(মিন্নাতুল বারী- ২৩তম পর্ব)
হাদীছের তাখরীজ :
ইমাম বুখারী[1] রহিমাহুল্লাহ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ আল-মুসনাদী রহিমাহুল্লাহ থেকে। ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন ইমাম ইসহাক্ব ইবনু রাহওয়াইহ, ইবনু আবী উমার আল-আদানী থেকে ও আবদ ইবনু হুমাইদ রহিমাহুমুল্লাহ থেকে। তারা সকলে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন আব্দুর রাযযাক ইবনু হাম্মাম আছ-ছানআনী রহিমাহুল্লাহ থেকে। তিনি মা‘মার ইবনু রাশেদ রহিমাহুল্লাহ থেকে। ইমাম আব্দুর রাযযাক রহিমাহুল্লাহ-এর সূত্রে হাদীছটি বিভিন্ন সনদে ইবনু হিব্বান,[2] ত্বহাবী[3] ও ত্ববারানী[4] রহিমাহুমুল্লাহ নিজ নিজ গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারী[5] ও ইমাম তিরমিযী[6] রহিমাহুমাল্লাহ হাদীছটি আরো বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক ও লাইছ ইবনু সা‘দ রহিমাহুমাল্লাহ-এর সূত্রে। তারা উভয়ে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন ইউনুস ইবনু ইয়াযীদ আল-আয়লী রহিমাহুল্লাহ থেকে। ইমাম বুখারী,[7] ইমাম মুসলিম[8] ও ইমাম নাসাঈ[9] রহিমাহুমুল্লাহ হাদীছটি আরো বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন সূত্রে ইবরাহীম ইবনু সা‘দ আবূ ইসহাক্ব আয-যুহরী রহিমাহুল্লাহ থেকে। ইমাম বুখারী[10] রহিমাহুল্লাহ হাদীছটি আরো বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন সূত্রে উকাইল ইবনু খালেদ আল-আয়লী ও শুআইব রহিমাহুমাল্লাহ থেকে। তারা সকলেই (মা‘মার, ইউনুস, আবূ ইসহাক্ব, উকাইল ও শুআইব রহিমাহুমুল্লাহ) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন ইমাম যুহরী রহিমাহুল্লাহ থেকে। তিনি উবাইদুল্লাহ ইবনু আব্দিল্লাহ ইবনে উতবা ইবনে মাসঊদ রহিমাহুল্লাহ থেকে। তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে। তিনি আবূ সুফিয়ান ইবনু হারব রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে। হাদীছটি ইমাম যুহরী রহিমাহুল্লাহ ছাড়াও অন্য সনদে ইমাম ত্ববারানী[11] রহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন।
রাবী পরিচয়:
উল্লেখ্য, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু, ইমাম যুহরী ও উবাইদুল্লাহ রহিমাহুমাল্লাহ-এর পরিচয় পূর্বে চলে গেছে।
(১) আল-হাকাম ইবনু নাফে‘ রহিমাহুল্লাহ :
নাম : আল-হাকাম ইবনু নাফে‘ আল-বাহরানী রহিমাহুল্লাহ।
কুনিয়াত : আবুল ইয়ামান।
বংশ : হিমছী, বাহরানী।
মৃত্যু : ২২২ হিজরীতে।
শিক্ষকবৃন্দ : (১) আরতা ইবনুল মুনযির, (২) ছফওয়ান ইবনু আমর, (৩) উফাইর ইবনু মা‘দান, (৪) ইসমাঈল ইবনু আইয়াশ, (৫) সাঈদ ইবনু আব্দিল আযীয, (৬) শুআইব ইবনু আবী হামযাহ, (৭) ইয়াযীদ ইবনু সাঈদ ইবনে আছওয়ান, (৮) সাঈদ ইবনু সিনান আবূ মাহদী রহিমাহুমুল্লাহ।
ছাত্রবৃন্দ : (১) ইমাম বুখারী, (২) আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনে হাম্বাল, (৩) আলী ইবনুল মাদীনী, (৪) আমর ইবনু মানছূর আন-নাসাঈ, (৫) আবূ হাতেম মুহাম্মাদ ইবনু ইদরীস আর-রাযী, (৬) আবূ উবাইদা কাসেম ইবনু সাল্লাম, (৭) মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া আয-যুহলী, (৮) ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন রহিমাহুমুল্লাহ।
মন্তব্য : হাকাম ইবনু নাফে‘ রহিমাহুল্লাহ, এই নামে কুতুবে সিত্তাহতে মাত্র এই একজন রাবীই রয়েছেন। তিনি মযবূত ও গ্রহণযোগ্য।[12]
(২) শুআইব রহিমাহুল্লাহ :
নাম : শুআইব ইবনু আবী হামযাহ দীনার রহিমাহুল্লাহ।
উপাধি : হাফেয।
কুনিয়াত : আবুল বাশার।
বংশ : আল-হাফেয, আল-হিমছী, আল-কুরাইশী, আল-উমাবী (অলা হিসেবে)।
মৃত্যু : ১৬২ বা ১৬৩ হিজরীতে।
শিক্ষকবৃন্দ : (১) হাজ্জাজ ইবনু আরতা, (২) যায়েদ ইবনু আসলাম, (৩) আব্দুল্লাহ ইবনু যাকওয়ান, (৪) উরওয়া ইবনু যুবায়ের, (৫) মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম, (৬) মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির, (৭) নাফে‘, (৮) হিশাম ইবনু উরওয়া রহিমাহুমুল্লাহ।
ছাত্রবৃন্দ : (১) হাকাম ইবনু নাফে‘, (২) উছমান ইবনু সাঈদ, (৩) আমর ইবনু উছমান, (৪) মুহাম্মাদ ইবনু ইদরীস, (৫) ওয়ালীদ ইবনু মুসলিম, (৬) মুহাম্মাদ ইবনু সুলাইমান, (৭) ইছাম ইবনু খালেদ, (৮) ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ রহিমাহুমুল্লাহ।
মন্তব্য : ইমাম আহমাদ ও ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন রহিমাহুমাল্লাহ তার প্রশংসা করেছেন। তিনি মযবূত ও গ্রহণযোগ্য রাবী। ইবনু মাঈন রহিমাহুল্লাহ তাকে ইমাম যুহরী রহিমাহুল্লাহ-এর সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্র বলে ঘোষণা করেছেন। তথা ইমাম যুহরী রহিমাহুল্লাহ-এর হাদীছ সম্পর্কে তার জ্ঞান সবচেয়ে বেশি ও মযবূত ছিল।[13]
(৩) আবূ সুফিয়ান ইবনু হারব রযিয়াল্লাহু আনহু :
নাম : ছখর ইবনু হারব ইবনে উমাইয়া ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদে মানাফ।
কুনিয়াত : আবূ সুফিয়ান, আবূ হানযালা।
বংশ : কুরাশী, মাক্কী, উমাবী।
মৃত্যু : ৩২ হিজরীতে।
ছাত্রবৃন্দ : (১) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস, (২) ক্বায়েস ইবনু আবী হাযম, (৩) মুআবিয়া ইবনু আবী সুফিয়ান, (৪) আল-মুছাইয়্যাব ইবনু হুযন রযিয়াল্লাহু আনহুম।
তিনি আবূ জাহলের পরে কুরাইশদের সর্দার হিসেবে বিবেচিত হতেন। বদরের পরে সকল যুদ্ধে আবূ জাহলের মৃত্যুর কারণে তিনিই কুরাইশদের সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মক্কা বিজয়ের দিন সকালে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হুনাইন ও তায়েফ বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কন্যা উম্মু হাবীবা রযিয়াল্লাহু আনহা-কে বিবাহ করে তাকে সম্মানিত করেন। তথা তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শ্বশুর। তার আরেক সন্তান মুআবিয়া রযিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের খলীফাতুল মুসলিমীন ছিলেন এবং তার হাত ধরেই উমাইয়া খেলাফতের সূচনা হয়। এককথায় তিনি উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবীবা রযিয়াল্লাহু আনহা ও মুআবিয়া রযিয়াল্লাহু আনহু-এর পিতা। তায়েফের যুদ্ধে তার এক চোখ শহীদ হয়ে যায়। দ্বিতীয় চোখ ইয়ারমুকের যুদ্ধে লড়াই অবস্থায় শহীদ হয়। অতঃপর তিনি মদীনাতেই বসবাস করতেন। ৩৪ হিজরীতে ৮৮ বছর বয়সে মদীনাতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার ছালাতে জানাযায় ইমামতি করেন উছমান রযিয়াল্লাহু আনহু।[14]
বর্ণনার পার্থক্য :
আলোচ্য হাদীছে ৯টি প্রশ্নের উপর হেরাক্লিয়াসের মন্তব্য বর্ণিত হয়েছে। ছহীহ বুখারীর ২৮০৪ নম্বর হাদীছে অন্য সনদে বাকী দুটি উত্তরের উপর হেরাক্লিয়াসের মন্তব্য বর্ণিত হয়েছে। সেখান থেকে সংগ্রহ করে সারমর্ম অনুবাদে হেরাক্লিয়াসের মোট ১১টি মন্তব্য যুক্ত করা হয়েছে।
সনদের সূক্ষ্মতা :
(১) এই বর্ণনায় আবুল ইয়ামান ‘আখবারানা’ শব্দ দিয়ে তার শায়খ থেকে হাদীছ বর্ণনা করলেও তিনি মূলত সরাসরি এই হাদীছ তার শায়খ থেকে শুনেননি, বরং ইজাযা-এর মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন।
ইজাযার সংজ্ঞা : ইজাযা শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে অনুমতি দেওয়া। হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে অনেক সময় একজন মুহাদ্দিছের সকল হাদীছ তার মুখ থেকে সরাসরি শ্রবণের সময় থাকে না। সেক্ষেত্রে মুহাদ্দিছ তার ছাত্রকে তার লিখিত পাণ্ডুলিপি থেকে হাদীছ বর্ণনা করার যে অনুমতি দেন তাকেই ইজাযা বলে। ধীরে ধীরে এই ইজাযার ব্যবহার অনেক ব্যাপক আকার ধারণ করে। এমনকি ফতওয়া দেওয়ার অনুমতি, দারস দেওয়ার অনুমতি, উস্তাযের নিকট থেকে পঠিত বই পড়ানোর অনুমতি, পবিত্র কুরআনের ক্বেরাআতের অনুমতি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে ইজাযার ব্যবহার শুরু হয়, যা বর্তমানেও অব্যাহত আছে। আমাদের এই হাদীছে ইজাযা মূলত সংজ্ঞায় উল্লিখিত হাদীছের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মুহাদ্দিছগণের ইজাযা উদ্দেশ্য। তথা আলোচ্য রাবী আবুল হাকাম সরাসরি শুআইবের মুখ থেকে সকল হাদীছ শ্রবণ করেননি। বরং তার পাণ্ডুলিপি থেকে বর্ণনার অনুমতি নিয়ে সেখান থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। শুআইব থেকে আবুল হাকামের ইজাযাকে সকল মুহাদ্দিছ গ্রহণযোগ্য মন্তব্য করেছেন।[15]
উল্লেখ্য, ইজাযার ক্ষেত্রে কখনো মুহাদ্দিছগণ أجازني (আজাযানী) আবার কখনো أنبأني (আনবায়ানী) ব্যবহার করে থাকেন। তবে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ এই হাদীছে ‘আখবারানী’ই ব্যবহার করেছেন।
(২) এই হাদীছটি আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু-কে আবূ সুফিয়ান রযিয়াল্লাহু আনহু নিজে শুনিয়েছেন। আবূ সুফিয়ান রযিয়াল্লাহু আনহু হাদীছটি গ্রহণ করেছেন বা ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন কাফের অবস্থায় এবং ঘটনা বর্ণনা করেছেন মুসলিম অবস্থায়।
(চলবে)
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৫১, ২৬৮১, ২৮০৪, ২৯৪০, ২৯৭৮, ৩১৭৪, ৪৫৫৩, ৫৯৮০, ৬২৬০, ৭১৯৫।
[2]. ইবনু হিব্বান, হা/৬৫৫৫।
[3]. ত্বহাবী, হা/৫১৩, ১৩৮০, ১৯৭৭, ১৯৮০।
[4]. ত্ববারানী, হা/৭২৬৯, ৭২৭৪।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৫১, ২৬৮১, ২৮০৪, ২৯৪০, ২৯৭৮, ৩১৭৪, ৪৫৫৩, ৫৯৮০, ৬২৬০, ৭১৯৫।
[6]. তিরমিযী, হা/২৭১৭।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৫১, ২৬৮১, ২৮০৪, ২৯৪০, ২৯৭৮, ৩১৭৪, ৪৫৫৩, ৫৯৮০, ৬২৬০, ৭১৯৫।
[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৭৩।
[9]. নাসাঈ কুবরা, হা/১০৯৯৮।
[10]. ছহীহ বুখারী, হা/৫১, ২৬৮১, ২৮০৪, ২৯৪০, ২৯৭৮, ৩১৭৪, ৪৫৫৩, ৫৯৮০, ৬২৬০, ৭১৯৫।
[11]. ত্ববারানী, হা/৭২৬৯, ৭২৭৪।
[12]. আল-জারহ ওয়াত তা‘দীল, ৩/১২৯।
[13]. তাহযীবুল কামাল, ১২/৫২০।
[14]. ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তী‘আব, ১/১৯০।
[15]. তাহযীবুত তাহযীব, ১/৪৭০।