নতুন বর্ষ এসেছে; জীবনে কোনো পরিবর্তনই আসেনি, শুধু সন লিখার ক্ষেত্রে ২৪ এর স্থলে ২৫ লিখা ব্যতীত। অথচ social network (fb, sms, email ইত্যাদি) আর মৌখিক শুভেচ্ছাবার্তাতে গোটা সমাজই ব্যতিব্যস্ত। মনে হয়, আবালবৃদ্ধবণিতা এ কাজেই ব্যস্ত। মাওলানাও বাদ যাননি। ইসলামের কথা বলেন, নিজে দ্বীনদার হিসেবে চলেন, এমন ব্যক্তিও আছেন এই কাতারে। অনেকে আবার বিগত বছরের কার্যাবলির ফিরিস্তিও দিচ্ছেন সাথে সাথে, পাশাপাশি নতুন বছরে ভালো কিছুর আশা। আবার অনেকে নববর্ষ উদযাপনেও ব্যস্ত; নাচ, গান, হৈ-হল্লা আর মত্ততায়। আপাতদৃষ্টিতে এসব খুবই ভালো ও সুন্দর শোনায়। এগুলো করলে আধুনিক, অপরের কল্যাণকামী আর নিদেনপক্ষে প্রগতিশীল বুঝা যায়। কিন্তু মুসলিম ভাইগণ! কখনো কি একটু চিন্তা করেছেন, এসব কী হচ্ছে, কী করছেন আপনি নিজে?
এ কথায় দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, নববর্ষ পালনের উৎসব অমুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকেই নেওয়া। মুসলিমদের ইতিহাসে নববর্ষের সূচনা হয়েছে কিংবা পালিত হয়েছে এমন কিছুই পাওয়া যায় না। এমন নয় যে, নতুন বর্ষ আসেনি; এবারই বা এই নতুন সভ্যতাতেই নববর্ষ আসছে। কোনো একটি হাদীছ কিংবা ইতিহাসে কি পাওয়া যায়, ছাহাবায়ে কেরাম নববর্ষ উপলক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে কোনো শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন, কোনো উৎসব পালন করেছেন? অথচ ছাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম-এর মতো কল্যাণকামী বন্ধু বা ভাই আজ পর্যন্ত আসেনি, আসবেও না। তাঁরা রাযিয়াল্লাহু আনহুম নিজেদের মধ্যে ‘সালাম’ই বলতেন। বিশ্বের মানুষ যে শান্তির জন্য হাহাকার করছে তা-ই অপরের জন্য কামনা করতেন। এর চাইতে বড় শুভেচ্ছাবার্তা আর কি হতে পারে? মনে রাখা দরকার, এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিনের অপেক্ষা তাঁরা রাযিয়াল্লাহু আনহুম করতেন না। দরজার আড়াল হলেই আবারও এই কল্যাণ কামনা করতেন। আর আমরা? শুভেচ্ছা দিই— শুভ নববর্ষ। এরা কতটুকু আন্তরিক নিজেদেরই প্রশ্ন করি?
ওহ, আরও একটা কথা, এই শুভেচ্ছাবার্তার কারণে আমরা সালামটাই ভুলে যাই। কোনো সুন্নাতের বিপরীতে যা আসে তা কোন শরীআতে বৈধ আল্লাহই জানেন!
অনেকে বলবেন, নববর্ষে অনৈসলামী কিছু না করলেই তো হলো! এমন নির্দোষ উদযাপনে বাধা কোথায়? তাদের চিন্তা-চেতনা সুন্দর, মানবিক তো বটেই। কিন্তু তারা এটা ভাবেন না যে, এই সংস্কৃতি কি আমাদের কোনো ভালো করতে পেরেছে? নাকি শুধু পোশাকি আচরণেই আমাদের উৎসাহিত করছে? আমাদের পূর্বপুরুষগণ কি এসব না করে খুব অকল্যাণে ছিলেন?
দ্বিতীয়ত, একটা দাবি, নববর্ষের এমন একটা উৎসব দেখান, যেখানে অনৈসলামী কার্যকলাপ নেই। সত্যি হলো, এসবে ইসলামী কিছুই থাকে না, পুরোটাই অনৈসলামী। অনৈসলামী সব অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে যদি কোনো অনুষ্ঠান করেন, সেখানে লোকজন যাবে তো? নাকি কুকুর আর কাক নিয়েই অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে?
তৃতীয়ত, সবকিছুকে কি ইসলামী বানানো যায়, নাকি বানানো উচিত? অর্থনীতি, সমাজনীতির ন্যায় দৈনন্দিন অপরিহার্য বিষয়কে ইসলামীকরণ করা যায়, করা উচিতও। কিন্তু যা অন্য ধর্মের বা অন্য সংস্কৃতির তা ইসলামীকরণ কেন? পূজা-অর্চনাকে ইসলামীকরণ করা কি ভালো শোনায়? (অন্য ধর্মাবলম্বীদের মনে আঘাত দেওয়া উদ্দেশ্য নয়)। এটা কি ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার প্রমাণ রাখে? স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, ইসলামের নিজস্ব কোনো সংস্কৃতি কি নেই?
চতুর্থত, নববর্ষ মানে নতুন এক বছরের সূচনা। ভালো, আমাদের জন্য বৎসর কোনটা। খ্রিষ্টীয়, বাংলা নাকি হিজরী। যদি তিনটাই মানি, তাহলে আমাদের বৎসর কত দিনে? নাকি এক বৎসরে তিনবার নববর্ষ? অনেকে হয়তো বলবেন, সবগুলোই আমাদের। সত্যিই, আসলেই আমাদের; আমাদের প্রয়োজনেই এগুলো সৃষ্ট। সেক্ষেত্রে আমাদের এই শুভকামনা হচ্ছে কিছুদিনের জন্য, এক বছরের নয়; কারণ কিছুদিনের মধ্যেই আরেকটা আসবে।
এখানে আরেকটা কথা, তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, যদি একটা মানতে হয়, তাহলে তিনটার কোনটা মানব? বাঙালি হিসেবে বাংলা সন মানাটাই স্বাভাবিক। আর মুসলিম হিসেবে, ইবাদতের সুবিধার্থে, হিজরী সন। তাহলে খ্রিষ্টীয় সন কেন ঘটা করে পালিত হয়? পাশ্চাত্যের অনুসরণে? পহেলা বৈশাখও ইদানীং আড়ম্বরেই পালিত হয়। অথচ পহেলা মুহাররম কোন দিক দিয়ে চলে যায় আমরা কেন জানি না? এরূপ পক্ষপাত কেন, তিনটাই তো আমাদের?
আসলে সত্য হলো, বর্তমান সভ্যতার (!) একমাত্র প্রতিপক্ষ হলো ইসলাম। আধুনিকতা যেখানে ধ্বংস আর সবলের সুবিধার কথা শোনায় সেখানে ইসলামই একমাত্র গোটা মানবজাতির মুক্তির কথা বলে। সুতরাং, যা-ই করো ইসলামের বিপক্ষে করো। ইসলামের নামে বা বেনামে মুসলিম স্বকীয়তা নষ্ট করার এই সব প্রচারণা ও প্ররোচনা আমাদের সমাজে আজ ব্যাপকাকারে প্রচলিত।
ছলেবলে-কৌশলে ইসলামের বিরোধিতার এই উদ্দেশ্য আজ আমরা মুসলিমরাই, অনেকাংশে আলেমগণও, বুঝতে পারছি না। আমাদের, মুসলিমদের, চিন্তা করা উচিত। নববর্ষে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী করতে বলেছেন আর ছাহাবীগণ কী করতেন? নতুন চাঁদ উঠলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু‘আ করতেন। নববর্ষে কিছু করতেন বলে আমি অন্তত জানি না। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!
* সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।