১. উপস্থাপনা
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সকল জ্ঞানের উৎস। এই সর্বশেষ আসমানী প্রত্যাদেশে ৭৫০টিরও অধিক বিজ্ঞান নির্দেশক আয়াত থাকলেও এটি বিজ্ঞানের কোনো গ্রন্থ নয়। আল্লাহ তাআলা এই গ্রন্থ শুধু মানুষের হেদায়াতের জন্য অবতীর্ণ করেছেন (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)। এখানে ভূগোলশাস্ত্রসংক্রান্ত অনেক আয়াত ও তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। বিভিন্ন আয়াতে ভূগোল চর্চার অনুপ্রেরণার সাথে সাথে বিভিন্ন ভৌগলিক স্থান, ভৌগলিক তত্ত্ব ও ভূগোল চর্চায় আত্মনিয়োগ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশনা আলোচনা করা হলো।
২. আল-কুরআনে ভূবিজ্ঞান
একবিংশ শতাব্দী জ্ঞান-বিজ্ঞানের শতাব্দী। শেষ নবীর উম্মতগণ জ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির চরম শিখরে আরোহণ করবে, এই বিষয়ে আল্লাহ তাআলা আগে থেকেই জানেন। এজন্য কিছু ক্লু তিনি প্রত্যাদেশে সংযোজন করে মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার লাগাম টেনেছেন। নিম্নে আল-কুরআনে বর্ণিত ভূগোল ও ভূবিজ্ঞান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
২.১ ভূপৃষ্ঠ ভূগোলের মূল উপাদান
ভূপৃষ্ঠের মাটির গঠন-প্রকৃতি হলো এটি সহজে খনন করা যায়। সমতল করে পথ তৈরি করা যায়। মাটি পানিতে গলে নরম হয়। আবার শুকালে শক্ত হয়। মাটি সহজে ভাঙা যায়। মাটির এই প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণ হলো মাটিতে অনেকগুলো রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ রয়েছে। অক্সিজেন, সিলিকন, আয়রন, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে বিদ্যমান থাকায় মাটির নমনীয় বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়। এর উর্বরতা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি মাটিকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করে মানুষ প্রয়োজনীয় সুবিধা গ্রহণ করছে। মাটি বিদীর্ণ করে উঠা বৃক্ষ, তরুলতা আর ক্ষেতের ফসল নানারকম খাদ্য উৎপন্ন করে। সৃষ্টিকুলে এ বৈচিত্র্য এনেছেন দয়াময় আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি নিপুণতার আলোকে। মহান আল্লাহ বলেন﴾هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِن رِّزْقِهِ وَإِلَيْهِ النُّشُورُ﴿ ‘তিনি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে সুগম করেছেন। অতএব, তোমরা তার কাঁধে বিচরণ করো এবং তাঁর দেওয়া রিযিক্ব আহার করো। তাঁরই কাছে পুনরুজ্জীবন হবে’ (আল-মুলক, ৬৭/১৫)।
২.২ পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় সৃষ্টি
আধুনিক ভূবিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে, ভূমির উপর পাহাড়গুলো পেরেকের মতো প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভূপৃষ্ঠে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে এবং ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে পৃথিবীবাসী অনেকখানি রক্ষা পেয়েছে। সেজন্য পৃথিবীময় ধ্বনি উঠেছে পাহাড় যেন না কাটা হয়। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনের বাণী প্রণিধানযোগ্য। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন,﴾وَأَلْقَى فِي الأَرْضِ رَوَاسِيَ أَن تَمِيدَ بِكُمْ وَأَنْهَارًا وَسُبُلاً لَّعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ﴿ ‘আর তিনি পৃথিবীর উপর বোঝা রেখেছেন যে, কখনো যেন তা তোমাদেরকে নিয়ে হেলে-দুলে না পড়ে এবং নদী ও পথ তৈরি করেছেন, যাতে তোমরা পথ প্রদর্শিত হও’ (আন-নাহল, ১৬/১৫)।
২.৩ পৃথিবী বসবাসের জায়গা
মহান আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষের জন্য বসবাসের জায়গা সৃষ্টি করেছেন। মানুষ এই পৃথিবীতে বসবাস, চলাচল, ভূপৃষ্ঠ ব্যবহার করে খাদ্য উপকরণ তৈরি করছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,﴾الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ مَهْدًا وَسَلَكَ لَكُمْ فِيهَا سُبُلًا وَأَنزَلَ مِنَ السَّمَاء مَاء فَأَخْرَجْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّن نَّبَاتٍ شَتَّى﴿ ‘তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে শয্যা করেছেন এবং তাতে চলার পথ করেছেন, আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন এবং তা দ্বারা আমি বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি’ (ত্ব-হা, ২০/৫৩)।
২.৪ ঋতুর পরিবর্তন
ঋতুর পরিবর্তনে সূর্য ও পৃথিবীর ভূমিকা অপরিসীম। সূর্য ও পৃথিবীকে আল্লাহ তাআলা যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর একথার উপরে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ সূর্যের নিজ কক্ষপথে চলার গতিবেগের হিসাব দিয়েছেন এবং তার কক্ষপথের দূরত্বের হিসাবও দিয়েছেন। তাদের মতে, সূর্য প্রতিদিন তার কক্ষপথে চলে ১২৯ কোটি ৬০ লক্ষ মাইল। এভাবে ২৫ কোটি বছরে তার কক্ষপথ একবার অতিক্রম করে। আশ্চর্যের বিষয় হলো সূর্যও যেমন দাঁড়িয়ে নেই; তেমনি সূর্য থেকে পৃথিবী তার দূরত্ব বজায় রেখে সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে পৃথিবীও চলছে। তাও চলছে এমনভাবে যেন সূর্যের চারপাশ দিয়ে ঘোরার সময় পথটা বৃত্তাকার না হয়ে ডিম্বাকার হয়। পৃথিবী নিজ মেরুদণ্ডের উপর সব সময় ঘূর্ণায়মান আছে। আর ঘূর্ণায়নের ফলে হয় ঋতু পরিবর্তন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,﴾لَا الشَّمْسُ يَنبَغِي لَهَا أَن تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ﴿ ‘সূর্য নাগাল পেতে পারে না চন্দ্রের এবং রাত্রি অগ্রে চলে না দিনের। প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণ করে’ (ইয়াসীন, ৩৬/৪০)।
২.৫ আবহাওয়ার পূর্বাভাস
পৃথিবীতে ঝড়, বৃষ্টি, সাইক্লোন প্রভৃতি শুরু হওয়ার আগে এমন একটি বায়ু প্রবাহিত হয়, যার মধ্য থেকে মেটোরোগ্রাফস অঙ্কন করা যায়। অর্থাৎ তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুর গতিবেগ, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, বজ্রবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতির সার্বিক মানচিত্র পাওয়া যায় এবং এ মানচিত্র অগ্রিম দেওয়ার নাম আবহাওয়ার পূর্বাভাস। পবিত্র কুরআন এটাকে বলেছে সুসংবাদবাহী পূর্বাভাস। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,﴾وَأَرْسَلْنَا الرِّيَاحَ لَوَاقِحَ فَأَنزَلْنَا مِنَ السَّمَاء مَاء فَأَسْقَيْنَاكُمُوهُ وَمَا أَنتُمْ لَهُ بِخَازِنِينَ﴿ ‘আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু পরিচালনা করি অতঃপর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি, এরপর তোমাদেরকে তা পান করাই। বস্তুত তোমাদের কাছে এর ভাণ্ডার নেই’ (আল-হিজর, ১৫/২২)।
২.৬ মেঘমালা সৃষ্টি
এ মহাশূন্যে তৈরি হয় মেঘমালা। আর তা থেকে বর্ষিত হয় বৃষ্টি। জলীয়বাষ্প থেকে মেঘ সৃষ্টি হয়। জলীয়কণা যখন সাগর, নদ-নদী, খাল-বিল থেকে বাষ্পাকারে উপরে উঠে, তখন সেটা চারপাশের বায়ুস্তরের চেয়ে হালকা হয়ে যায়। ফলে জলীয়বাষ্প উৎপন্ন হয়েই উপরের দিকে উঠতে থাকে। আবার ঊর্ধ্বগামী বায়ুপ্রবাহ ক্রমশ শীতল হয়ে আসে এবং ঘনীভূত হওয়ার মাধ্যমে সেটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পানিকণায় পরিণত হয়। নির্দিষ্ট উচ্চতায় ও তাপে মেঘমালা তৈরি হয় এবং বিশেষ সময়ে মেঘমালা থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,﴾أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يُزْجِي سَحَابًا ثُمَّ يُؤَلِّفُ بَيْنَهُ ثُمَّ يَجْعَلُهُ رُكَامًا فَتَرَى الْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلَالِهِ وَيُنَزِّلُ مِنَ السَّمَاء مِن جِبَالٍ فِيهَا مِن بَرَدٍ فَيُصِيبُ بِهِ مَن يَشَاء وَيَصْرِفُهُ عَن مَّن يَشَاء يَكَادُ سَنَا بَرْقِهِ يَذْهَبُ بِالْأَبْصَارِ﴿‘আপনি কি দেখেন না যে, আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন। অতঃপর তাকে পুঞ্জীভূত করেন। অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন। অতঃপর আপনি দেখেন যে, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি আকাশস্থিত শিলাস্তূপ থেকে শিলাবর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা, তা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। তার বিদ্যুৎঝলক দৃষ্টিশক্তি যেন বিলীন করে দিতে চায়’ (আন-নূর, ২৪/৪৩)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু পরিচালনা করি। অতঃপর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি, এরপর তোমাদেরকে তা পান করাই। বস্তুত তোমাদের কাছে এর ভাণ্ডার নেই’ (আল-হিজর, ১৫/২২)।
২.৭ পানিচক্র
চক্রাকারের যে প্রক্রিয়ায় পানি পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে সূর্যের তাপে জলীয়বাষ্পে পরিণত হয়, জলীয়বাষ্প ঠাণ্ডা হয়ে মেঘ সৃষ্টি হয়, এই মেঘ আরো ঘনীভূত বৃষ্টিরূপে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসে তাকেই পানিচক্র বলে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিতভাবে পানিচক্রের বিবরণ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,﴾وَمِنْ آيَاتِهِ يُرِيكُمُ الْبَرْقَ خَوْفًا وَطَمَعًا وَيُنَزِّلُ مِنَ السَّمَاء مَاء فَيُحْيِي بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ﴿ ‘তাঁর আরও নিদর্শন, তিনি তোমাদেরকে দেখান বিদ্যুৎ ভয় ও ভরসার জন্য এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর তা দ্বারা মৃত জমিনকে জীবিত করেন। নিশ্চয় এতে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে’ (আর-রূম, ৩০/২৪)।
২.৮ ভূগর্ভ পানির উৎস
মহাশূন্যের সব গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পানি রয়েছে পৃথিবীতে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, পৃথিবীর মোট আয়তনের শতকরা ৭১ ভাগ পানি। মানবদেহে পানির পরিমাণ শতকরা ৭১ ভাগ এবং আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত গ্যাসের মধ্যে পানির পরিমাণ ৭১ শতাংশ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,﴾وَالْأَرْضَ بَعْدَ ذَلِكَ دَحَاهَا - أَخْرَجَ مِنْهَا مَاءَهَا وَمَرْعَاهَا﴿ ‘পৃথিবীকে এর পরে বিস্তৃত করেছেন। তিনি এর মধ্য থেকে এর পানি ও ঘাস নির্গত করেছেন’ (আন-নাযিআত, ৭৯/৩০-৩১)।
৩. উপসংহার
এই গোলাকার পৃথিবীর সৃষ্টি, ঘূর্ণন, আলো-বাতাস, পানির উৎস, জীবজন্তুর বসবাসের স্থান ইত্যাদি সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ১৪৫০ বছর আগে যে তথ্য প্রকাশ করেছিল তা আজকের আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরা তার সত্যায়ন করছে। তাই প্রমাণিত যে, আল-কুরআনের সব তথ্যই সত্য এবং তা এড়িয়ে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
ড. মোহাম্মদ হেদায়াত উল্লাহ
সহকারী অধ্যাপক ও প্রধান মুফাসসির, সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।