দিন যায় দিন আসে। মাস যায় মাস আসে। বছর ঘুরে নতুন বছর আসে। একটা আশা পূরণ হয়, নতুন আরেকটি আশা-আকাঙ্ক্ষা মনে জাগে। প্রতীক্ষিত প্রহরের জন্য অপেক্ষা করতে করতে শেষ হয় দিনরাত্রি। এভাবে একসময় ধ্রুব সত্য মৃত্যু এসে কড়া নাড়ে জীবন নামক ঘরের দ্বারে। কী আমল করলাম এ সময়ে, একটু দেখার সুযোগ হয়েছে কি পিছন ফিরে? একটু ফুরসত হয়েছে কি রবের ডাকে সাড়া দিয়ে মসজিদ পানে ছুটে যাওয়ার? নাকি দুনিয়া নিয়ে মজে থেকেছি সারাক্ষণ? আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু উপদেশস্বরূপ কতই না সুন্দর কথা বলেছেন,ارْتَحَلَتِ الدُّنْيَا مُدْبِرَةً وَارْتَحَلَتِ الْآخِرَةُ مُقْبِلَةً وَلِكُلِّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا بَنُونَ فَكُونُوا مِنْ أَبْنَاءِ الْآخِرَةِ وَلَا تَكُونُوا مِنْ أَبْنَاءِ الدُّنْيَا فَإِنَّ الْيَوْمَ عَمَلٌ وَلَا حِسَابَ وَغَدًا حِسَابٌ وَلاَ عَمَلَ ‘ইহকাল পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে চলে যাচ্ছে এবং পরকাল সম্মুখে এগিয়ে আসছে আর এদের প্রত্যেকেরই অনুসারী রয়েছে। তবে তোমরা পরকালের অনুসারী হও, ইহকালের গোলাম হয়ো না। কেননা আজ আমলের সময়, এখানে কোনো হিসাব নেই। কিন্তু আগামীকাল হিসাবনিকাশ হবে, সেখানে কোনো আমলের সুযোগ থাকবে না’।[1]
প্রিয় ভাই! আমাদের মাঝ থেকে চলে গেল পুরো একটি বছর। জীবন নামক বাগান থেকে হারিয়ে ফেললাম আরেকটি বসন্ত। কী করলাম এই সময়ে, একটু পিছন ফিরে দেখুন তো। ভালো আমল করতে পেরেছি তো নাকি পাপের খাতাই শুধু পূর্ণ করেছি? মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং প্ৰত্যেকটি নাফস (ব্যক্তি) যেন লক্ষ্য করে যে, আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; তোমরা যা করো, নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত’ (আল-হাশর, ৫৯/১৮)।
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘একদিন জিবরীল আলাইহিস সালাম আমার কাছে এসে বললেন, يَا مُحَمَّدُ، عِشْ مَا شِئْتَ فَإِنَّكَ مَيِّتٌ، وَاعْمَلْ مَا شِئْتَ فَإِنَّكَ مَجْزِيٌّ بِهِ، وَأَحْبِبْ مَنْ شِئْتَ فَإِنَّكَ مُفَارِقُهُ ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি যতদিন ইচ্ছা বেঁচে থাকুন; তবে জেনে রাখুন, আপনাকে মরতে হবে। যা ইচ্ছা আমল করুন; তবে মনে রাখুন, তার প্রতিদান আপনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পাবেন। যার সাথে ইচ্ছা ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন; তবে জেনে রাখুন, একদিন তাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে’।[2]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِنْ قَبْلِكَ الْخُلْدَ ‘আপনার পূর্বেও আমি কোনো মানুষকে চিরস্থায়ী করিনি’ (আল-আম্বিয়া, ২১/৩৪)। তিনি আরও বলেন,وَلِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ ‘আর প্রত্যেক জাতির জন্য এক নির্দিষ্ট সময় আছে। অতঃপর যখন তাদের সময় আসবে, তখন তারা মুহূর্তকাল দেরি করতে পারবে না এবং এগিয়েও আনতে পারবে না’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৩৪)।
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন,اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ : شَبَابَكَ قَبْلَ هِرَمِكَ وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ ‘পাঁচটি বস্তুকে পাঁচটির পূর্বে গনীমত জেনে মূল্যায়ন করো— ১. বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবনকে, ২. অসুস্থতার পূর্বে তোমার সুস্থতাকে, ৩. দরিদ্রতার পূর্বে তোমার সচ্ছলতাকে, ৪. ব্যস্ততার পূর্বে তোমার অবসরকে এবং ৫. মরণের পূর্বে তোমার জীবনকে’।[3]
সুধী পাঠক! একটু ভেবে দেখুন তো, কেন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন? কী ছিল তাঁর অভিপ্রায়?
তিনি তো আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য। সকল ত্বাগূতকে বর্জন করে ইখলাছের সাথে শুধু তাঁরই দাসত্ব করার জন্য। যেমনটি কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল’ (আল-মুলক, ৬৭/২)।
যদি আমরা পুরো বছরটিকে আল্লাহর ইবাদতমূলক কাজে লাগিয়ে থাকি, তাহলে তো আল-হামদুলিল্লাহ আর যদি না পারি, তাহলে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ইসতিগফার করি, ক্ষমাপ্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে ক্ষমা করেন, ভুলত্রুটিগুলো মাফ করে দেন এবং নতুন বছরে অঙ্গীকারবদ্ধ হই এ বছরটিকে আল্লাহর ইবাদতমূলক কাজে ব্যয় করব, ইনশা-আল্লাহ।
নতুন বছরে যেমন হওয়া উচিত একজন মুসলিমের অঙ্গীকার:
(১) সর্বদায় আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে চলা, সাধ্যানুযায়ী পুণ্যের কাজ করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা। অর্থাৎ প্রকৃত মুমিন হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে কোনো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০২)।
আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একজন বেদুঈন ব্যক্তি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে ক্বিয়ামত কখন হবে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,مَا أَعْدَدْتَ لَهَا قَالَ مَا أَعْدَدْتُ لَهَا مِنْ كَثِيرِ صَلاَةٍ وَلاَ صَوْمٍ وَلاَ صَدَقَةٍ وَلَكِنِّي أُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ قَالَ أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ ‘তুমি এর জন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ?’ তিনি বললেন, ‘আমি এর জন্য তো অধিক ছালাত, ছওম এবং ছাদাক্বা আদায় করতে পারিনি; কিন্তু আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি’। তিনি বললেন, ‘তুমি যাকে ভালোবাস, তারই সাথী হবে’।[4]
(২) আক্বীদা বিশুদ্ধ করা। কারণ—
(ক) সঠিক আক্বীদা পোষণ করা ইসলামের যাবতীয় কর্তব্যসমূহের মাঝে সবচেয়ে বড় কর্তব্য। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রাসূল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়’।[5]
(খ) ঈমান সাধারণভাবে সমস্ত দ্বীন ইসলামকেই অন্তর্ভুক্ত করে আর আক্বীদা দ্বীনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় তথা অন্তরের অবিমিশ্র স্বীকৃতি ও আমলে তা যথার্থ বাস্তবায়নকে নিশ্চিত করে।
(গ) আক্বীদার সাথে সংশ্লিষ্ট পাপ তথা শিরক এমন ধ্বংসাত্মক যে, পাপী তওবা না করে মারা গেলে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।
(ঘ) আক্বীদা সঠিক থাকলে কোনো পাপী ব্যক্তি জাহান্নামে গেলেও চিরস্থায়ীভাবে সেখানে থাকবে না, বরং একসময় সে মুক্তি পাবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘ক্বিয়ামতের দিন যখন আমাকে সুপারিশ করার অনুমতি দেওয়া হবে, তখন আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক! যার অন্তরে এক সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে, তাকে তুমি জান্নাতে দাখিল করো। তারপর তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করা হবে। তারপর আমি বলব, তাকেও জান্নাতে প্রবেশ করাও, যার অন্তরে সামান্য ঈমানও আছে’।[6] অর্থাৎ সঠিক আক্বীদার কারণে একজন সর্বোচ্চ পাপী ব্যক্তিও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জাহান্নামে অবস্থানের পর জান্নাতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে।
(ঙ) আক্বীদা সঠিক না থাকলে সৎ আমলকারীকেও জাহান্নামে যেতে হবে। যেমন- একজন মুনাফেক্ব বাহ্যিকভাবে ঈমান ও সৎ আমল করার পরও অন্তরে কুফরী পোষণের কারণে সে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে। একই কারণে একজন কাফের সারাজীবন ভালো আমল করা সত্ত্বেও ক্বিয়ামতের দিন সে তার দ্বারা উপকৃত হতে পারবে না। কেননা তার বিশ্বাস ছিল ভ্রান্তিপূর্ণ।
(চ) সমকালীন মুসলিম সমাজের দিকে তাকালে আক্বীদার গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুভব করা যায়। তাদের মাঝে যেমন বহু লোক কবরপূজায় ব্যস্ত, তেমনি লিপ্ত হরহামেশা তাওহীদ পরিপন্থি ও শিরকী কার্যকলাপে। কেউবা ব্যস্ত নিত্য-নতুন ‘মাহদী’, ‘মাসীহ’ আবিষ্কারের প্রচেষ্টায়। মূর্তিপূজার স্থলে এখন আবির্ভাব হয়েছে শহীদ মিনার, স্তম্ভ, ভাস্কর্য, শিখা অনির্বাণ, প্রতিকৃতি ইত্যাদি শিরকী প্রতিমূর্তি। এগুলো সবই সঠিক আক্বীদা সম্পর্কে অজ্ঞতার দুর্ভাগ্যজনক ফল। অন্যদিকে আক্বীদায় দুর্বলতা থাকার কারণে মুসলিম পণ্ডিতদের চিন্তাধারা ও লেখনীর মাঝে শারঈ সূত্রগুলোর উপর নিজেদের জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা এবং বুদ্ধির মুক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতার নামে কুফরী বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধার দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি যুক্তিবাদী ও শৈথিল্যবাদী ধ্যানধারণার জন্মও নিচ্ছে, যার স্থায়ী প্রভাব পড়ছে পাঠকদের উপর। এভাবেই আক্বীদা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব আমাদের পথভ্রষ্ট করে ফেলছে প্রতিনিয়ত।
(৩) যথাসময়ে ছালাত আদায় করা। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنَّ نَهَرًا بِبَابِ أَحَدِكُمْ يَغْتَسِلُ فِيهِ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسًا مَا تَقُولُ ذَلِكَ يُبْقِي مِنْ دَرَنِهِ قَالُوا لاَ يُبْقِي مِنْ دَرَنِهِ شَيْئًا قَالَ فَذَلِكَ مِثْلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ يَمْحُو اللَّهُ بِهَا الْخَطَايَا ‘বলো তো, যদি তোমাদের কারো বাড়ির সামনে একটি নদী থাকে আর সে তাতে প্রত্যহ পাঁচবার গোসল করে, তাহলে কি তার শরীরে কোনো ময়লা থাকবে?’ তারা বললেন, ‘তার দেহে কোনোরূপ ময়লা বাকি থাকবে না’। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এ হলো পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের উদাহরণ, এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বান্দার গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেন’।[7]
(৪) যাকাতের নিছাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ‘তোমরা ছালাত কায়েম করো এবং যাকাত দাও’ (আল-বাক্বারা, ২/৪৩)।
(৫) রামাযানের ছিয়াম পালন করা। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৩)।
(৬) আল্লাহ তাআলা যা হালাল করেছেন, সেগুলো হালাল হিসেবে গ্রহণ করা। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘হে মানুষ! আল্লাহ তাআলা পবিত্র, তিনি পবিত্র ও হালাল বস্তু ছাড়া গ্রহণ করেন না আর আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রেরিত রাসূলদের যে হুকুম দিয়েছেন মুমিনদেরকেও সে হুকুম দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র ও হালাল জিনিস আহার করো এবং ভালো কাজ করো। আমি তোমাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে জ্ঞাত’ (আল-মুমিনূন, ২৩/৫১)। তিনি (আল্লাহ) আরও বলেছেন, ‘তোমরা যারা ঈমান এনেছ শোন! আমি তোমাদের যেসব পবিত্র জিনিস রিযিক্ব হিসেবে দিয়েছি, তা খাও’ (আল-বাক্বারা, ২/১৭২)। অতঃপর তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সফর করে। ফলে সে ধুলো ধূসরিত রুক্ষ কেশধারী হয়ে পড়ে। অতঃপর সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং তার দেহ হারাম দ্বারা গঠিত; কাজেই এমন ব্যক্তির দু‘আ কীভাবে কবুল হতে পারে?’।[8]
(৭) আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন এমন যাবতীয় কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। হাদীছে এসেছে, এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাকে এমন কাজের নির্দেশ দিন, যা করলে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারি। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করো না, ফরয ছালাত ক্বায়েম করো, নির্ধারিত যাকাত আদায় করো এবং রামাযানের ছিয়াম পালন করো’। সে লোকটি বললেন, সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! আমি কখনো এর মধ্যে বৃদ্ধি করব না আর তা থেকে কমতিও করব না। লোকটি যখন চলে গেলেন, তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যদি কেউ কোনো জান্নাতী লোক দেখে আনন্দিত হতে চায়, সে যেন এ ব্যক্তিকে দেখে নেয়’।[9]
(৮) সাধ্যানুযায়ী প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াত করা, যিকির-আযকার করা। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক অংশ, আল-হামদুলিল্লাহ মীযানের পরিমাপকে পরিপূর্ণ করে দিবে এবং সুবহানাল্লাহ ওয়াল-হামদুলিল্লাহ আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থানকে পরিপূর্ণ করে দিবে। ছালাত হচ্ছে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি। ছাদাক্বা হচ্ছে দলীল। ধৈর্য হচ্ছে জ্যোতির্ময় আর আল-কুরআন হবে তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে প্রমাণস্বরূপ। বস্তুত সকল মানুষই প্রত্যেক ভোরে নিজেকে আমলের বিনিময়ে বিক্রি করে। তার আমল দ্বারা সে নিজেকে (আল্লাহর আযাব থেকে) মুক্ত করে অথবা সে তার নিজের ধ্বংস সাধন করে’।[10]
(৯) আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করা। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন,وَأَنِيبُوا إِلَى رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُ ‘আর তোমরা তোমাদের প্রভুর অভিমুখী হও এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করো’ (আয-যুমার, ৩৯/৫৪)।
(১০) পাপের কাজ থেকে বিরত থাকা। কখনো শয়তানের প্ররোচনায় পাপ হয়ে গেলেও তার পরে ভালো কাজ করা এবং আল্লাহর কাছে কৃত পাপের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,اتَّقِ اللَّهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ ‘তুমি যেখানেই থাকো আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো, মন্দ কাজের পরপরই ভালো কাজ করো, তাতে মন্দ দূরীভূত হয়ে যাবে এবং মানুষের সাথে উত্তম আচরণ করো’।[11]
পরিশেষে আল্লাহ তাআলার কাছে দু‘আ করি, তিনি যেন আমাদেরকে আগামী দিনগুলো ঈমান ও আমলের সাথে অতিবাহিত করার তাওফীক্ব দান করেন এবং বিগত দিনের কৃত ভুলত্রুটিগুলো তাঁর ক্ষমা ও রহমতের চাদর দিয়ে ঢেকে নেন- আমীন!
কুল্লিয়া ১ম বর্ষ, মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
[1]. ছহীহ বুখারী, ২১/২৬৯; মিশকাত, হা/৫২১৫।
[2]. হাদীছটি ত্ববারানী বর্ণনা করেছেন। হাদীছ হাসান। ইমাম আলবানী সিলসিলা ছহীহার মধ্যে হাসান বলেন।
[3]. হাকেম, হা/৭৮৪৬; বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান, হা/১০২৪৮; ছহীহুল জামে‘, হা/১০৭৭।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৭১।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২২।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৫০৯।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৮।
[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৩৬।
[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫।
[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪২২।
[11]. তিরমিযী, হা/১৯৮৭।