ভূমিকা :
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন বিজ্ঞানের কোনো গ্রন্থ নয়। এটি মূলত ইলাহী বিধান; মানুষের হেদায়াতের জন্য সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ হিসেবে আল্লাহ তাআলা সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এর উপর অবতীর্ণ করেন। এখানে বিজ্ঞান নির্দেশক ৭৫০টি আয়াত মানুষের আবিষ্কার ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের প্রেক্ষাপটে মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের প্রকাশ ঘটিয়ে অদৃশ্য মহান শক্তিধর আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার আলোচনার মাঝে এখানে প্রাণিবিজ্ঞানও স্থান পেয়েছে। প্রাণিবিজ্ঞান আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা, যাকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞানের কথা কল্পনাও করা যায় না। মানুষ, পশু-পাখি, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি প্রাণিবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত আলোচ্য বিষয়। পবিত্র কুরআনে এসব প্রাণি সৃষ্টির উদ্দেশ্য, তাদের পঠন প্রণালি, তাদের উপকারিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাই বলা যায়, প্রাণিজ্ঞানের অন্যতম উৎস আল-কুরআন।
আল-কুরআনে প্রাণিবিজ্ঞান : মহাগ্রন্থ আল-কুরআন গবেষণার জন্য প্রাণিবিজ্ঞানের যেসব বিষয় বর্ণনা করেছে, তা নিম্নে বর্ণনা করা হলো :
১. বিচিত্র প্রাণির বর্ণনা
পবিত্র কুরআনে বিচিত্র সব প্রাণির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যাদের জীবনাচারও ভিন্ন ভিন্ন। এসব প্রাণির বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন স্থাপন করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَاللَّهُ خَلَقَ كُلَّ دَابَّةٍ مِن مَّاء فَمِنْهُم مَّن يَمْشِي عَلَى بَطْنِهِ وَمِنْهُم مَّن يَمْشِي عَلَى رِجْلَيْنِ وَمِنْهُم مَّن يَمْشِي عَلَى أَرْبَعٍ يَخْلُقُ اللَّهُ مَا يَشَاء إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾ ‘আল্লাহ সমস্ত জীব সৃষ্টি করেছেন পানি হতে, তাদের মধ্যে কিছু পেটে ভর দিয়ে চলে, কিছু চলে দু’পায়ে আর কতিপয় চলে চার পায়ে ভর দিয়ে, আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (আন-নূর, ২৪/৪৫)।
২. সমাজভুক্ত প্রাণির বর্ণনা
প্রাণিজগতে এমন সব প্রাণির অস্তিত্ব রয়েছে, যারা মানুষের ন্যায় সমাজভুক্ত হয়ে দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। শেখ সি বৌবাকিয়ার হামজা তার কুরআনের তরজমা ভাষ্যে বলেছেন, আসমানী জ্ঞানে সৃষ্ট অনুভূতির ফলে সব প্রাণি সমাজবদ্ধ হয় এবং দাবি করে যে, প্রত্যেক সদস্যের কাজ সমগ্র শ্রেণির স্বার্থে পরিচালিত হবে। এ প্রকার প্রাণির বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন,﴿وَمَا مِن دَآبَّةٍ فِي الأَرْضِ وَلاَ طَائِرٍ يَطِيرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلاَّ أُمَمٌ أَمْثَالُكُم مَّا فَرَّطْنَا فِي الكِتَابِ مِن شَيْءٍ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ يُحْشَرُونَ﴾ ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল এমন জীব নেই অথবা নিজ ডানার সাহায্যে এমন কোনো পাখি উড়ে না, যা তোমাদের মতো এক একটি সমাজ নয়। গ্রন্থে কোনো কিছু লিপিবদ্ধ করতে আমি ত্রুটি করিনি। অতঃপর তাদের সকলকে তাদের প্রতিপালকের কাছে সমবেত করা হবে’ (আল-আন‘আম, ৬/৩৮)।
৩. মৌমাছির জীবনধারা বর্ণনা
পরিত্র কুরআনে মৌমাছির জীবনধারা সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,﴿وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ - ثُمَّ كُلِي مِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلاً يَخْرُجُ مِن بُطُونِهَا شَرَابٌ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاء لِلنَّاسِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ﴾ ‘তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে তার অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছেন, গৃহ নির্মাণ করো পাহাড়ে, বৃক্ষে ও মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে। তারপর প্রত্যেক ফল হতে কিছু কিছু আহার করো, অতঃপর তোমার প্রতিপালক তোমার জন্য যে পদ্ধতি সহজ করেছেন, তার অনুসরণ করো। তার উদর হতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয়। এটাতে মানুষের জন্য আছে ব্যাধির প্রতিকার। অবশ্যই এতে রয়েছে নিদর্শন চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য’ (আন-নাহল, ১৬/৬৮-৬৯)।
মহান আল্লাহ এ সম্পর্কের চিন্তার বিষয় সন্নিবেশ করেছেন। মৌমাছির আচরণ সম্পর্কে এযাবৎ যে তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে, তার ভিত্তিতে শুধু এতটুকুই বলা যেতে পারে যে, তাদের সব আচরণ তাদের স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মৌমাছির নাচ অপর মৌমাছির সম্পর্কে যোগযোগের এটি উপায়। কতদূরে কোন দিকে অবস্থিত ফুল হতে মধু সংগ্রহ করা যেতে পারে, এভাবে তা তারা একে অপরকে জানিয়ে থাকে। তাদের দেহভঙ্গি দ্বারা কর্মী মৌমাছিদের মধ্যে সংবাদ বিনিময় করে থাকে বলে বিজ্ঞানী ফ্রিশের গবেষণায় সাব্যস্ত হয়েছে।
৪. মাকড়সা সম্পর্কে বর্ণনা
মাকড়সার ঘরে অস্থায়ী অবস্থা বিশেষভাবে দেখানোর জন্যই পবিত্র কুরআনে এ প্রাণির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। মাকড়সার ঘর তাদের ঘরের মতোই মজবুত, যারা দয়ালু আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে মনিব হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ প্রাণির জাল বুননের মধ্যে চিন্তাশীলদের জন্য গবেষণার সম্ভার রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,﴿مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ أَوْلِيَاء كَمَثَلِ الْعَنكَبُوتِ اتَّخَذَتْ بَيْتًا وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنكَبُوتِ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ﴾ ‘যারা আল্লাহর পরিবর্তে অপরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তাদের দৃষ্টান্ত মাকড়সা, সে নিজের জন্য ঘর বানায় এবং ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো দুর্বলতম যদি তারা জানত’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৪১)।
মাকড়সার জাল এতই দুর্বল ও ক্ষণভঙ্গুর যে, মানুষের পক্ষে এমন কিছু প্রস্তুত করা আদৌ সম্ভব নয়। এ জালের বিস্ময়কর ও অসাধারণ কারুকার্য দেখে প্রকৃতি বিজ্ঞানীগণ হতবাক হয়ে গেছেন। মাকড়সার স্নায়ুবিক কোষের অবস্থান বৈচিত্র্যের কারণেই জ্যামিতিকভাবে নিখুঁত অমন বুননকার্য হয়ে থাকে।
৫. পাখিদের জীবনধারা
পাখিদের চলাচল, উড্ডীয়মান ও জীবনধারার মধ্যে মহান আল্লাহ চিন্তাশীলদের জন্য গবেষণার খোরাক নিহিত রেখেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,﴿أَلَمْ يَرَوْاْ إِلَى الطَّيْرِ مُسَخَّرَاتٍ فِي جَوِّ السَّمَاء مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلاَّ اللّهُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾ ‘তারা কি লক্ষ করে না বিহঙ্গের প্রতি, যে আকাশের শূন্যগর্ভে সহজে বিচরণ করে? আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সেখানে স্থির রাখেন। মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে’ (আন-নাহল, ১৬/৭৯)।
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত মহান আল্লাহর হুকুমের ওপর পাখিদের নির্ভরতার সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্যের মিল রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কতিপয় প্রজাতির পাখি তাদের চলাফেরার পথের ব্যাপারে একটি নির্ধারিত ধারা অনুসরণ করে থাকে। এসব পাখি ও তাদের অভিজ্ঞ বাচ্চাগুলোর দীর্ঘ ও জটিল পথ সহজেই নিভুর্লভাবে অতিক্রম করে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট তারিখে আবার তাদের যাত্রাস্থলে ফিরে আসে। ফলে এ সত্যই প্রমাণিত হয়ে যায় যে, তাদের দেহের স্নায়ুতন্ত্রেই এ সফরের কর্মসূচি পূর্বনির্ধারিত অবস্থায় স্থাপিত আছে। অধ্যাপক হ্যাম বার্জার প্রশান্ত মহাসাগরীয় কতিপয় পাখির ওপর গ্রবষণা করে এ তথ্য প্রমাণ করেছেন।
৬. পিঁপড়াদের জীবনাচার : পিঁপড়ারা অতীব পরিশ্রমী প্রাণি
পিঁপড়াদের রয়েছে সামাজিক জীবনাচার। তারা একজন নেতার নেতৃত্বে দলবদ্ধভাবে বসবাস করে, পরস্পর ভাব বিনিময় করে এবং নেতার আনুগত্য করে। পিঁপড়াদের জীবনাচারের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,﴿حَتَّى إِذَا أَتَوْا عَلَى وَادِي النَّمْلِ قَالَتْ نَمْلَةٌ يَا أَيُّهَا النَّمْلُ ادْخُلُوا مَسَاكِنَكُمْ لَا يَحْطِمَنَّكُمْ سُلَيْمَانُ وَجُنُودُهُ وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ﴾ ‘অতঃপর যখন তার পিঁপড়াদের উপত্যকায় পৌঁছান, তখন এক পিঁপড়া বলল যে, পিঁপড়া সম্প্রদায়! তোমরা নিজ নিজ গর্তে ঢুকে যাও, যেন সুলায়মান ও তার বাহিনী তোমাদেরকে অজ্ঞাতসারে পায়ের নিচে দলিত-মথিত না করে’ (আন-নামল, ২৭/১৮)।
৭. উটের বর্ণনা
উটের শারীরিক গঠন, শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ, পানি পান, খাদ্য গ্রহণ, তার পথচলা অন্যান্য প্রাণির চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। উট মরুভূমিতে কয়েকদিন পানাহার না করেও বাঁচতে পারে। উচু মরুভূমির বালি ঝড়ের সময় বালিতে নাক-মুখ ডুবিয়ে রেখে শ্বাস গ্রহণ ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে। একাধারে দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতাও উটের রয়েছে। এজন্য উটকে মরুভূমির জাহাজ বলা হয়। তাই উটের বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ﴿أَفَلَا يَنظُرُونَ إِلَى الْإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ﴾ ‘তারা কি উটের প্রতি লক্ষ্য করে না, কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?’ (আল-গাশিয়া, ৮৮/১৭)। এ আয়াতে উট সম্পর্কে চিন্তাশীল লোকদের গবেষণার বিষয় নিহিত রয়েছে।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাণি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের সব তথ্য-উপাত্ত পবিত্র কুরআনের আলোকেই নির্ণীত হয়েছে। মহান আল্লাহ প্রাণিজগতের মধ্যে চিন্তাশীল লোকদের গবেষণার জন্য অনেক নিদর্শন নিহিত রেখেছেন এবং বিভিন্ন প্রাণির বর্ণনা দিয়ে সেদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দয়াময় আল্লাহর অসীম কুদরতের বহিঃপ্রকাশ বিজ্ঞানের এই সব আলোচনা। যাতে মানুষ একত্বের চেতনায় নিজেকে স্রষ্টার সান্নিধ্যে নিতে পারে। ইহ ও পরলৌকিক জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। আর এজন্য মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে প্রাণিবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ড. মোহাম্মদ হেদায়াত উল্লাহ
বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ; সহকারী অধ্যাপক,
আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, কুমিল্লা।