কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসলামে মুরদান (দাড়িবিহীন কিশোর-যুবক) সম্পর্কিত বিধিবিধান (পর্ব-৬)

post title will place here

ইসলামের দৃষ্টিতে সমকামিতা ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:

ইসলামের দৃষ্টিতে সমকামিতা:

আল্লাহ তাআলা মানুষকে এমন স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তারা ভালো কাজ, সততা, পবিত্রতা, উচ্চ লক্ষ্য এবং সুন্দর চরিত্রকে ভালোবাসে। তেমনি তিনি তাদের এমন স্বভাব দিয়েছেন, যাতে তারা মন্দ কাজ, নোংরা আচরণ এবং খারাপ চরিত্র, কাজ ও কথাবার্তাকে ঘৃণা করে। তবুও, মানুষের একটি অংশ এমন রয়েছে, যারা এই স্বাভাবিক সুন্দর স্বভাব থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে সমকামিতা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক কাজ। এটি মারাত্মক নিচু কাজ ও জঘন্য পাপ। এটি চরম বেহায়া ও নির্লজ্জতার বহিঃপ্রকাশ। এটি স্বভাববিরোধী। এ পাপ মহান আল্লাহর অমোঘ নিয়মের পরিপন্থি। এটি চরম সীমালঙ্ঘন ও আল্লাহ প্রদত্ত ফিত্বরাতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন। এর মাধ্যমে আল্লাহর যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা হয়। সমকামিতা পশুত্বকেও হার মানায়। মহান আল্লাহ যথার্থই বলেছেন, وَلَقَدْ ذَرَأْنا لِجَهَنَّمَ كَثِيراً مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لا يَفْقَهُونَ بِها وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لا يُبْصِرُونَ بِها وَلَهُمْ آذانٌ لا يَسْمَعُونَ بِها أُولئِكَ كَالْأَنْعامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولئِكَ هُمُ الْغافِلُونَ ‘আমি তো জাহান্নামের জন্য অনেক জিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা তা দিয়ে বুঝে না। চোখ আছে, কিন্তু তারা তা দিয়ে দেখে না। কান আছে, কিন্তু তারা তা দিয়ে শোনে না। তারা পশুর মতো, বরং পশুর চেয়েও গোমরাহ। তারাই হলো গাফেল (অসচেতন) লোক’ (আল-আরাফ, ৭/১৭৯)

সমকামিতা কী?

সমকামিতাকে আরবীতে ‘লিওয়াত্ব’ (اَللَّوَاطُ) বলা হয়। ‘লিওয়াত্ব’ শব্দটি আরবী ভাষায় ‘লাওতুন’ (لَوْطٌ) শব্দমূল থেকে এসেছে। এই শব্দের মূল অক্ষর লাম (ل), ওয়াও (و) এবং ত্ব (ط) এমন একটি ধারণা বহন করে, যার মর্মার্থ হলো— লেগে থাকা বা আঠার মতো সেঁটে যাওয়া। যেমন আরবীতে বলা হয়,لَاطَ الشَّيْءُ بِقَلْبِي، إِذَا لَصِقَ ‘কোনো কিছু আমার হৃদয়ে লেগে গেছে (অর্থাৎ গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছে)।[1] আরও বলা হয়, لاطَ الرَّجُلُ لِواطاً: عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ ‘কেউ যদি লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর ক্বওমের মতো কাজ করে, তখন তার ব্যাপারে বলা হয়, সে লিওয়াত্ব করেছে’।[2]

পরিভাষায়— اَللِّوَاطُ هُوَ تَغْيِيْبُ الْحَشَفَةِ فِي دُبُرِ الذَّكَرِ ‘পুরুষের গোপনাঙ্গের অগ্রভাগকে অন্য পুরুষের পায়ুপথে প্রবেশ করানোকে ‘লিওয়াত্ব’ বা সমকামিতা বলা হয়’।[3]

ইসলামের চোখে সমকামিতা:

সমকামিতা তো দূরের কথা, ইসলাম এর ধারেকাছেও যেতে সতর্ক করেছে। মহান আল্লাহ প্রকাশ্য-গোপন যাবতীয় অশ্লীলতা হারাম করেছেন এবং সেগুলোর নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ ‘বলুন (হে নবী), আমার প্রতিপালক তো শুধু অশ্লীল কাজই হারাম করেছেন, তা প্রকাশ্য হোক বা গোপন’ (আল-রাফ, /৩৩)। তিনি আরও বলেন,وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ ‘আর তোমরা অশ্লীল কাজের ধারে-কাছে যেয়ো না, তা প্রকাশ্য হোক কিংবা গোপন’ (আল-আনআম, /১৫১)

আবূ সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لاَ يَنْظُرُ الرَّجُلُ إِلَى عَوْرَةِ الرَّجُلِ وَلاَ الْمَرْأَةُ إِلَى عَوْرَةِ الْمَرْأَةِ وَلاَ يُفْضِي الرَّجُلُ إِلَى الرَّجُلِ فِي ثَوْبٍ وَاحِدٍ وَلاَ تُفْضِي الْمَرْأَةُ إِلَى الْمَرْأَةِ فِي ثَوْبٍ وَاحِدٍ ‘একজন পুরুষ যেন আরেকজন পুরুষের গোপন অঙ্গের দিকে না তাকায়, আর এক নারী যেন আরেক নারীর গোপন অঙ্গের দিকে না তাকায়। একজন পুরুষ যেন আরেক পুরুষের সঙ্গে এক কাপড়ে গা ঘেঁষে না শোয়, আর এক নারীও যেন আরেক নারীর সঙ্গে এক কাপড়ে গা ঘেঁষে না শোয়’।[4] আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لاَ تُبَاشِرُ الْمَرْأَةُ الْمَرْأَةَ فَتَنْعَتُهَا لِزَوْجِهَا كَأَنَّهُ يَنْظُرُ إِلَيْهاَ ‘কোনো নারী যেন অন্য নারীর (শরীর) স্পর্শ না করে, তারপর তার স্বামীর কাছে এমনভাবে বর্ণনা না করে, যেন সে (স্বামী) নিজ চোখে তাকে দেখে ফেলেছে’।[5]

সমকামিতার ব্যাপারে কুরআন কী বলে?

কোনো কোনো ঘটনা কুরআন মাজীদে একাধিক জায়গায় প্রতিবার আলাদা প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনাশৈলীতে ও নতুন নতুন শব্দচয়নে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। নিশ্চয় মহান আল্লাহ অযথা এভাবে একই ঘটনা বারবার উল্লেখ করেন না। বরং কুরআনে কারীমে বিভিন্ন ঘটনার এমন পুনরাবৃত্তি মহান প্রজ্ঞা বহন করে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: হৃদয়ে উপদেশ ও শিক্ষা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা, ঘটনার গুরুত্ব ও তার থেকে পাওয়া শিক্ষার উপর জোর দেওয়া, একক ঘটনাকে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপনের মাধ্যমে কুরআনের কৌশলী বর্ণনাশৈলী তুলে ধরা ইত্যাদি।

কুরআন মাজীদের ১৩-এরও বেশি জায়গায় সমকামিতা ও প্রথম সমকামীদের নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। নিশ্চয় মহান আল্লাহ একই বিষয়ে এতগুলো আয়াত অমূলক বলেননি। বরং এর পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির পেছনে উপর্যুক্ত হিকমা ও প্রজ্ঞাকে সামনে রেখে এবং সমকামিতার মতো ভয়াবহ বিষয় হওয়ার কারণে আমি সাধ্যানুযায়ী এখানে এ সম্পর্কিত সবগুলো আয়াত পাঠক সমীপে পেশ করেছি। সাথে সাথে আয়াতগুলো থেকে আমরা কী পাই, তাও উল্লেখ করেছি। আয়াতগুলোকে কুরআনের সূরাসমূহের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী সাজানো হয়েছে।

[1] وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِنَ الْعَالَمِينَ (80) إِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ شَهْوَةً مِنْ دُونِ النِّسَاءِ بَلْ أَنْتُمْ قَوْمٌ مُسْرِفُونَ (81) وَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَنْ قَالُوا أَخْرِجُوهُمْ مِنْ قَرْيَتِكُمْ إِنَّهُمْ أُنَاسٌ يَتَطَهَّرُونَ (82) فَأَنْجَيْنَاهُ وَأَهْلَهُ إِلَّا امْرَأَتَهُ كَانَتْ مِنَ الْغَابِرِينَ (83) وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ مَطَرًا فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُجْرِمِينَ (84)

[১] ‘(৮০) আর আমি লূতকেও পাঠিয়েছিলাম। তিনি তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, “তোমরা কি এমন খারাপ কাজ করে যাচ্ছ, যা তোমাদের আগে সৃষ্টিকুলের কেউ করেনি? (৮১) তোমরা তো কাম-তৃপ্তির জন্য নারীদের ছেড়ে পুরুষের কাছে যাও, বরং তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।” (৮২) উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু বলল, এদেরকে তোমাদের জনপদ থেকে বহিষ্কার করো, এরা তো এমন লোক, যারা অতি পবিত্র হতে চায়। (৮৩) অতঃপর আমরা তাকে ও তার পরিজনদের সবাইকে উদ্ধার করেছিলাম, তার স্ত্রী ছাড়া, সে ছিল পেছনে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত। (৮৪) আর আমরা তাদের উপর ভীষণভাবে বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম। কাজেই দেখুন, অপরাধীদের পরিণাম কীরূপ হয়েছিল’ (আল-রাফ, /৮০-৮৪)

উপর্যুক্ত আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায়: ১. সমকামিতা অত্যন্ত ঘৃণিত অপরাধ, যা লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায়ের পূর্বে জগতের আর কেউ করেনি। ২. এটি মানুষের স্বভাববিরোধী নোংরা কাজ, যা করার কারণে তাদেরকে সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ৩. স্বভাবসিদ্ধ যথার্থ যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন সত্ত্বেও তারা লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর কথা শোনেনি; বরং তারা তাঁকে এলাকাছাড়া করার হুমকি দিয়েছিল। ৪. কিন্তু মহান আল্লাহ লূত্ব আলাইহিস সালাম–এর স্ত্রী ছাড়া তাঁকে ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে রক্ষা করেছিলেন। ৫. সমকামিতার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে মহান আল্লাহ লূত্ব আলাইহিস সালাম–এর ক্বওমকে পাথরবৃষ্টি বর্ষণ করে সমূলে ধ্বংস করেছিলেন। ৬. আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পাপিষ্ঠ আখ্যা দিয়ে সেখান থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে বলেছেন।

[2] وَلَمَّا جَاءَتْ رُسُلُنَا لُوطًا سِيءَ بِهِمْ وَضَاقَ بِهِمْ ذَرْعًا وَقَالَ هَذَا يَوْمٌ عَصِيبٌ (77) وَجَاءَهُ قَوْمُهُ يُهْرَعُونَ إِلَيْهِ وَمِنْ قَبْلُ كَانُوا يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ قَالَ يَا قَوْمِ هَؤُلَاءِ بَنَاتِي هُنَّ أَطْهَرُ لَكُمْ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَلَا تُخْزُونِ فِي ضَيْفِي أَلَيْسَ مِنْكُمْ رَجُلٌ رَشِيدٌ (78) قَالُوا لَقَدْ عَلِمْتَ مَا لَنَا فِي بَنَاتِكَ مِنْ حَقٍّ وَإِنَّكَ لَتَعْلَمُ مَا نُرِيدُ (79) قَالَ لَوْ أَنَّ لِي بِكُمْ قُوَّةً أَوْ آوِي إِلَى رُكْنٍ شَدِيدٍ (80) قَالُوا يَا لُوطُ إِنَّا رُسُلُ رَبِّكَ لَنْ يَصِلُوا إِلَيْكَ فَأَسْرِ بِأَهْلِكَ بِقِطْعٍ مِنَ اللَّيْلِ وَلَا يَلْتَفِتْ مِنْكُمْ أَحَدٌ إِلَّا امْرَأَتَكَ إِنَّهُ مُصِيبُهَا مَا أَصَابَهُمْ إِنَّ مَوْعِدَهُمُ الصُّبْحُ أَلَيْسَ الصُّبْحُ بِقَرِيبٍ (81) فَلَمَّا جَاءَ أَمْرُنَا جَعَلْنَا عَالِيَهَا سَافِلَهَا وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهَا حِجَارَةً مِنْ سِجِّيلٍ مَنْضُودٍ (82) مُسَوَّمَةً عِنْدَ رَبِّكَ وَمَا هِيَ مِنَ الظَّالِمِينَ بِبَعِيدٍ (83)

[২] ‘(৭৭) আর যখন আমাদের প্রেরিত ফেরেশতাগণ লূত্বের কাছে আসল, তখন তাদের আগমনে তিনি বিষণ্ন হলেন এবং নিজকে তাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করলেন আর বললেন, এটা বড় বিপদের দিন। (৭৮) আর তার সম্প্রদায় তার কাছে উদভ্ৰান্ত হয়ে ছুটে আসল এবং আগে থেকেই তারা কুকর্মে ছিল। তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! এরা আমার কন্যা, তোমাদের জন্য এরা পবিত্র। কাজেই তোমরা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করো এবং আমার মেহমানদের ব্যাপারে আমাকে হেয় করো না। তোমাদের মধ্যে কি কোনো সুবোধ ব্যক্তি নেই? (৭৯) তারা বলল, তুমি তো জানো, তোমার কন্যাদেরকে আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই; আমরা কী চাই তা তো তুমি জানোই। (৮০) তিনি বললেন, তোমাদের উপর যদি আমার শক্তি থাকত অথবা যদি আমি আশ্রয় নিতে পারতাম কোনো সুদৃঢ় স্তম্ভের দিকে! (৮১) তারা বলল, হে লূত্ব! নিশ্চয় আমরা আপনার রব প্রেরিত ফেরেশতা। তারা কখনই আপনার কাছে পৌঁছতে পারবে না। কাজেই আপনি রাতের কোনো এক সময়ে আপনার পরিবারবর্গসহ বের হয়ে পড়ুন এবং আপনাদের মধ্যে কেউ পেছন দিকে তাকাবে না, আপনার স্ত্রী ছাড়া। তাদের যা ঘটবে, তারও তাই ঘটবে। নিশ্চয় প্রভাত তাদের জন্য নির্ধারিত সময়। প্রভাত কি খুব কাছে নয়? (৮২) অতঃপর যখন আমাদের আদেশ আসল, তখন আমরা জনপদকে উল্টে দিলাম এবং তাদের উপর ক্রমাগত বর্ষণ করলাম পোড়ামাটির পাথর, (৮৩) যা আপনার রবের কাছে চিহ্নিত ছিল। আর এটা যালেমদের থেকে দূরে নয়’ (হূদ, ১১/৭৭-৮৩)

উল্লিখিত আয়াতসমূহ থেকে বুঝা যায়: ১. ফেরেশতাগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে সুদর্শন পুরুষ বেশে লূত্ব আলাইহিস সালাম–এর নিকট তাঁর ক্বওমকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এসেছিলেন। কিন্তু এই সম্মানিত মেহমানদের ইজ্জত রক্ষার দুশ্চিন্তায় লূত্ব আলাইহিস সালাম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। ২. লূত্ব আলাইহিস সালাম–এর সমকামী ক্বওম ঠিকই সেই আগত সুদর্শন মেহমানগণের দিকে দ্রুত ছুটে আসে। ৩. লূত্ব আলাইহিস সালাম তাদেরকে নারীদের সাথে বিবাহপূর্বক পবিত্র সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশনা প্রদান করেন এবং তাঁর মেহমানের ব্যাপারে তাঁকে লাঞ্ছিত করতে নিষেধ করেন। ৪. সমকামীরা কোনো কৈফিয়ত না শুনলে লূত্ব আলাইহিস সালাম তাঁর দুর্বলতার কথা সেই মেহমানদের সামনে বলেন এবং তখনই ফেরেশতামণ্ডলী তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন, তাঁরা আসলে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ফেরেশতা। সুতরাং দুষ্কৃতিকারীরা কোনোভাবেই তাঁর কাছে আসতে পারবে না। ৫. ফেরেশতামণ্ডলী লূত্ব আলাইহিস সালাম–কে তাঁর পরিবারবর্গসহ রাতেই ঐ এলাকা ছেড়ে যাওয়া এবং যাওয়ার সময়ে পেছনে না তাকানোর নির্দেশনা প্রদান করেন। ৬. তাঁরা তাঁকে তাঁর স্ত্রীকে রেখে যাওয়ার নির্দেশনা দেন, অথবা সেও সাথে যাবে কিন্তু সে পেছনে তাকাবে এবং সমকামীদের শাস্তির মুখোমুখি হবে মর্মে ঘোষণা দেন। ৭. তাদের ভয়াবহ ও অভূতপূর্ব শাস্তির নির্ধারিত সময় ছিল ঐদিন রাতগত সকালে সূর্যোদয়ের সময়। ৮. নির্ধারিত সময়ে সমকামীদের সাদূম জনপদ উল্টিয়ে দেওয়া হয় এবং তাদের উপর মুহুর্মুহু চিহ্নিত পাথর বর্ষণ করে সাজা দেওয়া হয়। ৯. সমকামীরা যে যালেম, আয়াতগুলোর শেষে সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে অন্য যালেমদেরকেও সাবধান করা হয়েছে।

[3] قَالَ فَمَا خَطْبُكُمْ أَيُّهَا الْمُرْسَلُونَ (57) قَالُوا إِنَّا أُرْسِلْنَا إِلَى قَوْمٍ مُجْرِمِينَ (58) إِلَّا آلَ لُوطٍ إِنَّا لَمُنَجُّوهُمْ أَجْمَعِينَ (59) إِلَّا امْرَأَتَهُ قَدَّرْنَا إِنَّهَا لَمِنَ الْغَابِرِينَ (60) فَلَمَّا جَاءَ آلَ لُوطٍ الْمُرْسَلُونَ (61) قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ مُنْكَرُونَ (62) قَالُوا بَلْ جِئْنَاكَ بِمَا كَانُوا فِيهِ يَمْتَرُونَ (63) وَأَتَيْنَاكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّا لَصَادِقُونَ (64) فَأَسْرِ بِأَهْلِكَ بِقِطْعٍ مِنَ اللَّيْلِ وَاتَّبِعْ أَدْبَارَهُمْ وَلَا يَلْتَفِتْ مِنْكُمْ أَحَدٌ وَامْضُوا حَيْثُ تُؤْمَرُونَ (65) وَقَضَيْنَا إِلَيْهِ ذَلِكَ الْأَمْرَ أَنَّ دَابِرَ هَؤُلَاءِ مَقْطُوعٌ مُصْبِحِينَ (66) وَجَاءَ أَهْلُ الْمَدِينَةِ يَسْتَبْشِرُونَ (67) قَالَ إِنَّ هَؤُلَاءِ ضَيْفِي فَلَا تَفْضَحُونِ (68) وَاتَّقُوا اللَّهَ وَلَا تُخْزُونِ (69) قَالُوا أَوَلَمْ نَنْهَكَ عَنِ الْعَالَمِينَ (70) قَالَ هَؤُلَاءِ بَنَاتِي إِنْ كُنْتُمْ فَاعِلِينَ (71) لَعَمْرُكَ إِنَّهُمْ لَفِي سَكْرَتِهِمْ يَعْمَهُونَ (72) فَأَخَذَتْهُمُ الصَّيْحَةُ مُشْرِقِينَ (73) فَجَعَلْنَا عَالِيَهَا سَافِلَهَا وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ حِجَارَةً مِنْ سِجِّيلٍ (74)

[৩] ‘(৫৭) তিনি বললেন, হে প্রেরিত (ফেরেশতা)গণ! আপনাদের আর বিশেষ কী উদ্দেশ্য আছে? (৫৮) তারা বলল, নিশ্চয় আমাদেরকে এক পাপিষ্ঠ সম্প্রদায়ের কাছে পাঠানো হয়েছে। (৫৯) তবে লূত্বের পরিবারের বিরুদ্ধে নয়, আমরা তো অবশ্যই তাদের সবাইকে রক্ষা করব, (৬০) কিন্তু তাঁর স্ত্রীকে নয়; আমরা স্থির করেছি যে, নিশ্চয় সে পেছনে অবস্থানকারীদেরই অন্তর্ভুক্ত। (৬১) অতঃপর ফেরেশতাগণ যখন লূত্ব-পরিবারের কাছে আসল, (৬২) তখন লূত্ব বললেন, আপনারা তো অপরিচিত লোক। (৬৩) তারা বলল, না, তারা যে বিষয়ে সন্দিহান ছিল, আমরা আপনার কাছে তা-ই নিয়ে এসেছি; (৬৪) আর আমরা আপনার কাছে সত্য সংবাদ নিয়ে এসেছি এবং অবশ্যই আমরা সত্যবাদী। (৬৫) কাজেই আপনি রাতের কোনো এক সময়ে আপনার পরিবারবর্গকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন এবং আপনি তাদের পেছনে চলুন। আর আপনাদের মধ্যে কেউ যেন পেছনে না তাকায়; আমাদেরকে যেখানে যেতে বলা হয়েছে, তোমরা সেখানে চলে যাও। (৬৬) আর আমরা তাকে এ বিষয়ে ফয়সালা জানিয়ে দিলাম যে, নিশ্চয় তাদেরকে ভোরে সমূলে বিনাশ করা হবে। (৬৭) আর নগরবাসী উল্লসিত হয়ে উপস্থিত হলো। (৬৮) তিনি বললেন, নিশ্চয় এরা আমার অতিথি; কাজেই তোমরা আমাকে অপমানিত করো না। (৬৯) আর তোমরা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করো এবং আমাকে হেয় করো না। (৭০) তারা বলল, আমরা কি দুনিয়ার সকল লোককে আশ্রয় দিতে আপনাকে নিষেধ করিনি? (৭১) লূত্ব বললেন, একান্তই যদি তোমরা কিছু করতে চাও, তবে আমার এ কন্যারা রয়েছে। (৭২) আপনার জীবনের শপথ! নিশ্চয় তারা তাদের নেশায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরছিল। (৭৩) অতঃপর সূর্যোদয়ের সময় বিকট আওয়াজ তাদেরকে পাকড়াও করল; (৭৪) তাতে আমরা জনপদটিকে উল্টিয়ে উপর-নিচ করে দিলাম এবং তাদের উপর পোড়ামাটির পাথর-কঙ্কর বর্ষণ করলাম’ (আল-হিজর, ১৫/৫৭-৭৪)

এ আয়াতগুলোতে আগের আয়াতগুলোর বাইরে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলো হচ্ছে— ১. সমকামীদেরকে পাপিষ্ঠ বলা হয়েছে। ২. তারা তাদের অজ্ঞতা, ভ্রষ্টতা ও উন্মাদনায় নিমজ্জিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ৩. লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর স্ত্রীকে পেছনে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয়েছে। ৪. রাতে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় লূত্ব আলাইহিস সালাম-কে তাঁর পরিবারবর্গের পেছনে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ৫. অন্যান্য শাস্তির মধ্যে বিকট আওয়াজও তাদের উপর আপতিত হয়েছিল বলে স্পষ্ট করা হয়েছে।

[4] وَلُوطًا آتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَتْ تَعْمَلُ الْخَبَائِثَ إِنَّهُمْ كَانُوا قَوْمَ سَوْءٍ فَاسِقِينَ

[৪] ‘(৭৪) আর লূত্বকে আমরা দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান এবং তাকে উদ্ধার করেছিলাম এমন এক জনপদ থেকে, যার অধিবাসীরা লিপ্ত ছিল অশ্লীল কাজে; নিশ্চয় তারা ছিল এক মন্দ ফাসেক্ব সম্প্রদায়’ (আল-আম্বিয়া, ২১/৭৪)

উল্লিখিত আয়াতটিতে যা পাই: ১. লূত্ব আলাইহিস সালাম-কে মহান আল্লাহ প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দিয়েছিলেন মর্মে জানানো হয়েছে। ২. তাঁর ক্বওম নোংরা কাজ করত এবং তারা নিকৃষ্ট ও ফাসেক্ব ক্বওম ছিল মর্মে ঘোষণা করা হয়েছে।

[5] وَقَوْمُ إِبْرَاهِيمَ وَقَوْمُ لُوطٍ (43) وَأَصْحَابُ مَدْيَنَ وَكُذِّبَ مُوسَى فَأَمْلَيْتُ لِلْكَافِرِينَ ثُمَّ أَخَذْتُهُمْ فَكَيْفَ كَانَ نَكِيرِ (44) فَكَأَيِّنْ مِنْ قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا وَهِيَ ظَالِمَةٌ فَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَى عُرُوشِهَا وَبِئْرٍ مُعَطَّلَةٍ وَقَصْرٍ مَشِيدٍ (45)

[৫] ‘(৪৩) আর ইবরাহীম ও লূত্বের সম্প্রদায়, (৪৪) আর মাদইয়ানবাসীরা; অনুরূপভাবে মিথ্যারোপ করা হয়েছিল মূসার প্রতিও। অতঃপর আমি কাফেরদেরকে অবকাশ দিয়েছিলাম, তারপর আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছিলাম। অতএব, (প্রত্যক্ষ করুন) আমার প্রত্যাখ্যান (শাস্তি) কেমন ছিল। (৪৫) অতঃপর আমরা বহু জনপদ ধ্বংস করেছি, যেগুলোর বাসিন্দা ছিল যালেম। ফলে এসব জনপদ তাদের ঘরের ছাদসহ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অনুরূপভাবে বহু কূপ পরিত্যক্ত হয়েছে এবং অনেক সুদৃঢ় প্রাসাদও!’ (আল-হাজ্জ, ২২/৪৩-৪৫)

[6] كَذَّبَتْ قَوْمُ لُوطٍ الْمُرْسَلِينَ (160) إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ لُوطٌ أَلَا تَتَّقُونَ (161) إِنِّي لَكُمْ رَسُولٌ أَمِينٌ (162) فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ (163) وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ (164) أَتَأْتُونَ الذُّكْرَانَ مِنَ الْعَالَمِينَ (165) وَتَذَرُونَ مَا خَلَقَ لَكُمْ رَبُّكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَلْ أَنْتُمْ قَوْمٌ عَادُونَ (166) قَالُوا لَئِنْ لَمْ تَنْتَهِ يَا لُوطُ لَتَكُونَنَّ مِنَ الْمُخْرَجِينَ (167) قَالَ إِنِّي لِعَمَلِكُمْ مِنَ الْقَالِينَ (168) رَبِّ نَجِّنِي وَأَهْلِي مِمَّا يَعْمَلُونَ (169) فَنَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ أَجْمَعِينَ (170) إِلَّا عَجُوزًا فِي الْغَابِرِينَ (171) ثُمَّ دَمَّرْنَا الْآخَرِينَ (172) وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ مَطَرًا فَسَاءَ مَطَرُ الْمُنْذَرِينَ (173)

[৬] ‘(১৬০) লূত্বের সম্প্রদায় রাসূলগণের প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল, (১৬১) যখন তাদের ভাই লূত্ব তাদেরকে বললেন, তোমরা কি তাক্বওয়া অবলম্বন করবে না? (১৬২) আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। (১৬৩) কাজেই তোমরা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করো এবং আমার আনুগত্য করো। (১৬৪) আর আমি এর জন্য তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না, আমার প্রতিদান তো সৃষ্টিকুলের রব-এর কাছেই আছে। (১৬৫) সৃষ্টিকুলের মধ্যে তোমরাই কি পুরুষের সাথে উপগত হও? (১৬৬) আর তোমাদের রব তোমাদের জন্য যে স্ত্রীগণকে সৃষ্টি করেছেন, তাদেরকে তোমরা বর্জন করে থাক। বরং তোমরা তো এক সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। (১৬৭) তারা বলল, হে লূত্ব! তুমি যদি নিবৃত্ত না হও, তবে অবশ্যই তুমি নির্বাসিত হবে। (১৬৮) লূত্ব বললেন, আমি অবশ্যই তোমাদের এ কাজের ঘৃণাকারী। (১৬৯) হে আমার রব! আমাকে এবং আমার পরিবার-পরিজনকে, তারা যা করে, তা থেকে রক্ষা করুন। (১৭০) তারপর আমরা তাকে এবং তার পরিবার-পরিজন সকলকে রক্ষা করলাম (১৭১) এক বৃদ্ধ ছাড়া, যে ছিল পেছনে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত। (১৭২) তারপর আমরা অপর সকলকে ধ্বংস করলাম। (১৭৩) আর আমরা তাদের উপর শাস্তিমূলক বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম, ভীতি প্রদর্শিতদের জন্য এ বৃষ্টি ছিল কত নিকৃষ্ট!’ (আশ-শূআরা, ২৬/১৬০-১৭৩)

এসব আয়াতে নতুন যে তথ্য পাওয়া যায়: ১. লূত্ব আলাইহিস সালাম তাঁর ক্বওমের সামনে যথার্থ যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছিলেন, তোমাদের রব তোমাদের জন্য যে জোড়া (নারী) সৃষ্টি করেছেন, তা ছেড়ে তোমরা কীভাবে পুরুষের কাছে জৈবিক চাহিদা মেটাতে যেতে পারো! ২. স্বভাবজাত বিষয় পরিত্যাগ করে নোংরা কাজ করার কারণে তাদেরকে সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ৩. সমকামী ক্বওম তাদের নবী ও তাঁর অনুসারীগণকে এলাকা থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। কারণ তাঁরা তাদের মন্দ কর্মকে সমর্থন করেননি। ৪. লূত্ব আলাইহিস সালাম তাঁর ক্বওমের নোংরা কাজকে ঘৃণা করে তা থেকে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে রক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন।

[7] وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ وَأَنْتُمْ تُبْصِرُونَ (54) أَئِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ شَهْوَةً مِنْ دُونِ النِّسَاءِ بَلْ أَنْتُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ (55) فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَنْ قَالُوا أَخْرِجُوا آلَ لُوطٍ مِنْ قَرْيَتِكُمْ إِنَّهُمْ أُنَاسٌ يَتَطَهَّرُونَ (56) فَأَنْجَيْنَاهُ وَأَهْلَهُ إِلَّا امْرَأَتَهُ قَدَّرْنَاهَا مِنَ الْغَابِرِينَ (57) وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ مَطَرًا فَسَاءَ مَطَرُ الْمُنْذَرِينَ (58)

[৭] ‘(৫৪) আর স্মরণ করুন লূত্বের কথা, তিনি তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা দেখে-শুনে কেন অশ্লীল কাজ করছ? (৫৫) তোমরা কি কামতৃপ্তির জন্য নারীকে ছেড়ে পুরুষে উপগত হবে? তোমরা তো এক অজ্ঞ সম্প্রদায়। (৫৬) উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু বলল, লূত্ব-পরিবারকে তোমরা জনপদ থেকে বহিষ্কার করো, এরা তো এমন লোক, যারা পবিত্র থাকতে চায়। (৫৭) অতঃপর আমরা তাকে ও তার পরিজনবৰ্গকে উদ্ধার করলাম, তার স্ত্রী ছাড়া, আমরা তাকে অবশিষ্টদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। (৫৮) আর আমরা তাদের উপর ভয়ংকর বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম; সুতরাং ভীতি প্ৰদৰ্শিতদের জন্য এ বর্ষণ কতই না নিকৃষ্ট ছিল!’ (আন-নামল, ২৭/৫৪-৫৮)

উল্লিখিত আয়াতসমূহে নতুন যা পাই: ১. লূত্ব আলাইহিস সালাম তাঁর ক্বওমকে ফেরানোর উদ্দেশ্যে তাদের নিকট স্পষ্ট প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, দেখে-শুনে তোমরা কীভাবে নোংরা কাজটি করতে পারো? ২. তাদের এমন অশ্লীল কর্মের মূল কারণ ছিল অজ্ঞতা। সেজন্য তিনি তাদেরকে অজ্ঞ ও মূর্খ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

[8] وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ إِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِنَ الْعَالَمِينَ (28) أَئِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ وَتَقْطَعُونَ السَّبِيلَ وَتَأْتُونَ فِي نَادِيكُمُ الْمُنْكَرَ فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَنْ قَالُوا ائْتِنَا بِعَذَابِ اللَّهِ إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ (29) قَالَ رَبِّ انْصُرْنِي عَلَى الْقَوْمِ الْمُفْسِدِينَ (30) وَلَمَّا جَاءَتْ رُسُلُنَا إِبْرَاهِيمَ بِالْبُشْرَى قَالُوا إِنَّا مُهْلِكُو أَهْلِ هَذِهِ الْقَرْيَةِ إِنَّ أَهْلَهَا كَانُوا ظَالِمِينَ (31) قَالَ إِنَّ فِيهَا لُوطًا قَالُوا نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَنْ فِيهَا لَنُنَجِّيَنَّهُ وَأَهْلَهُ إِلَّا امْرَأَتَهُ كَانَتْ مِنَ الْغَابِرِينَ (32) وَلَمَّا أَنْ جَاءَتْ رُسُلُنَا لُوطًا سِيءَ بِهِمْ وَضَاقَ بِهِمْ ذَرْعًا وَقَالُوا لَا تَخَفْ وَلَا تَحْزَنْ إِنَّا مُنَجُّوكَ وَأَهْلَكَ إِلَّا امْرَأَتَكَ كَانَتْ مِنَ الْغَابِرِينَ (33) إِنَّا مُنْزِلُونَ عَلَى أَهْلِ هَذِهِ الْقَرْيَةِ رِجْزًا مِنَ السَّمَاءِ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (34)

[৮] ‘(২৮) আর স্মরণ করুন লূত্বের কথা, যখন তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, নিশ্চয় তোমরা এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের আগে সৃষ্টিকুলের কেউ করেনি। (২৯) তোমরাই তো পুরুষে উপগত হচ্ছ, তোমরাই তো রাহাজানি করে থাক এবং তোমরাই তো নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে ঘৃণ্য কাজ করে থাক। উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু এটাই বলল, আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আনয়ন করো—তুমি যদি সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাক। (৩০) তিনি বললেন, হে আমার রব! বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করুন। (৩১) আর যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ সুসংবাদসহ ইবরাহীমের কাছে আসল, তারা বলেছিল, নিশ্চয় আমরা এ জনপদবাসীকে ধ্বংস করব, এর অধিবাসীরা তো যালেম। (৩২) ইবরাহীম বললেন, এ জনপদে তো লূত্ব রয়েছে। তারা বলল, সেখানে কারা আছে, তা আমরা ভালো করে জানি, নিশ্চয় আমরা লূত্বকে ও তার পরিজনবৰ্গকে রক্ষা করব, তার স্ত্রীকে ছাড়া; সে তো পেছনে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত। (৩৩) আর যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ লূত্বের কাছে আসল, তখন তাদের জন্য তিনি বিষণ্ন হয়ে পড়লেন এবং নিজেকে তাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করলেন। আর তারা বলল, ভয় করবেন না, দুঃখও করবেন না; আমরা আপনাকে ও আপনার পরিজনবৰ্গকে রক্ষা করব, আপনার স্ত্রী ছাড়া; সে তো পেছনে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত; (৩৪) নিশ্চয় আমরা এ জনপদবাসীদের উপর আকাশ হতে শাস্তি নাযিল করব, কারণ তারা পাপাচার করছিল’ (আল-আনকাবূত, ২৯/২৮-৩৪)

উপর্যুক্ত আয়াতসমূহ থেকে নতুন যা পাই: ১. লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর সমকামী সম্প্রদায় শুধু তাদের এলাকার মানুষের সাথেই সমকামিতা করত না; বরং ঐ এলাকায় কোনো মুসাফির আসলে তার সাথেও এ জঘন্য কাজ করার চেষ্টা করত। আর এভাবে তারা মুসাফিরদের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। ২. তারা তাদের ক্লাবে বা জনসমাগমস্থলে সমকামিতা ছাড়াও নানা ধরনের নোংরা কথা ও কাজে লিপ্ত হতো। ৩. লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর দাওয়াত গ্রহণ না করে তাঁর ক্বওম হঠকারিতা প্রদর্শন করে বলেছিল, তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকলে আল্লাহর আযাব আমাদের নিকট নিয়ে এসো। ৪. ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও লূত্ব আলাইহিস সালাম সমসাময়িক নবী ছিলেন; বরং লূত্ব আলাইহিস সালাম ছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর ভাতিজা। ৫. যেসব ফেরেশতার মাধ্যমে সমকামীদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, তারা সর্বপ্রথম ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর কাছে এসেছিলেন এবং তাঁকে এ বিষয়ে সংবাদ দিয়েছিলেন। ৬. সমকামীদেরকে সরাসরি যালেম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ৭. তাদেরকে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বলা হয়েছে।

[9] وَإِنَّ لُوطًا لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ (133) إِذْ نَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ أَجْمَعِينَ (134) إِلَّا عَجُوزًا فِي الْغَابِرِينَ (135) ثُمَّ دَمَّرْنَا الْآخَرِينَ (136) وَإِنَّكُمْ لَتَمُرُّونَ عَلَيْهِمْ مُصْبِحِينَ (137) وَبِاللَّيْلِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (138)

[৯] ‘(১৩৩) আর নিশ্চয় লূত্ব ছিলেন রাসূলদের একজন। (১৩৪) স্মরণ করুন, যখন আমরা তাকে ও তার পরিবারের সকলকে উদ্ধার করেছিলাম (১৩৫) পেছনে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত এক বৃদ্ধা ছাড়া। (১৩৬) অতঃপর অবশিষ্টদেরকে আমরা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছিলাম। (১৩৭) আর তোমরা তো ধ্বংসাবশেষগুলো অতিক্রম করে থাক সকালে (১৩৮) ও সন্ধ্যায়। তবুও কি তোমরা বোঝ না?’ (আছ-ছফফাত, ৩৭/১৩৩-১৩৮)

[10] كَذَّبَتْ قَبْلَهُمْ قَوْمُ نُوحٍ وَعَادٌ وَفِرْعَوْنُ ذُو الْأَوْتَادِ (12) وَثَمُودُ وَقَوْمُ لُوطٍ وَأَصْحَابُ الْأَيْكَةِ أُولَئِكَ الْأَحْزَابُ (13) إِنْ كُلٌّ إِلَّا كَذَّبَ الرُّسُلَ فَحَقَّ عِقَابِ (14) وَمَا يَنْظُرُ هَؤُلَاءِ إِلَّا صَيْحَةً وَاحِدَةً مَا لَهَا مِنْ فَوَاقٍ (15)

[১০] ‘(১২) এদের আগেও রাসূলদের প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল নূহের সম্প্রদায়, আদ ও কীলকওয়ালা ফেরাউন, (১৩) ছামূদ, লূত্ব সম্প্রদায় ও আইকার অধিবাসী; ওরা ছিল এক-একটি বিশাল বাহিনী। (১৪) তাদের প্রত্যেকেই রাসূলগণের প্ৰতি মিথ্যারোপ করেছিল। ফলে তাদের ক্ষেত্রে আমার শাস্তি ছিল যথার্থ। (১৫) আর এরা তো কেবল অপেক্ষা করছে একটি মাত্র প্রচণ্ড শব্দের, যাতে কোনো বিরাম থাকবে না’ (ছোয়াদ, ৩৮/১২-১৫)

উপর্যুক্ত আয়াতসমূহ থেকে নতুন যা পাই: ১. নূহ আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায়, আদ, ফেরাউন, ছামূদ, লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায় ও আইকার অধিবাসীরা সবাই আল্লাহর নাফরমানী ও কুফরীর ক্ষেত্রে একই ঘাটের মাঝি ছিল। ২. তারা সবাই তাদের রাসূলগণকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল এবং সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিল।

[11] وَعَادٌ وَفِرْعَوْنُ وَإِخْوَانُ لُوطٍ (13) وَأَصْحَابُ الْأَيْكَةِ وَقَوْمُ تُبَّعٍ كُلٌّ كَذَّبَ الرُّسُلَ فَحَقَّ وَعِيدِ (14)

[১১] ‘(১৩) আর আদ, ফেরাউন ও লূত্ব সম্প্রদায়। (১৪) আর আইকার অধিবাসী ও তুব্বা সম্প্রদায়; তারা সকলেই রাসূলগণের প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল, ফলে তাদের উপর আমার শাস্তি যথার্থভাবে আপতিত হয়েছে’ (ক্ব-, ৫০/১৩-১৪)

[12] قَالَ فَمَا خَطْبُكُمْ أَيُّهَا الْمُرْسَلُونَ (31) قَالُوا إِنَّا أُرْسِلْنَا إِلَى قَوْمٍ مُجْرِمِينَ (32) لِنُرْسِلَ عَلَيْهِمْ حِجَارَةً مِنْ طِينٍ (33) مُسَوَّمَةً عِنْدَ رَبِّكَ لِلْمُسْرِفِينَ (34)

[১২] ‘(৩১) ইবরাহীম বললেন, হে প্রেরিত ফেরেশতাগণ! আপনাদের বিশেষ কাজ কী? (৩২) তারা বলল, নিশ্চয় আমরা এক অপরাধী সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরিত হয়েছি, (৩৩) যাতে তাদের উপর নিক্ষেপ করি মাটির শক্ত ঢেলা, (৩৪) যা সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য চিহ্নিত আপনার রবের কাছ থেকে’ (আয-যারিয়াত, ৫১/৩১-৩৪)

[13] كَذَّبَتْ قَوْمُ لُوطٍ بِالنُّذُرِ (33) إِنَّا أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ حَاصِبًا إِلَّا آلَ لُوطٍ نَجَّيْنَاهُمْ بِسَحَرٍ (34) نِعْمَةً مِنْ عِنْدِنَا كَذَلِكَ نَجْزِي مَنْ شَكَرَ (35)

[১৩] ‘(৩৩) লূত্ব সম্প্রদায় মিথ্যারোপ করেছিল সতর্ককারীদের প্রতি, (৩৪) নিশ্চয় আমরা তাদের উপর পাঠিয়েছিলাম পাথর বহনকারী প্রচণ্ড ঝটিকা, কিন্তু লূত্ব-পরিবারের উপর নয়; তাদেরকে আমরা উদ্ধার করেছিলাম রাতের শেষাংশে, (৩৫) আমাদের পক্ষ থেকে অনুগ্রহস্বরূপ; যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, আমরা এভাবেই তাকে পুরস্কৃত করে থাকি’ (আল-ক্বমার, ৫৪/৩৩-৩৫)

(ইনশা-আল্লাহ চলবে)


আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী

বিএ (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এমএ এবং এমফিল, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।


[1]. ইবনু ফারিস, মু‘জামু মাক্বাইসিল লুগাহ (দারুল ফিকর, ১৩৯৯ হি./১৯৭৯ খৃ.), ৫/২২১।

[2]. ইবনু সাইয়্যিদাহ, আল-মুহকামু ওয়াল মুহীতুল আ‘যামু (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪২১ হি./২০০০ খৃ.), ৯/২৩৮।

[3]. নাফরাবী, আল-ফাওয়াকিহ আদ-দাওয়ানী আলা রিসালাতি ইবনি আবী যায়েদ আল-ক্বায়রাওয়ানী (দারুল ফিকর, ১৪১৫ হি./১৯৯৫ খৃ.), ১/১১৮।

[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৩৮।

[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৪০।

Magazine