কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

সময় তো ফুরিয়ে এলো, নববর্ষ ও পহেলা বৈশাখে কেন আনন্দ কর?

হে মুসলিম! শোনো

সময় অতিবাহিত হচ্ছে দ্রুতগতিতে। পৃথিবী নাকি আধুনিক হচ্ছে। নিত্যনতুন আবিষ্কৃত হচ্ছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। শান্তির ঠিকেদারেরা তৈরি করেছে মানুষ মারার মারণাস্ত্র। মানবতা আজ ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। পৃথিবীতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কেউ কাউকে এক বিঘত জমি ছেড়ে দিতে রাজি নয়। অথচ সৃষ্টিকর্তার হুঁশিয়ারি, ‘মানুষের হিসাব কিতাবের সময় নিকটবর্তী, অথচ তারা বেখবর হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে’ (আল-আম্বিয়া, ২১/০১)

একজন মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করার পর, শিশু থেকে ধীরে ধীরে যৌবনে পদার্পণ করে। অতঃপর বার্ধক্য তাকে গ্রাস করে। তারপর এই অল্প সময়ের সুখ-দুঃখের জীবন দুনিয়াতে উপভোগ করে তাকে পাড়ি দিতে হয়— অনন্ত এক গন্তব্যে। —মৃত্যু! মৃত্যু হলো একটি চিরসত্য বিষয়। পবিত্র কুরআনে উচ্চারিত হয়েছে, ‘নিশ্চয় প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে’ (আলে ইমরান, ৩/১৮৫)। আমরা ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অথচ আমরা সৃষ্টিকর্তার বিধানের প্রতি তোয়াক্কা করি না। আমাদের প্রতিদিনই কেটে যায় সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতায়।

পহেলা বৈশাখ এসেছে। এসেছে বাংলা নতুন বছর। বাংলা নববর্ষ। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে, নতুন বছরকে বরণ করে নিতে তুমি প্রস্তুত। বর্ষবরণের নামে আনন্দোৎযাপনে মেতে ওঠা, ‘শুভ নববর্ষ’ বলে উইশ করা, ইলিশ-পান্তা খাওয়া, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ, গান-বাজনা, মেলা ও অশ্লীলতার দিকে ধাবিত হওয়া তোমার কাছে হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির অঙ্গ। অথচ দাবি কর— তুমি মুসলিম।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘তার নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে রাত, দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না এবং চন্দ্রকেও না। আর তোমরা সেই আল্লাহকেই সিজদা করো, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন। যদি তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করতে চাও’ (হা-মীম আস-সাজদা, ৪১/৩৭)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘নিশ্চয় মাসসমূহের সংখ্যা আল্লাহর কাছে ১২ মাস, সুনির্দিষ্ট রয়েছে আল্লাহর কিতাবে সেদিন থেকে যেদিন তিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন’ (আত-তওবা, ৮/৩৬)। সুতরাং, বর্ষপরিক্রমা ও ঋতুবৈচিত্র্য মহান আল্লাহর হুকুমেই হয়ে থাকে।

ভারতবর্ষে মুঘলসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরী সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর সন এবং আরবী হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।[1]

হে মুসলিম! বছর তো একটি আপেক্ষিক বিষয়। নতুন বছর এলো, তার অর্থ তোমার জীবন থেকে একটি বছর কমে গেল— এই চিন্তা-ভাবনার উদ্রেক কবে হবে? —তা না করে তুমি, দিনটিকে বরণ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছো। বাংলা নববর্ষ সাড়ম্বরে পালন করছ। বৈশাখী মেলায় অংশগ্রহণ করছ। রমনা বটমূলে এসে রবি ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’ গান গেয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছ। তুমি মঙ্গল শোভাযাত্রায় শরীক হচ্ছো। তোমার কাছে ইলিশ-পান্তা হয়ে উঠেছে বৈশাখের এক অনুষঙ্গ। তুমি পহেলা বৈশাখের নামে অমুসলিম সংস্কৃতিকে সাদরে গ্রহণ করছ। গান-বাজনার প্রতি আসক্ত হচ্ছ। নববর্ষের দিন শুভেচ্ছা বিনিময় করছ। তুমি বর্ষবরণের নামে নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতা চর্চায় মগ্ন। তুমি করছ আনন্দের নামে অপচয়। —এছাড়াও আরও কত কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি, হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিতে জর্জরিত তার তালিকা দীর্ঘ।

নতুন বছরের বর্ষবরণে তোমার উদ্দেশ্য আনন্দ-উল্লাস, হৈ-হুল্লোড় করে সময় পার করা। কিন্তু তুমি কি ভেবে দেখেছ, তুমি মুসলিম। তোমার সৃষ্টিকর্তা তোমাকে দুনিয়াতে আনন্দ-ফুর্তি করে সময় পার করার জন্য পাঠাননি। তুমি বলতে পার না, ‘খাও দাও ফুর্তি করো, দুনিয়াটা মস্ত বড়’। তোমার প্রভু তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর ইবাদত করার জন্য। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্য যে, যেন তারা আমারই ইবাদত করে’ (আয-যারিয়াত, ৫১/৫৬)

হে মুসলিম! তোমার অবগতির জন্য বলি, এ জীবন পরকালের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। তোমার প্রতিপালক জানিয়েছেন, ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, যেন তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন, কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ?’ (আল-মুলক, ৬৭/২)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা ক্ষণস্থায়ী এই জীবনের ব্যবস্থা এজন্য করেছেন, যাতে তিনি পরীক্ষা করতে পারেন যে, এই জীবনের সদ্ব্যবহার কে করে? যে এই জীবনকে ঈমান ও আনুগত্যের কাজে ব্যবহার করবে, তার জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান এবং যে এর অন্যথা করবে, তার জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।[2]

বন্ধু! তুমি তো এই জীবনের বহু পরীক্ষাতে বসেছো। —একাডেমিক পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষা, বা আরও অন্য কোনো পরীক্ষা। ধরো— কোনো পরীক্ষার সময় তিন ঘণ্টা। পরীক্ষা হলে তোমার সঙ্গে তোমারই মতো আরও অনেক পরীক্ষার্থী আছে। এখন এই তিন ঘণ্টা সময়কে যদি তুমি ইচ্ছাকৃত অবহেলা করে হৈ-হুল্লোড় করে পার করে পরীক্ষাতে ফেল কর, তাহলে তোমাকে কী বলা হবে? —বোকা নয় কি? —হ্যাঁ। কেননা, পরীক্ষা হলে সময়কে তুমি মূল্যায়ন করনি। পক্ষান্তরে তোমার বন্ধু, সময়কে মূল্যায়ন করে, গুরুত্ব দিয়ে প্রশ্নের উত্তরগুলো লিখেছে, ফলে সে পরীক্ষাতে পাশ করে গেছে। তোমার বন্ধুকে বলা হয়— বুদ্ধিমান।

বন্ধু! দুনিয়ার পরীক্ষায় ফেল করলে, পরের বার পুনরায় পরীক্ষায় বসার সুযোগ থাকে। কিন্তু জীবনের পরীক্ষার ঘণ্টা যদি বেজে যায়, তোমার দেহ থেকে যদি প্রাণবায়ু বের হয়ে যায়— তাহলে তোমার জীবনের পরীক্ষা সম্পূর্ণ শেষ। দ্বিতীয় বারের কোনো সুযোগ নেই। তবুও তুমি সচেতন হবে না?!

তুমি মুসলিম! তোমার ধর্ম ইসলাম। তোমার নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মহান আল্লাহর প্রতিটি ইবাদত তোমার সংস্কৃতি। মুসলিম সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির অনুশীলন করতে তুমি বাধ্য। তোমার সংস্কৃতির ম্যানুয়াল গাইড হলো— পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। পক্ষান্তরে, বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুশীলন তোমার জন্য অবৈধ। তোমার নবীর হুঁশিয়ারি, ‘যে ব্যক্তি বিজাতীর সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে’।[3]

হে মুসলিম! পহেলা বৈশাখের ‘বর্ষবরণ’ অনুষ্ঠান উদযাপন তোমার সংস্কৃতি নয়। এটি তোমার ইসলামী শরীআতের সাথে সাংঘর্ষিক একটি সংস্কৃতি। এটি অমুসলিমদের সংস্কৃতি। যা তুমি নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছ।

হে মুসলিম! তুমি নববর্ষে সকলকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছ। মতবিনিময় করছ। বলছ— ‘শুভ নববর্ষ’। অথচ তুমি মুসলিম। কামনা বা শুভেচ্ছা নয়, দু‘আ হলো ইসলামী রীতি। শুভেচ্ছা অর্থ আমাদের মনের ভালো ইচ্ছা। আর মানুষের কামনা বা ইচ্ছার মূল্য কী? মূল্য তো মহান আল্লাহর ইচ্ছার। এজন্য তার দরবারে দু‘আ করতে হবে নতুন বছরের সফলতার জন্য। এছাড়া অন্তসারশূন্য ইচ্ছা কামনা কোনো পরিবর্তন আনে না; বরং পরিবর্তনের সুদৃঢ় সংকল্প, নতুন বছরকে নতুনভাবে গড়ার সুদৃঢ় ইচ্ছা ও কর্মই পরিবর্তন আনে। কুরআন ও হাদীছের নির্দেশনা থেকে আমরা জানি যে, সৃষ্টির সেবা ও মানুষের উপকারই জাগতিক জীবনে মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের অন্যতম উপায়। অনুরূপভাবে মানুষের ক্ষতি করা বা ব্যক্তি বা সমাজের অধিকার নষ্ট করা আল্লাহর গযব ও শাস্তি লাভের অন্যতম কারণ। এসো আমরা সকলে মহান আল্লাহর নির্দেশ মতো তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে মানুষের অধিকার আদায় ও ক্ষতি থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে নতুন বছরের সূচনা করি। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দিন।[4]

বন্ধু আমার! তুমি পহেলা বৈশাখে ‘ইলিশ-পান্তা’য় মেতে উঠেছ। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে, বৈশাখী সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার হয়েছে এখন বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ‘ইলিশ’। কথিত সংস্কৃতিসেবীরা এদিন ‘ইলিশ-পান্তা’ খেয়ে থাকেন। অথচ ইলিশের জাটকা বৃদ্ধির মওসুম হলো নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত। ইলিশ সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। বাংলাদেশের জিডিপিতে অর্থাৎ মোট জাতীয় আয়ে এককভাবে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ। এ মাছ মানুষের রক্তের ক্ষতিকর কোলেষ্টেরল-এর মাত্রা কমায়। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। এ ধরনের একটি মহামূল্যবান মাছকে নির্মূল করার মিশনে নামেন উভয় বাংলার কথিত বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক সুশীল সমাজভুক্ত একদল লোক। এরা হাজার হাজার টাকা খরচ করে ‘ইলিশ-পান্তা’ খাওয়ার বিলাসী প্রতিযোগিতায় নামেন এদিন। যা পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ যাদের, তাদের সাথে নিষ্ঠুর রসিকতার শামিল।[5]

বন্ধু আমার! তুমি মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করছ। মঙ্গল শোভাযাত্রা কী?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহরের শাহবাগ-রমনা এলকায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই শোভাযাত্রায় চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। এছাড়াও বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়।[6]

তুমি মুসলিম। তুমি কীভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পার। যেখানে মুখোশ, মূর্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। এখান থেকে তুমি কীভাবেই বা মঙ্গল লাভের আশা করতে পার। অথচ তোমার জানা উচিত, ছবি ও মূর্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কেউ প্রাণীর ছবি আঁকে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাতে প্রাণ ফুঁকে দেওয়ার জন্য বাধ্য করা হবে। কিন্তু সে প্রাণ ফুঁকতে পারবে না’।[7] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ফেরেশতা ঐ ঘরে প্রবেশ করে না, যে ঘরে কুকুর থাকে এবং ঐ ঘরেও না, যে ঘরে ছবি থাকে’।[8] তোমার আরও জেনে রাখা উচিত, কোনো সময়কে শুভ বা অশুভ মনে করা কোনো মুসলিমের কাজ নয়। মঙ্গল-অমঙ্গলের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘শোনো! তাদের অশুভ আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণাধীন, কিন্তু তাদের অধিকাংশ তা জানে না’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৩১)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো বস্তুকে কুলক্ষণ মনে করা শিরক’।[9] তিনি আরও বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে ব্যক্তি (কোনো বস্তু, ব্যক্তি, কর্ম বা কালকে) অশুভ লক্ষণ বলে মানে অথবা যার জন্য অশুভ লক্ষণ দেখা হয়, যে ব্যক্তি (ভাগ্য) গণনা করে অথবা যার জন্য (ভাগ্য) গণনা করা হয়। আর যে ব্যক্তি জাদু করে অথবা যার জন্য (বা আদেশে) জাদু করা হয়’।[10]

বন্ধু আমার! এছাড়াও তুমি বৈশাখী উৎসব উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ কর, যেখানে গান-বাজনা চলে, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ থাকে, অশ্লীলতার চর্চা হয়। কিন্তু তোমার জেনে রাখা ভালো, গান-বাজনা ইসলামে হারাম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞ লোকদের আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করার জন্য অসার বাক্য ক্রয় করে এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। ওদেরই জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি’ (লুক্বমান, ৩১/৬)। ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘সেই আল্লাহর কসম, যিনি ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই! নিশ্চয় তা (অসার বাক্য) হচ্ছে গান।’ এছাড়াও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমার উম্মতের কিছু লোক এমন হবে, যারা যেনা, (পুরুষের জন্য) সিল্ক, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে’।[11] এছাড়াও, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও অশ্লীলতার চর্চা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ’ (বানী ইসরাঈল, ১৭/৩২)

বন্ধু আমার! তোমাকে তো আগেই বলেছি, আমাদের এই জীবন পরকালের জন্য পরীক্ষা। পরীক্ষার ফলাফল তোমাকে সুনিশ্চিত করবে— তোমার ফাইনাল ডেস্টিনেশন কোথায়? —জান্নাত, না-কি জাহান্নাম? সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে যতটুকু আয়ু নিয়ে এসেছ, ততটুকুই তোমার সময়। এই সময়টুকুর কোনোভাবে অবমূল্যায়ন করলে চলবে না। তা নাহলে পস্তাতে হবে শেষ বিচারের দিন। হ্যাঁ— আমরা প্রতি মিনিটে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছি। মৃত্যু আমাদের এই জীবনের পরিসমাপ্তি। তারপর...! তারপর শুরু হবে নতুন জীবন। কবরের জীবন। কিয়ামতের মাঠ। পুলসিরাত। জান্নাত। জাহান্নাম। এ জীবন হলো আমাদের কর্ম জগৎ। এর পরের জীবন কর্মফলের জগৎ। পহেলা বৈশাখ আসার অর্থ, সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে নিয়ে আসা আমার আয়ুর একটি বছর শেষ হয়ে গেল। এক বছর আয়ু কমে গেল আমার জীবন থেকে। আমার জীবন বসন্ত থেকে খসে পড়ল আরও একটি বছর। সেই আমি, কীভাবে বর্ষবরণে মেতে উঠতে পারি? কীভাবে আনন্দ-উল্লাস, হৈ-হুল্লোড়ে সময় কাটাতে পারি? কীভাবে সৃষ্টিকর্তার বিধানকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারি? আমার তো চিন্তা করা উচিত ছিল, বিগত দিনে কী করলাম! আমার তো হিসেব করা উচিত ছিল, কতটুকু ইবাদতে সময় পার করলাম! আমার তো আত্মসমীক্ষা করা উচিত ছিল। আমার নিজের নফসের কাছে জবাবদিহি করা উচিত ছিল। মৃত্যুর পরে এই জীবনের সমস্ত কর্মের হিসাব দিতে হবে ভেবে আমার আতঙ্কিত হওয়া উচিত ছিল। আমার উচিত ছিল সেদিনের কথা ভেবে ভীত হওয়া, যেদিন কেরামান-কাতেবীনের তৈরিকৃত আমলনামা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে; সেদিন প্রত্যেককে বলা হবে, ‘তুমি তোমার কিতাব (আমলনামা) পাঠ করো, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব নিকাশের জন্য যথেষ্ট’ (বানী ইসরাঈল ১৭/১৩-১৪)

সেই আমি কিনা...

আমার চিন্তা এক মুহূর্তে থমকে গেল! আমি মুসলিম! আমার নিজস্ব সমাজ ও সংস্কৃতি আছে। আমার নিজস্ব কৃষ্টি ও কালচার আছে। আমার নিজস্ব আদর্শ আছে। আমার স্বাধীন সত্তা আছে। আমার স্বাধীন চিন্তাশক্তি আছে। আমার আত্মমর্যাদাবোধ আছে। আমি প্রগতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পারি না। আমি আমার স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিতে পারি না। আমার সমাজ ও সংস্কৃতি কোনো মানুষের বানানো নয়। স্রষ্টা প্রেরিত। কুরআন ও হাদীছ হলো উৎস। সেই আমি, কীভাবে মানুষের বানানো স্রষ্টার বিধান উপেক্ষিত নিয়মকে সংস্কৃতি বলতে পারি?— না, ওটা সংস্কৃতি নয়। ওটা অপসংস্কৃতি। আমার সংস্কৃতি কুরআন ও হাদীছ দিয়ে মোড়ানো। আমি কীভাবে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে মেতে উঠতে পারি। আমি তো স্রষ্টার দাস। আমার কর্তব্য তো তারই আনুগত্য করা।

ইসলাম আমার দ্বীন। ইসলাম আমার ধর্ম। আমি ইসলামের অনুসারী। আমি মুসলিম। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (আল-বাক্বারা, ২/২০৮)

—হ্যাঁ, আমাকে পুরোপুরিভাবে ইসলামে প্রবেশ করতে হবে। এমন করা যাবে না, যে নির্দেশগুলো আমার স্বার্থ ও মন পছন্দ হবে, সেগুলোর উপর আমল করব এবং অন্যান্য নির্দেশগুলো ত্যাগ করব।

বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ইসলাম সমর্থিত নয়। দিবস উদযাপনের বৈধতা ইসলামে নেই। ইসলামে আছে বাৎসরিক দুটি ঈদ। আছে সাপ্তাহিক ঈদ— জুমআ। আমরা প্রতিদিন ও প্রতিরাতই বরণ করি। তবে তা মানবরচিত নয়। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ মোতাবেক। আমরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করি। প্রতি সপ্তাহে, বৃহস্পতিবার ও সোমবার ছিয়াম পালন করি। প্রতি মাসে তিনটি ছিয়াম পালন করি। রামাযান মাসে পুরো মাস ছিয়াম পালন করি। প্রতি রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করি। প্রতি সকাল বেলা চাশতের ছালাত আদায় করি। ছাদাক্বা করি। যাকাত আদায় করি। হজ্জ করতে যাই। আমাদের এই ফরয ও নফল ইবাদতগুলো পালনের মধ্য দিয়ে বরণ করি— প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত, প্রতিটি সপ্তাহ, প্রতিটি মাস ও প্রতিটি বছর। আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রায় কল্যাণ খুঁজি না। কল্যাণ খুঁজি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথায়। তিনি বলেছেন, ‘রাতের মধ্যে এমন একটি সময় আছে, যদি কোনো মানুষ সে সময় লাভ করতে পারে, তবে আল্লাহর নিকট ইহকাল ও পরকালের কোনো কল্যাণ চাইলে আল্লাহ তাকে দান করেন। আর এ সময়টি প্রতি রাতেই রয়েছে’।[12] এছাড়াও জুমআর দিন সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, ‘জুমআর দিন হলো সপ্তাহের দিনসমূহের নেতা এবং তা আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত। এ দিনটি আল্লাহর নিকট কুরবানীর দিন ও ঈদুল ফিত্বরের দিনের চেয়ে অধিক সম্মানিত। এ দিনে রয়েছে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য : এ দিন আল্লাহ আদম আলাইহিস সালাম-কে সৃষ্টি করেন, এ দিনই আল্লাহ তাঁকে পৃথিবীতে পাঠান এবং এ দিনই আল্লাহ তাঁর মৃত্যু দান করেন। এ দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, কোনো বান্দা তখন আল্লাহর নিকট কিছু প্রার্থনা করলে তিনি তাকে তা দান করেন, যদি না সে হারাম জিনিসের প্রার্থনা করে এবং এ দিনই কিয়ামত সংঘটিত হবে। নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ, আসমান-জমীন, বায়ু, পাহাড়-পর্বত ও সমুদ্র সবই জুমআর দিন শঙ্কিত হয়’।[13] আমরা কল্যাণ খুঁজি— লায়লাতুল ক্বদরের রাত্রিতে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম (আল-ক্বদর, ৯৭/৩)। এগুলোই আমাদের ইবাদত। এই ইবাদতগুলোই আমাদের সংস্কৃতি। মুসলিম সংস্কৃতি। এগুলোই আমাদের আল্লাহর দয়া, রহমত ও বরকত পেতে সাহায্য করবে। এগুলোই আমাদের ‘জান্নাত’ নামক ফাইনাল ডেস্টিনেশনে পৌঁছে দেবে।

আর তুমি— স্রষ্টার বিধানকে উপেক্ষা করে, অপসংস্কৃতি ও কুসংস্কারকে বরণ করে, দুনিয়ায় আনন্দ-ফুর্তির মাধ্যমে সময় পার করলে তোমার ফাইনাল ডেস্টিনেশন হলো ‘জাহান্নাম’। অতএব, সাবধান! সিদ্ধান্ত তোমার!

জাবির হোসেন

এম. এ. (বাংলা), কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, মুর্শিদাবাদ, ভারত।

[1]. উইকিপিডিয়া।

[2]. তাফসীর আহসানুল বায়ান, সূরা আল-মুলক, ২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

[3]. আবূ দাঊদ, হা/৪০৩১, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/৪৩৪৭।

[4]. ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, খুতবাতুল ইসলাম (আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স), পৃ. ৩২।

[5]https://at-tahreek.com/article_details/8320.

[6]. উইকিপিডিয়া।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৪২।

[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৪৯।

[9]. আবূ দাঊদ, হা/৩৯১০, হাদীছ ছহীহ।

[10]. সিলসিলা ছহীহা, হা/২১৯৫।

[11]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৯০; মিশকাত, হা/৫৩৭৫।

[12]. ছহীহ মুসলিম, হ/৭৫৭; মিশকাত, হা/১২২৪।

[13]. ইবনু মাজাহ, হা/১০৮৪, হাদীছ হাসান।

Magazine