কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসলামে মুরদান (দাড়িবিহীন কিশোর-যুবক) সম্পর্কিত বিধিবিধান (পর্ব-৫)

post title will place here

মুরদানের প্রতি আসক্তির কারণ:

আসলে কারণ ছাড়া কোনো কিছুই ঘটে না। সব ঘটনার পেছনে কোনো না কোনো কারণ বিদ্যমান। মুরদানের প্রতি আসক্তির পেছনেও রয়েছে অনেক কারণ। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ উপস্থাপিত হলো—

(১) ঈমানের দুর্বলতা ওঅন্তর থেকে আল্লাহর ভালোবাসা দূরে সরে যাওয়া এবং তাঁর শাস্তির ভয় কমে যাওয়া: এটি যাবতীয় পাপের মূল কারণ। দুর্বল ঈমান, আল্লাহ তাআলা থেকে হৃদয়ের দূরত্ব, তাঁর প্রতি অনুরাগ ও সান্নিধ্যের অভাব একজন মানুষকে যেকোনো পাপে নিপতিত করতে পারে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لَا يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَسْرِقُ السَّارِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ ‘কোনো যেনাকার যখন যেনা করে, তখন সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন থাকে না। কোনো চোর যখন চুরি করে, তখন সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন থাকে না এবং কোনা মদপানকারী যখন মদ পান করে, তখন সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন থাকে না’।[1]

(২) দাড়িবিহীন যুবকদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া এবং তাদের সৌন্দর্য ও আকর্ষণে আসক্ত হওয়া: মূলত এটিই পাপের প্রথম ধাপ। সেজন্যই তো মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারামের দিক থেকে দৃষ্টি অবনত রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।[2] ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহবলেছেন,

وَالنَّظَرُ أَصْلُ عَامَّةِ الْحَوَادِثِ الَّتِي تُصِيبُ الْإِنْسَانَ، فَالنَّظْرَةُ تُوَلِّدُ خَطْرَةً، ثُمَّ تُوَلِّدُ الْخَطْرَةُ فِكْرَةً، ثُمَّ تُوَلِّدُ الْفِكْرَةُ شَهْوَةً، ثُمَّ تُوَلِّدُ الشَّهْوَةُ إِرَادَةً، ثُمَّ تَقْوَى فَتَصِيرُ عَزِيمَةً جَازِمَةً، فَيَقَعُ الْفِعْلُ وَلَا بُدَّ، مَا لَمْ يَمْنَعْ مِنْهُ مَانِعٌ، وَفِي هَذَا قِيلَ: الصَّبْرُ عَلَى غَضِّ الْبَصَرِ أَيْسَرُ مِنَ الصَّبْرِ عَلَى أَلَمِ مَا بَعْدَهُ.

‘মানুষকে যে বিপদগুলো ঘিরে ধরে, তার বেশিরভাগের ক্ষেত্রে মূল কারণই হচ্ছে দৃষ্টি। দৃষ্টি চিন্তার জন্ম দেয়, চিন্তা কল্পনার জন্ম দেয়, কল্পনা কামনার জন্ম দেয়, কামনা থেকে আসে ইচ্ছা, ইচ্ছা প্রবল হয়ে তা বাস্তবায়িত হয়—যদি না কোনো বাধা তাকে থামিয়ে দেয়। এজন্যই বলা হয়: চোখ নামিয়ে রাখার ধৈর্যপরবর্তীতে যে কষ্ট আসতে পারে তা সহ্য করার চেয়েও সহজ’[3]

() ফরয ও নফল ইবাদতে গাফিলতি: ইবাদতে গাফিলতি বা উদাসীনতা একজন মানুষকে যেকোনো পাপে নিমজ্জিত করতে পারে। সেজন্য যদি মুরদানের প্রতি আসক্ত ব্যক্তি ছালাতগুলো যথা সময়ে ও যথা নিয়মে আদায় করত, তাহলে সেগুলোই তাকে অশ্লীলতা ও অন্যায় থেকে বিরত রাখত। মহান আল্লাহ যথার্থই বলেছেন, إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ নিশ্চয়ই ছালাত অশ্লীলতা ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে’(আল-আনকাবূত, ২৯/৪৫)। তাহলে ভাবুন, যদি কেউ নিয়মিত সুন্নাত ও নফল ছালাতের প্রতি যত্নবান হয়, তাহলে তার ফল কত মিষ্টি হতে পারে!

(৪) কুরআন মাজীদ ত্যাগ করা এবং সৎলোকদের জীবনচরিত ও বড় আলেমদের জীবনী পড়া পরিত্যাগ করা: আল্লাহর কিতাবে রয়েছে হেদায়াত, আলো এবং আরোগ্য। তাই এটা পাপ থেকে বাঁচার শ্রেষ্ঠ প্রতিরক্ষা; আর যারা পাপে লিপ্ত, তাদের জন্য শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা। ফলে যখন কেউ বড় আলেমদের জীবনচরিত পড়ে, তখন তাদেরকে আদর্শ মনে করে, তাদের সান্নিধ্যে মানসিক শান্তি লাভ করে এবং নীচতা থেকে নিজেকে তুলে আনতে সচেষ্ট হয়। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآيَاتِ رَبِّهِ فَأَعْرَضَ عَنْهَا وَنَسِيَ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ إِنَّا جَعَلْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ أَكِنَّةً أَنْ يَفْقَهُوهُ وَفِي آذَانِهِمْ وَقْرًا وَإِنْ تَدْعُهُمْ إِلَى الْهُدَى فَلَنْ يَهْتَدُوا إِذًا أَبَدًا ‘তার চেয়ে বেশি যালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার প্রভুর আয়াতসমূহ দ্বারা উপদেশ দেওয়া হয়েছে, অথচ সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং যা (পাপ) তার দুই হাত আগেই করে রেখেছে, সে তা ভুলে গেছে! নিশ্চয়ই আমি তাদের হৃদয়সমূহের উপর পর্দা দিয়ে দিয়েছি, যাতে তারা তা বুঝতে না পারে। আর তাদের কানসমূহে রয়েছে বধিরতা এবং আপনি যদি তাদেরকে হেদায়াতের দিকে আহ্বান করেন, তবুও তারা কখনই হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে না’ (আল-কাহ্‌ফ, ১৮/৫৭)

(৫) জ্ঞানার্জনে গাফেলতি: জ্ঞান হলো আলো। এর মাধ্যমে কেউ হালাল সম্পর্কে জেনে তা বাস্তবায়ন করতে পারে এবং হারাম সম্পর্কে জেনে তা বর্জন করতে পারে। সে মহান আল্লাহর নাম, গুণ ও কর্ম সম্পর্কে অবহিত হয়ে তাঁকে চিনতে পারে। এতে কোনো নিকৃষ্ট কাজ করার ক্ষেত্রে তার অন্তরে আল্লাহর ভয় ও লজ্জা সৃষ্টি হয়। এমনকি তার হৃদয়ে ফেরেশতামণ্ডলী থেকেও লজ্জা সৃষ্টি হয়। জ্ঞানের মাধ্যমে সে পাপিষ্ঠদের অবস্থা এবং আল্লাহ তাদের জন্য কী শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন, তা জানতে পারে। ক্বাতাদাহ রাহিমাহুল্লাহবলেন, اجْتَمَعَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَرَأَوْا أَنَّ كُلَّ شَيْءٍ عُصي بِهِ فَهُوَ جَهَالَةٌ، عَمْدًا كَانَ أَوْ غَيْرَهُ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছাহাবীগণ একত্রিত হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, যা কিছুর মাধ্যমে আল্লাহর অবাধ্যতা করা হয়, তা অজ্ঞতা (জাহালাত),— তা ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত’।[4]

ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহবলেন, قَالَ أَحْمَدُ بْنُ عَاصِمٍ: مَنْ كَانَ بِاللَّهِ أَعْرَفَ كَانَ لَهُ أَخْوَفَ، وَيَدُلُّ عَلَى هَذَا قَوْلُهُ تَعَالَى: {إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ} [فاطر: 28] ‘আহমাদ ইবনু আছেম রাহিমাহুল্লাহবলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে বেশি চেনে, সে-ই তাঁর থেকে বেশি ভয় করে। একথার প্রমাণ হলো আল্লাহ তাআলার এই বাণী— إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ “আল্লাহকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে কেবল আলেমগণই (সত্যিকারভাবে) ভয় করে” (ফাতির, ৩৫/২৮)[5]

(৬) জীবনে অতিরিক্ত ফাঁকা সময় থাকা: যদি কেউ তার সময় ইবাদতে, জ্ঞানার্জনে বা যেকোনো বৈধ কাজে ব্যয় করে, তাহলে সে হারাম কাজ করা তো দূরের কথা, এমনকি হারাম কাজ করার কথা চিন্তা করারই সময় পাবে না। পক্ষান্তরে অতিরিক্ত ফাঁকা সময় ভালো কাজে না লাগালে তা পাপ কামাইয়ের বাহন হতে পারে। ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহবলেন,صَحِبْتُ الصُّوفِيَّةَ. فَمَا انْتَفَعْتُ مِنْهُمْ إِلَّا بِكَلِمَتَيْنِ، سَمِعْتُهُمْ يَقُولُونَ: الْوَقْتُ سَيْفٌ. فَإِنْ قَطَعْتَهُ وَإِلَّا قَطَعَكَ. وَنَفْسُكَ إِنْ لَمْ تَشْغَلْهَا بِالْحَقِّ، وَإِلَّا شَغَلَتْكَ بِالْبَاطِلِ. ‘আমি ছূফীদের সঙ্গ পেয়েছি, কিন্তু তাদের থেকে দুটি বাক্য ছাড়া উপকার পাইনি। তাদের বলতে শুনেছি— ১. সময় হলো একটি তলোয়ার; তুমি যদি তাকে কাটতে পারো, তাহলে তো ভালো। অন্যথা সে-ই তোমাকে কেটে ফেলবে। ২. তোমার মনকে যদি তুমি সঠিক কাজে ব্যস্ত না রাখো, তবে তা বৃথা কাজে তোমাকে ব্যস্ত করে ফেলবে’।[6] শায়খ আব্দুর রহমান আস-সুদাইস হাফিযাহুল্লাহ বলেন,وَكَمْ كَانَ الْفَرَاغُ سَبَبًا فِي الِانْحِرَافِ بِكُلِّ ضُرُوبِهِ، وَالْفَسَادِ بِشَتَّى صُوَرِهِ، عِندَ عَدَمِ اسْتِثْمَارِهِ، فَهُوَ مِنَّةٌ وَنِعْمَاءٌ، لَكِنْ إِذَا اسْتُغِلَّ فِي مَعْصِيَةِ اللَّهِ فَهُوَ نِقْمَةٌ وَبَلَاءٌ ‘ফাঁকা সময় নানা ধরনের বিপথগামিতা ও বিচিত্র রকমের ফ্যাসাদের কত-না কারণ হয়েছে, যখন এই সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়নি। এটি একদিকে আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ ও নিয়ামত। কিন্তু যদি তা আল্লাহর অবাধ্যতায় ব্যবহৃত হয়, তবে সেটি হয়ে দাঁড়ায় এক অভিশাপ ও বিপদ’।[7] সেজন্যই তো আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,إِنِّي لَأَمْقَتُ الرَّجُلَ أَنْ أَرَاهُ، فَارِغًا، لَيْسَ فِي شَيْءٍ مِنْ عَمَلِ الدُّنْيَا، وَلَا عَمَلِ الْآخِرَةِ ‘আমি কাউকে এমন অলস বসে থাকতে দেখে খুব ঘৃণা করি যে, সে না দুনিয়ার কোনো কাজ করছে, না আখিরাতের কোনো কাজ করছে’।[8] সত্যি কথা বলতে মুমিনজীবনে ফাঁকা সময় বলে আসলে কিছু নেই।

(৭) খারাপ বন্ধু ও অসৎ সঙ্গী গ্রহণ করা: রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খারাপ সঙ্গীকে কামারের সাথে তুলনা করেছেন; যে হয় তার সঙ্গীর পোশাক পুড়িয়ে দেয়, না হলে সে তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পায়।[9] বন্ধুর ভালো বা মন্দ যেকোনো স্বভাব বন্ধুর মাঝে খুব সহসাই প্রবেশ করে। তাই তো রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الْمَرْءُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ، فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ ‘একজন মানুষের জীবনধারা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতোই হয়ে যায়। তাই তোমাদের প্রত্যেকের উচিত গভীরভাবে চিন্তা করা— কার সঙ্গে সে বন্ধুত্ব গড়ছে’।[10] সেজন্যই খারাপ কাউকে বন্ধু বানানো যাবে না। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথার্থই বলেছেন, لَا تُصَاحِبْ إِلَّا مُؤْمِنًا، وَلَا يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلَّا تَقِيٌّ ‘তুমি মুমিন ব্যতীত কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না আর পরহেযগার ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ যেন তোমার খাবার না খায়’।[11] অসৎ সঙ্গী বিষের মতো প্রাণঘাতী। অতএব, সাবধান!

(৮) বিয়ে না করা: মহান আল্লাহ পুরুষদের মধ্যে স্বাভাবিক কামনা সৃষ্টি করেছেন এবং তা পূরণের বিষয়টি নারীদের মধ্যেই নিহিত করেছেন। আর এর একমাত্র হালাল পথ হলো বিবাহ। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে। আর যার সেই সামর্থ্য নেই, সে যেন ছওম রাখে। কারণ ছওম তার কামনাকে নিয়ন্ত্রণের উপায়’।[12]

অতএব, যার স্বভাব রূপান্তরিত হয়ে যায়, সে এই কামনা পুরুষদের মাঝেই মেটাতে চায়। এতে সে পশুর থেকেও নিচে নেমে যায়। পশুদের মধ্যেও কি আমরা কোনো মর্দা পশুকে আরেক মর্দা পশুর ওপর চড়তে দেখি? সুতরাং বিয়ের মাধ্যমে যৌন পবিত্রতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

() অশ্লীলতা উপস্থাপনকারী টেলিভিশন চ্যানেলদেখা: যেখানে নারীদের ছবি দেখানো হয় এবং ফেতনা ও অসভ্যতা ছড়ানো হয়। এসব টিভি চ্যানেল মানুষকে নোংরা ভালোবাসার দিকে ঠেলে দেয়।

(১০) কারো প্রতি আকর্ষণ বা আসক্তিকে স্বাভাবিক মনে করা: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে না জানার কারণে মানুষ এ ধরনের অনৈতিক আকর্ষণে জড়ায়। কারণ এটাকে সে স্বাভাবিক মনে করে। অথচ এমন আসক্তি অত্যন্ত ভয়ানক এবং স্বভাববিরোধী।

(১১) প্রেমের কাহিনী, প্রেমমূলক উপন্যাস ও কবিতাপড়া: এসব কারণে মুরদানের প্রতি আসক্তি জন্মাতে পারে। অনুরূপভাবে গোপন বাসনা, অশ্লীল ম্যাগাজিন পড়া ও দৃষ্টি অব্যাহতভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমেও এ রোগ তৈরি হতে পারে।[13]

মুরদানের প্রতি আসক্তির ভয়াবহ পরিণতি:

সম্মানিত পাঠক! মুরদান তথা দাড়িবিহীন কিশোর-যুবকদের প্রতি আসক্তি কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা নিশ্চয় উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আপনার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। এ ব্যাপারে কুরআনে কারীম ও হাদীছে নববীর পাশাপাশি উলামায়ে কেরামের কঠোর বক্তব্য আমরা দেখে এসেছি। সমগোত্রীয় মানুষের প্রতি আকর্ষণ ও দৃষ্টি বা অন্য কোনো অঙ্গের মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন একজন ব্যক্তির নিকৃষ্ট প্রবৃত্তির পরিচায়ক। এটি মহান আল্লাহর সৃষ্ট স্বাভাবিক ফেতরাত বা স্বভাববিরোধী। এই আসক্তি একজন মানুষকে সমকামিতা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে –নাঊযুবিল্লাহ-।

এখানে আমরা মুরদানের প্রতি আসক্তির মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কিত কয়েকটি ভয়াবহ ঘটনা উল্লেখ করছি।

ঘটনা-১: ইমাম ইবনুল জাওযী রাহিমাহুল্লাহবর্ণনা করেন, আবূ আব্দিল্লাহ ইবনুল জাল্লা বলেন, আমি একবার এক সুন্দর চেহারার খ্রিষ্টান বালকের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তখন আবূ আব্দিল্লাহ আল-বালখি আমার পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেনো?

আমি বললাম, চাচা! আপনি কি দেখছেন না, এই চেহারা কীভাবে আগুনে জ্বলবে! (অর্থাৎ আমি এতটাই বিমোহিত ছিলাম যে, ভাবছিলাম- এমন সুন্দর একটি চেহারাকে জাহান্নামের আগুন কীভাবে পোড়াবে!)

তিনি তখন আমার পিঠে হাত দিয়ে মারলেন এবং বললেন, তুমি এ কাজের পরিণাম অবশ্যই টের পাবে।

ইবনুল জাল্লা বলেন, আমি এ কাজের পরিণাম টের পেয়েছিলাম ৪০ বছর পরে, যখন আমি কুরআন ভুলে গিয়েছিলাম।[14]

ঘটনা-২: একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষের প্রেমে ভীষণভাবে মুগ্ধ হয়। এমনকি সে তার প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়ে যায় যে, প্রেমের কষ্টে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু যার প্রতি সে আকৃষ্ট ছিল, সে ঐ লোকটির প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি, বরং বিরত ছিল।

যখন সে ব্যক্তির দেহে মৃত্যুর লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে, তখন মৃত্যুশয্যায় সে এই কবিতাটি আবৃত্তি করে:

يَا أَسْلَمُ يَا رَاحَةَ الْعَلِيلِ ... وَيَا شِفَاء الْمُدْنَفِ النَّحِيلِ

رِضَاك أَشْهَى إِلَى فُؤَادِي ... مِنْ رَحْمَةِ الْخَالِقِ الْجَلِيلِ

(কবিতাটির ভাবানুবাদ) ‘হে আসলাম! হে আমার অসুখী প্রাণের শান্তি! হে এই দুর্বল, রোগাক্রান্ত হৃদয়ের আরোগ্য! তোমার সন্তুষ্টি আমার হৃদয়ের কাছে সেই মহান সৃষ্টিকর্তার দয়ার চেয়েও প্রিয়!’ [15]

সম্মানিত পাঠক! দেখুন, লোকটি দুনিয়াবি প্রেমে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়ে যে, আল্লাহর রহমত থেকেও সে মানবিক প্রেমের তৃপ্তিকে প্রাধান্য দিতে থাকে। এটি মারাত্মক ধ্বংসাত্মক মানসিক অবস্থা, যার কারণে মানুষ ধীরে ধীরে ঈমান হারিয়ে ফেলে -না‘ঊযুবিল্লাহি মিন যালিক-।

ঘটনা-: হাফেয ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী রাহিমাহুল্লাহক্বরা ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, ‘সে দাড়িগোঁফহীন এক সুদর্শন যুবকের দিকে ইশারা করে বলল, এটাই আমার ইলাহ, আমি যার উপাসনা করি। এটি পাথরের উপাসনার চেয়ে মন্দ কিছু নয়। তখন উপস্থিত একজন বলল, এমন কথা তো কুফরী। জবাবে সে বলল, যদি সে ইলাহ না-ও হয়, তবে সে ইলাহ-এর ভাই’।[16]

প্রিয় পাঠক! ভাবতে পারেন, জঘন্য পাপটি একজন মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে! -না‘ঊযুবিল্লাহি মিন যালিক-।

ঘটনা-৪: হাফেয ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী রাহিমাহুল্লাহ৮২৫ হিজরীর জুমাদাল আখেরাহ মাসের একটি ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এ মাসে একজন অনারব ব্যক্তি তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে। ঘটনা হচ্ছে, সে একজন সুন্দর কিশোরকে ভালোবাসত, কিন্তু তাকে পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। একসময় এমন এক সুযোগ ঘটে গেল যে, সেই কিশোর নিজে থেকেই তার কাছে নিজেকে উপস্থাপন করল। কিন্তু সে যখন এগোতে গেল, তখন তার যৌনাঙ্গ উত্তেজিত হলো না। এতে সে এতটাই হতাশ হয়ে পড়ল যে, রাগ ও বেদনায় নিজের যৌনাঙ্গ কেটে ফেলল। এরপর তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো, কিন্তু সেখানেই সে মারা গেল’।[17]

সম্মানিত পাঠক! এই জঘন্য কাজটির ভয়াবহ পরিণতি কতটা মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে, তা এই ঘটনা থেকে সহজে অনুমেয়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন।

তাই প্রতিটি পিতা-মাতা ও অভিভাবকের উচিত, তাদের সন্তানদের সতর্ক করা, যেন তারা তাদের চেয়ে বয়সে বড়দের সঙ্গে অযথা না বসে এবং যেন তারা বুদ্ধিহীন লোকদের সঙ্গেও না বসে, যদিও তারা সমবয়সী হয়।
তেমনি যুবকদের জন্যও জরুরী হচ্ছে, তারা সুন্দর চেহারার কিশোরদের (যাদের প্রতি ফেতনার ভয় থাকে) বন্ধু না বানায়, তাদের সঙ্গে ওঠাবসা না করে এবং একান্তে সময় না কাটায়। কারণ এগুলো ফেতনার দরজা খুলে দেয় এবং সাধারণত শয়তান এই ধরনের নির্জনতা ও সান্নিধ্যের মাঝেই প্রবেশ করে আর তার ফাঁদ পাতে। আমরা মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

সমলিঙ্গের প্রতি আসক্তি সমকামিতার প্রধান ফটক: কোনো সমাজে সমকামিতা তখনই ছড়িয়ে পড়ে, যখনই মানুষ সুন্দর চেহারার লোকদের দেখা এবং তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করার ব্যাপারে অসতর্ক হয়ে পড়ে। একারণে ইসলামের বড় বড় আলেমগণ একমত হয়েছেন যে, কোনো কমবয়সী দাড়িহীন ছেলের দিকে যৌন চাহিদা নিয়ে তাকানো সম্পূর্ণ হারাম। এমনকি বেশিরভাগ আলেম বলেছেন, যদি তাকানোর কারণে শরীরে যৌন অনুভূতি জাগার আশঙ্কা থাকে, তাহলেও তাকানো হারাম। আর কেউ কেউ বলেছেন, যৌন অনুভূতির ঝুঁকি না থাকলেও এমন ছেলের দিকে তাকানো থেকে বিরত থাকা উচিত।[18]

(ইনশা-আল্লাহ চলবে)

* বিএ (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এমএ এবং এমফিল, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৭৫; ছহীহ ‍মুসলিম, হা/৫৭।

[2]. দ্রষ্টব্য: সূরা আন-নূর, ২৪/৩০-৩১।

[3]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-জাওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়াইশ শাফী, পৃ. ১৫৩।

[4]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ২/২৩৫।

[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন বায়না ইয়্যাকা না‘বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতা‘ঈন (বৈরূত: দারুল কিতাবিল আরাবী, ২য় সংস্করণ: ১৪১৬ হি./১৯৯৬ খৃ.), ৩/৩৭৬।

[6]. মাদারিজুস সালিকীন, ৩/১২৪-১২৫।

[7]. দুরূসুশ শায়খ আব্দির রহমান আস-সুদাইস, দারস নং ৫৯। এগুলো মূলত: শায়খের লেকচার, যা http://www.islamweb.net কর্তৃপক্ষ টেক্সট-এ রূপান্তরিত করেছে। دروس للشيخ عبد الرحمن السديس নামে মাকতাবাহ শামেলায় তথ্যটি পাওয়া যাবে।

[8]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, আছার নং ৩৪৫৬২; আবূ দাঊদ, আয-যুহদ, আছার নং ১৭৪; আবূ নু‘আইম ইছফাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া, ১/১৩০।

[9]. হাদীছটি দেখুন: ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৩৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬২৮।

[10]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৪১৮, ‘হাসান’।

[11]. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪৮৩২; সুনানে তিরমিযী, হা/২৩৯৫, ‘হাসান’।

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৬৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪০০।

[13]. দেখুন: https://m.islamqa.info/ar/answers/94836/ https://almoslim.net/node/80108

[14]. ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস (বৈরূত: দারুল ফিকর, ১৪২১ হি./২০০১ খৃ.), পৃ. ২৪৬।

[15]. কুরতুবী, আত-তাযকিরা বিআহওয়ালিল মাওতা ওয়া উমূরিল আখিরাহ (রিয়াদ: মাকতাবাতু দারিল মিনহাজ, ১৪২৫ হি.), পৃ. ১৯৫; ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-জাওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়াইশ-শাফী (মরক্কো: দারুল মা‘রেফাহ, ১৪১৮ হি./১৯৯৭ খৃ.), পৃ. ১৬৮।

[16]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ইম্বাউল গুম্‌র বিআম্বাইল উম্‌র (মিশর: লাজনাতু এহইয়াইত তুরাছিল ইসলামী, ১৩৮৯ হি./১৯৬৯ খৃ.), ৩/২৩৩।

[17]. প্রাগুক্ত, ৩/২৭৩।

[18]. দেখুন: https://islamqa.info/ar/answers/316186/।

Magazine