বিদায় নিল বহু মাহাত্ম্যপূর্ণ মাস— মাহে রামাযান। রামাযান ছিল রহমত, বরকত ও মাগফিরাতে পূর্ণ এক কল্যাণময় মাস। রামাযান ছিল নিজেকে তাক্বওয়ার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করার মাস। সাহরী, ইফতার, তারাবীহ, লায়লাতুল ক্বদর, ই‘তিকাফ ও যাকাতুল ফিত্বর ইত্যাদি ইবাদতে পূর্ণ এক মহান মাস ছিল এটি।
দেখতে দেখতে এক বছর পর পুনরায় রামাযান মাস এসে উপস্থিত হয়েছিল। মুসলিম সমাজ নতুন চাঁদ দেখে মাহে রামাযানকে স্বাগত জানিয়েছিল। এক মাস ছিয়ামব্রত পালন করে মুমিন-মুসলিমগণ আত্মসংযমের মাধ্যমে আত্মিক উন্নয়ন এবং তাক্বওয়া অর্জনের নিয়্যত করেছিল। এক বছর পর আবার এই রামাযান মাস পাওয়া না পাওয়ার চিন্তায় অনেকে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল।
সত্যিই মুমিন মুসলিমদের নিকট রামাযান মাস বড় আনন্দের মাস। আর আনন্দের হবেই বা না কেন? কেননা এই মাসে মহান স্রষ্টা আল্লাহর পক্ষ থেকে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। যে কুরআন মানবতার মুক্তির মহাসনদ। যে কুরআন মুমিনদের জন্য আলোকবর্তিকাস্বরূপ। যে মাস রহমত, বরকত ও মাগফিরাতে ভরা। নইলে চিন্তা করুন তো, কীভাবে একজন মানুষ আনন্দের সহিত ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে পারে। ছিয়াম উপলক্ষ্য ব্যতীত যেটা থাকা অত্যন্ত মুশকিল।
কিন্তু এই মাস তো বিদায় নিল। এখন কী হবে? আমাদের ইবাদতের যে স্পৃহা বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা কি কমে যাবে? আমরা যে ইবাদতে অভ্যস্ত হয়েছি, তা কি বন্ধ হয়ে যাবে? রামাযান তো বিদায় নিল, কিন্তু আমরা কি এই মাস থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করব না?
মুমিনগণ শুধু এক মাস মহান আল্লাহর ইবাদত পালন করে না; তারা রামাযান মাসে যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ছিয়াম পালন এবং ইবাদতের যে চর্চা করেছে, রামাযানের বাইরেও সেই মহান আল্লাহকে খুশী করার জন্য বাকী ১১ মাস ইবাদত পালন অব্যহত রাখবে।
রামাযান মাসকে আমরা ইবাদত পালনের জন্য প্রশিক্ষণকালীন সময়ের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। এক মাস প্রশিক্ষণের প্রতিফলন বাকী মাসগুলোতে দেখা যাবে— এটাই কাম্য। উদাহরণস্বরূপ— সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর প্রত্যেক আর্মি অফিসারকে একটি নির্দিষ্ট সময় প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে হয়। সেখানে তাকে সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ, নেতার আনুগত্য, অস্ত্রচালনা, শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নিজের এবং দেশ রক্ষার কৌশল তাকে শেখানো হয়।
এই রকম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো আর্মি আফিসার যদি দেশের সীমান্তে শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই না করে জুয়া, মদ, গাঁজা, গান, বাজনা আর নারী বাজিতে মত্ত থাকে আর শত্রুপক্ষের গুলির বিরুদ্ধে নিজের অস্ত্র প্রয়োগ না করে মারা যায়, তাহলে তাকে কী বলা হবে?
—‘বেওকুফ’।
‘হ্যাঁ, তাকে বেওকুফই বলা হবে’।
নিজের জীবন ও দেশ রক্ষার জন্য সরকার তার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। যদি সে ঐ অস্ত্র সঠিকভাবে প্রয়োগ করে মারা যেত, তাহলে সে শহীদের মর্যাদা পেত। আর যদি সে সাফল্য লাভ করত, তাহলে সে গাজী বা বিজয়ী যোদ্ধার মর্যাদা পেত। সর্বাবস্থায় সে সফল তথা উভয় অবস্থাই তার জন্য মর্যাদার। কারণ বাঁচলে গাজী আর মরলে শহীদ।
অনুরূপ স্রষ্টার ইবাদতে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য রামাযান মাস হলো আমাদের জন্য প্রশিক্ষণকালীন সময়। আমাদের শত্রু শয়তানকে বন্দী রেখে তার বিরুদ্ধে কীভাবে সফল হওয়া যাবে, তার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এই সময়ে। প্রায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পানাহার ও যৌনকর্মসহ যাবতীয় হারাম কাজ থেকে বিরত থেকে সে (একজন মুমিন) সংযমের এমন প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে, যা ১১ মাসব্যাপী শয়তানের হাজারো প্রলোভনে প্রতারিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে। শয়তানের যে কোনো কুমন্ত্রণাকে প্রতিহত করা তার জন্য খুবই সহজ হয়ে যাবে। সে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সৃষ্টিকর্তার ইবাদতে মশগূল থাকবে। শয়তানকে প্রতিহত করার মোক্ষম অস্ত্র হলো তাক্বওয়া; আর সেটাই ছিয়াম পালনের মাধ্যমে অর্জিত হয়। যেমনটি কুরআনে বলা হয়েছে,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় তোমাদের উপরও ছিয়াম অপরিহার্য কর্তব্যরূপে নির্ধারিত করা হলো, যেন তোমরা তাক্বওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জন করতে পারো’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৩)।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, তাক্বওয়া কী? সাধারণ অর্থে আল্লাহভীতিকে তাক্বওয়া বলা হয়। হারাম কাজ পরিত্যাগ করার আরেক নাম হচ্ছে তাক্বওয়া। ব্যাপক অর্থে, তাক্বওয়া হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশিত বিষয় বাস্তবায়ন করা, তাঁর নিষেধ থেকে দূরে থাকা।[1] অথবা বলা যায়, পরকালীন জীবনের জন্য ক্ষতিকারক যে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকার নাম তাক্বওয়া।
একদা উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু উবাই ইবনু কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট তাক্বওয়ার ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আপনি কি কখনো এমন পথ অতিক্রম করেছেন, যেটি খুবই কণ্টকাকীর্ণ এবং যার দুই দিকই কাঁটাযুক্ত গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত? তদুত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। উবাই ইবনু কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন বললেন, এমতাবস্থায় আপনি কীভাবে পথ অতিক্রম করেছেন? জবাবে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, কাপড় ও শরীর বাঁচিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সে পথ আমি অতিক্রম করেছি। উবাই ইবনু কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এটাই তাক্বওয়া।[2]
যার হৃদয়ে তাক্বওয়া যত বেশি, তার আখলাক, আমল তত বেশি স্বচ্ছ। যার হৃদয় তাক্বওয়াশূন্য তার হৃদয় শয়তানের ঘাঁটি। সুতরাং যে অস্ত্র দ্বারা শয়তানকে প্রতিহত করা যায়, সেই অস্ত্রের প্রশিক্ষণ যেহেতু রামাযান মাসে হয়ে থাকে, তাই বাকী ১১ মাসে নিজেকে রক্ষা করতে সেই অস্ত্রের (তাকওয়া) ব্যবহার করতে হবে। শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয় লাভ করতে হবে। তাক্বওয়া প্রতিফলন ঘটাতে হবে নিজেদের জীবনে।
মুমিনের ইবাদত নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকবে। মহান আল্লাহর ঘোষণা, وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ ‘মৃত্যু আসা অবধি তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করতে থাকো’ (আল-হিজর, ১৫/৯৯)। তাই রামাযান বিদায় নিলেও বহু সুন্নাহসম্বলিত নেক আমল সম্পাদনের সুযোগ অবারিত থাকে। আমাদের উচিত, রামাযানে যে সমস্ত আমলে অভ্যস্ত হয়েছি, বাকী ১১ মাসেও তা চলমান রাখা।
আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর তাআলার কাছে সর্বাধিক প্রিয় আমল কী? তিনি বললেন, أَدْوَمُهَا وَإِنْ قَلَّ ‘যে আমল সর্বদা সম্পাদন করা হয় (তা উত্তম), যদিও তা (পরিমাণে বা সংখ্যায়) অল্প হয়’।[3]
প্রিয় পাঠক! আমরা প্রভুর সন্তুষ্টির নিমিত্তে এক মাস ছিয়াম পালন করেছি। এখন রামাযান মাস বিদায় নিয়েছে। এখন আমাদের করণীয় কী?
আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে আদেশ করেছেন, তাঁকে ভয় করার। হ্যাঁ, আমরা তো তাঁকে ভয় করেছি। তাই তো ছিয়ামরত অবস্থায় লুকিয়ে এক ঢোক পানিও পান করিনি। আমরা কি আমাদের প্রতিপালককে এইভাবে সারা বছর তথা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভয় করতে পারব না? হ্যাঁ, আমরা পারব। আমাদেরকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইবাদত করে যেতে হবে। যেমনভাবে আমরা এই এক মাস করেছি। কেননা এটিই আমাদের প্রভুর নির্দেশ।
আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে আদেশ করেছেন, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করার। আমারা কি পারব না, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত সময়মতো আদায় করতে? —হ্যাঁ, আমরা পারব। আমাদের মধ্যে সেই যোগ্যতা আছে। যদি না পারি, তাহলে এই এক মাস কীভাবে পেরেছি? কোন শক্তি আমাদেরকে বাধ্য করেছিল এই এক মাস? হাদীছে এসেছে, জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, بَيْنَ الْعَبْدِ وَبَيْنَ الْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلاَةِ ‘(মুমিন) বান্দা ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো ছালাত ত্যাগ করা’।[4]
রামাযান মাস হলো পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ ‘রামাযান হলো সেই মাস, যেই মাসে নাযিল করা হয়েছে কুরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সৎ পথের সুস্পষ্ট নির্দেশ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)। এই কুরআন পড়তে ও মেনে চলতে আদেশ করেছেন— আমাদের প্রতিপালক। আমরা কি পারব না, সারা বছর কুরআনের অনুশীলন করতে? —হ্যাঁ, অবশ্যই আমরা পারব। কারণ, এই এক মাসে নিশ্চয় এক বার কুরআন পড়া শেষ করেছি অথবা কিছু তো পড়েছি। তাহলে বাকী ১১ মাস কেন পারব না বলুন তো? হাদীছে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لاَ أَقُولُ الم َرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ ‘আল্লাহ তাআলার কিতাবের যে ব্যক্তি একটি হরফ পাঠ করবে, সে তার জন্য এর ছওয়াব পাবে। আর ছওয়াব হবে ১০ গুণ। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’।[5]
আমরা তো পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত মিস করি না। প্রতিপালকের খুশী অর্জনের জন্য আমাদেরকে নফল ছালাত আদায়েরও বিধান দেওয়া হয়েছে— যাতে করে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। নফল ছালাতের মধ্যে উত্তম হলো তাহাজ্জুদের ছালাত। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ ‘রামাযান মাসের ছিয়ামের পর সর্বোৎকৃষ্ট ছিয়াম হলো আল্লাহ তাআলার মুহাররম মাসের ছিয়াম আর ফরয ছালাতের পর সর্বোৎকৃষ্ট ছালাত হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) ছালাত’।[6] আমরা কি পারব না, আরো নফল ছালাত আদায় করতে? —হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই পারব। আমরা তাহাজ্জুদের ছালাত আদায় করতে পারব। এক মাস তারাবীহ পড়ে আমাদের মধ্যে সেই যোগ্যতা তৈরি হয়েছে। তাহলে রামাযান শেষ হয়েছে বলে, কেন তাহাজ্জুদকে গুরুত্ব দিচ্ছি না?
রামাযান মাস ঠিকই বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ছিয়ামের সকল বিধান বিদায় নেয়নি। রামাযানের বিদায়ের পরও সুন্নাত ও নফল ছিয়ামের বিধান বিদ্যমান আছে। তার মধ্যে নিম্নে বর্ণিতগুলো অন্যতম-
(১)আশূরায়ে মুহাররমের ছিয়াম :আবূ ক্বতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ إِنِّى أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِى قَبْلَهُ ‘আশূরার ছিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিকট আমি আশা পোষণ করি যে, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের (গুনাহ) ক্ষমা করে দিবেন’।[7]
(২) শা‘বান মাসের ছিয়াম : আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,لَمْ يَكُنِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُوْمُ شَهْرًا أَكْثَرَ مِنْ شَعْبَانَ فَاِنَّهُ كَانَ يَصُوْمُ شَعْبَانَ كُـلَّهُ ‘নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বান মাসের চেয়ে অন্য কোনো মাসে এত বেশি (নফল) ছিয়াম রাখতেন না। তিনি শা‘বান মাসের (প্রায়) পুরোটাই ছিয়াম রাখতেন’।[8] উসামা ইবনু যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে শা‘বান মাসে যে পরিমাণ ছিয়াম পালন করতে দেখি, (বছরের) অন্য কোনো মাসে সে পরিমাণ ছিয়াম পালন করতে দেখি না। তিনি বললেন, ‘শা‘বান মাস রজব এবং রামাযানের মধ্যবর্তী এমন একটি মাস যে মাসের (গুরুত্ব সম্পর্কে) খবর মানুষ রাখে না, অথচ এ মাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট আমলনামা উত্তোলন করা হয়। তাই আমি পছন্দ করি যে, আমার আমলনামা আল্লাহ তাআলার নিকটে এমন অবস্থায় উত্তোলন করা হোক, যখন আমি ছিয়াম পালনরত আবস্থায় আছি’।[9]
(৩) শাওয়াল মাসের ছিয়াম : আবূ আইয়ূব আনছারী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ فَذَلِكَ صِيَامُ الدَّهْرِ ‘যে ব্যক্তি রামাযান মাসে ছিয়াম পালন করল, অতঃপর শাওয়াল মাসের ছয় দিন ছিয়াম পালন করল, সে যেন সম্পূর্ণ বছরই ছিয়াম পালন করল’।[10]
(৪) আরাফার দিনের ছিয়াম : আবূ ক্বাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ إِنِّى أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِى قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِى بَعْدَهُ ‘আমি আল্লাহ তাআলার নিকট আরাফাতের দিনের ছিয়াম সম্পর্কে আশা করি যে, তিনি (এর মাধ্যমে) পূর্ববর্তী এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন’।[11]
(৫) সোমবার ও বৃহস্পতিবারের ছিয়াম : আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَحَرَّى صَوْمَ الاِثْنَيْنِ وَالْخَمِيسِ ‘নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার ও বৃহস্পতিবারের ছিয়ামের প্রতি অধিক যত্নসহকারে খেয়াল রাখতেন।[12]
(৬) আইয়ামুল বীযের ছিয়াম : আবূ যার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন, يَا أَبَا ذَرٍّ إِذَا صُمْتَ مِنَ الشَّهْرِ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ فَصُمْ ثَلاَثَ عَشْرَةَ وَأَرْبَعَ عَشْرَةَ وَخَمْسَ عَشْرَةَ ‘হে আবু যার! তুমি প্রতি মাসে তিন দিন ছিয়াম পালন করতে চাও, তবে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ ছিয়াম পালন করো’।[13] অন্য বর্ণনায় আছে, আবূ যার রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতি মাসে তিন দিন ছিয়াম পালন করল, সে যেন সারা বছরই ছিয়াম পালন করল। এর সমর্থনে আল-কুরআনে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি একটি ছওয়াবের কাজ করে, তাহলে তার প্রতিদান হচ্ছে এর ১০ গুণ’ (আল-আনআম, ৬/১৬০)। সুতরাং এক দিন ১০ দিনের সমান।[14]
আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে ঝগড়া করতে নিষেধ করেছেন। আমরা কি পারব না সারা বছর এ থেকে বেঁচে থাকতে? হ্যাঁ, আমরা সারা বছর এ থেকে বিরত থাকতে পারব, যেমনভাবে ছিয়ামরত অবস্থায় কেউ ঝগড়া করতে এলে আমরা বলেছি, ‘আমি ছিয়াম রেখেছি’। ঠিক এইভাবেই আমরা পারব।
আমরা দান-ছাদাক্বা করার জন্য রামাযান মাসকে বেছে নিয়েছিলাম। রামাযান শেষে যাকাতুল ফিত্বরও আদায় করেছি। কিন্তু দান-ছাদাক্বা শুধু রামাযান মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; রামাযানের বাইরেও দান-ছাদাক্বা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীছে এসেছে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَا مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ الْعِبَادُ فِيهِ إِلاَّ مَلَكَانِ يَنْزِلاَنِ فَيَقُولُ أَحَدُهُمَا اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا وَيَقُولُ الآخَرُ اللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا ‘প্রতিদিন বান্দা যখন সকাল করে, তখন দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করে; তাদের একজন বলে, হে আল্লাহ! দানকারীকে উত্তম প্রতিদান দাও আর অপরজন বলে, হে আল্লাহ! কৃপণের (সম্পদকে) ধ্বংস করে দাও’।[15]
আমাদের জন্য এই মাসে শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এখন কিন্তু তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে শয়তানের আনুগত্য করতে নিষেধ করেছেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ ‘হে মুমিনগণ, তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (আল-বাক্বারা, ২/২০৮)। আমরা কি পারব না, শয়তানকে হারাতে? —হ্যাঁ, আমরা পারব। আমরা শয়তানের গোলামী করতে বাধ্য নই। আমাদেরকে যদি শয়তানকে হারাতে হয়, তবে তাকে চিনতে হবে। জানতে হবে তার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে। শিখতে হবে আত্মরক্ষার কৌশল।
শয়তান আমাদেরকে হারানোর জন্য পি-এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেছে। কিন্তু শয়তানের মোকাবিলার জন্য আমাদের নিকট প্রাথমিক স্তরের পাঠও নেই। কিন্ত আমরা চাইলে কত সহজে তাকে পরাজিত করতে পারি। চিন্তা করুণ হে পাঠক! শয়তানের কৌশল কত বড় দুর্বল। মাকড়সার জালের সদৃশ। তাক্বওয়া অবলম্বন করলেই আমরা শয়তানকে পরাস্ত করতে পারব।
প্রিয় বন্ধু! জেনে রাখুন, নেক আমল বা সৎকর্ম আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার অন্যতম লক্ষণ হলো, আমলকারী ওই কর্মের পরে পুনরায় অন্যান্য সৎকর্ম চলমান রাখবে। সুতরাং রামাযানের পর আমাদের অন্যান্য নেক আমল করতে থাকা এ কথারই প্রমাণ বহন করে যে, আমাদের ছিয়াম ও তারাবীহ মহান আল্লাহ কবুল হয়েছে। আর হ্যাঁ, আমরা কখনোই পুনরায় আমাদের সেই অবস্থায় ফিরে যাবে না, যে অবস্থায় ছিলাম রামাযানের পূর্বে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সে নারীর মতো হয়ো না, যে তার সুতা মযবূত করে পাকানোর পর তার পাক খুলে নষ্ট করে দেয়’ (আল-কুরআন ১৬/৯২)।[16]
বন্ধুগণ! একদিন আমাদের মরতেই হবে— আমরা চাই বা না চাই। এটাই রবের বিধান। মৃত্যুর পরবর্তী দিনগুলোতে আমরা শান্তি চাই কি চাই না? যদি শান্তি চাই, তাহলে আমাদের শান্তির পথে হাঁটতে হবে। তবেই আমরা সেই গন্তব্যে পৌঁছতে পারব। নতুবা তখন ‘হায় হায়’ করতে হবে, আর বলতে হবে, হায়! আমি যদি আগে কিছু সৎ আমল প্রেরণ করতাম। হায়! আমি যদি দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেতাম।
না, বন্ধু না! দ্বিতীয় চান্স নেই। জীবন একবার। মৃত্যু একবার। পরকালের জীবন অনন্তকালের। বন্ধু! আমাদের চিন্তার খোরাক এখানে আছে। রামাযানের শিক্ষা প্রতিফলিত হোক আমাদের জীবনে। এখন আমরা ভেবে দেখি— বিদায় রামাযান! অতঃপর...।
জাবির হোসেন
এম. এ. (অধ্যয়নরত), বাংলা বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, মুর্শিদাবাদ, ভারত।
[1]. শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছয়মীন রাহিমাহুল্লাহ, ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, অনুবাদ : আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী ও আব্দুল্লাহ আল-কাফী, (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃ. ৫০৫।
[2]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ১/৭৫।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৬৫।
[4]. সুনানে তিরমিযী, হা/২৬২০, ছহীহ লিগয়রিহী।
[5]. সুনানে তিরমিযী, হা/২৯১০, ছহীহ।
[6]. সুনানে তিরমিযী, হা/৪৩৮, ছহীহ।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬২, ।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৭০।
[9]. সুনানে নাসাঈ, হা/২৩৫৭, হাসান।
[10]. সুনানে তিরমিযী, হা/৭৫৯, হাসান-ছহীহ।
[11]. সুনানে তিরমিযী, হা/৭৪৯, ছহীহ।
[12]. সুনানে তিরমিযী, হা/৭৪৫, ছহীহ।
[13]. সুনানে তিরমিযী, হা/৭৬১, হাসান-ছহীহ।
[14]. সুনানে তিরমিযী, হা/৭৬২, ছহীহ।
[15]. ছহীহ বুখারী, হা/১৪৪২।
[16]. আব্দুল হামীদ মাদানী, রমযানের ফাযায়েল ও রোযার মাসায়েল (তাওহীদ প্রকাশনী-বর্ধমান), পৃ. ১৫০।