মুসলিম শাসকের জন্য জনগণের করণীয়
বায়‘আত যেহেতু খলীফা বা রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে নির্দিষ্ট, সেহেতু বায়‘আত সংঘটিত হওয়ার পরে শাসক ও জনগণের পারস্পরির দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করাও এ লেখার দাবি।
ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলিম শাসকদের প্রতি জনগণের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা যায়: (ক) কার্যমূলক দায়িত্ব ও (খ) বর্জনমূলক দায়িত্ব।
(ক) কার্যমূলক দায়িত্ব: যেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য জনগণকে বাস্তবায়ন করতে হয়, সেগুলো এই ভাগের অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দায়িত্ব হচ্ছে—
১. বায়‘আত রক্ষা করা: জনগণের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে সরকারের সাথে কৃত বায়‘আত রক্ষা করে চলা। রাষ্ট্রের শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বায়‘আতে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করা অতীব জরুরী। মহান আল্লাহ অঙ্গীকার পূরণ করতে বলেছেন। তিনি বলেন,يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَوْفُوْا بِالْعُقُوْدِ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করো’ (আল-মায়েদাহ, ৫/১)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,فُوْا بِبَيْعَةِ الْأَوَّلِ فَالْأَوَّلِ، أَعْطُوْهُمْ حَقَّهُمْ، فَإِنَّ اللهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ ‘তোমরা একের পর এক তাদের বায়‘আত পূর্ণ করো। অতঃপর তাদের হক্ব আদায় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন ঐ সকল বিষয়ে, যেসবের দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করা হয়েছিল’।[1]
২. আনুগত্য করা: মুসলিম সরকারের আনুগত্য পবিত্র কুরআন ও হাদীছের নির্দেশ। মহান আল্লাহ বলেন,يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأُوْلِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং আনুগত্য করো রাসূলের ও তোমাদের মধ্যকার কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের’ (আন-নিসা, ৪/৫৯)।
উল্লিখিত আয়াতে أُولِي الْأَمْرِ ‘নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ’ কথাটি দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে, তা নিয়ে ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ মতভেদ উল্লেখ করার পর বলেন,وَأَصَحُّ هٰذِهِ الْأَقْوَالِ الْأَوَّلُ وَالثَّانِيْ ‘এসব বক্তব্যের মধ্যে বিশুদ্ধতম বক্তব্য হচ্ছে, প্রথমটি ও দ্বিতীয়টি’[2]অর্থাৎ শাসকশ্রেণি এবং উলামায়ে কেরাম।
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,اِسْمَعُوْا وَأَطِيْعُوْا، وَإِنِ اسْتُعْمِلَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ حَبَشِيٌّ، كَأَنَّ رَأْسَهُ زَبِيْبَةٌ ‘যদি তোমাদের উপর কোনো হাবশী দাসকেও শাসক নিযুক্ত করা হয়, যার মাথাটি কিশমিশের ন্যায়, তবুও তার কথা শোনো ও তার আনুগত্য করো’।[3] অন্য হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ أَطَاعَنِيْ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ عَصَانِيْ فَقَدْ عَصَى اللهَ، وَمَنْ أَطَاعَ أَمِيْرِيْ فَقَدْ أَطَاعَنِيْ، وَمَنْ عَصٰى أَمِيْرِيْ فَقَدْ عَصَانِيْ ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার নাফরমানী করল, সে আল্লাহর নাফরমানী করল। অনুরূপভাবে যে আমার আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। আর যে আমার আমীরের নাফরমানী করল, সে আমার নাফরমানী করল’।[4] মুহাল্লাব রহিমাহুল্লাহ বলেন,هٰذَا يَدُلُّ عَلٰى وُجُوْبِ طَاعَةِ السُّلْطَانِ وُجُوْبًا مُجْمَلًا؛ لِأَنَّ فِيْ ذٰلِكَ طَاعَةَ اللهِ وَطَاعَةَ رَسُوْلِه# ‘মোটের উপর শাসকের আনুগত্য করা ওয়াজিব বলে এ হাদীছ প্রমাণ করে। কেননা এতে রয়েছে আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য’।[5] নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিম্নবর্ণিত বাণীটি এই প্রয়োগের প্রতিই ইঙ্গিত বহন করে: تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُمْ ‘তুমি মুসলিমদের ‘জামা‘আত’ এবং তাদের ইমামের সাথে থাকবে’।[6] মুহাল্লাব রহিমাহুল্লাহ-এর বক্তব্যে হাদীছে উল্লিখিত ‘আমীর’ কথাটির প্রকৃত অর্থ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়েছে। আর তা হচ্ছে শাসকশ্রেণি। মূলত সর্বযুগের উলামায়ে কেরামের বক্তব্যও তাই।
আরেকটা জরুরী বিষয় হচ্ছে, এখানে ‘আলেম-উলামা ও শাসকশ্রেণি’ বলতে নির্দিষ্ট কোনো আলেম বা শুধু সরকার প্রধানকে বুঝানো হয়নি। বরং সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কুরআন মাজীদ ও ছহীহ হাদীছের ধারক-বাহক হক্বপন্থি সকল আলেম এবং সরকারের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বুঝানো হয়েছে। তবে, তাদের আনুগত্যের মৌলিক দু’টি শর্ত হচ্ছে— (১) তাদেরকে মুসলিম হতে হবে ও (২) তাদের আদেশ-নিষেধের মধ্যে আল্লাহ ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাফরমানী ও অবাধ্যতা থাকা চলবে না। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِيْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় কোনো সৃষ্টির আনুগত্য নেই’।[7] সুতরাং নির্দিষ্ট নিয়ম ও শর্ত সাপেক্ষে আলেম-উলামা ও শাসকশ্রেণির আনুগত্য করতে হবে।[8]
৩. শাসককে সাহায্য করা ও তার পক্ষে লড়াই করা: মুসলিম শাসকের জন্য জনগণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হচ্ছে, সুখে-দুঃখে, কঠিন অবস্থায়, স্বাভাবিক অবস্থায়— সর্বাবস্থায় তাকে সাহায্য করতে হবে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,الدِّينُ النَّصِيحَةُ» قُلْنَا: لِمَنْ؟ قَالَ: «لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُولِهِ وَلِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ» ‘দ্বীন হচ্ছে নছীহত’। আমরা বললাম, কার জন্য? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল, মুসলিম শাসকগোষ্ঠী ও সাধারণ মুসলিম জনগণের জন্য’।[9] ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘মুসলিম শাসকগোষ্ঠীকে নছীহতের অর্থ হচ্ছে, হক্বের ব্যাপারে তাদেরকে সহযোগিতা করা ও আনুগত্য করা। তাদেরকে হক্বের নির্দেশনা দেওয়া ও কোমলতার সাথে সাবধান করা…’।[10]
ভেতরের বা বাইরের যে-ই রাষ্ট্রে ফেতনা করতে আসবে, তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষে কাজ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوْا فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرٰى فَقَاتِلُوا الَّتِيْ تَبْغِيْ حَتّٰى تَفِيْءَ إِلٰى أَمْرِ اللهِ ‘মুমিনদের দুই দল লড়াইয়ে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও; অতঃপর তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাচরণ করলে তোমরা বিদ্রোহী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/৯)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِه# وَيُتَّقٰى بِه#، فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ وَعَدَلَ، فَإِنَّ لَهُ بِذٰلِكَ أَجْرًا وَإِنْ قَالَ بِغَيْرِهِ فَإِنَّ عَلَيْهِ مِنْهُ ‘ইমাম (সরকার) তো ঢালস্বরূপ। তার নেতৃত্বে যুদ্ধ (হয়) এবং তারই মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন করা যায়। অতঃপর যদি সে আল্লাহর তাক্বওয়ার নির্দেশ দেয় এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে, তবে তার জন্য এর পুরস্কার রয়েছে আর যদি সে এর বিপরীত করে, তবে এর মন্দ পরিণাম তার উপরই বর্তাবে’।[11]
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার জন্য বা কোনো ফাসাদ সৃষ্টিকারীকে প্রতিহত করতে সরকার আহ্বান করলে তার পক্ষে লড়াই করা সরকারের আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত।
৪. শাসকশ্রেণিকে নছীহত করা: এটা বিশেষ করে দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কাজ, যাদের কথা সহজে শাসকশ্রেণির কাছে পৌঁছা সম্ভব। বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে নছীহত করা, তাদের ভুল শুধরিয়ে দেওয়া এ শ্রেণির মানুষের দায়িত্ব। তবে, সাধারণ জনগণও এর আওতায় আসতে পারে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, اَلدِّيْنُ النَّصِيْحَةُ. قُلْنَا: لِمَنْ؟ قَالَ: لِلّٰهِ وَلِكِتَابِه# وَلِرَسُوْلِه# وَلِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِيْنَ وَعَامَّتِهِمْ ‘নছীহত করাই দ্বীন। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কার জন্য? তিনি বললেন, আল্লাহর, তাঁর কিতাবের, তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর, মুসলিম শাসক ও মুসলিম জনগণের জন্য’।[12] খুলাফায়ে রাশেদূন বিষয়টি উপলব্ধি করে জনগণকে নছীহতের প্রতি উৎসাহিত করতেন। আবূ বকর রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, فَإِنْ أَحْسَنْتُ فَأَعِيْنُوْنِيْ، وَإِنْ أَسَأْتُ فَقَوِّمُوْنِيْ ‘আমি ঠিক কাজ করলে আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন। আর বেঠিক কিছু করলে আমাকে সংশোধন করে দিবেন’।[13] সাধারণ জনগণ তাদেরকে নছীহত করলেও তারা তা সাদরে গ্রহণ করতেন। সুতরাং নছীহতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার দিকে খেয়াল রেখে শাসকগোষ্ঠীর নছীহত করা এবং তাদের গ্রহণ করা উচিত।
৫. শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ঘটিত অপছন্দনীয় ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করা: শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক অপছন্দনীয় কিছু ঘটে গেলে, এমনকি অত্যাচার ঘটে গেলেও জনগণকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ رَأَىٰ مِنْ أَمِيْرِه# شَيْئًا يَكْرَهُهُ فَلْيَصْبِرْ عَلَيْهِ فَإِنَّهُ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَمَاتَ، إِلَّا مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি তার আমীরের মাঝে এমন কোনো বিষয় প্রত্যক্ষ করে, যা সে অপছন্দ করে, তবে সে যেন ধৈর্যধারণ করে। কেননা যে ব্যক্তি ‘জামা‘আত’ থেকে এক বিঘত সরে গেল এবং এ অবস্থায় মারা গেল, নিশ্চিত তার জহেলী মৃত্যু হলো’।[14] অপর হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,اَلسَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ فِيْمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ، مَا لَمْ يُؤْمَرْ بِمَعْصِيَةٍ، فَإِذَا أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلاَ طَاعَةَ ‘যতক্ষণ আল্লাহর নাফরমানীর নির্দেশ দেওয়া না হয়, ততক্ষণ পছন্দনীয় ও অপছন্দনীয় সকল বিষয়ে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য (শাসককে) মেনে নেওয়া ও তার আনুগত্য করা কর্তব্য। যখন নাফরমানীর আদেশ দেওয়া হয়, তখন আর কোনো মান্যতা ও আনুগত্য নেই’।[15] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,تَسْمَعُ وَتُطِيْعُ لِلْأَمِيْرِ وَإِنْ ضُرِبَ ظَهْرُكَ وَأُخِذَ مَالُكَ فَاسْمَعْ وَأَطِعْ ‘তুমি শুনবে ও আনুগত্য করবে। যদি তোমার পিঠে বেত্রাঘাত করা হয় এবং তোমার ধনসম্পদ কেড়েও নেওয়া হয়, তবুও তুমি আনুগত্য করবে’।[16] এরকম আরো বহু হাদীছ আছে এবং উলামায়ে কেরামও এমনটিই বলেছেন।
৬. শাসককে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা: শাসকগোষ্ঠীকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,إِنَّ مِنْ إِجْلَالِ اللهِ إِكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ، وَحَامِلِ الْقُرْآنِ غَيْرِ الْغَالِيْ فِيْهِ وَالْجَافِيْ عَنْهُ، وَإِكْرَامَ ذِي السُّلْطَانِ الْمُقْسِطِ ‘নিশ্চয়ই বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা, কুরআনের যথাযথ ধারক-বাহক ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের প্রতি সম্মান দেখানো মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত’।[17] ত্বঊস ইবনে কায়সান রহিমাহুল্লাহ বলেন, مِنَ السُّنَّةِ أَنْ يُوَقَّرَ أَرْبَعَةٌ: اَلْعَالِمُ، وَذُو الشَّيْبَةِ، وَالسُّلْطَانُ، وَالْوَالِدُ ‘চার শ্রেণির মানুষকে শ্রদ্ধা করা সুন্নাত— আলেম, বৃদ্ধ, রাষ্ট্রনেতা ও পিতা-মাতা’।[18]
৭. শাসকের জন্য বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করা: শাসক যাতে বাইরের দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করে যেতে পারেন, সেজন্য বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তার জন্য বেতন-ভাতা নির্ধারণ করতে হবে। আবূ বকর রযিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য ছাহাবায়ে কেরাম বেতন-ভাতা নির্ধারণ করেছিলেন।[19]
(খ) বর্জনমূলক দায়িত্ব: যেসব বিষয় জনগণকে বর্জন করতে হবে, সেগুলো হচ্ছে বর্জনমূলক দায়িত্ব। এগুলোর কয়েকটি আলোকপাত করা হলো—
১. শাসকগোষ্ঠীকে গালমন্দ না করা: শাসক ও জনগণের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকা চাই। তাহলে শাসক যেমন জনগণের উপর আস্থা রাখতে পারবে, জনগণও তেমনি শাসকগোষ্ঠীর উপর আস্থা রাখতে পারবে। এভাবে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে সবাই মিলে ভূমিকা রাখতে পারবে। পক্ষান্তরে এর বিপরীত হলে সবকিছু পিছিয়ে যাবে। সেজন্য ইসলাম শাসকগোষ্ঠীর সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে বলেছে। আনাস ইবনে মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর বড় বড় ছাহাবী নিষেধ করেছেন,لَا تَسُبُّوْا أُمَرَاءَكُمْ، وَلَا تَغِشُّوْهُمْ، وَلَا تَبْغَضُوْهُمْ، وَاتَّقُوا اللهَ وَاصْبِرُوْا ‘তোমাদের শাসকদেরকে তোমরা গালি দিও না। তাদের সাথে প্রতারণা করো না, তাদেরকে ঘৃণা করো না। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্যধারণ করো...’। [20]
২. শাসকগোষ্ঠীর সাথে প্রতারণা না করা: প্রতারণা কস্মিনকালেও মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। সাধারণভাবে এটা মারাত্মক অপরাধ; আর যদি তা সরকারের সাথে হয়, তাহলে তার ভয়াবহতা আরো বেশি। এতে দেশ ও জনগণের ক্ষতি হয়। সেকারণে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রকার প্রতারণা করতে নিষেধ করেছেন। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّيْ ‘যে প্রতারণা করে, সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়’।[21] আনাস ইবনে মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বড় বড় ছাহাবী নিষেধ করেছেন, ‘তোমাদের শাসকদেরকে তোমরা গালি দিও না। তাদের সাথে প্রতারণা করো না, তাদেরকে ঘৃণা করো না। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্যধারণ করো...’। [22]
৩. রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ না করা: শাসকগোষ্ঠীর সাথে খেয়ানত করে বা অন্য কোনো উপায়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া হারাম এবং এটা বড় ধরনের খেয়ানত। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لَا أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ يَجِيْءُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلٰى رَقَبَتِه# بَعِيرٌ لَهُ رُغَاءٌ، يَقُوْلُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، أَغِثْنِي، فَأَقُوْلُ: لَا أَمْلِكُ لَكَ شَيْئًا، قَدْ أَبْلَغْتُكَ ‘আমি তোমাদের কাউকে ক্বিয়ামতের দিন যেন এমন অবস্থায় উপস্থিত না পাই যে, চিৎকাররত উট তার ঘাড়ের উপর সওয়ার হয়ে আছে আর সে আবেদন করছে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। তখন আমি বলব, তোমার ব্যাপারে আমার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। আমি তো তোমার কাছে (আগেই সতর্কবার্তা) পৌঁছে দিয়েছি...’।[23] আদি ইবনে উমাইরা আল-কিন্দী রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنِ اسْتَعْمَلْنَاهُ مِنْكُمْ عَلٰى عَمَلٍ، فَكَتَمَنَا مِخْيَطًا، فَمَا فَوْقَهُ كَانَ غُلُوْلًا يَأْتِيْ بِه# يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘আমরা তোমাদের মধ্যে যাকে কোনো কাজে নিযুক্ত করি আর সে একটি সুচ পরিমাণ বা তার চাইতেও স্বল্প মাল আমাদের নিকট গোপন করে, তা-ই আত্মসাৎ বলে গণ্য হবে এবং তা নিয়েই সে ক্বিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে’।[24]
সুতরাং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি আত্মসাৎ করা, হাতিয়ে নেওয়া ও নষ্ট করার অধিকার কারো নেই।
৪. সরকারকে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে নছীহত না করা: আমরা আগে দেখে এসেছি, সরকারকে নছীহত করতে হবে, তার ভুলত্রুটি শোধরানোর চেষ্টা করতে হবে। তবে, সরকারের নছীহত হবে কোমলতার সাথে গোপনে; প্রকাশ্যে নয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ أَرَادَ أَنْ يَنْصَحَ لِسُلْطَانٍ بِأَمْرٍ فَلَا يُبْدِ لَهُ عَلَانِيَةً وَلَكِنْ لِيَأْخُذْ بِيَدِهِ فَيَخْلُوَ بِه# فَإِنْ قَبِلَ مِنْهُ فَذَاكَ وَإِلَّا كَانَ قَدْ أَدَّى الَّذِيْ عَلَيْهِ لَهُ ‘যে ব্যক্তি শাসককে কোনো ব্যাপারে নছীহত করতে চায়, সে যেন তা প্রকাশ্যে না করে। বরং তার হাত ধরে নির্জনে গিয়ে নছীহত করে। তিনি গ্রহণ করলে তো ভালো। আর না করলে সে তার দায়িত্ব পালন করল’ (মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৩৩৩, হাদীছটির একাংশ ‘ছহীহ লিগয়রিহী’, অপর অংশ ‘হাসান লিগয়রিহী’, অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য হাদীছ)। উসামা ইবনে যায়েদ রযিয়াল্লাহু আনহু উছমান রযিয়াল্লাহু আনহু-কে গোপনে নছীহত করতেন। তাকে বলা হলো, ‘আপনি উছমান রযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে গিয়ে তার সাথে আলাপ-আলোচনা করেন না কেন?’ জবাবে তিনি বললেন, أَتَرَوْنَ أَنِّيْ لَا أُكَلِّمُهُ إِلَّا أُسْمِعُكُمْ؟ وَاللهِ لَقَدْ كَلَّمْتُهُ فِيْمَا بَيْنِيْ وَبَيْنَهُ ‘আমি তার সাথে কথা বলি না- তোমরা কি এটা মনে করছ? তোমাদের শুনিয়ে কথা বলব? আল্লাহর কসম! আমার ও তার মধ্যকার যে কথা বলার, আমি তাকে তা বলেছি’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৮৯)।
সুতরাং মিছিল-মিটিং-এ, বক্তব্যে, পত্র-পত্রিকায়, বই-পুস্তকে বা আধুনিক নানা যোগাযোগ মাধ্যমে মুসলিম সরকারের মন্দ কর্মের সমালোচনা করা শরী‘আত অনুমোদিত পদ্ধতি নয়। এটা হচ্ছে, সাধারণ নিয়ম।
কিন্তু এর বিপরীত মতও যেমন আছে, তেমনই গণতান্ত্রিক দেশে দাবি আদায় ও প্রতিবাদের নিয়ম কী হবে, তা অবশ্যই গবেষণার দাবি রাখে।
(ইনশা-আল্লাহ চলবে)
* বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৫৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৪২।
[2]. কুরতুবী, আল-জামে‘ লিআহকামিল কুরআন, (কায়রো: দারুল কুতুবিল মিছরিয়্যাহ, ২য় প্রকাশ: ১৩৮৪ হি./১৯৬৪ খৃ.), ৫/২৫৯-২৬০।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১৪২।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩৫।
[5]. ইবনু বাত্ত্বাল, শারহু ছহীহিল বুখারী, ৮/২০৯।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৮৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৪৭।
[7]. বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হা/২৪৫৫, ‘ছহীহ’।
[8]. দ্রষ্টব্য: খালেদ আহমাদ শানতূত, আত-তারবিয়্যাহ আস-সিয়াসিয়্যাহ ফিল মুজতামা‘ইল মুসলিম, (মুদ্রণ তথ্যবিহীন), পৃ. ৯২-৯৩।
[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৫।
[10]. আল-মিনহাজ শারহু ছহীহ মুসলিম ইবনিল হাজ্জাজ, ২/৩৮।
[11]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯৫৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৪১।
[12]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৫।
[13]. তবারী, তারীখুর রুসুলি ওয়াল মুলূক (তারীখে তবারী), (বৈরূত: দারুত তুরাছ, ২য় প্রকাশ: ১৩৮৭ হি.), ৩/২১০।
[14]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৫৪ ও ৭১৪৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৪৯।
[15]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১৪৪।
[16]. প্রাগুক্ত।
[17]. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪৮৪৩, ‘হাসান’।
[18]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, আছার/২০১৩৩।
[19]. ইবনে আসাকের, তারীখু দিমাশক, (দারুল ফিকর, প্রকাশকাল: ১৪১৫ হি./১৯৯৫ খৃ.), ৩০/৩২১।
[20]. ইবনু আবী আছেম, আস-সুন্নাহ, (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১ম প্রকাশ: ১৪০০ হি.), হা/১০১৫।
[21]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০২।
[22]. ইবনু আবী আছেম, আস-সুন্নাহ, (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১ম প্রকাশ: ১৪০০ হি.), হা/১০১৫।
[23]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০৭৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩১।
[24]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩৩।