কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ক্ষমার আদর্শে রাসূল (ছা.)

post title will place here

ক্ষমা ছোট্ট একটি শব্দ; কিন্তু এই গুণটি মহৎ হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিদের আদর্শিক শক্তির উৎস। উদার ব্যক্তিবর্গের অন্যতম একটি গুণ হলো ক্ষমা করা। সমাজে ওই ব্যক্তিকেই মহৎ গুণের অধিকারী বলা হয়, যার মধ্যে ‘ক্ষমা’ করার মতো সৌজন্যবোধ আছে। আপনার প্রতিশোধ গ্রহণ করার সামর্থ্য আছে কিন্তু প্রতিশোধ না নিয়ে মাফ করে দেওয়াই হলো প্রকৃত অর্থে ক্ষমা। ক্ষমা না করে প্রতিশোধ নেওয়ার দ্বারা অধিকাংশ সময় ফয়সালা হয় না। কেননা প্রতিশোধের স্পৃহা আসে রাগ, হিংসা, অহংকার থেকে। মানবজাতির ভ্রাতৃত্ব ধ্বংসকারী এই সমস্ত অসৎ গুণের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা নিজেকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন। ক্রোধ, রাগ, দাম্ভিকতা আল্লাহর পছন্দ নয়। রাগকে যারা দমন করতে পারেন, আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন। আল্লাহ বলেন,﴿الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الْكٰظِمِیْنَ الْغَیْظَ وَ الْعَافِیْنَ عَنِ النَّاسِ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ﴾ ‘সচ্ছল হোক কিংবা অসচ্ছল সর্বাবস্থায় যারা (আল্লাহর পথে) নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, যারা নিজেদের ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষের অপরাধসমূহ যারা ক্ষমা করে দেয়; (আসলে) ভালো মানুষদের আল্লাহ (সর্বদাই) ভালোবাসেন’ (আলে ইমরান, ৩/১৩৪)

উদার হৃদয়ের অধিকারী ক্ষমাশীল ব্যক্তিকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সবসময় ভালোবাসেন। ক্ষমার আদর্শে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সবার সেরা। অপরের ভুলত্রুটি ক্ষমা করা এবং অন্যের অসদাচরণের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করা মুমিনের অনন্য একটি গুণ। একটি নষ্ট আচরণ বা অন্যায় দূর করতে রাগ-ক্রোধ, কঠোর আচরণ, বদমেজাজ ও প্রতিশোধপরায়ণতা যতটুকু কাজে আসে, তার থেকে শতগুণ বেশি কাজে আসে ক্ষমা করার দ্বারা। তাই ক্ষমাকে একটি মহৎ গুণ বলা হয়েছে। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নযির স্থাপন করেন। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন,يا معشر قريش: ما تظنون أني فاعل بكم؟ قالوا أخ كريم، ابن أخ كريم، قال: فاذهبوا فأنتم الطلقاء‎ ‘হে কুরাইশগণ! তোমরা আমার কাছ থেকে আজ কেমন ব্যবহার আশা কর? তারা বলল, সম্মানিত ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্রের মতো। তিনি বললেন, তোমরা চলে যাও! আজ তোমরা মুক্ত’।[1]

মক্কা বিজয়ের পূর্ব ইতিহাসে যদি আমরা একটু নযর দিয়ে দেখি, তাহলে দেখতে পাব রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন তখন তৎকালীন কাফের-মুশরেকরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কী ধরনের আচরণ করেছিল! কত কঠিন ও ভয়ংকর যুলুম নির্যাতন করেছে, কত অত্যাচার করেছে, তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। এ সবকিছুকে কেন্দ্র করে আল্লাহ তাআলা একসময় তাকে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে যেতে বললেন। মদীনায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো, তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে আবার জন্মভূমি মক্কায় ফিরে এসে মক্কা বিজয় করলেন, মক্কার ক্ষমতা তার হাতে আসল। যেদিন তিনি ক্ষমতা পেলেন তার ক্ষমাশীলতার আদর্শ সেদিন মানুষের কাছে আরো সুস্পষ্ট হয়ে গেল। তারা তাকে অনেক অত্যাচার-নির্যাতন, তিরস্কার, সামাজিকভাবে বয়কট করা এমনকি হত্যার চেষ্টা করা সত্ত্বেও তিনি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এই ধরনের ক্ষমাশীল। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এই ধরনের ক্ষমাশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,﴿خُذِ الْعَفْوَ وَ اْمُرْ بِالْعُرْفِ وَ اَعْرِضْ عَنِ الْجٰهِلِیْنَ﴾ ‘হে নবী! কোমলতা ও ক্ষমার পথ অবলম্বন করুন। সৎকাজের উপদেশ দিতে থাকুন এবং মূর্খদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখুন’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৯৯)

আখেরী যামানার নবী আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বোত্তম ক্ষমাশীল। ক্ষমাশীলতার আদর্শে তাঁর জীবনের বহু ঘটনা আমাদের অনুপ্রেরণা। তার মাদানী জীবনের স্বল্প পরিসরে ক্ষমার কিছু দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি মক্কা বিজয়ের ঘটনায়। এই ধরনের ঘটনা ইতিহাসে তার ক্ষমার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। তার মাক্কী জীবনের ছোট্ট একটি ঘটনার প্রতি চোখ বুলিয়ে আসি। নবুঅতী জীবনের শুরুর দিকে তিনি যখন তায়েফে উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। তখন পাশের খাদেম বলেছিল, আপনি তাদের জন্য বদ দু‘আ করুন তারা যেন ধ্বংস হয়ে যায়। জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে বললেন, আপনি হুকুম দিন! তায়েফের দুপাশের পাহাড় এক করে দিয়ে তায়েফবাসীকে পিশে ধ্বংস করে দিই। কিন্তু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী বললেন? না! আমি বদ দু‘আ করার জন্য প্রেরিত হয়নি। আমি রহমত হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। অবলীলায় ক্ষমা করে দিলেন ওই জঘন্য মানুষগুলোকে। এ কারণেই তাকে বলা হয়েছে আদর্শের মূর্তপ্রতীক। মানবসভ্যতার ইতিহাসে তাঁর মতো এমন উদার ও ক্ষমাশীল মানুষ আর ছিল না, এখনও নেই আর কিয়ামত পর্যন্ত আসবেও না।

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য ক্ষমার উত্তম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। আর তিনি যেহেতু আমাদের জন্য শিক্ষক, তাই তার এই শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদেরকেও হতে হবে ক্ষমাশীল। কেউ বারবার অসদাচরণ করার পরেও যদি তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, তাহলে একসময় সে তার ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে শুধরে নেয়। ক্ষমা করার এই মানসিকতা যদি আমরা সমাজে লালন করতে পারি, তবে আমাদের সমাজ আরও সুন্দর হবে ইনশাআল্লাহ।

এম. আব্দুল মজেদ মারুফ

 আলোচক, লেখক ও সাংবাদিক।


[1]. তাফসীরে খাযান, ৭ম খণ্ড, ৩১৩ পৃ.।

Magazine