[১]
রামাযান মাসকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে স্ত্রীর বাপের বাড়ি থেকে ইফতারী খাওয়ার জঘন্য একটি রেওয়াজ চালু রয়েছে। এটা রীতিমতো যৌতুকের শামিল যা অনেক বড় এক সামাজিক ব্যাধি। এমন যৌতুক ভদ্রবেশে আদায় করা হয়। এটা যে কী পরিমাণ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, তা একমাত্র ভুক্তভোগী নারীই বুঝতে পারে, বুঝতে পারে সেই নারীর বাপ-ভাইয়েরা। এটি একজন নারীর জন্য ভীষণ কষ্টের বিষয়। সে না মুখ ফুটিয়ে কিছু বলতে পারে, না সহ্য করে যেতে পারে। টপটপ করে চোখের পানি ফেলা ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না। বুকের ভেতর তার জমাট বাঁধা কষ্টগুলো যেন চোখের অশ্রু হয়ে বের হয়।
অনেক সময় মেয়ে তার লজ্জা ভেঙে মনে কষ্ট নিয়ে মাকে ফোন করে বলে, মা! বাবাকে একটু বলে দিয়ো, তিনি যেন একটু বেশি করে ইফতারী নিয়ে আসেন। তা না হলে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাকে নানান কথা শুনাবে। এসব শুনে বাপ বেচারা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, মেয়ে তার পরিবারের কাছে ছোট হয়ে যাবে ভেবে ঋণ করে হলেও বুকে পাথর বেঁধে মেয়ের বাড়িতে ইফতারী নিয়ে যান। এদিকে বেয়াইয়ের বাড়ির লোকেরা তাদের জন্য আনা ইফতারের বাহারি ধরনের আইটেম সাজিয়ে বেয়াই সাহেবকে এমনভাবে আপ্যায়ন করেন, যেন তারা তাদের নীরব যুলম বুঝতেই পারল না। অথচ মেয়ের বাবা কতটা ক্ষত হৃদয় নিয়ে তাদের সাথে ইফতার করছেন তা যদি তারা নিজ চোখে দেখতে পেত, তবে তারা আঁতকে না উঠে পারত না। তখন তারা বুঝতে পারত তাদের যুলম কতটা ভয়ানক ছিল।
সমাজের কিছু কিছু নিচু মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ আছে, যারা তাদের ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে রামাযানের শুরুর দিকে চাতক পাখির মতো ইফতারী পাওয়ার আশায় বসে থাকে। এমন চরম নির্লজ্জ ও ব্যক্তিত্বহীন মানুষেরা ইফতারী না আসলে ঘরের বউয়ের সাথে খোঁচা মেরে কথা বলে, নানান কষ্টদায়ক কথা শুনায়। দেরি হয়ে যাওয়ার নাম করে পরবর্তীতে দিলেও আর নিতে চায় না। অমুক বাড়ির অমুকের ইফতারী চলে এসেছে আর আমাদেরটার এখনো খবর নেই— এসব বলে ঘরের বউকে মানসিক কষ্টের মধ্যে রাখে। আহ, বেচারি লজ্জায় কিছু বলতেও পারে না। আসলে, কত বড় বেশরম ও আত্মমর্যাদাহীন হলে এসব লোকেরা এরকম ঘৃণিত আচরণ করতে পারে, ভাবা যায়?
[২]
ভাবুন তো, একজন মেয়েকে তার মা-বাবা জন্ম দিয়ে ছোট থেকে বড় করে তুললেন, পড়াশোনা করিয়ে শিক্ষিত করে তুললেন, বেড়ে উঠার পথে চিকিৎসা বাবদ যত খরচ লেগেছে, তার সবই বহন করলেন। মোটকথা, তার পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করলেন। অতঃপর তাদের আদরের মেয়েটিকে একটা সময় বিয়ের মাধ্যমে স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। এই যে তারা এত কষ্ট করে নিজে খেয়ে না খেয়ে মেয়েটার সকল ভরণপোষণ দিয়ে স্বামীর হাতে তুলে দিলেন, এখন মেয়েটার কাছ থেকে কি তারা কোনো সার্ভিস নিচ্ছেন? এই মেয়েটা কি তার মা-বাবার পাশে থেকে তাদের সেবা করতে পারছে?
তাদের আদরের মেয়ের পিছনে এত কিছু বিনিয়োগ করেও তারা নিজেরা তার থেকে কোনো সার্ভিস গ্রহণ না করে আস্ত একটা মেয়েকে তার স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। তারপর তার স্বামী সেই মেয়ের কাছ থেকে তার বাচ্চাকাচ্চা জন্ম দেওয়া ও দেখাশোনার সার্ভিস, বাচ্চাদেরকে শিক্ষাদীক্ষা দেওয়ার সার্ভিস, নিজের মা-বাবা এবং আত্মীয়দের দেখাশুনা করার সার্ভিস; সর্বোপরি, নিজের চরিত্র হেফাযতের সার্ভিসসহ সমস্ত প্রয়োজনীয় সার্ভিস পেয়ে যাচ্ছে। এই এতকিছুর পরও আর কী চাই? এগুলো ভাবার বিষয় নয় কি? গাছ রোপণ করলেন মা-বাবা, সেটার পেছনে মেহনতও করলেন তারা। আর স্বামী সেটার ফল ভোগ করে যাচ্ছে। অথচ শ্বশুরবাড়ি থেকে বিভিন্ন সময়ে এটা সেটা পাওয়ার মানসিকতায় তার বড় অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়।
যে মা-বাবা তাদের মেয়েকে আপনার স্ত্রীর মর্যাদায় নিয়ে আসতে এত এত কষ্ট করলেন, সেই তাদের কাছে কি এটা সেটা চাইতে আপনার লজ্জা হওয়ার কথা নয়? আপনার সার্ভিসের উপযোগী করে তুলতে আপনার স্ত্রীর পেছনে তাদের এত আত্মত্যাগের পর কোন মুখে আপনি তাদের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশায় বসে থাকেন? এতে আপনার ব্যক্তিত্ব কত সস্তাভাবে এক্সপোজ হচ্ছে— তা কি আপনি বুঝতে পারছেন না?
আপনি কখন আপনার শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মান করলেন, জানেন? শ্বশুর-শাশুড়িকে কেবল সালাম আর ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করাতেই সম্মান করা হয়ে যায় না। তাদেরকে আপনার তখনই সম্মান করা হবে, যখন আপনি তাদের মেয়েকে দিয়ে তাদের নিকট এটা সেটা চাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। যৌতুক থেকে বাঁচিয়ে দেওয়াই তাদের প্রতি আপনার বড় সম্মান।
[৩]
আপনি কি কাউকে ভালোবেসে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে পারবেন? পারবেন না। কিন্তু আপনার প্রতি আপনার স্ত্রীর ভালোবাসা এতটাই গভীর যে, সে তার সকল আপনজন ছেড়ে আপনার কাছে চলে এসেছে। আপনাকে সে কত বেশি ভালোবাসে, আপনাকে সে কত বেশি আপন করে নিয়েছে, সেটা বোঝার জন্য তার সকল প্রিয়জনকে ছেড়ে আপনার কাছে চলে আসার মহান ত্যাগই যথেষ্ট। এরপরও কি আপনি স্বামী তার মূল্য বুঝবেন না? তার আবেগ বুঝবেন না?
যে মেয়ে একসময় তার মাকে ছাড়া থাকতেই পারত না, যে মেয়ে তার নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য বাড়িতে গিয়ে থাকা কমফোর্ট ফিল করত না, সেই মেয়ে আজ আপনার কাছে দিনের পর দিন অনায়াসে থাকছে, সেই মেয়ে আপনার বাড়িকে তার কমফোর্ট জোন বানিয়ে নিয়েছে। এরপরও বুঝবেন না আপনার প্রতি তার ভালোবাসা? আপনার প্রতি যার এত ভালোবাসা, তাকে কীভাবে তার বাপের বাড়ি থেকে কৌশলে এটা সেটা এনে দেওয়ার কথা বলে মানসিক কষ্টে রাখতে পারেন? কীভাবে পান থেকে চুন খসলেই তার গায়ে হাত তুলতে পারেন? একটুও কি তার প্রতি আপনার মায়া হয় না? তার এত ত্যাগ কি আপনার একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার দাবি রাখে না?
চিন্তা করুন তো, আপনার মেয়েকে যদি তার স্বামী বাপের বাড়ি থেকে এটা সেটা আনার কথা বলে, তবে আপনার কেমন লাগবে? পারবেন কি মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে? পারবেন না। এখন যে কষ্ট আপনি আপনার মেয়ের বেলায় চিন্তাও করতে পারেন না, সে একই কষ্ট আপনি কেন অন্যের মেয়েকে দিবেন? আপনি যদি আপনার নিজের মেয়ের বেলায় ইনছাফ আশা করেন, তবে অন্যের মেয়ের সাথে কেনো বে-ইনছাফ করবেন?
যে আপনি নিজের কোনো কিছুর বেলায় ইনছাফের কথা বলেন, সে আপনি নিজেই কি অন্যের সাথে ইনছাফ করছেন? অন্যের বেলায় যদি ইনছাফ না করা হয়, তবে নিজের বেলায় ইনছাফ আশা করা কতটা যৌক্তিক নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন তো।
[৪]
কখনো স্ত্রীর সাথে এমন ব্যবহার করবেন না, যে ব্যবহারে সে আপনার অনুপস্থিতি কামনা করে, যে ব্যবহারের কথা মনে করে তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু পড়ে, তার মনের বার্তা আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আপনার স্ত্রীর সাথে এমন ব্যবহার করুন, যে ব্যবহার আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার ভালোবাসার স্মরণ তাকে ভীষণ কাঁদায়। যে ব্যবহারে সে ছালাত আদায় করে রবের কাছে আপনাকে তার জীবনে পাওয়ার শুকরিয়া আদায় করে।
স্ত্রীকে আপনার তখনই ভালোবাসা হবে, যখন আপনি তার বাপের বাড়ি থেকে এটা সেটা এনে দেওয়ার কথা বলে মানসিক কষ্টে রাখবেন না। স্ত্রীর প্রতি আপনার ভালোবাসার গভীরতা তখনই বোঝা যাবে, যখন আপনি আপনার স্ত্রীকে কাছে টেনে এনে বলবেন, দেখো! তুমি ইফতারী নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করো না। ঘরের সবাইকে আমি বিনয়ের সাথে বুঝাব যে, আমরা কোনো ইফতারী নেব না। তোমার কাছে আমার একটাই চাওয়া। আর সেটা হচ্ছে, যে রব আমাকে তোমার মতো পরম নেয়ামত দিয়েছেন, সেই রবের ইবাদত-বন্দেগীতে তুমি সময় কাটাও। রবের সন্তুষ্টি ঘিরে তোমার সকল চিন্তা হোক; ইফতারীকে ঘিরে নয়।
আপনার আচরণ যেন এমন না হয়, যে আচরণ দেখে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আহ! এ আমরা কার কাছে মেয়েটাকে বিয়ে দিলাম। এমনকি মাথায় হাত রেখে যেন আক্ষেপের স্বরে না বলে, হায়! এমন মানুষের কাছে আমাদের মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা জীবনের বড় এক ভুল ছিল।
পক্ষান্তরে, নিজের চরিত্রকে সেইভাবে উন্নত করুন, আপনার যে চরিত্র দেখে বিয়ের পর আপনার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মনে বড় আনন্দ নিয়ে বলে যে, এই মানুষটির কাছে আমাদের মেয়ে বিয়ে না দেওয়ার সিদ্ধান্তটা জীবনের অনেক বড় এক ভুল হয়ে যেত। রবের কাছে অসংখ্য শুকরিয়া যে, তিনি আমাদেরকে এমন মানুষের কাছে বিয়ে দেওয়ার মতো বড় ভালো একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাওফীক্ব দিয়েছিলেন। আল-হামদুলিল্লাহ!
[৫]
সমাজে যখন স্ত্রীর বাপের বাড়ি থেকে ইফতারী খাওয়ার রীতি চালু রয়েছে, তখন আপনি সে প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আপনার স্ত্রীকে একটি সারপ্রাইজ দিতে পারেন। জানেন সেটা কী? সেটা হচ্ছে, আপনি আপনার স্ত্রীকে হাসিমুখে গিয়ে বলবেন, চলো! আমরা একদিন আমার শ্বশুরবাড়িতে তাদের জন্য কিছু ইফতার সামগ্রী নিয়ে তাদেরকে দেখে আসি।
যে শ্বশুর-শাশুড়ির কারণে তোমার মতো একজন স্ত্রী আমি অধম পেয়েছি, যে শ্বশুর-শাশুড়ির সুধারণার কারণে আমি তোমার স্বামী হতে পেরেছি, সেই তাদের সাথে কিছু সুন্দর সময় কাটিয়ে আসি, সেই তাদের দু‘আ নিয়ে আসি।
এভাবে বললে কী হবে, জানেন? এভাবে সুন্দর ভাষায় মহব্বত নিয়ে মন থেকে বললে দেখবেন আপনার স্ত্রী আপনার উপর অনেক খুশি হবে। সে এক অন্য লেভেলের খুশি। তখন তার মাথা থেকে তার বাবার বাড়ি থেকে ইফতারী নিয়ে আসার মহা টেনশন দূর হবে। যে দুশ্চিন্তার ভারে সে মানসিকভাবে নুইয়ে পড়ছিল, সেটা নিমিষেই দূর হয়ে যাবে আপনার চমৎকার একটি কথাতেই। সে যে কী খুশি হবে, তা একবার করেই দেখুন না। বিশ্বাস করুন, তার খুশি দেখে আপনি হৃদয়ে অন্যরকম এক প্রশান্তি অনুভব করবেন। এছাড়া, আপনার প্রতি তার সম্মান, কেয়ারিং, ভালোবাসা আরও বহুগুণ বেড়ে যাবে। স্ত্রীর সাথে এমন সুন্দর দৃশ্য দেখে আল্লাহও অনেক খুশি হবেন। আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে আপনার সম্মান আরও বাড়িয়ে দেবেন। আর কারো দুশ্চিন্তা দূর হয়, এমন কিছু করায় আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনারও দুনিয়া-আখেরাতের সকল দুশ্চিন্তা দূর করে দিবেন।
রাকিব আলী
আম্বরখানা, সিলেট।