কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ছালাত : ঝামেলা নয়; আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা

বাস থেকে নেমে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আহমাদকে বললাম, ‘চল, ঝামেলার কাজটা আগে সম্পূর্ণ করে নিই’।

আমরা যাচ্ছি সালমানদা’র বাড়ি। গতকাল তাঁর বিয়ে হয়েছে। আজকে অলীমা। কয়েকদিন আগে আমাদের মেসে এসে ইনভাইট করে গেছে। আজকে যাচ্ছি, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে।

সালমানদা’র বাড়ি ডোমকল। ডোমকল বাসস্ট্যান্ড থেকে ট্রেকার যোগে আরও কিছুটা গিয়ে, তবেই তাদের বাড়ি। দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়া করে মেস থেকে বের হয়েছি। ডোমকল পৌঁছাতে বিকাল হয়ে গেল। বাসের মধ্যে থেকে আছরের আযান শুনতে পেয়েছি।

আহমাদ আমার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত হয়ে বলল, ‘ঝামেলার কাজ কোনটাকে বলছিস?’

আমি বললাম, ‘বুঝতে পারলি না—আরে! আমি আছরের ছালাতের কথা বলছি। এখানে একটা মসজিদ আছে— তা জানি। কয়েক বছর আগে এসেছিলাম। এখন যদি ছালাত আদায় না করি, তাহলে পরে অনেক ভারী মনে হবে’।

আহমাদ বলল, ‘তোর কাছে ছালাত আদায় করাটা ঝামেলার কাজ বলে মনে হলো’।

আমি বললাম, ‘না ভাই! যখন ছালাত আদায় করতেই হবে, তখন তাড়াতাড়ি করে নেওয়াটা ভালো নয় কি?’

‘রাইট! কিন্তু, তুই ছালাতকে ঝামেলার কাজ বললি কেন?’

 ‘আরে ইয়ার! আমি কী মন থেকে বলেছি, মুখ স্লিপ করে বেরিয়ে গেছে’।

‘আচ্ছা! তুই বলতো— আমরা কেন ছালাত আদায় করি?’

প্রশ্নটি আমাকে ভাবাতে শুরু করল। তাই তো, আগে কখনো তো ভাবিনি! আমি কেন ছালাত আদায় করি? আমি যখন পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, তখন থেকে ছালাত পড়ি। কিন্তু, এই প্রশ্নটি তো কোনোদিন আমার মাথায় আসেনি।

আমতা আমতা করে বললাম, ‘ইসলামের একটি বড় ইবাদত হলো ছালাত— তাই’।

আহমাদ বলল, ‘হ্যাঁ, একথা সঠিক; তবে প্রশ্ন হলো, এই ইবাদত কেন করতে হবে?’

‘কেন আবার করতে হবে, সেই ছোটবেলা থেকে পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের দেখে আসছি। গ্রামের মৌলানারা বলেন, মুসলিমদের ছালাত আদায় করতেই হবে— তাই আর কী! —মনে মনে বললাম। তবে মুখ ফুটে বলার সাহস হলো না। কী জানি— বললে আবার কী রকম ধমক দেয়!’

‘কী ভাবছিস?’ —আহমাদ বলল।

‘কই— কিছু না তো। তোর প্রশ্নটাই ভাবছিলাম। ভাই, আমার দ্বারা সম্ভব হলো না। তুই আমাকে বুঝিয়ে বল— কেন আমরা আল্লাহর ইবাদত করি?’

আমি জানি আহমাদ এ বিষয়টি আমাকে গুছিয়ে বলতে শুরু করবে। ও এমনই করে। তাই উত্তরের প্রত্যাশায়, মন দিয়ে তাঁর প্রতি চেয়ে থাকলাম।

আহমাদ বলতে শুরু করল, ‘তোর আব্বা-মা তোকে অনেক আদর যত্ন দিয়ে লালনপালন করেছে, তাই না?’

—‘হ্যাঁ’।

‘তোর সব অভাব-অভিযোগ পূরণ করেছে। তোর যখন যেটা প্রয়োজন, তখন তোকে তাই দিয়েছে। এখন তুই প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিস। এখন তুই যদি তোর বাবা-মায়ের খোঁজ খবর না নিস, তাঁদের যত্ন না করিস; তাদের কথা না শুনিস, তবে তোকে কী বলা হবে?’

আমি বললাম, ‘অমানুষ বা অকৃতজ্ঞ’।

‘ঠিক তেমনই— মহান আল্লাহ যিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা, তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। শুধু আমাদেরই নয়, আমাদের পিতা-মাতাকেও সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাঁর দয়া ও রহমত দিয়ে আমাদের পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন।

তিনি আমাদের দিয়েছেন জীবন। দিয়েছেন এই পৃথিবীর সমস্ত উপাদান, যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য একান্ত প্রয়োজন। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান।

তিনি দিয়েছেন সুপেয় পানি। যা পান না করলে কিছুদিনের মধ্যেই আমরা মারা যাব। 

তিনি আমাদের দিয়েছেন অক্সিজেন, যা গ্রহণ করে আমরা বেঁচে থাকি। মাত্র কয়েক মিনিট যদি আমরা বাতাস না পায় তাহলে...!

তাইতো মহান আল্লাহ বলেছেন, فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ ‘সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?’ (আল-রহমান, ৫৫/১৩)

যিনি এতকিছু অনুগ্রহ দান করেছেন, তাঁর নির্দেশ মেনে না চলে যদি তাঁর বাণীকে উপেক্ষা করি এবং সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন না করি, তাহলে আমাদেরকে কী বলা হবে?

—অকৃতজ্ঞ নয় কি?

তারই জন্যে তো মহান আল্লাহ আমাদের অকৃতজ্ঞতা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন, ‘মানুষ অবশ্যই তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ’ (আল-হাজ্জ, ২২/৬৬; আয-যুখরুফ,৪৩/১৫; আল-আদিয়াত, ১০০/৬)

মহান আল্লাহ চান, আমরা তাঁর ইবাদত করি এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলি। যেমনটি তিনি বলেছেন,وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ‘আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে এজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে’ (আয-যারিয়াত, ৫১/৫৬)

যদি আমরা আল্লাহর ইবাদত করি এবং তাঁর প্রশংসা করি— এতে তাঁর কোনো উপকার হবে না। কিন্তু, উপকার হবে আমাদের। উপকার হবে মানুষের। সেই সঙ্গে খুশি হবেন আমাদের প্রতিপালক’।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে?’

আহমাদ বলল, ‘একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। একজন ডাক্তার, যিনি গরীব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দিচ্ছেন। এখন, একজন রোগী যদি ডাক্তারের পরামর্শ না শোনে এবং ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ সেবন না করে, তবে ডাক্তারের কেমন লাগবে? সে যদি নিজের ইচ্ছামতো ওষুধ খায়, তবে তার নিজেরই ক্ষতি হবে; এতে ডাক্তারের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু, যে ব্যক্তি ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলবে, তাঁর দেওয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ সেবন করবে, এতে ডাক্তারবাবুর কোনো উপকার না হলেও উপকার হবে— সেই পেশেন্টের। এর পাশাপাশি ডাক্তারও খুশি হবেন এই ভেবে যে, তার রোগী সুস্থ হয়ে যাবে।

তাই আমরা যেন দৈহিকভাবে ও আত্মিকভাবে সুস্থ থাকি, তারই জন্য মহান আল্লাহ বিভিন্ন প্রকার ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন: ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি। আমরা যদি আল্লাহর ইবাদত না করি, তাতে আল্লাহর কোনো ক্ষতি হবে না; আবার যদি ইবাদত করি, তাতে আল্লাহর কোনো উপকার হবে না। মহান আল্লাহ অমুখাপেক্ষী (আল-ইখলাছ, ১১২/২)। ইবাদত পালন করলে উপকার আমাদের, আর না করলে ক্ষতিও আমাদের।

ছালাত হলো ন্যায়পরায়ণতার ট্রেনিং। ছালাত হলো জীবন দর্শন। ছালাত আমাদের মনে প্রশান্তি আনে এবং দূর করে মলিনতা। ছালাত আমাদের ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপনের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নেয়। ছালাত আমাদের মধ্যে কর্তব্যবোধের শিক্ষা দেয়। ছালাত আমাদের মধ্যে ধনী-গরীব, ছোট-বড়, সাদা-কালোর ভেদাভেদ; গর্ব-অহংকার-আভিজাত্য সবকিছু দূর করে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একত্রে আদায় করতে বলে। ছালাত আমাদের অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ

‘ছালাত প্রতিষ্ঠা করো। নিশ্চয় ছালাত বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দ কাজ হতে’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৪৫)। 

আহমাদের এই মনোমুগ্ধকর বক্তব্যে শ্রোতার ভূমিকায় অংশগ্রহণ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করলাম। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, ‘ভাই! তুই আমাকে অসাধারণ শিক্ষা দিলি’।

সত্যিই তো, ছালাত আমাদের জন্য ঝামেলা বা বোঝার কাজ নয়। ছালাত আমাদের স্বেচ্ছায় নিবেদিত আল্লাহর প্রতি ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। আমরা কত বড় অকৃতজ্ঞ বান্দা যে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র এক ঘণ্টা সময় বের করতে কষ্ট হয়— স্রষ্টার প্রতি সিজদা নিবেদন করতে। অথচ আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিই, আড্ডা-ইয়ার্কি ও খেল-তামাশা করে।

আবার আমরা যারা ছালাত আদায় করি, তারা কেন ছালাত আদায় করতে হয়— সেটুকুও জানার চেষ্টা করি না। সত্যিই আমাদের....!

রাস্তার বাম পাশে একটি মসজিদ চোখে পড়ল। আহমাদকে বললাম, ‘ভাই চল, স্রষ্টার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে আছরের ছালাত আদায় করে আসি’।

 এম. এ. (অধ্যয়নরত), বাংলা বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, মুর্শিদাবাদ, ভারত।

Magazine