ফেরেশতাগণ আল্লাহ তা‘আলার আজ্ঞাবহ। তারা নূর থেকে সৃষ্ট। তারা সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে রত থাকেন। তাদের আহার, নিদ্রার দরকার হয়না। আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করা মাত্রই তারা তা তৎক্ষণাৎ পালন করেন। তারা কখনো আল্লাহর অবাধ্য হন না। তারা আল্লাহর কাছে যে দু‘আ করেন, আল্লাহ তা কবুল করে থাকেন।
সুধী পাঠক! আল্লাহর যমীনে এমন কিছু দুর্ভাগা মানুষ আছে, যারা তাদের অবাধ্যতা ও পাপের কারণে ফেরেশতা কর্তৃক লা‘নতপ্রাপ্ত। ফেরেশতারা লা‘নত করেন এমন সব পাপ ও পাপীদের নিয়েই বক্ষ্যমান প্রবন্ধের অবতারণা। নিম্নে পর্যায়ক্রমে তার কয়েকটি আলোচনা পেশ করা হলো-
(১) কৃপণ ব্যক্তি: কৃপণতা একটি ঘৃণিত স্বভাব। কৃপণ ব্যক্তিকে তার আত্মীয়-স্বজন, সমাজ সকলেই ঘৃণা করে। কৃপণ ব্যক্তি সমাজেও অপমানিত হয়। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَا مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ الْعِبَادُ فِيهِ إِلاَّ مَلَكَانِ يَنْزِلاَنِ فَيَقُولُ أَحَدُهُمَا اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا. وَيَقُولُ الآخَرُ اللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا ‘প্রত্যেক বান্দা যখন সকালে ওঠে, তখন দুজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! খরচকারীর ধন আরো বাড়িয়ে দাও এবং দ্বিতীয়জন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দাও’।[1]
(২) ইলম (জ্ঞান) গোপনকারী: ইলম বা জ্ঞান গোপন করা একটি মারাত্মক অপরাধ। যে বা যারা খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে জেনেবুঝে ইলম গোপন করে, তাদের উপর আল্লাহ ও ফেরেশতাদের অভিশাপ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ ‘নিশ্চয়ই যারা আমার নাযিলকৃত উজ্জ্বল নিদর্শনাবলি ও হেদায়াত গোপন করে যদিও আমি কিতাবে তা মানুষের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছি, তাদের প্রতি আল্লাহ লা‘নত বর্ষণ করেন এবং অন্য লা‘নতকারীরাও (ফেরেশতারা) লা‘নত করেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৯)।
(৩) কাফের ও মুরতাদ: যে বা যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করে, তারা স্পষ্ট কাফের। আর যারা কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহ ও ফেরেশতাদের লা‘নত বা অভিশাপ। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ﴾ ‘নিশ্চয়ই যারা কুফরী করেছে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের ওপর আল্লাহ, ফেরেশতা ও সব মানুষের লা‘নত’ (আল-বাক্বারা, ২/১৬১)।
(৪) ছাহাবীদেরকে গালিদাতা: ছাহাবীগণ ছিলেন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একান্ত আপনজনের মতো। ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে শত কষ্ট সহ্য করে তারা ঈমানের ওপর হিমাদ্রির মতো অবিচল ছিলেন। তাদের শানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক প্রশংসা করেছেন। তারা ছিলেন দ্বীনের প্রকৃত ধারক। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সম্পর্কে বলেছেন, مَنْ سَبَّ أَصْحَابِيْ فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللهِ وَالْـمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ ‘যারা আমার ছাহাবীকে গালি দিবে, তাদের ওপর আল্লাহ, ফেরেশতা ও সব মানুষের পক্ষ থেকে অভিশাপ’।[2]
(৫) অস্ত্র নিশানাকারী: কোনো মুসলিমের প্রতি ইচ্ছাকৃত বা খেলতামাশার ছলে অস্ত্র নিশানা করা নিষিদ্ধ। কোনো অবস্থায়ই এ কাজ করা যাবে না। হাদীছে এসেছে,
عَنِ ابْنِ سِيرِينَ سَمِعْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ يَقُولُ قَالَ أَبُو الْقَاسِمِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ أَشَارَ إِلَى أَخِيهِ بِحَدِيدَةٍ فَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ تَلْعَنُهُ حَتَّى وَإِنْ كَانَ أَخَاهُ لأَبِيهِ وَأُمِّهِ.
ইবনু সীরীন রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আবুল কাসেম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রতি (লৌহ নির্মিত) মারণাস্ত্র দ্বারা ইঙ্গিত করে, সে তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত ফেরেশতাগণ তাকে অভিসম্পাত করতে থাকেন, যদিও সে তার আপন ভাই হয়’।[3]
(৬) নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টিকারী: মুসলিমদের দেওয়া নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা নিকৃষ্ট একটি কাজ। নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা একজন প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। এমন কাজের জন্য তাদের উপর ফেরেশতারা লা‘নত করেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ذِمَّةُ الْمُسْلِمِينَ وَاحِدَةٌ فَمَنْ أَخْفَرَ مُسْلِمًا فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللهِ وَالْمَلاَئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لاَ يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلاَ عَدْلٌ ‘মুসলিম কর্তৃক নিরাপত্তাদানের অধিকার সবার ক্ষেত্রে সমান। তাই যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দেওয়া নিরাপত্তাকে লঙ্ঘন (ওয়াদা ভঙ্গ) করবে, তার প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত এবং সব ফেরেশতা ও মানুষের অভিসম্পাত। আর কবুল করা হবে না তার কোনো নফল কিংবা ফরয ইবাদত’।[4]
(৭) নিজ পিতা ব্যতীত অন্য কাউকে পিতা দাবী করা: নিজ পিতা ছাড়া অন্য কাউকে পিতা দাবী করা যাবে না। কেউ এমনটা করলে তার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যাবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنِ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ وَهْوَ يَعْلَمُ فَالْجَنَّةُ عَلَيْهِ حَرَامٌ ‘যে ব্যক্তি জেনেশুনে নিজ পিতা ছাড়া অন্য কাউকে পিতা দাবী করবে, তার জন্য জান্নাত হারাম’।[5] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য হাদীছে বলেন, مَنِ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ أَوِ انْتَمَى إِلَى غَيْرِ مَوَالِيهِ فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلاَئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لاَ يَقْبَلُ اللَّهُ مِنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ صَرْفًا وَلاَ عَدْلاً ‘যে ব্যক্তি তার পিতাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে পিতা বলে দাবী করবে অথবা যে ক্রীতদাস তার মনিবকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মাওলা বানায়, তার ওপর আল্লাহর লা‘নত, ফেরেশতা ও সমগ্র মানবজাতির লা‘নত বর্ষিত হবে। কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তার কোনো ফরয কিংবা নফল (ইবাদত) কবুল করবেন না’।[6]
(৮) স্বামীর অবাধ্য স্ত্রী: একজন স্ত্রীর কাছে তার স্বামী সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা আল্লাহ প্রদত্ত একটি নেয়ামত। স্বামী-স্ত্রীর সাংসারিক জীবনে ছোটখাটো মনোমালিন্য বা সম্পর্কের অবনতি হতেই পারে। কিন্তু বিষয়টিকে অস্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে কোনো স্ত্রী যদি স্বামীর উপর রাগ করে শয্যা ত্যাগ করে এবং স্বামী তাকে আহ্বান করার পরও যদি সাড়া না দেয়, তাহলে সেই স্ত্রীর উপর ফেরেশতারা অভিশাপ করতে থাকেন। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ فَلَمْ تَأْتِهِ فَبَاتَ غَضْبَانَ عَلَيْهَا لَعَنَتْهَا الْمَلاَئِكَةُ حَتَّى تُصْبِحَ ‘স্বামী যখন স্ত্রীকে বিছানায় আহ্বান করে এবং সে না আসায় তার স্বামী তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে রাত্রি যাপন করে, সে স্ত্রীর প্রতি ফেরেশতারা ভোর হওয়া পর্যন্ত লা‘নত করতে থাকেন’।[7]
(৯) হত্যার ন্যায়বিচারে বাধাপ্রদানকারী: হত্যার ন্যায়বিচার পাওয়া একটি মানবিক অধিকার। এমন স্পর্শকাতর অধিকারে বাধা প্রদান করা একটি গর্হিত অপরাধ। এমন বিষয়ে কেউ বাধা দিলে তার উপর ফেরেশতারা লা‘নত করতে থাকেন। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ قُتِلَ فِى عِمِّيَا أَوْ رِمِّيَا تَكُونُ بَيْنَهُمْ بِحَجَرٍ أَوْ سَوْطٍ أَوْ بِعَصًا فَعَقْلُهُ عَقْلُ خَطَإٍ وَمَنْ قَتَلَ عَمْدًا فَقَوَدُ يَدِهِ فَمَنْ حَالَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُ فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلاَئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لاَ يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلاَ عَدْلٌ ‘যে ব্যক্তি কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামায় অথবা পাথর, কোড়া অথবা লাঠি ছোড়াছুড়ির মাঝে পড়ে নিহত হয়, তার দিয়াত (রক্তপণ) হবে ভুলে হত্যার দিয়াতের মতো আর যদি ইচ্ছাকৃত হত্যা হয়, তবে তাতে ক্বিছাছ (মৃত্যুদণ্ড) ওয়াজিব হবে। আর যদি কেউ এর মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তবে তার ওপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের এবং সব মানুষের লা‘নত। তার ফরয বা নফল কিছুই কবুল হবে না’।[8]
সুধী পাঠক! এতক্ষণ আমরা এমন কিছু পাপ সম্পর্কে আলোচনা করলাম, যেসব পাপের কারণে ফেরেশতামণ্ডলী পর্যন্ত সেই পাপীর উপর লা‘নত করতে থাকেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সে সকল পাপ থেকে বেঁচে থেকে ফেরেশতামণ্ডলীর নেক দু‘আয় শামিল হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-আমিন
সহকারী শিক্ষক (ধর্ম), মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয়, তানোর, রাজশাহী।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৪৪২; ছহীহ মুসলিম, হা/১০১০।
[2]. সিলসিলা ছহীহা, হা/২৩৪০; ছহীহুল জামে‘, হা/৫২৮৫।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬১৬।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৭০।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৩২৬।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৭০।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৩৬।
[8]. সুনান নাসাঈ, হা/৪৭৮৯, হাদীছ ছহীহ।