কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কিছু হারিয়ে যাওয়া সুন্নাহ

মুয়াযযিনের আযানের ধ্বনি কানে ভেসে আসছে, এই তো বলছে ‘আছ-ছলাতু খয়রুম মিনান নাউম’ অর্থাৎ ঘুম থেকে ছালাত উত্তম। ঘুম থেকে উঠে সুন্দরভাবে ওযূ করে দুই রাকআত ছালাত আদায় করলাম। অতঃপর বাসা থেকে ফজরের ছালাতের জন্য মসজিদে রওয়ানা দিলাম। মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকআত তাহিয়্যাতুল মাসজিদ ছালাত আদায় করলাম। তাহিয়্যাতুল মাসজিদ ছালাত সম্পর্কে অনেকেই জানেন না যে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ছালাত। হাদীছে এসেছে, আবূ ক্বাতাদা সুলামী রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে সে যেন বসার পূর্বে দুই রাকআত ছালাত আদায় করে নেয়’।[1]

যাহোক তাহিয়্যাতুল মাসজিদ ছালাত আদায় করে কিছুক্ষণ বসে ছিলাম, তারপর ইমাম সাহেব এসে ফজরের ছালাত শুরু করলেন। মসজিদের সকল মুছল্লী জামাআতবদ্ধ হয়ে ফজরের ছালাত আদায় করলাম।

ফজরের ছালাতের পর আমি কিছুক্ষণ যিকির-আযকার করলাম। অতঃপর দেখা যাচ্ছে একে একে সবাই যার যার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছে। মসজিদ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আমিও ভাবলাম বাসায় চলে যাই, কেন জানি আজ একটু বেশি ঘুম পাচ্ছে। যখনই মসজিদ থেকে উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিব, ঠিক তখনই আমাদের মহল্লার দ্বীনী বড় ভাই আহমাদ মসজিদের এক কোণায় বসে ছিলেন, তিনি আমাকে ডাকলেন। প্রায় সময় দেখা যায় ফজরের সময় আমরা সবাই চলে গেলেও তিনি মসজিদে বসে থাকেন। তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বলছেন, জাহিদ! এই জাহিদ!

—জি ভাই! আস-সালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?

—ওয়ালাইকুম আস-সালাম! এইতো আল-হামদুলিল্লাহ ভালো। তোমার কী অবস্থা? ইদানীং দেখা যাচ্ছে ফজরের সময় তোমার খুব তাড়া?!

—ইয়ে মানে, আসলে ভাই ইদানীং রাতে একটু দেরি করে ঘুমাই তো, সেজন্য ফজরের সময় চোখে প্রচণ্ড ঘুম থাকে। তাই বাসায় গিয়ে একটু ঘুমাই।

—ও তাহলে এই ব্যাপার। কিন্তু জাহিদ তুমি কি জানো আজ আমাদের মাঝে একটি সুন্নাহ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে? যা অধিকাংশ মানুষেরই অজানা ।

—কী সেই সুন্নাহ ভাই, যা আমিও জানি না?

—এই যে ফজরের ছালাতের পর সূর্য উঠা পর্যন্ত মসজিদে বসে থাকা। এটি একটি বিলুপ্ত সুন্নাহ। কেননা আমাদের রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সময় সূর্য না উঠা পর্যন্ত তার জায়গা ছেড়ে উঠতেন না।

—কী বলেন ভাই? তার মানে আপনাকে এ কারণেই মাঝে মাঝে দেখি ফজরের সময় মসজিদে বসে থাকতে। কিন্তু ভাই কী করব রাতে যে দেরি করে ঘুমাই।

—এটিও আজ একটি বিলুপ্ত সুন্নাহ, রাতে আগে আগেই ঘুমিয়ে যাওয়া। হাদীছ থেকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার পূর্বে ঘুমানো এবং পরে কথাবার্তা বলা অপছন্দ করতেন।[2] অথচ দেখো, আজ আমাদের জীবনটা হয়ে গেছে পুরো উল্টো। যার কারণে দেখা যায় আমরা প্রায়ই সময়মতো ফজরের ছালাত জামাআতের সাথে আদায় করতে পারি না।

তুমি জেনে আরও অবাক হবে যে, আমরা যারা ফজরের পর ঘুমাই, তারা আল্লাহ তাআলার এক বিশেষ নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়ে যাই। আর তা হচ্ছে- আল্লাহ তাআলা তার বান্দার উপর বরকত নাযিল করেন। হাদীছ থেকে আমরা জানতে পারি, সাখর আল-গামিদী রযিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মতকে ভোরের কাজে বরকত দান করুন’।[3]

অথচ আমরা এই সময়টা ঘুমিয়ে পার করে দেই। এমনকি আজ বিজ্ঞানও বলছে, যারা রাতে দেরি করে ঘুমায় আর সকালে দেরি করে উঠে, তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অথচ দেখো আজ থেকে সেই চৌদ্দশ বছর আগেই আমাদের প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রেখে যাওয়া সুন্নাহ বলছে, তাড়াতাড়ি ঘুমাতে এবং তাড়াতাড়ি সকালে উঠতে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। যার কারণে আজ আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করে রাখছি।

আহমাদ ভাই যখন কথাগুলো বলছিল, তখন কেন জানি কথাগুলো নিজের হৃদয়ে গিয়ে খুব করে নাড়া দিচ্ছিল। আসলেই আজ আমরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত হিসেবে দাবি করছি অথচ তার সুন্নাহর ব্যাপারে আমরা খুবই বেখেয়াল। অতঃপর আবার আহমাদ ভাই বলল, —দেখো জাহিদ! আসলে আমি তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলছি না। আমার নিজেরই খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি আমরা নিজেরাই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি অথচ আমরা নিজেদেরকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত হিসেবে দাবি করছি।

—নাহ ভাইজান, আসলেই কথাগুলো আজ আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমিও ভাবছিলাম, আমরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত হিসেবে দাবি করছি অথচ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহর ব্যাপারে উদাসীন। যাহোক ভাইজান, আমি আজ থেকে চেষ্টা করব সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ পাবন্দী করার, ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করব এখন থেকে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর এবং ফজরের সময় সূর্য না উঠা পর্যন্ত মসজিদে বসে থাকার।

—যাক আল-হামদুলিল্লাহ, খুবই ভালো লাগল। আমরা যদি একে একে এভাবে হারিয়ে যাওয়া সুন্নাহর গুরুত্ব বুঝি, তাহলে একদিন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ আবারও পুনরুজ্জীবিত হবে ইনশাআল্লাহ।

অতঃপর আমরা সূর্য উঠা পর্যন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম আর আমি আহমাদ ভাইয়ের কথাগুলো নিয়ে ভাবছিলাম। নীরবতা ভেঙে আবারও আহমাদ ভাই বললেন, —আচ্ছা জাহিদ! আমার মনে হয়, তুমি আমার কথাগুলো শুনে কষ্ট পেয়েছ?

—কী যে বলেন ভাই! বরং কথাগুলো আরও আমার জন্য অনেক প্রয়োজন ছিল।

—আচ্ছা জাহিদ! তুমি কি জানো ফজরের সময় সূর্য উঠার পর একটা বিশেষ আমল আছে? যা শুনলে হয়তো তুমি খুশি হয়ে যাবে।

—আসলেই? কোন্‌ আমল ভাই? বলুন তো একটু।

—আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জামাআতের সাথে ফজরের ছালাত আদায় করে সূর্যোদয় পর্যন্ত সেখানে বসে আল্লাহর যিকির করবে। এরপর দুই রাকআত ছালাত আদায় করবে, তার জন্য একটি হজ্জ ও উমরা পালনের ছওয়াব হবে’।[4] দেখেছ, আমরা মক্কায় না গিয়েও এখান থেকে হজ্জ ও উমরা পালনের ছওয়াব পেতে পারি মাত্র দুই রাকআত ছালাত আদায় করলে।

—সুবহানাল্লাহ! ভাইজান কী শোনালেন আমাকে! আমার মন তো ভরে গেল। আহ! কত বড় একটা ফযীলত মাত্র দুই রাকআত ছালাত আদায় করলেই।

তারপর আমি আর আহমাদ ভাই দুই রাকআত ছালাত আদায় করলাম। আজকের ফজরটা কেন জানি আগেকার তুলনায় খুবই ভালো লাগলো। মসজিদের ভেতরটা সূর্যের আলোয় আলোকিত হচ্ছে। অবশেষে আমরা মসজিদ থেকে বাইরে বের হলাম। আজ বাইরে কিছুটা ঠাণ্ডা অনুভব করছি, এই মুহূর্তে যদি এক কাপ চা পান করা যেত, তাহলে আজকের সকালটা পরিপূর্ণ হতো। যেমন ভাবা তেমন কাজ, আহমাদ ভাই বললেন, —জাহিদ! চলো চা পান করি।

অবশেষে আমরা একটি চায়ের দোকানে পৌঁছলাম। দোকানি মামা আমাদেরকে চা পরিবেশন করলেন। আমরা চা পান করছি এরই মাঝে আহমাদ ভাই আমাকে বললেন, —জাহিদ একটা জিনিস কি তুমি খেয়াল করেছ?

—কোন্‌ জিনিস ভাই?

—এই যে আমরা চায়ের দোকানে এসে চা পান করছি, একটু পরেই দোকানি মামাকে টাকা দিব। জিনিসটা খেয়াল করো সে কিন্তু তার রিযিক্বটা আমাদের মাধ্যমে সকাল সকাল পাচ্ছে। আর আল্লাহ তাআলাও আমাদেরকে তার দোকানে রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন। তাহলে বুঝা গেল, আমাদের উপর রহমত নাযিল হচ্ছে আর তার উপর রিযিক্ব, তাই না?

—এরকম তো কখনো ভেবে দেখিনি, ভাইজান! না ভাই আর সকাল বেলা ঘুমানো যাবে না। আল্লাহ তাআলার রহমতপ্রাপ্ত হতে হবে আমাদের।

—তাই বলে আবার সকাল সকাল এসে মামার সব চা একাই পান করে ফেল না কিন্তু, অন্যদেরকেও রহমতপ্রাপ্ত হতে দিয়ো।

—কী যে বলেন না ভাই আপনি।

অবশেষে আমরা চা পান করে যে যার মতো বাসায় চলে গেলাম।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হারিয়ে যাওয়া সুন্নাহগুলো পালন করার তাওফীক্ব দান করুক- আমীন!

মুহাম্মাদ জাহিদ হাসান

এইচ.এস.সি ফলপ্রার্থী, সরকারি মোল্লারটেক উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণখান, ঢাকা।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪৪।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৯।

[3]. আবূ দাঊদ, হা/২৬০৬, হাদীছ ছহীহ।

[4]. তিরমিযী, হা/৫৮৬, হাসান।

Magazine