পেশ করা হলো—
(১) ঋতুমতী স্ত্রীর সাথে সহবাস ছাড়া সকল কাজ করার মাধ্যমে ইয়াহূদীদের বিরোধিতা প্রকাশ : আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ইয়াহূদীরা তাদের মহিলাদের হায়েয (পিরিয়ড) হলে তার সাথে একসঙ্গে খাবার খেত না এবং এক ঘরে বাস করত না। ছাহাবায়ে কেরাম এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করলেন, ‘তারা আপনার কাছে হায়েয সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন, তা হলো কষ্টদায়ক। সুতরাং হায়েয অবস্থায় তোমরা মহিলাদের থেকে পৃথক থাকো…’ (আল-বাক্বারা, ২/২২২)। এরপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা (সে সময় তাদের সাথে) শুধু সহবাস ছাড়া অন্যান্য সব কাজ করো’। এ খবর ইয়াহূদীদের কাছে পৌঁছলে তারা বলল, এ লোকটি সব কাজেই কেবল আমাদের বিরোধিতা করতে চান।[3]
(২) ছালাতের আযানের প্রচলনের মাধ্যমে ইয়াহূদীদের বিরোধিতা প্রকাশ করা : ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলতেন যে, মুসলিমরা যখন মদীনায় আগমন করেন, তখন তারা ছালাতের সময় অনুমান করে সমবেত হতেন। এর জন্য কোনো ঘোষণা দেওয়া হতো না। একবার তারা এ বিষয়ে আলোচনা করলেন। কয়েকজন ছাহাবী বললেন, খ্রিষ্টানদের ন্যায় ঘণ্টা বাজানোর ব্যবস্থা করা হোক। আর কয়েকজন বললেন, ইয়াহূদীদের ন্যায় শিঙায় ফুঁক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ছালাতের ঘোষণা দেওয়ার জন্য তোমরা কি একজন লোক পাঠাতে পারো না? তখন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে বেলাল! উঠো এবং ছালাতের জন্য ঘোষণা দাও’।[4]
(৩) ক্বেবলা পরিবর্তন হওয়ার মাধ্যমে ইয়াহূদীদের বিরোধিতা প্রকাশ করা : বারা ইবনু আযেব রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মাক্বদিসমুখী হয়ে ১৬ বা ১৭ মাস ছালাত আদায় করেছেন আর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বার দিকে ক্বেবলা হওয়া পছন্দ করতেন। মহান আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন, ‘আকাশের দিকে আপনার বারবার তাকানোকে আমরা অবশ্য লক্ষ করছি’ (আল-বাক্বারা, ২/১৪৪)। অতঃপর তিনি কা‘বার দিকে মুখ করেন। আর নির্বোধ লোকেরা অর্থাৎ ইয়াহূদীরা বলত, ‘তারা এ যাবৎ যে ক্বেবলা অনুসরণ করে আসছিল, তা হতে কীসে তাদেরকে ফিরিয়ে দিলো?’ ‘বলুন, (হে নবী) পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। তিনি যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৪২)। তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে এক ব্যক্তি ছালাত আদায় করলেন এবং বেরিয়ে গেলেন। তিনি আছরের ছালাতের সময় আনছারদের এক গোত্রের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা বায়তুল মাক্বদিসের দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করছিলেন। তখন তিনি বললেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে কা‘বার দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করেছি’। তখন সে গোত্রের লোকজন ঘুরে কা‘বার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।[5]
(৪) জুতা, মোজা পায়ে দিয়ে ছালাত আদায়ের মাধ্যমে ইয়াহূদীদের বিরোধিতা প্রকাশ করা : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, خَالِفُوا الْيَهُودَ فَإِنَّهُمْ لاَ يُصَلُّونَ فِى نِعَالِهِمْ وَلاَ خِفَافِهِمْ ‘তোমরা (জুতা ও মোজা পরিধান করে ছালাত আদায় করে) ইয়াহূদীদের বিরোধিতা করো। কেননা তারা জুতা ও মোজা পরিধান করে ছালাত আদায় করে না’।[6]
এই হাদীছ পেশ করে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইয়াহূদীদের বিরোধিতা প্রকাশের ইচ্ছায় জুতা পায়ে দিয়ে ছালাত আদায় করা মুস্তাহাব হবে।[7]
(৫) আশূরার ছিয়াম পালনের মাধ্যমে ইয়াহূদীদের বিরোধিতা প্রকাশ করা : নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাররমের ১০ তারিখে আশূরার ছিয়াম পালন করতেন। পরবর্তীতে তিনি ৯ ও ১০ তারিখে ২টি ছিয়াম রাখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন, যাতে করে ইয়াহূদীদের বিরোধিতা প্রকাশ পায়। তিনি এভাবে বলেছেন,لَئِنْ بَقِيتُ إِلَى قَابِلٍ لأَصُومَنَّ التَّاسِعَ ‘যদি আমি সামনের বছর বেঁচে থাকি, তাহলে অবশ্যই আমি ৯ তারিখেও ছিয়াম পালন করবো’।[8]
(৬) সাহারী খাওয়ার মাধ্যমে ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের বিরোধিতা প্রকাশ করা : ছাহাবী আমর ইবনুল ‘আছ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,إِنَّ فَصْلَ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ أَكْلَةُ السُّحُورِ ‘আমাদের এবং আহলে কিতাবদের (ইয়াহূদী-খ্রিষ্টান) ছিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হলো সাহারী খাওয়া (তথা আমরা সাহারী খাই আর তারা সাহারী খায় না)।[9]
(৭) তাড়াতাড়ি ইফতার করার মাধ্যমে ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের বিরোধিতা প্রকাশ করা : আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لاَ يَزَالُ الدِّينُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ لأَنَّ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى يُؤَخِّرُونَ ‘দ্বীন ততদিন বিজয়ী থাকবে, যতদিন মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে। কেননা ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানরা দেরিতে ইফতার করে’।[10]
উক্ত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়, দ্বীন প্রতিষ্ঠিত থাকবে দ্বীনে হানীফের উপর, যতদিন মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে।
(৮) ছওমে বিছাল (তথাএকবার সাহারী খেয়ে একাদিক্রমে লাগাতার ছিয়াম রাখা) নিষেধের দ্বারা খ্রিষ্টানদের বিরোধিতা প্রকাশ করা : হাদীছে এসেছে,أَرَدْتُ أَنْ أَصُومَ يَوْمَيْنِ مُوَاصَلَةً فَمَنَعَنِى بَشِيرٌ وَقَالَ إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْهُ وَقَالَ يَفْعَلُ ذَلِكَ النَّصَارَى وَقَالَ عَفَّانُ يَفْعَلُ ذَلِكَ النَّصَارَى وَلَكِنْ صُومُوا كَمَا أَمْرَكُمُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ وَأَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ فَإِذَا كَانَ اللَّيْلُ فَأَفْطِرُوا বর্ণনাকারী বলেন, ‘আমি লাগাতার দুদিন ছিয়াম রাখতে চেয়েছিলাম। তারপর বাশীর আমাকে নিষেধ করে বললেন, নিশ্চয় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে ছিয়াম রাখতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, এভাবে খ্রিষ্টানরা ছিয়াম রাখে। আফফান বলেন, এভাবে খ্রিষ্টানরা ছিয়াম রাখে। বরং আল্লাহ যেভাবে আদেশ করেছেন, তুমি সেভাবে ছিয়াম পালন করো এবং রাত পর্যন্ত ছিয়াম রাখো। রাত হয়ে গেলে ছিয়াম ভেঙে ফেলো’।[11]
উক্ত হাদীছ দ্বারা ছওমে বিছাল নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ বুঝা যায়, আর তা হলো খ্রিষ্টানদের কর্মের বিরোধিতা প্রকাশ করা।
(৯) সাদা চুলে রং লাগানোর মাধ্যমে ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের বিরোধিতা প্রকাশ করা : আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى لاَ يَصْبُغُونَ فَخَالِفُوهُمْ ‘নিশ্চয় ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানরা (চুলে) রং লাগায় না, তাই তোমরা তাদের বিপরীত করো’ (তথা তোমরা চুলে রং লাগাও)।[12]
এখানে লক্ষণীয় দিক হলো সাদা চুলে কালো রং লাগানোর কথা হাদীছে বলা হয়নি। বরং হাদীছে কালো রং বাদে অন্য যে কোনো রং লাগানো যাবে বলে বলা হয়েছে। তাই কালো রং থেকে সকলকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ সাদা চুলে কালো রঙের খিযাব করা হারাম। হাদীছে কঠোরভাবে তা নিষেধ করা হয়েছে।
(১০) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যাপকভাবে মুশরেকদেরযাবতীয় অনুষ্ঠান, উৎসবের বিরোধিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন : যেমন—
(ক) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করলেন, তখন মদীনাবাসী দুদিন খেলাধুলা করতেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই দুই দিন কী হচ্ছে? তারা জবাবে বললেন, আমরা জাহেলী যুগে এই দুদিন খেলাধুলা করতাম। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,إِنَّ اللهَ قَدْ أَبْدَلَكُمْ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا يَوْمَ الأَضْحَى وَيَوْمَ الْفِطْرِ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা এই দুদিনের পরিবর্তে তোমাদের জন্য উত্তম দিন দান করেছেন, তা হলো— ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর’।[13]
(খ) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে এক লোক ‘বুয়ানা’ নামক জায়গায় তার উট যবেহ করার মানত করলেন। অতঃপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলেন। লোকটি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন, আমি মানত করেছি যে, আমার একটা উট ‘বুয়ানা’ নামক জায়গায় যবেহ করব। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একথা শুনে বললেন, ‘সেখানে কি কোনো জাহেলী যুগের মূর্তি আছে, যার ইবাদত করা হতো?’ তারা বললেন, ‘জি, না’। আবার তিনি বললেন, ‘সেখানে কি তাদের কোনো উৎসব উদযাপন হয়?’ তারা বললেন, ‘জি, না’। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তবে তোমার মানত পূর্ণ করো। জেনে রাখো! আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কোনো কাজে মানত পূর্ণ করা যাবে না এবং আদম সন্তান যে জিনিসের মালিক নয় সেটিতেও মানত চলে না’।[14]
(গ) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাজূসী তথা অগ্নিপূজকদের বিরোধিতা করার জন্য দাড়ি ছেড়ে দেওয়া এবং গোঁফকে ছোট করার জন্য বলেছেন, خَالِفُوا الْمُشْرِكِينَ وَفِّرُوا اللِّحَى وَأَحْفُوا الشَّوَارِبَ ‘তোমরা মুশরেকদের বিরোধিতা করো; দাড়ি আপন অবস্থায় ছেড়ে দাও এবং গোঁফ ছোট করো’।[15] অন্যত্র বলেছেন,خَالِفُوا الْمَجُوسَ ‘তোমরা অগ্নিপূজকদের বিরোধিতা করো’।[16]
ইয়াহূদী-খ্রিষ্টান ইসলাম ও মুসলিমদের চিরশত্রু। তারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে সর্বদা লেগেই আছে। ইসলামের আবির্ভাবে তামাম দুনিয়ার সকল রসম-রেওয়াজ, ধর্ম, মতবাদসহ যত কিছু আছে সব কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। সেই সাথে ইসলামের সর্বজনীনতার কাছে পরাজিত হয়েছে সকল আদর্শ, উৎসব, অনুষ্ঠান। ইসলামের এই মহত্তম আদর্শ, উৎসব, অনুষ্ঠান, সুন্নাহকে মুসলিমদের মানসপট থেকে মুছে দিতে মুসলিমবিরোধীরা বিভিন্ন ধরনের দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, বাৎসরিক উৎসব বা অনুষ্ঠান উদযাপনের নাম করে বিশ্ব মিডিয়া ও ম্যাগাজিন দখল করে জোরালোভাবে প্রকাশ করছে। ফলে ইসলামের অনুসারী মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই তাদের এই নোংরা অপসংস্কৃতি, রসম-রেওয়াজের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। অথচ ইসলামের নীতিমালা, সুন্নাহ, রসম-রেওয়াজ, উৎসব, অনুষ্ঠানই তামাম দুনিয়ার জন্য রোল মডেল ও কল্যাণকর, তা হয়তো অনেকেই জানে না। ইসলাম শ্রেষ্ঠ জীবনব্যবস্থা, নবী মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর সফল অনুসরণীয়, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, তা খোদ মুসলিম বিশ্বের অনুসারীরা জানা সত্ত্বেও জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বিশ্বাসের বাস্তব রূপরেখা ফুটিয়ে তুলে না, তাহলে কীভাবে মুসলিম উম্মাহর মুক্তি সম্ভব হবে? কীভাবে আপনি নিজেকে ইসলামের প্রকৃত অনুসারী, মুমিন বলে স্বীকৃতি দিবেন? ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধানের নাম। সেটা কি বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, বাৎসরিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর উৎসব উদযাপনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়? তা কি একটু বিবেচনা করবেন না? নচেৎ ইসলামের পরিপূর্ণতা আপনার কাছে অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। আল্লাহ আমাদের বিজাতীয় সকল অপসংস্কৃতি থেকে বেঁচে থেকে ইসলামের সমুজ্জ্বল সংস্কৃতির অনুসরণ, অনুকরণ করার এবং তার ধারক ও বাহক হওয়ার তাওফীক্ব দান করুক- আমীন!
মাযহারুল ইসলাম
অধ্যয়নরত, দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা দারুস সুন্নাহ, মিরপুর, ঢাকা।
[1]. আবূ দাঊদ, হা/৪০৩১; মিশকাত, হা/৪৩৪৭, হাসান।
[2]. তিরমিযী, হা/২৬৯৫, হাসান।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩০২।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৪।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৯৯।
[6]. আবূ দাঊদ, হা/৬৫২, হাদীছ ছহীহ।
[7]. উমদাতুল ক্বারী, ১/১১৯।
[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৩৪।
[9]. নাসাঈ, হা/২১৬৬, হাদীছ ছহীহ।
[10]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৫৩, হাসান।
[11]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২০০৫।
[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৬২; ছহীহ মুসলিম, হা/২১০৩।
[13]. মুসতাদরাক হাকেম, হা/১০৯১, হাদীছ ছহীহ।
[14]. আবূ দাঊদ, হা/৩৩১৩।
[15]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৮৯২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯।
[16]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬০।