কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসলামে দাসপ্রথা

post title will place here

অমুসলিমরা ও ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলামের দোষ খুঁজতে সদা তৎপর। কীভাবে ইসলামকে কলুষিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় এটা তাদের অস্থিমজ্জার সাথে মিশে আছে। ইসলামের বিষয়ে জ্ঞান অর্জন না করে অবান্তর প্রশ্ন করে বেড়ায়। এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন কে? আল্লাহ তাআলা। এই শাশ্বত ধ্রুব সত্য কথাটি তারা বিশ্বাস করে না। যেহেতু আল্লাহ তাআলা এই অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু তিনি জানেন পরিচালনা কীভাবে করতে হবে। কোন বিধানটি কোথায় প্রয়োগ করলে সৃষ্টিজীবের কল্যাণ হবে আর কোথায় প্রয়োগ করলে অকল্যাণ হবে তিনি সবই বুঝেন। পৃথিবী সৃষ্টি করার পর নড়াচড়া করছিল। এটাকে স্থির রাখার জন্য পর্বতমালা সৃজন করলেন। এখন যদি প্রশ্ন কর, ‘কেন এই পর্বতমালা অনর্থক সৃষ্টি করা হলো?’ নিশ্চয় এ প্রশ্ন অবান্তর হবে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ﴿الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ﴾ ‘আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করে দিলাম’ (আল-মায়েদা, ৫/৩)। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করে দিলাম। তিনি কিন্তু একথা বলেননি যে, তোমাদের জ্ঞান পরিপূর্ণ করে দিলাম।

মানুষের জ্ঞান যেহেতু স্বল্প সীমিত, সেহেতু না জেনে মূর্খতাসুলভ আচরণ করে অহেতুক প্রশ্ন করে। আদম আলাইহিস সালাম-কে সৃষ্টি করার পূর্বে ইবলীস ছিল শীর্ষস্থানীয় ইবাদতকারীদের একজন। যখন আল্লাহ তাআলা সকল ফেরেশতা ও ইবলীসকে আদম আলাইহিস সালাম-কে সেজদা করতে বললেন, তখন ইবলীস অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল, অবাধ্য হলো আল্লাহর কথার। এরপর থেকেই শুরু হলো হক্ব-বাতিলের লড়াই। ইবলীস সরাসরি শত্রুতা ও বিদ্বেষের বীজ ছিটিয়ে দিল; ওপেন চ্যালেঞ্জ করল আল্লাহর সাথে, ‘আমি আমার যাপিত জীবনের শ্রম ব্যয় করে হলেও আদম ও তাঁর বংশধরদের বিপথগামী করব। একসাথে সবাই মিলে জাহান্নামের অন্ধকার কুঠুরিতে আবাসন গড়ব’। তবে আপনি আমাকে মহাপ্রলয় দিবস অবধি আয়ু বৃদ্ধি করুন। আল্লাহ তাআলা তাকে সুযোগ দিলেন। আবহমানকাল থেকে শুরু হওয়া সংঘাতের এই রেশ চূড়ান্ত ফয়সালা হওয়া পর্যন্ত চলমান থাকবে। ইবলীস মানুষ ও জিন থেকে অধিকাংশকেই নিজ দলে ভিড়াতে সক্ষম হয়েছেন। তার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে কিছু মানুষ তো মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে শেষ নবী ও রাসূল হিসেবে মানতে নারাজ। শুধু এতটুকু করেই ক্ষান্ত হয়নি; মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসারীদের নির্যাতন, জ্বালাও-পোড়াও করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ইসলামের অনুসারীদের উত্তপ্ত রাখতে পারলে তারা পুলকিত হয়, স্বস্তিবোধ করে। যেহেতু হক্ব-বাতিলের দ্বন্দ্ব আবহমানকাল থেকে চলমান, সেহেতু পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহ হবে এটাই স্বাভাবিক।

ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে বর্তমান অবধি কত যুদ্ধ যে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আল্লাহ তাআলা জানেন এর সঠিক সংখ্যা। এই যুদ্ধবিগ্রহে কত সুরম্য, তিলোত্তমা নগরী পরিণত হয়েছে বিরাণভূমিতে, কত জাঁকজমকপূর্ণ জনপদ পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে, কত কোলাহলপূর্ণ বসতি পরিণত হয়েছে জনমানবহীন শূন্য মরুভূমিতে, কত নারী বিধবা হয়েছে, কত শিশু হয়েছে ইয়াতীম, কত মা হয়েছে সন্তানহারা, কত বীরপুরুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে কত যুবক, হারিয়েছে কত নারী সতীত্ব সম্ভ্রম! ইতিহাসের বইগুলো পড়লে মানবআর্তনাদ আজও কর্ণকুহরে ভেসে আসে। সাদা পৃষ্ঠার উপর কালো কালির অঙ্কিত হাহাকারগুলো মানসপটে দুঃখ-বেদনার উদ্রেক সৃষ্টি করে। আল্লাহ তাআলা যথার্থই বলেছেন,﴿إِنَّ الْمُلُوكَ إِذَا دَخَلُوا قَرْيَةً أَفْسَدُوهَا وَجَعَلُوا أَعِزَّةَ أَهْلِهَا أَذِلَّةً وَكَذَلِكَ يَفْعَلُونَ﴾ ‘রাজা-বাদশাগণ যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে, তখন তো সেটাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার মর্যাদাবান ব্যক্তিদেরকে অপদস্ত করে; আর এরূপ করাই তাদের রীতি’ (আন-নামল, ২৭/৩৪)

মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবের পূর্বে এই সংঘাত পরিলক্ষিত হতো ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের মাঝে। তার প্রয়াণের পর নানামুখী আগ্রাসন এসে পড়ে তার অনুসারীদের ওপর। আর একটা চিরন্তন সত্য কথা হলো যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হলে মানুষ মারা যাবে, পঙ্গু হবে অথবা বন্দি হবে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কাফেরদের সাথে যুদ্ধবিগ্রহে ওরা আমাদেরকে বন্দী করে নিয়ে যাবে, আর আমরা কি আঙ্গুল চুষবো?

বিজয়ী সৈন্যদল বিজিত অঞ্চলে কেমন আচরণ করে তা সকলের নিকট বোধগম্য। ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্রুসেড যুদ্ধে খ্রিষ্টানরা বায়তুল মাক্বদিস জয় করে তথাকার অধিবাসী মুসলিমদের সাথে কীরূপ আচরণ করেছে তা মোটা দাগে ইতিহাসের পাতায় পাতায় টইটম্বুর। ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে হালাকু খান তদানীন্তন মুসলিম জাহানের রাজধানী বাগদাদ নগরী দখল করে সেখানে কী তাণ্ডব চালিয়েছে প্রায় হাজার বছর পর ইতিহাস পড়ে আমাদের গায়ের লোম শিউরে উঠে। আলেম, পণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞ আবালবৃদ্ধবনিতা সকলকে কচুকাটা করেছে। খলীফা মু‘তাছিম বিল্লার দু’কন্যাকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে। অনেক নারীকে বন্দি করে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে। স্বপ্নপুরী খ্যাত বাগদাদের বায়তুল হিকমা লাইব্রেরি জ্বালিয়ে দিয়েছে। মুসলিমদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে দজলা নদী। নারীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করার পর হত্যা করেছে। নারীরা পরিণত হয়েছিল তাদের ক্রীড়ানকে। কালের পালাবদলে এই জনপদ আবার যখন মুসলিম সেনানীরা উদ্ধার করে, তখন তারা কেমন আচরণ করেছিল অমুসলিমদের সাথে ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের কাছে তা সমাদৃত। আশ্চর্য হতে হবে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সমরনীতি দেখে। যুদ্ধে তিনি নারী, শিশু, বৃদ্ধ, ধর্মযাজক, অসামরিক লোকদের হত্যা করতে নিষেধ করেন এবং আরো নিষেধ করেন গাছপালা ঘরবাড়ি বিরান করতে।[1] এতো উদার কোনো জাতিই নেই। অথচ আজ মুসলিমদের উপর অপবাদ আরোপ করা হচ্ছে, ‘কেন ইসলামে দাস-দাসীর প্রথা বিলুপ্ত করা হয়নি’। আগেও বলা হয়েছে ক্বিয়ামত অবধি যুদ্ধবিগ্রহ হবে আর যুদ্ধ হলে নারী-পুরুষ দাস-দাসী হবেই। কারণ সংগ্রামে রত দু’পক্ষের একপক্ষ বিজয়ী হবেই। ইসলামের পরিকল্পনা এতো সুনিপুণ স্বচ্ছ, তথাপিও কিছু মানুষ থাকবে একগুঁয়ে বক্র প্রকৃতির। সবকিছু তাদের কাছে প্রস্ফুটিত হওয়া সত্ত্বেও গোস্বার আঙুল তুলবে ইসলামের প্রতি। ইসলাম বলে যুদ্ধবন্দিদের সাথে দুরাচরণ করা যাবে না, অনাহারে রাখা যাবে না, তাদের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যাবে না। একজন বন্দি নারীকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া শ্রেয়, না-কি তাকে এমনিতেই রেখে দিয়ে প্রয়োজনের সময় শুধু মেলামেশা করা শ্রেয়? নিঃসন্দেহে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে রাখা শ্রেয়। অমুসলিমরা ইতিবাচক দিক নিয়ে গেছে নেতিবাচক দিকে। এর কারণ হলো জিহাদ থেকে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা।

নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কয়েকজন স্ত্রী ছিলেন বন্দিদাসী। তিনি তাদের সম্ভ্রম নষ্ট করেননি; তাদের মুক্ত করে বৈধ পন্থায় বিয়ে করে জীবনযাপন করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীগণ ছিলেন শত্রুপক্ষের লোক। সাধারণত যাদের থেকে ক্ষতির শঙ্কা করা হয়। জীবনে কখনো তারা নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে শত্রুতা করা তো দূরের কথা, একটা কাঁটা তার পায়ে ফুটুক এটা তারা সহ্য করতে পারতেন না। সুবহানাল্লাহ! রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুপম আচরণে তারা কতটা বিমোহিত ছিলেন। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্যতম স্ত্রী ছফিয়্যা রযিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন ইয়াহূদী বংশোদ্ভূত। যুদ্ধে তার পিতা, চাচা ও আত্মীয়স্বজন, এমনকি প্রাণস্পন্দন স্বামী নিহত হয়েছে। তথাপি তিনি একদিনও নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রতিশোধ নিতে উদ্যোগী হননি। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দাসীদের স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে অবহেলায় অগুরুত্বের সাথে রেখে দেননি। প্রত্যেকদিন আছরের পর তাদের খোঁজখবর নিতেন, শত ব্যস্ততার মধ্যে তাদের সাথে খোশগল্প করতেন, আদর করে চুমু দিতেন, সান্ত্বনার আলপনা বুলিয়ে দিতেন তাদের মাথায়। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অতীত স্মৃতি ভুলে যান তারা। একদিনের জন্য তাদের তনুমনে চিন্তার উদ্রেক হয়নি তিনি আমাদের চিরশত্রু।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পালক পুত্র ছিলেন যায়েদ ইবনু হারেছা। তিনি তাকে মুক্ত করে নিজ সন্তানের মতো দেখেন। মদীনার মানুষরা ঈর্ষা করত তাকে নিয়ে। হায়! আমরা যদি যায়েদের মতো হতাম। আমরা যদি কাছ থেকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্নিগ্ধ ভালোবাসা পেতাম। যায়েদ রযিয়াল্লাহু আনহু-কে নেওয়ার জন্য তার পিতা-মাতা এসেছিল। কিন্তু তিনি সাফ ‘না’ বলে দেন। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালোবাসা ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। কত পাগল ছিলেন একজন দাস নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য! কতটা ভালোবাসা পেয়েছেন তার কাছ থেকে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রাণপাখি চলে যাওয়া পর্যন্ত তিনি তার সাথে ছিলেন। আকণ্ঠ মহব্বত করতেন তাকে। আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর দাসী ছিলেন বারীরাহ। তিনি বারীরাহকে আযাদ করে দেন। সদাচরণ করেন সদা তার সাথে; এমন কি পূর্বের স্বামীর সাথে থাকার ব্যাপারে তাকে স্বাধীনতাও দান করেন। এই হলো দাস-দাসীর সাথে ইসলামের নীতি। এই নীতি ভালো, না-কি তাদের একঘরে করে অন্ধকার কুঠুরিতে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা ভালো? তারা তো মুসলিমদের ভুল ধরার জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে।

বুঝা গেল যে, যুদ্ধবিগ্ৰহ হবে বিধায় আল্লাহ তাআলা দাস-দাসীর প্রথা বিলুপ্ত করেননি। আর এটা আল্লাহর জ্ঞানে রয়েছে। ইসলাম যেমন দাস-দাসীর প্রথা বিলুপ্ত করেনি; অনুরূপভাবে সমাজে যেন দাস-দাসী না থাকে এজন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্ৰহণ করেছে। ইসলাম কত সুন্দর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে! যেমন- যাকাতের ক্ষেত্রে একটি অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে দাস-দাসী মুক্ত করার জন্য। আল্লাহ বলেন,﴿إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِي﴾ ‘যাকাত তো শুধু ফক্বীর, মিসকীন ও যাকাত আদায়ের কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের জন্য, যাদের (অমুসলিমদের) অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তিতে, ঋণগ্ৰস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য’ (আত-তাওবা, ৯/৬০)

বান্দা কোনো পাপ কাজে জড়িয়ে পড়লে তার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে দাস-দাসী মুক্ত করতে বলা হয়েছে। কোনো স্বামী স্ত্রীকে স্বীয় মায়ের সাথে তুলনা করলে তার কাফফারা বা প্রায়শ্চিত্তে বলা হয়েছে দাস-দাসী মুক্ত করতে। আল্লাহ বলেন,﴿وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنْ نِسَائِهِمْ ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَتَمَاسَّا﴾ ‘যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে যিহার (স্ত্রীকে মায়ের সাথে সাদৃশ্য দেয়) করে, পরে তাদের উক্তি প্রত্যাহার করে, তবে একে অন্যকে স্পর্শ (সহবাস) করার আগে একটি দাস মুক্ত করতে হবে’ (আল-মুজাদালাহ, ৫৮/৩)

কসম করে ভঙ্গ করলে কাফফারা হিসেবে দাস মুক্ত করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,﴿فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ﴾ ‘শপথ ভঙ্গের কাফফারা হলো ১০ জন মিসকীনকে মধ্যম ধরনের খাবার দেওয়া অথবা কাপড় দেওয়া কিংবা একজন দাস মুক্ত করা অথবা তিনটি ছিয়াম পালন করা’ (আল-মায়েদা, ৫/৮৯)

রামাযান মাসে দিনের বেলা ছিয়াম রেখে স্ত্রীর সাথে সহবাস করলে এর প্রায়শ্চিত্তে বলা হয়েছে দাস মুক্ত করতে।[2]

ভুলক্রমে কোনো মুমিনকে হত্যা করে ফেললে এর বদলা হিসেবে দাসমুক্ত করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,﴿وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَنْ يَقْتُلَ مُؤْمِنًا إِلَّا خَطَأً وَمَنْ قَتَلَ مُؤْمِنًا خَطَأً فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ﴾ ‘কোনো মুমিনের জন্য সমীচীন নয় কোনো মুমিনকে হত্যা করা। যদি কেউ ভুল করে হত্যা করে ফেলে তাহলে একটি মুমিন দাসী মুক্ত করতে হবে’ (আন-নিসা, ৪/৯২)

দাস-দাসী মুক্তকরণে ইসলাম উৎসাহ-উদ্দীপনাব্যঞ্জক অনেক বাক্য উচ্চারণ করেছে; এমনকি অন্ধকারাচ্ছন্ন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এর মাধ্যমে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُؤْمِنَةً أَعْتَقَ اللَّهُ مِنْهُ بِكُلِّ عُضْوٍ مِنْهُ عُضْوًا مِنَ النَّارِ حَتَّى يُعْتِقَ فَرْجَهُ بِفَرْجِهِ ‘যদি কেউ কোনো মুমিন গোলাম মুক্ত করে, তবে আল্লাহ তাআলা তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিনিময়ে তার (আযাদকারীর) প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে জাহান্নামের আগুন হতে মুক্ত করে দেন। এমনকি তার লজ্জাস্থানের বিনিময়ে আযাদকারীর লজ্জাস্থানকে মুক্ত করেন’।[3]

দাসীকে অবজ্ঞা করে অবহেলায় অবরুদ্ধ করে রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের সাথে সর্বোত্তম আচরণ করার, লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়ার এবং অমায়িক শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার কথা বলছে ইসলাম। কেউ যদি দাসীকে শিক্ষা দেওয়ার পর বিয়ে করে, তাহলে তার জন্য ডাবল প্রতিদান রয়েছে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,ثَلَاثَةٌ يُؤْتَوْنَ أَجْرَهُمْ مَرَّتَيْنِ الرَّجُلُ تَكُونُ لَهُ الْأَمَةُ، فَيُعَلِّمُهَا فَيُحْسِنُ تَعْلِيمَهَا، وَيُؤَدِّبُهَا فَيُحْسِنُ أَدَبَهَا، ثُمَّ يُعْتِقُهَا فَيَتَزَوَّجُهَا، فَلَهُ أَجْرَانِ ‘তিন প্রকার লোককে দ্বিগুণ নেকী দান করা হবে। এর মধ্যে এক প্রকার হলো এমন ব্যক্তি, যে ব্যক্তির একটি দাসী আছে, সে তাকে উত্তমরূপে শিক্ষাদান করে, উত্তমরূপে শিষ্টাচার শিক্ষাদান করে। অতঃপর তাকে মুক্ত করে দিয়ে বিয়ে করে, সে ব্যক্তির জন্য দ্বিগুণ নেকী রয়েছে’।[4]

তাছাড়া বিভিন্ন ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে ঠুনকো কারণে মানুষকে দাস-দাসীতে পরিণত করা হতো বা কোথাও কোথাও এখনও হয়। কিন্তু ইসলাম এতোসব অত্যাচার বন্ধ করে দাস-দাসী বানানোর কেবলমাত্র একটি রাস্তা খোলা রেখেছে। আর হচ্ছে, জিহাদ। যেহেতু জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।

ইসলামের নবী তো আমরণ দাস-দাসীর কথা বলেছেন। তিনি তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে, ধমক দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করতেন। তার মৃত্যু যখন ঘনিয়ে এলো, তখনও তিনি তাদের সাথে উত্তম আচরণের অছিয়ত করেন। হাদীছে এসেছে,كَانَ آخِرُ كَلَامِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّلَاةَ الصَّلَاةَ اتَّقُوا اللَّهَ فِيمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শেষ উপদেশ ছিল ছালাত সম্পাদন করো, ছালাত সম্পাদন করো এবং দাস-দাসীদের সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করা’।[5]

আমাদের সমাজে আমরা শুধু অপরকেই উপদেশ দেই। কিন্তু নিজের মাঝে ওই গুণ ঘুণাক্ষরেও নেই। আমরা শুধু চাপার জোরে আলোচনা করে যাই, আমলের বেলায় ঠনঠন। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে আমল করে গেছেন। তিনি ছাহাবীগণকে দাস-দাসীদের সাথে উত্তম আচরণ করতে বলেছেন এবং নিজে আগে আমল করে দেখিয়েছেন।

নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতো এমন মহৎ আদর্শবান ব্যক্তি ক্বিয়ামত অবধি আর আসবে না। মানুষের প্রতি তাঁর দরদ ছিল অসাধারণ। মাঝে মাঝে চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু প্রবাহিত হয়! আমরা আমাদের অধীনস্থ কাজের লোককে বিভিন্ন কটু কথা বলে সম্বোধন করি। আয়া, বুয়া, বুড়ি, কাজের লোক আরো কত কী। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ব্যাপারে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করেছেন। আল্লাহু আকবার!

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন আমার ‘আব্‌দ ও আমাত তথা আমার দাস, আমার দাসী’ না বলে। কারণ তোমাদের সকল পুরুষই আল্লাহর বান্দা এবং তোমাদের সকল নারীই আল্লাহর বান্দী। সুতরাং বলবে, গোলামী, ওয়া জারিয়াতী, ওয়া ফাতায়া, ওয়া ফাতাতী’ অর্থাৎ আমার সেবক, আমার সেবিকা’।[6]

অনেক সময় নামিদামি রেস্তোরাঁয় আমরা খেতে যাই। সাথে নিয়ে যাই অবহেলিত সেই কাজের বুয়াকে। হ্যাঁ, আমরা কাজের বুয়াই বলি। তাকে নিয়ে যাই আমাদের সাথে ভোজনে অংশগ্রহণ করার জন্য, তাই না? তাকে তো নিয়ে যাই আমাদের বাচ্চা কোলে করে রাখার জন্য। একটি বারের জন্য বলি না তুমিও আমাদের সাথে বসো। হ্যাঁ, তবে কিছু মানুষ আছে এমন, যারা কাজের লোককে সাথে নিয়ে আহার করে। তবে এদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। আলিশান বড় বড় শপিং মলগুলোতে আমরা যাই। নিজেদের জন্য হরেকরকম বস্ত্র ক্রয় করি। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে সেই বুয়া। তার হিয়া বারবার বলতে চায় আমাকেও একটা কিনে দিন; কিন্তু চোখ লজ্জায়, অপমানের ভয়ে তারা শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। মুখ ফসকে একবারও বলে না। আর আমরাও কেমন হতচ্ছাড়া একবারও তাকে জিজ্ঞেস করি না, ‘তোমার কিছু লাগবে নাকি?’ নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত সুন্দর কথা বলেছেন, ‘আল্লাহ দাস-দাসীদের তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তা খাওয়াবে এবং তোমরা যেমন পোশাক পরবে তাদেরকেও তা পরাবে। তোমরা তাদের উপর এমন কোনো কাজের ভার চাপিয়ে দিবে না, যা করতে তারা হিমশিম খেয়ে যায়। যদি তোমরা তাদেরকে অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দাও, তাহলে এ কাজে তাদের সাহায্যও করো’।[7] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো দাস-দাসী যদি তোমাদের খাদ্য পাকায়, যেহেতু খাবারের ঘ্রাণ তার নাকে ঢুকেছে, সেহেতু তাকে নিয়ে খাবে। এটা না পারলে এক লোকমা তার হাতে দিবে’।[8]

কিছুদিন আগে একটি পত্রিকায় পড়লাম। একজন খেলোয়ার তার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে কাজের লোককে বেদম প্রহার করেছে। প্রহারের আঘাতে পিঠে কালো রেখা হয়ে গেছে। আমরা নিজেরদের সভ্য, অভিজাত দাবি করি, সুশীল সমাজ আমাদের বাহবা দেয়; কিন্তু আমাদের আচরণ পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। একটি পশুও বিনা কারণে অন্য পশুর উপর আঘাত হানে না। আমাদের ভেতরের হিংস্রতার প্রভাব ফুটে ওঠে আমাদের ক্রিয়াকলাপে। আমরা বুঝতেও পারি না। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখনিঃসৃত বাণী কত চমৎকার শ্রুতিমধুর, مَنْ لَطَمَ مَمْلُوكَهُ أَوْ ضَرَبَهُ فَكَفَّارَتُهُ أَنْ يُعْتِقَهُ ‘যে ব্যক্তি তার ক্রীতদাসকে চড় মারবে বা মারধর করবে, এর কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) হলো তাকে মুক্ত করে দেওয়া’।[9]

ইসলামের নবী বলেছেন, কেউ যদি তার দাসকে মুখ ফসকে বলে ফেলে, ‘তুমি মুক্ত’ তাহলে ওই দাসমুক্ত হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তির ওযর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ মুক্ত জীবন কত যে আনন্দময়, কত যে তৃপ্তিদায়ক তা বলে বুঝানো যাবে না! যখন দাস তার মনিব থেকে মুক্ত করে দেওয়ার সংবাদ শুনবে, তখন সে মনে করবে তার মনিব সত্যি সত্যি একথা বলেছে। তার যেন মনঃক্ষুণ্ণ না হয় এজন্য ইসলাম বলছে, সে মুক্ত।

আমরা শুধু ইসলামের সমালোচনা নিয়ে পড়ে থাকি; ইসলামের ভালো দিকগুলো গ্রহণ করি না! আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!

সাঈদুর রহমান

 শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।


[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৪৪।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৩৭।

[3]. তিরমিযী, হা/১৫৪১, হাদীছ ছহীহ।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০১১।

[5]. আবূ দাঊদ, হা/৫১৫৬, হাদীছ ছহীহ।

[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৭৬৭।

[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪২০৫।

[8]. মুসনাদ আহমাদ, হা/৯২৫৮, হাদীছ ছহীহ।

[9]. আবূ দাঊদ, হা/৫১৬৮, হাদীছ ছহীহ।

Magazine