কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মানবজীবনে দ্বীনি শিক্ষার ভূমিকা

post title will place here

ভূমিকা:

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলাম ধর্মীয় বিধিবিধান, আচার-অনুষ্ঠান, ইবাদত পালন-সহ মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে। দ্বীনি শিক্ষা বা ইসলামী শিক্ষা হলো আখেরাতে সাফল্য লাভের এবং দুনিয়াতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীজুড়ে শান্তি, ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করার একটি মাধ্যম। দ্বীনি শিক্ষা আমাদেরকে সঠিকভাবে জীবন পরিচালনা করতে সহায়তা করে, মানবজাতিকে উন্নতির দিকে পরিচালিত করে এবং পরকালীন মুক্তির রসদ যোগাতে সহায়ক হয়।

দ্বীনি শিক্ষা কী এবং তার গুরুত্ব কতটুকু?

দ্বীনি শিক্ষা বলতে ইসলামের ধর্মীয় জ্ঞান এবং শিক্ষাকে বোঝায়, যা একজন মুসলিমের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা অনুসারে জীবনযাপন করতে সাহায্য করে। এটি ইসলামের মূল বিশ্বাস, ইবাদত, নৈতিকতা এবং আচার-আচরণ সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও পরকালীন মুক্তির উদ্দেশ্যে কাজ করে।

দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ‘পড়ুন, আপনার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (আল-আলাক্ব, ৯৬/১)। এখানে শিক্ষার সূচনা আল্লাহর নাম নিয়ে, যা দ্বীনি জ্ঞান অর্জনের ভিত্তি। এছাড়াও আল্লাহ তাআলা বলেছেন, يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ  ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন’ (আল-মুজাদিলা, ৫৮/১১)। এই আয়াতে দ্বীনি জ্ঞানের মাধ্যমে ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইহকাল ও পরকালে সফলতার পথ। হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয’।[1] এখানে জ্ঞান বলতে দ্বীনি জ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে, যা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অত্যাবশ্যক। অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কোনো পথ অবলম্বন করে, মহান আল্লাহ তাদ্বারা তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন’।[2]

এভাবে কুরআন ও হাদীছ আমাদের জানায় যে, দ্বীনি শিক্ষা মানুষের আত্মিক উন্নতি, সঠিক পথপ্রাপ্তি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রধান উপায়। এটি দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতার চাবিকাঠি। নিম্নে বিভিন্ন অঙ্গনে দ্বীনি শিক্ষার ভূমিকা আলোকপাত করা হলো—

ব্যক্তিগত জীবনে দ্বীনি শিক্ষার ভূমিকা:

দ্বীনি শিক্ষা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি একজন ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ এবং জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। একজন মুসলিমের চরিত্রে পরিশুদ্ধতা, সততা, মেহনত, দয়া, সহিষ্ণুতা এবং বিনয় প্রতিষ্ঠা করতে দ্বীনি শিক্ষা সহায়তা করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আল-আহযাব, ৩৩/২১)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا ‘তোমাদের মধ্যে ঈমানে পরিপূর্ণ মুসলিম হচ্ছে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি’।[3] এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের চরিত্রের শুদ্ধতা এবং নৈতিক উন্নয়ন। ব্যক্তি যদি দ্বীনি শিক্ষা মেনে চলেন, তাহলে তার জীবন শুদ্ধ হয় এবং সে সমাজে একজন আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

পারিবারিক জীবনে দ্বীনি শিক্ষার ভূমিকা:

ইসলাম পারিবারিক জীবনের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। দ্বীনি শিক্ষার আলোকে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, দয়া, সহানুভূতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম বিবাহ, সন্তান পালন এবং পরিবারে কর্তব্য পালনকে সুষ্ঠুভাবে নির্ধারণ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে আর তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর’ (আত-তাহরীম, ৬৬/৬)। এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, পরিবার এবং সন্তানদের সঠিক দ্বীনি শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা পার্থিব এবং পরকালীন জীবনে সফল হতে পারে।

ইসলামিক শিষ্টাচার, ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতা একজন মুসলিমের পারিবারিক জীবনের মূল ভিত্তি। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ ‘তোমাদের মাঝে সে-ই ভালো, যে তার পরিবারের নিকট ভালো’।[4] এই হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, ইসলাম পরিবারে ভালো সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সহানুভূতি, ভালোবাসা এবং দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠা করেছে।

দ্বীনি শিক্ষা কেবল পারিবারিক সম্পর্ককেই মজবুত করে না; এটি সদস্যদের আখেরাতমুখী জীবনযাপন করতে উদ্বুদ্ধ করে। একজন সন্তান সঠিক ইসলামী জ্ঞান লাভ করলে সে পিতামাতার জন্য আখেরাতে ছওয়াবের কারণ হয়। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নেক সন্তান, যে তার পিতামাতার জন্য দু‘আ করে’— এটি মৃত্যুর পরও চলমান ছওয়াবের একটি মাধ্যম।[5]

সামাজিক জীবনে দ্বীনি শিক্ষার ভূমিকা:

ইসলাম সামাজিক জীবনের প্রতিটি দিকেও গভীর প্রভাব ফেলে। দ্বীনি শিক্ষা মানুষের সামাজিক আচরণ, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সামগ্রিক সমাজব্যবস্থাকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ‘সৎকাজ ও তাক্বওয়ার ব্যাপারে তোমরা পরস্পরকে সহযোগিতা করো; পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো না’ (আল-মায়েদা, ৫/২)। এই আয়াত সমাজে পরস্পরের কল্যাণে কাজ করার এবং অন্যায় ও পাপ থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা দেয়।

দ্বীনি শিক্ষা মানুষকে সহযোগিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সহমর্মিতার আদর্শে গড়ে তোলে, যা সমাজের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ الْمُؤْمِنَ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا ‘একজন মুমিন আরেকজন মুমিনের জন্য দালানস্বরূপ, যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে থাকে’।[6] এই হাদীছ দেখায় যে, একজন ব্যক্তি তার সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অন্যদের জন্য উপকার বয়ে আনে। দ্বীনি শিক্ষা ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে এই সেতুবন্ধন তৈরি করে।

ইসলামে সমাজে শান্তি, ন্যায় এবং পরস্পরের সহায়তা প্রতিষ্ঠার জন্য একাধিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইসলাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং সমাজে শোষণ, বৈষম্য, অন্যায়, হিংসা ও অপব্যবহার প্রতিরোধ করতে প্রেরণা দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে এবং অন্যায় দূর করতে আদেশ দেন’ (আল-নাহল, ১৬/৯০)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করবে, যা তার নিজের জন্য পছন্দ করে’।[7] এই হাদীছ পারস্পরিক ভালোবাসা এবং সহমর্মিতার গুরুত্বকে স্পষ্ট করে। দ্বীনি শিক্ষা সমাজে এই মানবিক গুণাবলি প্রচলন করে, যা সামাজিক বন্ধনকে মজবুত করে।

তাছাড়া, সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং সৎকাজের আদেশ দেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ বলেন,كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ‘তোমরাই সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, তোমরা সৎকাজে আদেশ করবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে’ (আলে ইমরান, ৩/১১০)। দ্বীনি শিক্ষা মানুষকে সৎকাজের প্রসার এবং অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতে উৎসাহিত করে, যা সমাজের সুস্থতা নিশ্চিত করে।

অর্থনৈতিক জীবনে দ্বীনি শিক্ষার ভূমিকা:

ইসলাম অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও সততার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ‘আর পরিমাপ ও ওযন ইনছাফের সাথে পরিপূর্ণ দেবে’ (আল-আনআম, ৬/১৫২)। এছাড়া ইসলামে হালাল রিযিক্ব অর্জনের উপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র এবং তিনি পবিত্র ব্যতীত কিছু গ্রহণ করেন না’।[8] রাসূলূল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র বলেছেন,كُلُّ جَسَدٍ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ فَالنَّارُ أَوْلَى بِهِ ‘যে দেহ হারাম দ্বারা লালিত হয়েছে, তার জন্য জাহান্নামের আগুনই যথাযোগ্য’।[9]

ব্যবসা-বাণিজ্যে শারঈ নির্দেশনা মেনে চলার মাধ্যমে মানুষ আর্থিক লেনদেনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সূদ (রিবা) ইসলামে হারাম। আল্লাহ তাআলা সূদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন,الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا‘যারা সূদ খায় তারা তার ন্যায় দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটা এজন্য যে, তারা বলে, ‘ক্রয়-বিক্রয় তো সূদেরই মতো। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সূদকে হারাম করেছেন’ (আল-বাক্বারা, ২/২৭৫)

সুতরাং দ্বীনি শিক্ষা সূদের মতো শোষণমূলক ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে লেনদেনকে উৎসাহিত করে। তাছাড়া, সম্পদের সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য ইসলাম যাকাত ও দানের ব্যবস্থা চালু করেছে। যাকাত অর্থনীতিতে গরীব-দুঃখীর অধিকার সংরক্ষণ করে এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে। এটি ধনী-গরীবের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন গড়ে তোলে।

দ্বীনি শিক্ষা মানুষকে অপচয় ও অপব্যয়ের বিরুদ্ধে সচেতন করে। কুরআনে বলা হয়েছে,إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ‘নিশ্চয় যারা অপব্যয় করে, তারা শয়তানের ভাই’ (আল-ইসরা, ১৭/২৭)

ইসলাম কাউকে শোষণ বা আর্থিক নির্যাতন থেকে বিরত থাকতে বলেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ وَلَهُ أَجْرٌ كَرِيمٌ‘এমন কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম কর্জ দিবে? তাহলে তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান’ (আল-হাদীদ, ৫৭/১১)। এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ছাদাক্বা বা দান করার দিকে মুসলিমদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। ইসলাম অর্থনৈতিক জীবনে দানের মাধ্যমে সামগ্রিক কল্যাণ এবং সমাজের জন্য সহানুভূতির গুরুত্ব দেয়।

রাষ্ট্রীয় জীবনে দ্বীনি শিক্ষার ভূমিকা:

রাষ্ট্রীয় জীবনে দ্বীনি শিক্ষার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একটি রাষ্ট্রের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দ্বীনি শিক্ষার অনুশীলন অপরিহার্য। রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থায় দ্বীনি শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি জনগণের চরিত্র গঠনে সহায়ক। এটি নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা এবং সৎ চরিত্র গড়ে তোলে। পাশাপাশি সমাজের সকল স্তরে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

ইসলামের মৌলিক আদর্শ হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা। কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে দ্বীনি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু শাসনব্যবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে না, বরং শাসক ও শাসিতদের মধ্যে একটি সুস্থ সম্পর্কও গড়ে তোলে। দ্বীনি শিক্ষা রাষ্ট্রীয় নীতিমালার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এটি সমাজে ইনছাফ, সমতা এবং সামাজিক ন্যায়ের ধারণা প্রতিষ্ঠা করে। যেমন- কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর জন্য সাক্ষীরূপে’ (আন-নিসা, ৪/১৩৫)

দ্বীনি শিক্ষা শাসকদের নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। ইসলামে খলীফা বা শাসককে জনগণের সেবক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তাদের কাজ হচ্ছে আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন করা। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে’।[10]

অতএব, রাষ্ট্রীয় জীবনে দ্বীনি শিক্ষা কেবল একটি শারঈ দায়িত্বই নয়, বরং এটি একটি সমৃদ্ধ সমাজ ও সফল রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম ভিত্তি। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলে সেখানে মানুষ সত্যিকার অর্থে শান্তি ও কল্যাণের স্বাদ পেতে পারে।

উপসংহার:

মানবজীবনে দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মানুষকে নৈতিক ও আত্মিকভাবে উন্নত করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা অর্জনে সাহায্য করে। একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে দ্বীনি শিক্ষার প্রভাব সুস্পষ্ট। তাই আমাদের উচিত, নিজেরা দ্বীনি শিক্ষার চর্চা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই শিক্ষায় আলোকিত করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ এবং তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

-মো. আকরাম হোসেন

শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৪।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৯।

[3]. তিরমিযী, হা/১১৬২, হাসান।

[4]. তিরমিযী, হা/৩৮৯৫, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/৩২৫২।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৩১।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮১।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৯।

[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০১৫; মিশকাত, হা/২৭৬০।

[9]. ছহীহুল জামে‘, হা/৪৫১৯।

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৯৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৯।

Magazine