জুম‘আর ছালাতের জন্য এক আযান দিতে হবে :
জুম‘আর ছালাতের জন্য যে দুই আযান প্রথা সমাজে চালু আছে তা সুন্নাতসম্মত নয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবুবকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফতের প্রথম দিকে এ আযান ছিল না। মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে ওছমান রাযিয়াল্লাহু আনহু মসজিদে নববীর অনতিদূরে ‘যাওরা’ নামক বাজারে জুম‘আর পূর্বে আরেকটি আযান চালু করেন।[1]
যরূরী কথা হলো ওছমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আযান যদি সকল মসজিদের জন্য পালনীয় হতো তাহলে তিনি মদীনায় চালু করলেন কিন্তু মক্কায় চালু করলেন না কেন? এমনকি ঐ সময় তিনি আর কোথাও দ্বিতীয় আযান চালু করেননি। ওমর ইবনে আলী আল-কাফহানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যিয়াদ রাহিমাহুল্লাহ সর্বপ্রথম বাছরায় ডাক আযান চালু করেন। আর হাজ্জাজ রাহিমাহুল্লাহ সর্বপ্রথম মক্কায় চালু করেন।[2] আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর রাজধানী কূফাতেও এই আযান চালু ছিল না।[3] ইবনে হাজার আসক্বালানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, খলীফা হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক রাহিমাহুল্লাহ সর্বপ্রথম ওছমানী আযানকে ‘যাওরা’ নামক স্থান হতে মসজিদে নববীর ভিতরে চালু করেন।[4] ইবনে হাজ্জ মালেকী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, হিশাম রাহিমাহুল্লাহ সর্বপ্রথম আযানকে মিনার থেকে নামিয়ে খুৎবার সময় ইমামের সামনে নিয়ে এসেছেন।[5] অতএব এখন যে আযান সমাজে চালু আছে তা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আযান নয়, ওছমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আযান নয়। বরং এটা হাজ্জাজী ও হিশামী যুগের বিদ‘আতী আযান।
জুম‘আর খুৎবা দাঁড়িয়ে দিতে হবে :
জুম‘আর খুৎবা বসে দেওয়া যাবে না। বসে খুৎবা দেওয়া ছহীহ হাদীছ বিরোধী আমল।
عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْطُبُ قَائِمًا ثُمَّ يَجْلِسُ ثُمَّ يَقُومُ فَيَخْطُبُ قَائِمًا فَمَنْ نَبَّأَكَ أَنَّهُ كَانَ يَخْطُبُ جَالِسًا فَقَدْ كَذَبَ فَقَدَ وَالله صليت مَعَه أَكثر من ألفي صَلَاة.
জাবির ইবনে সামুরা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন। অতঃপর বসতেন। তারপর আবার দাঁড়াতেন এবং দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন। তিনি আরও বলেন, কেউ যদি আপনাকে বলে যে, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসে খুৎবা দিতেন। তাহলে সে মিথ্যা কথা বলেছে। জাবির ইবনে সামুরা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহর কসম! আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে দুই হাজার বারেরও বেশি ছালাত আদায় করেছি।[6]
উক্ত হাদীছ প্রমাণ করে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন। ছাহাবী জাবির ইবনে সামুরা রাযিয়াল্লাহু আনহু কসম করে বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন। তবে এই হাদীছে যে দুই হাজার ছালাতের কথা বলা হয়েছে তা মূলত জুম‘আর ছালাত নয়; বরং তিনি প্রায় সবসময় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে থাকতেন একথা বুঝানো হয়েছে। কারণ মদীনায় আসার পর জুম‘আ চালু হয়েছে। তাতে প্রায় পাঁচশ’ জুম‘আ হয়। অথবা কথায় জোর দেওয়ার জন্য এভাবে বলা হয়েছে।
عَنْ كَعْبِ بْنِ عُجْرَةَ: أَنَّهُ دَخَلَ الْمَسْجِدَ وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ أُمِّ الْحَكَمِ يَخْطُبُ قَاعِدًا فَقَالَ: انْظُرُوا إِلَى هَذَا الْخَبِيثِ يَخْطُبُ قَاعِدًا وَقد قَالَ الله تَعَالَى: (وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً أَوْ لَهْوًا انْفَضُّوا إِلَيْهَا وَتَرَكُوك قَائِما)
কা‘ব ইবনে উজরা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি মসজিদে প্রবেশ করেন। তিনি দেখেন যে, আব্দুর রহমান ইবনে উম্মে হাকাম রাযিয়াল্লাহু আনহু বসে খুৎবা দিচ্ছেন। তিনি উপস্থিত লোকের সামনে বলেন, আপনারা এ খবীছকে দেখুন, এ খবীছ বসে খুৎবা দিচ্ছে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘মসজিদের মুছল্লীরা ব্যবসায়ীদের দেখল অথবা খেলোয়াড়দের দেখল তখন তারা সেদিকে ছুটে গেল এবং আপনাকে খুৎবা চলাকালীন দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে চলে গেল’।[7]
উক্ত আয়াত ও হাদীছ প্রমাণ করে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে খুৎবা দিচ্ছিলেন। অতএব জুম‘আর খুৎবা দাঁড়িয়েই দিতে হবে।
লাঠি হাতে নিয়ে খুৎবা দেওয়া সুন্নাত :
লাঠি হাতে নিয়ে খুৎবা দিতে হবে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ يَزِيدَ بْنِ الْبَرَاءِ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- نُوِّلَ يَوْمَ الْعِيدِ قَوْسًا فَخَطَبَ عَلَيْهِ
ইয়াযীদ ইবনে বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ঈদের দিন একটি ধনুক নিয়ে যাওয়া হলো, তিনি তার উপর ভর দিয়ে ঈদের খুৎবা দিলেন।[8] হাকাম ইবনে হাযন রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে জুম‘আর দিন উপস্থিত ছিলাম, তিনি লাঠির উপর ভর দিয়ে জুম‘আর খুৎবা দিলেন।[9] এই হাদীছ প্রমাণ করে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাঠির উপর ভর দিয়ে জুম‘আর খুৎবা দিতেন। ইবনে জুরাইয রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি আত্বা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বললাম, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি লাঠি হাতে নিয়ে জুম‘আর খুৎবা দিতেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তিনি লাঠির উপর ভর দিয়েই খুৎবা দিতেন।[10]
খুৎবা বোধগম্য ভাষায় হতে হবে :
মুছল্লী যে ভাষায় খুৎবা উপলদ্ধি করতে পারবে, খুৎবা সে ভাষাতেই হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ ‘আমি সকল রাসূলকেই তার সম্প্রদায়ের ভাষাতেই প্রেরণ করেছি যেন তিনি তাদের সামনে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন’ (ইবরাহীম, ৪)। এই আয়াত প্রমাণ করে, যিনি মানুষের সামনে কুরআন-হাদীছের কথা বলবেন তাকে জনগণের ভাষাতেই বলতে হবে। তাহলে আল্লাহর আদেশ পালন করা হবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পাঠানোর উদ্দেশ্য সফল হবে।
عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ: كَانَتْ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خُطْبَتَانِ يَجْلِسُ بَيْنَهُمَا يقْرَأ الْقُرْآن وَيذكر النَّاس
জাবির ইবনে সামুরা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুম‘আর দু’টি খুৎবা দিতেন। দুই খুৎবার মাঝে বসতেন। দুই খুৎবাতেই কুরআন মাজীদ পড়তেন এবং মানুষকে উপদেশ দিতেন।[11] এই হাদীছ প্রমাণ করে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই খুৎবাতেই কুরআন পড়ে উপদেশ দিতেন। পৃথিবীর প্রতিটি জুম‘আর মসজিদের খত্বীবকে দুই খুৎবাতেই কুরআন পড়ে উপদেশ দিতে হবে। অর্থাৎ কুরআন মাজীদ ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছ শুনাতে হবে। মানুষ হবে বাংলা ভাষার আর খুৎবা হবে আরবীতে এর চেয়ে কুরআন হাদীছ বিরোধী কথা হতে পারে না। কুরআন-হাদীছ জেনেও যারা হঠকারিতা করে একথা বলে তারা শুধুমাত্র মাযহাব মানে, কুরআন-হাদীছ মানে না। এটাই তার প্রমাণ। তারা বিদ‘আত করবে অর্থাৎ খুৎবার পূর্বে বাংলা ভাষায় বক্তব্য দিবে কিন্তু কুরআন-হাদীছ মানবে না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের সামনে আরবী ভাষায় খুৎবা দেননি; বরং তিনি তার মাতৃভাষায় খুৎবা দিয়েছেন যা ছিল আরবী। অতএব বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সামনে আরবী ভাষায় খুৎবা দেওয়া অর্থহীন, বোকামী, হঠকারিতা এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের বিরোধিতার শামিল। আরবী ভাষায় খুৎবা দিয়ে মানুষকে কী বুঝাবে? যেমনভাবে খুৎবার পূর্বে বাংলা ভাষায় বক্তব্য দেওয়ার কোনো বিধান নেই, তেমনিভাবে আরবী ভাষাতে খুৎবা দেওয়ারও কোনো বিধান নেই।
জুম‘আর ছালাতের জন্য মুছল্লী সংখ্যা নির্ধারণ করা যাবে না :
জুম‘আর ছালাতের জন্য ৪০ জন্য লোক হতে হবে একথা ঠিক নয়। বরং দু’জন লোক হলেও খুৎবার মাধ্যমে জুম‘আর ছালাত আদায় করতে হবে। কারণ জুম‘আর ছালাত অন্যান্য ফরয ছালাতের মতই ফরয। কোনো স্থানে দু’জন লোক হলেও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আযান, ইক্বামতসহ জামা‘আত সহকরে ছালাত আদায় করতে বলেন।
عَنْ مَالِكِ بْنِ الْحُوَيْرِثِ عَنِ النَّبِىِّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ «إِذَا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ فَأَذِّنَا وَأَقِيمَا، ثُمَّ لِيَؤُمَّكُمَا أَكْبَرُكُمَا» .
মালিক ইবনে হুয়াইরিছ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন ছালাতের সময় হবে, তখন তোমরা দুইজনের জন্য আযান এবং ইক্বামত দাও। আর তোমাদের দুইজনের বড় যে জন, সে তোমাদের ইমামতি করবে’।[12] এই হাদীছ প্রমাণ করে, জামা‘আতের জন্য কমপক্ষে দু’জন লোক লাগে। দু’জন হলেই আযান ও খুৎবার মাধ্যমে ছালাত আদায় করতে হবে। জুম‘আর ছালাতের জন্য ৪০ জন বা ৫০ জন হতে হবে, এর প্রমাণে হাদীছগুলো সঠিক নয়।
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সুন্নাত হিসাবে প্রচলিত আছে যে, তিনজন হলে একজন ইমাম নির্ধারণ করবে। ৪০ জন বা তার চেয়ে বেশি হলে জুম‘আ, ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহা ক্বায়েম করা যাবে। আর এটাই হচ্ছে মূলত জামা‘আত।[13] হাদীছটি জাল।[14] আবু উমামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘৫০ জন ছাড়া জুম‘আর ছালাত হবে না’।[15] আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এ ব্যাপারে অনেক হাদীছ আছে সবগুলোই ত্রুটিপূর্ণ। এ ব্যাপারে কোনো ছহীহ হাদীছ নেই। হাদীছগুলো দারাকুৎনী বর্ণনা করেছেন।[16]
জুম‘আর পূর্বে রাক‘আত সংখ্যা নির্ধারণ নেই :
জুম‘আর ছালাতের পূর্বে কত রাক‘আত সুন্নাত পড়তে হবে তা নির্ধারিত নেই। যার যত রাক‘আত পড়া সম্ভব, সে তত রাক‘আত পড়বে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ. عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنِ اغْتَسَلَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَصَلَّى مَا قُدِّرَ لَهُ ثُمَّ أَنْصَتَ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ خُطْبَتِهِ ثُمَّ يُصَلِّيَ مَعَهُ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الْأُخْرَى وَفَضْلُ ثَلَاثَةِ أَيَّام»
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গোসল করে জুম‘আর ছালাতে আসবে অতঃপর তার সাধ্যানুযায়ী ছালাত আদায় করবে। তারপর ইমামের খুৎবা শেষ করা পর্যন্ত চুপ থাকবে অতঃপর ইমামের সাথে ছালাত আদায় করবে, তার এই জুম‘আ এবং পরবর্তী জুম‘আর মাঝের পাপরাশি ক্ষমা করা হবে। অতিরিক্ত আরও তিন দিনের পাপ ক্ষমা করা হবে’।[17] এই হাদীছ প্রমাণ করে, জুম‘আর পূর্বে যার যত রাক‘আত সম্ভব, সে তত রাক‘আত পড়বে।
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ وَأَبِي هُرَيْرَةَ قَالَا: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «من اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَلَبِسَ مِنْ أَحْسَنِ ثِيَابِهِ وَمَسَّ مِنْ طِيبٍ إِنْ كَانَ عِنْدَهُ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَلَمْ يَتَخَطَّ أَعْنَاقَ النَّاسِ ثُمَّ صَلَّى مَا كَتَبَ اللَّهُ لَهُ ثُمَّ أَنْصَتَ إِذا خرج إِمَام حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ صَلَاتِهِ كَانَتْ كَفَّارَةً لِمَا بَيْنَهَا وَبَيْنَ جُمُعَتِهِ الَّتِي قَبْلَهَا»
আবু সাঈদ খুদরী এবং আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন গোসল করল এবং তার সুন্দর কাপড় পরিধান করল আর তার নিকট আতর থাকলে গায়ে লাগাল, তারপর জুম‘আর ছালাতে আসল। মানুষের কাঁধ ডিঙ্গিয়ে আসল না। তারপর আল্লাহ তার জন্য যত রাক‘আত ছালাত নির্ধারণ করেছেন, তা আদায় করল। তারপর ইমাম বের হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকল। এভাবে ছালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকল, তাহলে তার এই জুম‘আ এবং তার পূর্বের জুম‘আর মাঝের পাপ ক্ষমা হয়ে যাবে’।[18] এই হাদীছ প্রমাণ করে, জুম‘আর পূর্বে কোনো নির্ধারিত ছালাত নেই। যার যা সম্ভব, সে তা আদায় করবে। তবে খুৎবা আরম্ভ হওয়ার পর আসলে মাত্র দুই রাক‘আত পড়বে।
عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم وَهُوَ يخْطب: «إِذَا جَاءَ أَحَدُكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ فليركع رَكْعَتَيْنِ وليتجوز فيهمَا»
জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুম‘আর খুৎবা চলাকালীন বলেন, ‘যখন তোমাদের কোনো ব্যক্তি জুম‘আর দিন আসবে এমতাবস্থায় ইমাম খুৎবা দিচ্ছেন, তাহলে সে যেন সংক্ষিপ্ত করে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করে’।[19] এই হাদীছ প্রমাণ করে, খুৎবা আরম্ভ হলেও কেউ মসজিদে ঢুকে বসতে পারবে না। অন্তত দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করতেই হবে, সংক্ষিপ্ত করে হলেও।
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ الْمَسْجِدَ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ قَبْلَ أَنْ يجلس
আবু ক্বাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কোনো ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করবে, সে যেন বসার পূর্বে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করে’।[20] এই হাদীছ প্রমাণ করে, যে কোনো সময়ে মসজিদে প্রবেশ করলে বাধ্যগতভাবে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করতে হবে। দুই রাক‘আত ছালাত আদায় না করে বসতে পারবে না। মসজিদে ঢুকেই বসে যাওয়া হাদীছ বিরোধী আমল, হাদীছ না মানার শামিল।
জুম‘আর পর মসজিদে সুন্নাত পড়লে ৪ রাক‘আত পড়বে :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ كَانَ مِنْكُمْ مُصَلِّيًا بَعْدَ الْجُمُعَةِ فَلْيُصَلِّ أَرْبَعًا
‘যখন তোমাদের কেউ জুম‘আর ছালাত আদায় করবে, তখন সে যেন জুম‘আর পরে চার রাক‘আত ছালাত আদায় করে’।[21] এই হাদীছ প্রমাণ করে জুম‘আর ছালাতের পর মসজিদে সুন্নাত পড়লে চার রাক‘আত পড়বে। তবে বাড়ীতে পড়লে দুই রাক‘আত পড়বে।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يُصَلِّي بَعْدَ الْجُمُعَةِ حَتَّى يَنْصَرِفَ فَيُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ فِي بَيته
ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুম‘আর পর বাড়ীতে না ফিরে ছালাত আদায় করতেন না। অতঃপর তিনি তাঁর বাড়ীতে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন।[22] এই হাদীছ প্রমাণ করে, জুম‘আর ছালাতের পর বাড়ীতে সুন্নাত পড়লে দুই রাক‘আত পড়তে হবে।
জুম‘আর পূর্বে চার রাক‘আত পড়ার হাদীছগুলো যঈফ :
ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুম‘আর পূর্বে চার রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন কিন্তু এর মাঝে সালাম ফিরিয়ে পৃথক করতেন না।[23] হাদীছটি নিতান্তই যঈফ।[24] ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুম‘আর পূর্বে চার রাক‘আত পড়তেন এবং জুম‘আর পরে চার রাক‘আত পড়তেন। কিন্তু এগুলোর মাঝে সালাম ফিরিয়ে পৃথক করতেন না। হাদীছটি বাতিল।[25]
পৃথিবীর সবস্থানেই জুম‘আ চলবে :
শহর ছাড়া জুম‘আ চলবে না একথা শরী‘আত বিরোধী। গ্রামে জুম‘আ না পড়ে আখেরী যোহর পড়া বিদ‘আত।
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّهُ قَالَ إِنَّ أَوَّلَ جُمُعَةٍ جُمِّعَتْ بَعْدَ جُمُعَةٍ فِى مَسْجِدِ رَسُولِ اللَّهِ - صلى الله عليه وسلم - فِى مَسْجِدِ عَبْدِ الْقَيْسِ بِجُوَاثَى مِنَ الْبَحْرَيْنِ .
ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নিশ্চয় মসজিদে নববীতে জুম‘আ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম যে জুম‘আর ছালাত ক্বায়েম হয়েছিল সেটা ‘জোওয়াছা’ নামক গ্রামে, যা ছিল বাহরাইনের কোনো একটি গ্রাম।[26] এই হাদীছ প্রমাণ করে, গ্রামে জুম‘আ ক্বায়েম করতে হবে। হাদীছটিকে সামনে রেখে ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ একটি অনুচ্ছেদ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, গ্রাম এবং শহরসমূহে জুম‘আ ক্বায়েম করতে হবে। ইমাম আবুদাঊদ রাহিমাহুল্লাহ এ ব্যাপারে একটি অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেন, গ্রামসমূহে জুম‘আ ক্বায়েম করতে হবে। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, ইয়ামানবাসীরা ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট চিঠি লিখে জিজ্ঞেস করল জুম‘আর ছালাত সম্পর্কে, তখন ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু উত্তর লিখে পাঠান- যেখানেই তোমরা অবস্থান করবে, সেখানেই জুম‘আর ছালাত আদায় করবে।[27] ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মক্কা এবং মদীনার মাঝে যেখানে পানি জমা থাকত, সে পানির পাশে লোকেরা জুম‘আ ক্বায়েম করত। সেটা খারাপ মনে করা হত না।[28] এ ব্যাপারে সবচেয়ে শক্তিশালী কথা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমাদেরকে জুম‘আর দিন জুম‘আর ছালাত আদায়ের জন্য ডাকা হবে, তখন তোমরা আল্লাহকে ডাকার জন্য দৌড়িয়ে আসো। আর যখন ছালাত শেষ হয়ে যাবে, তখন আল্লাহর অনুগ্রহ খোঁজার জন্য যমীনে ছড়িয়ে পড়ো’ (জুম‘আ, ৯)। এই আয়াত প্রমাণ করে, পৃথিবীর সকল মানুষকেই জুম‘আর ছালাত আদায় করতে হবে। জামা‘আতের জন্য দু’জন মানুষ লাগে। যে কোনো স্থানে দুই বা ততোধিক মানুষ জমা হলেই আযান দিয়ে খুৎবার মাধ্যমে জুম‘আর ছালাত আদায় করবে। শহর ছাড়া জুম‘আ হবে না মর্মে হাদীছগুলো জাল।
আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘শহর ছাড়া ঈদের ছালাত এবং জুম‘আর ছালাত হবে না’। হাদীছটি জাল, যার কোনো ভিত্তি নেই।[29] জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘জুম‘আ, ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের জন্য ৪০ জন্য মুছল্লী হতে হবে’। হাদীছটি নিতান্তই যঈফ।[30] মুছ‘আব ইবনে ওমায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আসার পূর্বে ৪০ জন লোক দিয়ে মদীনায় জুম‘আ চালু করেন। এই হাদীছটিও যঈফ।[31]
কাঠের তৈরি মিম্বার হতে হবে :
পাথর, টাইলস, সিমেন্ট, মাটি ইত্যাদি দ্বারা মিম্বার তৈরি করা যাবে না। ইমামকে এখানে সুন্নাতের প্রতি কঠোর হওয়া একান্ত যরূরী এবং সিমেন্ট বা মাটির তৈরি মিম্বার বর্জন করা উচিত। সুন্নাত হচ্ছে, কাঠ দ্বারা মিম্বার তৈরি করতে হবে। তিন স্তরের মিম্বার তৈরি করতে হবে।
আবু হাযিম ইবনু দীনার হতে বর্ণিত যে, (একদিন) কিছু লোক সাহ্ল ইবনু সা‘দ সাঈদীর নিকট আগমন করে এবং মিম্বরটি কোন কাঠের তৈরি ছিল, এ নিয়ে তাদের মনে প্রশ্ন জেগে ছিল। তারা এ সম্পর্কে তার নিকট জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি সম্যকরূপে অবগত আছি যে, তা কিসের ছিল। প্রথম যেদিন তা স্থাপন করা হয় এবং প্রথম যে দিন এর উপর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসেন তা আমি দেখেছি। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনছারদের অমুক মহিলার (বর্ণনাকারী বলেন, সাহ্ল রাযিয়াল্লাহু আনহু তার নামও উল্লেখ করেছিলেন) নিকট লোক পাঠিয়ে বলেছিলেন, তোমার কাঠমিস্ত্রি গোলামকে আমার জন্য কিছু কাঠ দিয়ে এমন জিনিস তৈরি করার নির্দেশ দাও, যার উপর বসে আমি লোকদের সাথে কথা বলতে পারি। অতঃপর সে মহিলা তাকে আদেশ করেন এবং সে (মদীনা হতে নয় মাইল দূরবর্তী) এলাকার ঝাউ কাঠ দ্বারা তা তৈরি করে নিয়ে আসে। মহিলাটি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট তা পাঠিয়েছেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশে এখানেই তা স্থাপন করা হয়। অতঃপর আমি দেখেছি, এর উপর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছালাত আদায় করেছেন। এর উপর উঠে তাকবীর দিয়েছেন এবং এখানে (দাঁড়িয়ে) রুকূ করেছেন। অতঃপর পিছনের দিকে নেমে এসে মিম্বারের গোড়ায় সিজদা করেছেন এবং (এ সিজদা) পুনরায় করেছেন, অতঃপর ছালাত শেষ করে সমবেত লোকদের দিকে ফিরে বলেছেন, হে লোক সকল! আমি এটা এ জন্য করেছি যে, তোমরা যেন আমার অনুসরণ করতে পারো এবং আমার ছালাত শিখে নিতে পারো’।[32]
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, (মসজিদে নববীতে) এমন একটি (খেজুর গাছের) খুঁটি ছিল যার সাথে হেলান দিয়ে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়াতেন। অতঃপর যখন তাঁর জন্য মিম্বার স্থাপন করা হলো, আমরা তখন খুঁটি হতে দশ মাসের গর্ভবতী উটনীর মতো ক্রন্দন করার শব্দ শুনতে পেলাম। এমনকি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার হতে নেমে এসে খুঁটির উপর হাত রাখলেন।[33]
তুফায়েল ইবনে ওবাই ইবনে কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর গাছের কা--র উপর বা তার পাশে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করাতেন। তখন মসজিদ ছিল আঙ্গুর গাছের মাচানের মতো ছাদবিহীন, তিনি খেজুর গাছের কাণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন। তাঁর ছাহাবীগণের মধ্য হতে একজন ছাহাবী বললেন, আপনার জন্য আমরা এমন কিছু করি, যার উপর দাঁড়িয়ে আপনি জুম‘আর দিন খুৎবা দিবেন, যাতে করে মানুষ আপনাকে দেখতে পায়। আর আপনি তাদেরকে আপনার বক্তব্য শুনাতে পারেন। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছো’। তখন তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য তিন স্তরের কাঠের মিম্বার তৈরি করলেন। আর এটি হলো সবচাইতে উঁচু মিম্বার। মিম্বারটি তৈরি করা হলে তা যখাস্থানে রাখা হলো। এরপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুৎবা দেওয়ার ইচ্ছা করলেন, তখন তিনি ঐ খেজুর গাছের কাণ্ডের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন ঐ কাণ্ডটি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে, ফলে তা ফেটে যায়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুকনো খেজুর গাছের কান্নার শব্দ শুনে মিম্বার থেকে নেমে আসেন এবং নিজ হাত তাতে বুলিয়ে দেন। ফলে তা শান্ত হয়ে যায়। তারপর তিনি মিম্বারের দিকে ফিরে যান। এরপর যখন তিনি ছালাত আদায় করতেন, তখন তার দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করতেন। মসজিদ ভেঙ্গে যখন এর আকার পরিবর্তন করা হয়, তখন উবাই ইবনে কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু সেটি সংরক্ষণ করেন। অবশেষে উইপোকা তাকে খেয়ে ফেলে। ফলে তা টুকরা টুকরা হয়ে যায়।[34]
উক্ত হাদীছসমূহ প্রমাণ করে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিম্বার ছিল কাঠের। মিম্বারটিতে ছিল তিনটি সিঁড়ি। অতএব যরূরীভাবে ইট-সিমেন্টের মিম্বার পরিহার করতে হবে। সব মসজিদেই কাঠের তৈরি মিম্বার ব্যবহার করতে হবে।
মিম্বারে উঠার সময় উপস্থিত মুছল্লীকে সালাম দিতে হবে :
অনেক ইমাম মিম্বারের পাশে বসা মুছল্লীদের সালাম দেন। কিন্তু সুন্নাত হলো মিম্বারে বসে সকলকে লক্ষ করে সালাম দিতে হবে। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মিম্বারে উঠতেন, তখন সালাম দিতেন।[35] ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন মিম্বারে দাঁড়াতেন, তখন মুছল্লীদেরকে সালাম দিতেন আর মুছল্লীরাও তার উত্তর দিতেন।[36] ওছমান রাযিয়াল্লাহু আনহু মিম্বারে উঠে লম্বা উচ্চারণে সালাম দিতেন।[37] এই হাদীছসমূহ প্রমাণ করে, মিম্বারে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায় সালাম দিতে হবে।
মিম্বারের পাশে বসে থাকা মুছল্লীদেরকে সালাম দেওয়ার প্রমাণে হাদীছটি যঈফ। ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, জুম‘আর দিনে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মিম্বারের কাছাকাছি পৌঁছতেন, তখন মিম্বারের নিকটে বসে থাকা ব্যক্তিদের সালাম দিতেন। তারপর যখন মিম্বারে উঠে মানুষের দিকে মুখ করতেন, তখন আবার সালাম দিতেন।[38]
জুম‘আর খুৎবা দুই রাক‘আত ছালাতের সমান একথা সঠিক নয় :
অনেকেই মনে করেন, জুম‘আর ছালাত পাওয়ার জন্য জুম‘আর খুৎবা পাওয়া যরূরী। কারণ খুৎবা হচ্ছে জুম‘আর দুই রাক‘আত ছালাতের সমান। কাজেই জুম‘আর খুৎবা না পেলে তাকে যোহরের চার রাক‘আত ছালাত আদায় করতে হবে। এ ধারণা ছহীহ হাদীছ বিরোধী। ছহীহ হাদীছে এসেছে, জুম‘আর এক রাক‘আত পেলেই জুম‘আ পেয়ে যায়।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « مَنْ أَدْرَكَ مِنَ الْجُمُعَةِ رَكْعَةً فَلْيُصَلِّ إِلَيْهَا أُخْرَى ».
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুম‘আর ছালাতের এক রাক‘আত পাবে সে যেন তার সাথে পরের রাক‘আত পড়ে’।[39] এই হাদীছ প্রমাণ করে, জুম‘আর ছালাত এক রাক‘আত পেলে জুম‘আ পেয়ে যায়। তাকে আর যোহরের ছালাত আদায় করতে হবে না। তবে এক রাক‘আত অথবা রুকূ না পেলে চার রাক‘আত যোহর পড়তে হবে।
জুম‘আর খুৎবা দুই রাক‘আত ছালাতের সমান মর্মে হাদীছগুলো যঈফ। ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘খুৎবাকে দুই রাক‘আতের সমান করা হয়েছে। অতএব যে খুৎবা পাবে না, সে যেন চার রাক‘আত ছালাত পড়ে নেয়’। হাদীছটি যঈফ।[40] ইবনে মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যে খুৎবা পাবে, তার জন্য জুম‘আর ছালাত দুই রাক‘আত। আর যে খুৎবা পাবে না, সে যেন চার রাক‘আত পড়ে নেয়’। হাদীছটি যঈফ।[41]
খুৎবার সময় ইমামের দিকে লক্ষ্য করতে হবে :
ইমাম খুৎবা আরম্ভ করলে সকল মুছল্লীকে মনোযোগ সহকারে ইমামের প্রতি লক্ষ্য করতে হবে। আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মিম্বারে বসতেন, তখন আমরাও তাঁর আশেপাশে বসতাম।[42] আদি ইবনে ছাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মিম্বারে বসতেন, তখন তাঁর ছাহাবীগণ তাঁদের মুখ তাঁর দিকে ঘুরিয়ে বসতেন।[43] এই হাদীছসমূহ প্রমাণ করে, খুৎবার সময় ইমামের দিকে মুখ করে মনোযোগ সহকারে খুৎবা শুনতে হবে।
জুম‘আর খুৎবা চলাকালীন মসজিদে প্রবেশ করলেও দুই রাক‘আত সুন্নাত পড়তে হবে :
মসজিদে প্রবেশ করে বসার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি খুৎবা চলাকালীন প্রবেশ করলেও দুই রাক‘আত পড়তে হবে।
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ وَالنَّبِىُّ - صلى الله عليه وسلم - يَخْطُبُ النَّاسَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَالَ « أَصَلَّيْتَ يَا فُلاَنُ » . قَالَ لاَ . قَالَ « قُمْ فَارْكَعْ » .
জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি জুম‘আর দিনে মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবা দিচ্ছিলেন। তিনি ঐ লোকটিকে বললেন, তুমি কি ছালাত আদায় করেছ? তিনি বললেন, না। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি দাঁড়াও, দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করো’।[44] এই হাদীছ প্রমাণ করে, ইমাম খুৎবা দেওয়ার সময় যদি দেখেন কোনো মানুষ মসজিদে প্রবেশ করে বসে পড়ল, তাহলে ইমাম তাকে দাঁড়াতে বলবেন এবং দুই রাক‘আত ছালাত আদায়ের জন্য আদেশ করবেন।
عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم وَهُوَ يخْطب: «إِذَا جَاءَ أَحَدُكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ فليركع رَكْعَتَيْنِ وليتجوز فيهمَا» .
জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সময় খুৎবা দিচ্ছিলেন, তখন তিনি বলেন, ‘ইমাম খুৎবা দেওয়া অবস্থায় জুম‘আর দিনে তোমাদের কেউ যদি মসজিদে প্রবেশ করে, তাহলে সে যেন দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করে আর তা সংক্ষিপ্তভাবে আদায় করে’।[45] এই হাদীছ প্রমাণ করে, খুৎবা অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করলে সংক্ষিপ্তভাবে দুই রাক‘আত পড়তে হবে। এ ব্যাপারে ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ একটি অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেন, ইমাম খুৎবা দেওয়া অবস্থায় যখন কোনো ব্যক্তিকে মসজিদে আসতে দেখবেন, তখন তিনি তাকে আদেশ দিবেন যেন সে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করে। ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ এই অনুচ্ছেদে বলতে চান, খুৎবা অবস্থায় যারা মসজিদে প্রবেশ করবে, ইমাম ছাহেব তাদেরকে দুই রাক‘আত ছালাত আদায়ের জন্য আদেশ করবেন। এ ব্যাপারে ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ আরও একটি অনুচ্ছেদ উল্লেখ করেন, তাতে তিনি বলেন, খুৎবা অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করলে দুই রাক‘আত আদায় করবে এবং সংক্ষিপ্ত করবে।
খুৎবা চলাকালীন সময়ে ছালাত আদায় করা যাবে না মর্মে হাদীছগুলো জাল। আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ইমাম খুৎবা দেওয়া অবস্থায় তোমরা ছালাত আদায় করো না’। হাদীছটি জাল।[46] ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি বলতে শুনেছি, ‘ইমাম খুৎবা দেওয়া অবস্থায় তোমাদের কেউ যখন প্রবেশ করবে, তখন ইমামের খুৎবা শেষ হওয়া পর্যন্ত কোনো ছালাত আদায় করো না এবং কোনো কথা বলো না’। হাদীছটি বাতিল।[47]
(চলবে)
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৯১২।
[2]. মিরআত, ২/৩০৭।
[3]. তাফসীরে জালালাইন, পৃঃ ৪৬০।
[4]. মিরক্বাত, দিল্লী ছাপা, ৩/২৬৩।
[5]. আওনুল মা‘বূদ, কায়রো ছাপা, ৩/৪৩৩-৩৪।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৬২; মিশকাত, হা/১৪১৫।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৬৪; মিশকাত, হা/১৪১৬; সূরা জুম‘আ, ১১।
[8]. আবুদাঊদ, হা/১১৪৫।
[9]. আবুদাঊদ, হা/১০৯৬।
[10]. মুসনাদে আহমাদ, ১/১৬৩; আল-উম্ম, ১/১৭৭।
[11]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৩২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/১৩২১।
[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৭০।
[13]. দারাকুৎনী, হা/১৫৯৮।
[14]. ইরওয়াউল গালীল, হা/৬০৩।
[15]. মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ২/১৭৬।
[16]. ইরওয়াউল গালীল, ৩/৭০।
[17]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৫৭; মিশকাত, হা/১৩৪২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/১৩০০।
[18]. আবুদাঊদ, হা/৩৪৩; মিশকাত, হা/১৩৮৭।
[19]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৭৫; মিশকাত, হা/১৪১১।
[20]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৭১৪; মিশকাত, হা/৭০৪।
[21]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৮১; মিশকাত, হা/১১৬৬।
[22]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৮২; মিশকাত, হা/১১৬১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/১০৯৩।
[23]. ইবনু মাজাহ, হা/১১২৯।
[24]. প্রাগুক্ত।
[25]. সিলসিলা যঈফাহ, হা/১০০১।
[26]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৯২।
[27]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হা/৫১০৮; ইরওয়াউল গালীল, হা/৫৯৯-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[28]. ইরওয়াউল গালীল, হা/৫৯৯-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[29]. সিলসিলা যঈফাহ, হা/৯১৭।
[30]. ইরওয়াউল গালীল, হা/৬০৩।
[31]. ইরওয়াউল গালীল, হা/৬০২।
[32]. ছহীহ বুখারী, হা/৯১৭।
[33]. ছহীহ বুখারী, হা/৯১৮।
[34]. ইবনে মাজাহ, হা/১৪১৪।
[35]. ইবনে মাজাহ, হা/১১০৯; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২০৭৬।
[36]. সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২০৭৬-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[37]. সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২০৭-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[38]. সিলসিলা যঈফাহ, হা/৪১৯৪।
[39]. ইবনে মাজাহ, হা/১১২১।
[40]. সিলসিলা যঈফাহ, হা/৫২০০।
[41]. মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হা/৩১৬৪।
[42]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৫২।
[43]. ইবনে মাজাহ, হা/১১৩৬।
[44]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৩০ ও ৯৩১।
[45]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৭৫; মিশকাত, হা/১৪১১।
[46]. তানকীহুল কালাম, পৃঃ ৪৩৩।
[47]. সিলসিলা যঈফাহ, হা/৮৭।