কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

শাওয়ালের ছিয়াম ও অন্যান্য নফল ছিয়ামের গুরুত্ব

হিজরী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের মাসব্যাপী ছিয়াম সাধনার পর শাওয়ালের প্রথম তারিখে ঈদুল ফিত্বর উদযাপনের মাধ্যমে শুরু হয় হিজরী ক্যালেন্ডারের দশম মাস শাওয়াল। ইহকালীন জীবন ও জগতের সার্বিক কল্যাণ বিধানে এবং পরকালীন জীবনে শান্তিময় জান্নাত লাভের জন্য রামাযানের ছিয়ামের পাশাপাশি শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়ামসহ সারা বছরের অন্যান্য সকল নফল ছিয়ামের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সীমাহীন।

মানবজীবনে আল্লাহভীতি, সহমর্মিতা, ধৈর্য, ত্যাগ ও তাক্বওয়াসহ সকল প্রকার গুণ একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। তাই মানবজীবনটা যাতে ভোগের মোহকে মিটিয়ে দিয়ে ত্যাগের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়, মনুষ্য সমাজ যাতে আদর্শিক মানদণ্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়, সেজন্য মহান আল্লাহ মুসলিমদের ওপর মাহে রামাযানের ছিয়ামকে ফরয করেছেন।

তবে ছিয়ামের মহৎ শিক্ষা যেন শুধু রামাযানের একটি মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বছর জুড়ে জীবনব্যাপী এর অনুশীলন হতে থাকে সেজন্যই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বছরের ১২ মাসের বিভিন্ন সময়ে নফল ছিয়াম নিজে রেখেছেন এবং উম্মাহকে রাখতে উৎসাহিত করেছেন। ছিয়ামের ফযীলত সম্পর্কে আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

‏قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ فَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ يَوْمَئِذٍ وَلاَ يَسْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ ‏.‏ وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ وَلِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ بِفِطْرِهِ وَإِذَا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ.‏

‘আল্লাহ ইরশাদ করেন, আদম সন্তানের যাবতীয় আমল তার নিজের জন্য কিন্তু ছিয়াম ব্যতীত। কেননা তা আমারই জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দিব। ছিয়াম হলো ঢালস্বরূপ। তোমাদের কারো ছিয়াম পালনের দিন সে যেন স্ত্রীর সাথে উপগত না হয় এবং শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালমন্দ করে অথবা কেউ যদি তার সাথে ঝগড়াবিবাদ করে, তবে সে যেন বলে, আমি একজন ছিয়াম পালনকারী। যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, তাঁর শপথ! ছিয়াম পালনকারী ব্যক্তির মুখের গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট মিসকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক উত্তম। ছিয়াম পালনকারী ব্যক্তির খুশির বিষয় দুটি, যখন সে ইফতার করল তখন ইফতারের কারণে সে আনন্দ লাভ করল এবং যখন সে তার রবের সাথে মিলিত হবে, তখন সে তার ছিয়ামের কারণে আনন্দিত হবে’।[1]

ফরয ইবাদতের বাইরে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য অন্য সব ইবাদত ছিল নফল। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরয ইবাদতের পর যে সকল নফল ইবাদত নিজে করতেন এবং ছাহাবীগণকে করার জন্য উৎসাহ দিতেন, সেসকল ইবাদতই উম্মতের জন্য সুন্নাত। আমরা জানি, কিয়ামতের দিন নফল বা সুন্নাত ইবাদত দ্বারা ফরয ইবাদতের ঘাটতি পূরণ করা হবে। সুতরাং আমাদের উচিত ফরযের পাশাপাশি সুন্নাত ইবাদতগুলো যথাযথভাবে পালন করা। ফরয ছালাতের পর সুন্নাত ছালাত যেমন রয়েছে, তেমনি রামাযানের ফরয ছিয়ামের পর সারা বছরই বিভিন্ন মাস ও দিনকেন্দ্রিক নফল ছিয়ামও রয়েছে। রামাযান ব্যতীত ছওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নফল ছিয়ামের নিয়্যতে অন্য সময়ে মাস ও দিনকেন্দ্রিক যেসব ছিয়াম রাখতেন, সেগুলোই হলো উম্মতের জন্য নফল ছিয়াম। আর নফল ছিয়ামগুলোর মধ্যে শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়াম, প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়্যামে বীযের তিনটি ছিয়াম, প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবারের সাপ্তাহিক ছিয়াম, আরাফার দিবসের ছিয়াম এবং যিলহজ্জ মাসের প্রথম নয় দিনের ছিয়াম, আশূরার দিন ও আশূরার আগের দিন, শা‘বান মাসে বেশি বেশি ছিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম।

ফরয ছিয়াম পালনের পর আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য নফল ছিয়ামগুলো আল্লাহর বান্দাদের জন্য বেশ সহায়ক। তাছাড়া রামাযানের ছিয়ামের মধ্যে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকলে নফল ছিয়ামের মাধ্যমে তার পূর্ণতা অর্জিত হবে। রামাযানের পর শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়ামসহ অন্যান্য নফল ছিয়াম দ্বারাও আমরা আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং কুপ্রবৃত্তি দমন করতে পারি।

নিম্নে বিভিন্ন ছহীহ হাদীছে বর্ণিত সারা বছরের নফল ছিয়ামসমূহের গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণনা করা হলো :

শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়াম :

নফল ছিয়ামগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়াম। সাধারণ মুসলিম এই ছয় ছিয়ামকে সাক্ষী ছিয়াম হিসেবে জানলেও পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ বা সুপরিচিত কোনো ধর্মীয় গ্রন্থাদিতে সাক্ষী ছিয়াম নামটি খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়ামের ফযীলত ব্যাপক।

হিজরী সনের দশম মাস শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ জাতীয় উৎসব ঈদুল ফিত্বর উদযাপনের আনন্দে মুসলিমগণ যাতে রামাযানের মহৎ শিক্ষাটা ভুলে না যায়, সেজন্যই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে ছয়টি ছিয়াম রাখতে উম্মাহকে উৎসাহিত করেছেন। আবূ আইয়ূব আনছারী রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ ‘যে ব্যক্তি রামাযান মাসের সব ফরয ছিয়াম পালন করল, তারপর শাওয়াল মাসে আরও ছয় দিন ছিয়াম রাখল, সে যেন সারা বছর ছিয়াম রাখল’।[2]

আলোচ্য হাদীছে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তা হলো- শুধু শাওয়াল মাসে ছয়টি ছিয়াম রাখলেই এক বছরের ছিয়াম রাখার ছওয়াব পাওয়া যাবে তেমনটি নয়। আবার শুধু মহিমাম্বিত রামাযানে পুরো এক মাস ছিয়াম রাখলে এক বছরের ছিয়ামের ছওয়াব দেওয়া হবে সেকথা কোথাও বলা হয়নি। বরং পুরো রামাযান মাস ছিয়াম রাখার পরে শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি নফল ছিয়াম রাখলে তবেই পূর্ণ এক বছর ছিয়াম রাখার ছওয়াব লাভ করা যাবে সেকথাই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীছে বলেছেন।

বস্তুত হাদীছে পবিত্র কুরআনেরই একটি আয়াতের বক্তব্য বিবৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا وَمَنْ جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَلَا يُجْزَى إِلَّا مِثْلَهَا وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ ‘যে ব্যক্তি নেক আমল (সৎকর্ম) করবে, তার জন্য আছে ১০ গুণ ছওয়াব (পুরস্কার)। আর যে ব্যক্তি অসৎকাজ করবে, তাকে শুধু কৃতকর্মের তুল্য প্রতিফল দেওয়া হবে, তাদের উপর অত্যাচার করা হবে না’ (আল-আনআম, ৬/১৬০)

সুতরাং রামাযানের এক মাসের ছিয়ামের ১০ গুণ হলো ১০ মাস ছিয়াম আর শাওয়াল মাসের ছয় দিনের ছিয়ামের ১০ গুণ হলো ৬০ দিন ছিয়াম অর্থাৎ দুই মাস।

অর্থাৎ (১০ মাস + ২ মাস) = ১২ মাস বা পূর্ণ এক বছরের ছিয়ামের ছওয়াব লাভের জন্য রামাযানের ছিয়াম রাখার পরে শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়াম রাখার শর্ত থাকলেও যদি কেউ শারঈ কোনো কারণে রামাযানের পূর্ণ মাস ছিয়াম রাখতে না পারেন আর ছুটে যাওয়া ছিয়াম পরে ক্বাযা আদায় করেন, তাহলে শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়াম রাখা যাবে না বিষয়টি এমন নয়।

আরবী শাওয়াল মাসের অর্থাৎ প্রথমদিকে, মাঝামাঝি দিনগুলোতে অথবা শেষদিকে আবার একাধারে ছয় দিন অথবা এক দিন ছিয়াম রেখে তারপর এক দিন বা দুই দিন বিরতি দিয়ে আবার একদিন যেকোনোভাবে ছিয়াম রাখা যাবে। শাওয়াল মাসের মধ্যে ছয়টি ছিয়াম রাখলেই হাদীছে বর্ণিত ছওয়াব পাওয়া যাবে ইনশা-আল্লাহ।

আইয়্যামে বীযের তিনটি ছিয়াম :

প্রতি আরবী মাস বা চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের ছিয়ামকে হাদীছে সারা বছর ছিয়াম পালনের সমতুল্য বলা হয়েছে।

عَنْ ابْنِ مِلْحَانَ الْقَيْسِيِّ عَنْ أَبِيهِ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‌يَأْمُرُنَا ‌أَنْ ‌نَصُومَ ‌الْبِيضَ ثَلَاثَ عَشْرَةَ وَأَرْبَعَ عَشْرَةَ وَخَمْسَ عَشْرَةَ قَالَ وَقَالَ هُنَّ كَهَيْئَةِ الدَّهْرِ.

ইবনু মিলহান আল-ক্বায়সী রযিয়াল্লাহু আনহু তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে আইয়্যামে বীয অর্থাৎ প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে ছিয়াম রাখার নির্দেশ দিতেন। ইবনু মিলহান বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এ ছিয়ামগুলোর মর্যাদা (ফযীলত) সারা বছর ছিয়াম রাখার সমতুল্য’।[3]

সোম ও বৃহস্পতিবারের সাপ্তাহিক ছিয়াম :

প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবারের সাপ্তাহিক ছিয়াম সম্পর্কে আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,‌تُعْرَضُ ‌الأَعْمَالُ ‌يَوْمَ ‌الِاثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ فَأُحِبُّ أَنْ يُعْرَضَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ ‘প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমল পেশ করা হয়। সুতরাং আমি ভালোবাসি ছায়েম অবস্থায় আমার আমলসমূহ পেশ করা হোক’।[4]

উসামা ইবনু যায়েদ রযিয়াল্লাহু আনহু-এর আযাদকৃত গোলাম হতে অন্য এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, একদা তিনি উসামা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে কুবা নামক উপত্যকায় তাঁর মালের জন্য গমন করেন। তিনি (উসামা) সোমবার ও বৃহস্পতিবার ছিয়াম রাখেন। তাঁর আযাদকৃত গোলাম তাঁকে বলেন, আপনি সোমবার ও বৃহস্পতিবার কেন ছিয়াম রাখেন অথচ আপনি একজন অতি বৃদ্ধ ব্যক্তি। তিনি বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোম ও বৃহস্পতিবার ছিয়াম রাখতেন। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘মানুষের আমলসমূহ সোমবার ও বৃহস্পতিবার আল্লাহর সমীপে পেশ করা হয়’।[5]

সোমবারের ছিয়াম সম্পর্কে আবূ ক্বাতাদা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে সোমবারের ছিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘ঐদিন আমি জন্মলাভ করেছি এবং ঐদিন আমার উপর (কুরআন) নাযিল হয়েছে’।[6]

আরাফার দিবসের ছিয়াম :

আরাফার দিবসের ছিয়াম সম্পর্কে আবূ ক্বাতাদা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশা করি যে, আমার এতটা শক্তি হোক’। তিনি পুনরায় বললেন, ‘প্রতি মাসে তিন দিন ছিয়াম পালন করা এবং রামাযান মাসের ছিয়াম এক রামাযান থেকে পরবর্তী রামাযান পর্যন্ত সারা বছর ছিয়াম পালনের সমান। আর আরাফার দিবসের ছিয়াম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তাতে পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহের ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে। আর আশূরার ছিয়াম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তাতে পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহসমূহের কাফফারা হয়ে যাবে’।[7]

আশূরার ছিয়াম :

হিজরী ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হলো মুহাররম। মুহাররম মাসের ১০ তারিখকে আশূরা বলা হয়। হাদীছে এসেছে, এই দিন ছিয়াম রাখলে পূর্বের এক বছরের পাপ মোচন হয়।[8] আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘রামাযানের ছিয়ামের পর সর্বোত্তম ছিয়াম হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের ছিয়াম এবং ফরয ছালাতের পর সর্বোত্তম ছালাত হচ্ছে রাতের ছালাত’।[9]

কিন্তু ইয়াহূদীরা একই দিনে ছিয়াম পালন করত বিধায় ছাহাবীগণ এই দিন ছিয়াম রাখার ব্যাপারে আপত্তি জানালে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তাহলে মুহাররমের ৯ তারিখেও ছিয়াম রাখব। সুতরাং মুহাররমের ৯ ও ১০ উভয় তারিখেই ছিয়াম রাখা উচিত, যেন ইয়াহূদীদের সঙ্গে সাদৃশ্য না হয়ে যায়’।

এ প্রসঙ্গে আবূ গাত্বাফান রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু-কে এরূপ বলতে শুনেছি যে, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশূরার দিন ছিয়াম রাখেন, তখন আমাদেরকেও ঐ দিন ছিয়াম রাখার নির্দেশ দেন। ছাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এ তো এমন দিন, যাকে ইয়াহূদী ও নাছারা সম্মান করে থাকে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন আগামী বছর এ সময় আসবে, তখন আমরা মুহাররমের নবম তারিখে ছিয়াম রাখব’। কিন্তু পরবর্তী বছর আগমনের পূর্বেই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করেন।[10]

যিলহজ্জ মাসের প্রথম ৯ দিনের ছিয়াম :

হাদীছের ভাষ্যে, যিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমলের চেয়ে অন্য কোনো আমলই আল্লাহর কাছে এত বেশি প্রিয় নয়। সে হিসেবে এ মাসের প্রথম ৯ দিন ছিয়াম পালনের ফযীলত অনেক। উল্লেখ্য, এ মাসের ১০ তারিখ যেহেতু ঈদুল আযহা, সেহেতু এ দিন ছিয়াম রাখা হারাম। আর এ মাসের ৯ তারিখই হলো আরাফার দিন।

এ প্রসঙ্গে হুনায়দা ইবনু খালেদ তাঁর স্ত্রী হতে এবং তিনি নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো এক স্ত্রী হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ্জের প্রথম ৯ দিন ও আশূরার দিন ছিয়াম রাখতেন। আর তিনি প্রতি মাসে তিন দিন, প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার ছিয়াম রাখতেন।[11]

শা‘বান মাসের ছিয়াম :

হাদীছে এসেছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাযানের পূর্ণ মাসের ছিয়ামের পর শা‘বান মাসেই সবচেয়ে বেশি ছিয়াম পালন করতেন। এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনু কায়স রযিয়াল্লাহু আনহু আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা-কে বলতে শুনেছেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট মাসসমূহের মধ্যে (নফল) ছিয়ামের জন্য প্রিয়তম মাস ছিল শা‘বান মাস। এরপর তিনি রামাযানের ছিয়াম রাখা শুরু করতেন।[12]

এ প্রসঙ্গে অন্য এক বর্ণনায় আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে এত বেশি ছিয়াম পালন করতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর ছিয়াম পরিত্যাগ করবেন না। (আবার কখনো এত বেশি) ছিয়াম পালন না করা অবস্থায় একাধারে কাটাতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর (নফল) ছিয়াম পালন করবেন না। আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রামাযান ব্যতীত কোনো পুরো মাসের ছিয়াম পালন করতে দেখিনি এবং শা‘বান মাসের চেয়ে অন্য কোনো মাসে এত বেশি (নফল) ছিয়াম পালন করতে দেখিনি।[13]

উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম, বছরের কোনো কোনো দিনে নফল ছিয়াম রাখার বিশেষ ফযীলত ও গুরুত্ব রয়েছে। আসুন! রামাযানের পর এই ছিয়ামগুলো পালনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার জন্য সচেষ্ট হই। মহান আল্লাহ আমাদেরকে ছহীহ হাদীছে বর্ণিত এই নফল ছিয়ামগুলো রাখার মতো শক্তি এবং মানসিকতা দান করুন- আমীন!

অধ্যাপক ওবায়দুল বারী বিন সিরাজউদ্দীন

পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৪।

[3]. আবূ দাঊদ, হা/২৪৪৯, হাদীছ ছহীহ।

[4]. তিরমিযী, হা/৭৪৭, হাদীছ ছহীহ।

[5]. আবূ দাঊদ, হা/২৪৩৬, হাদীছ ছহীহ।

[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬২।

[7]. প্রাগুক্ত

[8]. প্রাগুক্ত।

[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৩।

[10]. আবূ দাঊদ, হা/২৪৪৫, হাদীছ ছহীহ।

[11]. আবূ দাঊদ, হা/২৪৩৭, হাদীছ ছহীহ।

[12]. আবূ দাঊদ, হা/২৪৩১, হাদীছ ছহীহ।

[13]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৬৯।

Magazine