কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

জিপিএ-৫ মানেই কি সফলতা?

post title will place here

সম্প্রতি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ফল প্রকাশিত হয়েছে। ২০২২ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন এবং পরীক্ষায় ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। তাছাড়া ২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন এবং পাশের হার ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ।[1]

আলহামদুলিল্লাহ আগের তুলনায় অনেক শিক্ষার্থীই ভালো ফলাফল করেছে। তাছাড়া আমাদের অনেক অভিভাবকও খুশী তার সন্তান জিপিএ-৫ পাওয়ায়। কিন্তু মনমরা হয়ে গিয়েছে সেই পরিবারের যার সন্তান জিপিএ-৫ পায়নি। যার ফলশ্রুতিতে অনেক সন্তানই আজ হতাশায় ভুগছে এই কারণে কেন আমার জিপিএ-৫ আসলো না? কেন আমার রেজাল্ট খারাপ হলো? ইশ! আরেকটু মার্কস আসলেই আমার জিপিএ-৫ চলে আসত।

তাছাড়া এ নিয়ে রীতিমতো পরিবার থেকেও হয়তো নানা ধরনের কথা শুনতে হয়েছে। আর যারা ২/১ বিষয়ে ফেল করেছে, তারা তো অনেকে ধরেই নিয়েছে আত্মহত্যাই একমাত্র পথ। এইতো ফল প্রকাশের পরপরই ঘটনা দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ি এলাকায় এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় আত্মহত্যা করেছে বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে। এইচএসসির ফল প্রকাশের পর বেলা ১২টার দিকে নিজ বাড়িতে নওসিন জাহান নামের ওই শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।[2]

শুধু এরকম একটা ঘটনা নয় আরও যে কত শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে তার কোনো হিসাব নেই। আর এই আত্মহত্যার সংখ্যাটা কেন জানি যেকোনো পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ঘটে থাকে। শুধু যে ফল প্রকাশের পরই ঘটে থাকে তা কিন্তু নয়; আজ আমাদের অনেক শিক্ষার্থীই এই পথ বেছে নিচ্ছে নির্দ্বিধায়। তাছাড়া আমাদের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার সংখ্যাটা রীতিমতো বেড়েই যাচ্ছে। এর পিছনে কারণটা কী? শুধু কি জিপিএ-৫ মানেই সফলতা?

আচ্ছা, কখনো কি ভেবে দেখেছেন যারা দুনিয়াতে সফল হয়েছেন, তাদের অনেকেই জিপিএ-৫ তো দূরের কথা শিক্ষাজীবনে পাশ পর্যন্ত করেননি।

এছাড়াও আমাদের পরিচিত কিছু ব্যক্তি এই যেমন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথাই বলা যাক, যিনি ছোটবেলা থেকে দুখু মিয়া হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ছোটবেলা থেকে তার দুঃখের শেষ ছিল না? পড়াশোনা তো দূরে থাক, জীবিকার তাগিদে তিনি রুটির দোকানে রুটি বানিয়েছেন। কারণ তার পড়াশোনা করার জন্য পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা ছিল না। বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার করতে পারেননি। কিন্তু তিনি আজ আমাদের মাঝে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত।

শুধু বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ খান এর কথাই বলা যাক, তিনি ছোটবেলা থেকে রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন এবং পাশাপাশি পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি পড়াশোনা ভালো করে করতেন না বলে অনেকবার ফেলও করেছেন। তবুও তিনি হার মানেননি এবং কখনো নকলও করেননি। তিনি বারবার পরীক্ষা দিয়ে গেছেন এবং সফলতা অর্জন করেছেন।[3]

এছাড়াও আরও অসংখ্য সফল মানুষ পদে পদে ব্যর্থ হয়ে এই পর্যন্ত এসেছেন। আজ তাদের সফলতার সামনে ছাত্রজীবনের সেই ব্যর্থতাগুলো কিছুই না। তবে এগুলো তো শুধু দুনিয়াবী ব্যক্তিদের সফলতার গল্প কিন্তু আমাদের ইসলাম সফলতা সম্পর্কে কী বলেছে তা কি আমাদের জানা আছে? আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ﴾ ‘প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর অবশ্যই ক্বিয়ামতের দিন তাদের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে দেওয়া হবে। সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সেই সফলতা পাবে। আর দুনিয়ার জীবন শুধু ধোঁকার সামগ্রী’ (আলে ইমরান, ৩/১৮৫)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ﴿مَنْ يُصْرَفْ عَنْهُ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمَهُ وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْمُبِينُ﴾ ‘সেদিন যার থেকে আযাব সরিয়ে নেওয়া হবে তাকেই তিনি অনুগ্রহ করবেন, আর এটাই প্রকাশ্য সফলতা’ (আল-আনআম, ৬/১৬)

সুতরাং এই দুনিয়াবী সফলতাই আমাদের একমাত্র সফলতা নয়। কেননা আমাদের মূল সফলতাই হচ্ছে জান্নাতে প্রবেশ করা; আর সেটাই হবে আমাদের জীবনে একমাত্র সফলতা। তাই পরীক্ষায় ২/১ বিষয় খারাপ হতে পারে কিংবা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নাও আসতে পারে তাই বলে নিজেকে ব্যর্থ ভাবা যাবে না।

কেননা মহান আল্লাহ আমাদের এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন এক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। আর সেই পরীক্ষায় তারাই উর্ত্তীণ হবে যারা চূড়ান্তভাবে জান্নাতে যেতে পারবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ﴾ ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জানমাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৫)

তাই আল্লাহ তাআলা আমাদের নানাভাবে পরীক্ষা নিতে পারেন। সেই পরীক্ষায় যদি আমরা ধৈর্যের সাথে থাকতে পারি, তাহলে আল্লাহ তাআলা বলছেন, ‘ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৫)। এছাড়াও আল্লাহ তাআলা বলছেন,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ﴾ ‘হে মুমিনগণ, ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৩)

তাছাড়া এই জিপিএ-৫ পেয়েই বা কী লাভ; দিন শেষে দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত বাড়ছে শিক্ষার্থীদের মাঝে মোবাইল আসক্তি, মাদকের প্রতি আসক্তি, পিতা-মাতার প্রতি দুর্ব্যবহার এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে নেই ইসলামী মূল্যবোধ। এছাড়াও বেড়ে যাচ্ছে সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা। তাছাড়াও জিপিএ-৫ পেয়েও হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের মাঝে সঠিক জ্ঞানের পরিচর্চা। গদবাঁধা কিছু মুখস্থ বিদ্যা অর্জন করে অনেকেই পেয়ে যাচ্ছে জিপিএ-৫। তাহলে এর মূল্যটা কোথায়?

তাই আমরা যারা সত্যিকার অর্থে পরিশ্রম করেছি কিন্তু পরীক্ষায় একটু খারাপ হয়েছে, তাদের উচিত আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করা। আল্লাহ বলেন,﴿وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ﴾ ‘আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই’ (আত-ত্বলাক, ৬৫/৩)

বাংলায় একটা কথা প্রচলন আছে ‘পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না’। হয়তো আপনি ভাবছেন জিপিএ-৫ পাইনি, এখন আর সামনে এগিয়ে কী লাভ? হয়তো আপনি ভাবছেন পরীক্ষায় ২/১ বিষয়ে ফেল এসেছে; অতএব আর পড়াশুনা করব না! কিন্তু আপনি জানেন না, আপনার জন্য কোনটা কল্যাণকর। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ﴾ ‘হতে পারে কোনো বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোনো বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জানো না’ (আল-বাক্বারা, ২/২১৬)

সুতরাং পরিশ্রম একদিন না একদিন কাজে আসবেই। হয়তো সাময়িক আপনার উপর এক পরীক্ষা চলছে কিন্তু খুব শীঘ্রই এর প্রতিদান পাবেন ইনশাআল্লাহ। কিন্তু যারা ভেবেছেন, পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ হয়েছে তাই এ জীবন রেখে আর কী লাভ, তার থেকে বড় আত্মহত্যাই একমাত্র পথ! তাদের জেনে রাখা ভালো- আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمً﴾ ‘আর তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু’ (আন-নিসা, ৪/২৯)। এছাড়াও আল্লাহ বলেন,﴿وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾ ‘তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। আর কল্যাণকর কাজ করে যাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ কল্যাণকারীদেরকে ভালোবাসেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৫)

হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ «مَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَهُوَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ يَتَرَدَّى فِيهِ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا، وَمَنْ تَحَسَّى سُمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَسُمُّهُ فِي يَدِهِ يَتَحَسَّاهُ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا، وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ، فَحَدِيدَتُهُ فِي يَدِهِ يَجَأُ بِهَا فِي بَطْنِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا»

আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে লোক পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের আগুনে পুড়বে, চিরকাল সে জাহান্নামের ভিতর ঐভাবে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। যে লোক বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে। যে লোক লোহার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের আগুনের ভিতর সে লোহা তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে তা দিয়ে নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে’।[4] অতএব, আত্মহত্যা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম।

পরিশেষে এটাই বলতে চাই, আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য যেন শুধু জিপিএ-৫ না হয়। আমাদের শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। তবেই আমরা সফল হব, নতুবা আমরা যতই জ্ঞান অর্জন করি না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না। আর যেখানেই যা পড়াশুনা করি না কেন, দ্বীনের জ্ঞান অর্জন অবশ্যই করতে হবে। কারণ দ্বীনের জ্ঞান অর্জন মুসলিম নারী-পুরুষ সবার জন্য আবশ্যক। আনাস ইবনু মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয’।[5]

আল্লাহ আমাদের কথাগুলো বুঝার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

মুহাম্মাদ জাহিদ হাসান 

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী, দক্ষিণখান, ঢাকা।


[1]. https://thedailycampus.com/.

[2].https://bangla.bdnews24.com/samagrabangladesh/47xb86wp5q.

[3]. https://www.manobkantha.com.bd/column/394680/.

Magazine