হজ্জ ও উমরার শর্তসমূহ
(১) মুসলিম হওয়া : হজ্জ ও উমরা পালনের প্রথম শর্ত হলো মুসলিম হওয়া। কোনো অমুসলিম ব্যক্তি হজ্জ ও উমরা পালন করতে পারবে না। কোনো অমুসলিম হজ্জ ও উমরা পালন করার পর মুসলিম হলে তাকে পুনরায় হজ্জ করতে হবে। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, বিদায় হজ্জের পূর্বের বছরে কুরবানীর দিন আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রযিয়াল্লাহু আনহু আমাকে একটি দলের মাঝে পাঠালেন, ঘটনাটি সেই হজ্জ কাফেলায় ঘটেছিল, যার প্রতিনিধি আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রযিয়াল্লাহু আনহু-কে নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, আবূ বকর ছিদ্দীক্ব! তুমি আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলে দাও যে, সে যেন মানুষ সমাজে ঘোষণা দেয় যে, এ বছরের পরে আর কোনো অমুসলিম হজ্জ করতে পারবে না এবং নগ্ন অবস্থায় বায়তুল্লায় ত্বাওয়াফ করতে পারবে না।[1]
(২) বোধশক্তিসম্পন্ন হওয়া : আলী রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তিন শ্রেণির মানুষের ভুল-ত্রুটি লিপিবদ্ধ করা হয় না- ১. ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ পর্যন্ত ঘুম থেকে না উঠে। ২. অপ্রাপ্ত বয়স্ক, যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং ৩. পাগল, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাগলামি থেকে মুক্ত হয়’।[2] এমন ব্যক্তি সামর্থ্যবান হলে পাগলামি ভালো হওয়া বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাকে হজ্জ করতে হবে।
(৩) প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া : কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্কের উপর হজ্জ ও উমরা ফরয নয়। তবে যে ব্যক্তি অপ্রাপ্ত বয়স্কদের হজ্জ ও উমরা করাবে, সে উক্ত নেকী পাবে। ইবনে আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা এক মহিলা তার ছোট বাচ্চাকে তুলে ধরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ বাচ্চার কি হজ্জ হবে? রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। তবে নেকী তোমার জন্য হবে’।[3] এই হাদীছ প্রমাণ করে হজ্জের জন্য পূর্ণ বয়স হতে হবে। বাল্য অবস্থায় হজ্জ করলে বড় হওয়ার পর সামর্থ্য থাকলে আবার হজ্জ করতে হবে। ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তোমরা আমার নিকট হতে শিখে নাও, তবে এ কথা বলো না যে, ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, (বরং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন) কোনো কৃতদাসকে যদি তার মালিক হজ্জ করায়, অতঃপর তাকে আযাদ করে দেওয়া হয়, সে সামর্থ্যবান হলে তাকে পুনরায় হজ্জ করতে হবে। কোনো ছোট বাচ্চাকে যদি তার অভিভাবক হজ্জ করায়, অতঃপর সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যায় এবং সামর্থ্য থাকে, তাহলে তাকে পুনরায় ফরয হজ্জ পালন করতে হবে।[4]
(৪) স্বাধীন হওয়া : কোনো কৃতদাস হজ্জ-উমরা পালন করলে তা নফল হবে। পরে কোনো সময় স্বাধীন হলে এবং সামর্থ্য থাকলে তাকে পুনরায় হজ্জ-উমরা পালন করতে হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তোমরা আমার কাছ থেকে ভালো করে মুখস্থ করে নাও, আর একথা বলো না যে, একথা ইবনু আব্বাস বলেছেন (অর্থাৎ এটা স্বয়ং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা), ‘যে দাসকে তার মালিক হজ্জ করালো, অতঃপর সে আযাদ হয়ে গেল, তার উপর পুনরায় হজ্জ ফরয। অনুরূপভাবে যে শিশুকে পরিবারের লোকেরা হজ্জ করালো, বালেগ হওয়ার পর পুনরায় তার উপর প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের মতো হজ্জ ফরয’।[5]
(৫) শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম হওয়া : আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা বায়তুল্লাহর পথ অবলম্বনে সক্ষম তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ্জ করা ফরয’।[6] অতএব, শারীরিক ও আর্থিকভাবে অক্ষম ব্যক্তির উপর হজ্জ ও উমরা ফরয নয়।
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضي الله عنهما قَالَ جَاءَتِ امْرَأَةٌ مِنْ خَثْعَمَ ، عَامَ حَجَّةِ الْوَدَاعِ ، قَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ فَرِيضَةَ اللَّهِ عَلَى عِبَادِهِ فِى الْحَجِّ أَدْرَكَتْ أَبِى شَيْخًا كَبِيرًا ، لاَ يَسْتَطِيعُ أَنْ يَسْتَوِىَ عَلَى الرَّاحِلَةِ فَهَلْ يَقْضِى عَنْهُ أَنْ أَحُجَّ عَنْهُ قَالَ نَعَمْ
ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিদায় হজ্জের বছর খাছআম গোত্রের এক মহিলা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! নিশ্চয় হজ্জ আল্লাহর বান্দাদের উপর ফরয। তবে আমার পিতা অনেক বয়স্ক হওয়ার ফলে বাহনে বসে স্থির থাকতে পারেন না। অতএব, আমি যদি তার পক্ষ হতে হজ্জ আদায় করি, তাহলে কি ক্বাযা আদায় হবে? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ।[7] অনুরূপ কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি হজ্জ না করেই মারা যায়, তাহলে তার মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পদ দিয়ে তার পক্ষ হতে হজ্জ পালন করতে হবে।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ جَاءَتِ امْرَأَةٌ إِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ إِنَّ أُمِّى مَاتَتْ وَلَمْ تَحُجَّ أَفَأَحُجُّ عَنْهَا قَالَ نَعَمْ حُجِّى عَنْهَا
আব্দুল্লাহ ইবনে বুরায়দা রযিয়াল্লাহু আনহু তার পিতা হতে বর্ণনা করে বলেন, জনৈকা মহিলা ছাহাবীর মা মারা গেলে তিনি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমার মা মারা গেছেন, কিন্তু তিনি হজ্জ করেন নি, আমি কি তার পক্ষ হতে হজ্জ করতে পারব? নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। তোমার মায়ের পক্ষ হতে তুমি হজ্জ করো।[8]
(৬) মহিলা হজ্জ পালনকারীর মাহরাম সঙ্গী হওয়া : কোনো মহিলা মাহরাম ব্যতীত সফর করতে পারবে না।[9] মাহরাম হলো স্বামী এবং ঐ সকল পুরুষ, যাদের সাথে চিরদিনের জন্য বিবাহ হারাম। যেমন রক্ত সূত্রে পিতা, পুত্র, নিজের ভাই, আপন চাচা ও মামা। এ ছাড়াও বোনের ছেলে, ভাইয়ের ছেলে এবং দুধ পানের সূত্রে দুধ পিতা, দুধ পুত্র, দুধ ভাই, দুধ চাচা ও দুধ মামা। বৈবাহিক সূত্রে শ্বশুর, স্বামীর অন্য স্ত্রীর ছেলে, মায়ের দ্বিতীয় স্বামী এবং মেয়ের স্বামী। এছাড়া আর অন্য পুরুষ মাহরাম নয়। তাদের সাথে সফর করা এবং হজ্জ ও উমরা করা বৈধ হবে না। এ অবস্থায় হজ্জের এজেন্ট এবং মহিলা গোনাহগার হবে।
হজ্জ ও উমরার রুকনসমূহ :
হজ্জ কিংবা উমরায় যে সকল কাজ সম্পাদন করা একান্ত জরুরী এবং তা ছুটে গেলে হজ্জ-উমরা বিশুদ্ধ হয় না, সেগুলো হজ্জ-উমরার রুকন বলে।
উমরার রুকন : উমরার রুকন তিনটি। যথা : ১. ইহরাম বাঁধা, ২. ত্বাওয়াফ করা এবং ৩. সা‘ঈ করা।
হজ্জের রুকন : হজ্জের রুকন চারটি। যথা : ১. ইহরাম বাঁধা, ২. আরাফায় অবস্থান করা, ৩. ত্বওয়াফে ইফাযা করা এবং ৪. সা‘ঈ করা।
রুকনসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ :[10]
ইহরাম বাঁধা : উমরা বা হজ্জের জন্য অন্তরে নিয়্যত করে মুখে ‘লাব্বাইকা উমরাতান’ অথবা হজ্জের জন্য হলে ‘লাব্বাইকা হাজ্জান’ বলাকে ইহরাম বাঁধা বলে। অবশ্য হজ্জ ও উমরার ক্ষেত্রে বাক্যগুলো উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করা সুন্নাত। উমরার জন্য নির্ধারিত মীক্বাত (স্থান) হতে ইহরাম বাঁধতে হবে। ‘হজ্জে ক্বিরান’ ও ‘হজ্জে ইফরাদ’ এর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মীক্বাত হতে ইহরাম বাঁধতে হবে। আর ‘হজ্জে তামাত্তু’ হলে যুলহিজ্জার ৮ তারিখে যেখানে অবস্থান করা হয়, সেখান থেকে ইহরাম বাঁধতে হবে।
ত্বাওয়াফ করা : কা‘বা ঘরের চতুর্দিকে সাত চক্কর ঘুরতে হবে। আল্লাহ তাআলা ত্বওয়াফ করার জন্য আদেশ করে বলেন, وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ ‘তারা যেন প্রাচীন ঘর কা‘বা ঘরের ত্বওয়াফ করে’ (আল-হজ্জ, ২২/২৯)। এই আয়াতে বুঝা যায়, ত্বওয়াফ হজ্জ ও উমরার জন্য ফরয কাজ। উমরার প্রথম কাজ কা‘বা ঘর ত্বওয়াফ করা। উল্লেখ্য যে, হজ্জের জন্য যুলহিজ্জা মাসের ১০ তারিখে যে ত্বওয়াফ করা হয়, তাকে ত্বওয়াফে ইফাযা বা ত্বওয়াফে যিয়ারা বলা হয়।
সা‘ঈ করা : সাফা পর্বত হতে মারওয়া পর্বত পর্যন্ত দৌড়ানোকে এক সা‘ঈ বলে। এভাবে মারওয়া হতে সাফা আসলে আরেক সা‘ঈ হয়। এভাবে সাতবার সা‘ঈ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا ‘নিশ্চয়ই সাফা এবং মারওয়া পাহাড় আল্লাহর নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। অতএব যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহয় হজ্জ এবং উমরা করবে, তার এই দুই পাহাড় ত্বাওয়াফ করাতে কোনো গুনাহ নেই’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৮)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ اسْعَوْا فَإِنَّ اللَّهَ كَتَبَ عَلَيْكُمُ السَّعْيَ ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা সাফা-মারওয়ায় সা‘ঈ করো। কেননা সা‘ঈ তোমাদের জন্য আল্লাহ ফরয করে দিয়েছেন।[11] আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা কোনো মানুষের হজ্জ ও উমরা পূর্ণ করবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সাফা-মারওয়া সা‘ঈ করবে’।[12] এই হাদীছ প্রমাণ করে, সাফা-মারওয়ার সা‘ঈ করা ফরয কাজ।
উল্লিখিত তিনটি রুকন উমরা এবং হজ্জ উভয়ের জন্যই ফরয। তবে হজ্জের জন্য আরও একটি অপরিহার্য রুকন হচ্ছে, আরাফায় অবস্থান করা।
আরাফায় অবস্থান : যুলহিজ্জা মাসের ৯ তারিখে সূর্য ঢলে যাওয়ার পর হতে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত আরাফার মাঠে অবস্থান করাই মূলত হজ্জ। এটা হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরয কাজ।[13] যথাসময়ে আরাফার মাঠে উপস্থিত হতে না পারলে ফজরের পূর্বে যে কোনো মুহূর্তে অবস্থান করতে পারলেও ফরয আদায় হয়ে যাবে।[14]
(চলবে)
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬২২; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪৭; মিশকাত, হা/২৫৭৩।
[2]. আবূ দাঊদ, হা/৪৪০৩, হাদীছ ছহীহ।
[3]. তিরমিযী, হা/৯২৪; ইবনে মাজাহ, হা/২৯১০।
[4]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/১৪৮৭৫; বায়হাক্বী, হা/৯৯৫১।
[5]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/১৫১০৫।
[6]. আলে ইমরান, ৩/৯৭।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৫৪; তিরমিযী, হা/৯৩০।
[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৭; তিরমিযী, হা/৯২৯।
[9]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৬২; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪১।
[10]. বি.দ্র. বিস্তারিত বিবরণ পররর্তীতে আসবে ইনশাআল্লাহ।
[11]. দারাকুৎনী, হা/২৬১৬; আহমাদ, হা/২৭৪০৮; ইরওয়াউল গালীল, হা/১০৮৭।
[12]. ছহীহ বুখারী, হা/১৭৯০।
[13]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮; মিশকাত, হা/২৫৯৩, ২৫৯৫, ২৫৯৬।
[14]. ইবনে মাজাহ, হা/৩০১৫।