আচ্ছা, কেউ কি কখনো নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারে? হয়তো কেউ মারে। আর এই কাজে ছাত্র-ছাত্রীরা বেশ পটু। একথা শোনার পর হয়তো তোমার চক্ষু চড়কগাছ! তুমি হয়তো ভাবছো, আমি তোমার সাথে রসিকতা করছি। তুমি দ্বিধায় পড়ে গেছো, কেনোই-বা মানুষ নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মেরে আঘাত করতে যাবে? আর শিক্ষার্থীরা কেনো এ অযাচিত কাজটিতে অধিক পারদর্শী? পাগলও তো এ কাজ করবে না! মনের মাঝে কুণ্ডলী পাঁকিয়ে থাকা এ ভাবনাগুলো হয়তো এখন তোমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিচ্ছে, কীভাবে সম্ভব এটা?
হ্যাঁ, তোমার মনের অলিন্দে আছড়ে পড়া এ ভাবনাগুলোর তত্ত্ব উদ্ঘাটন করতেই আমার এ ছোট্ট প্রয়াস। তাই প্রবন্ধটির আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলো। তবেই বিষয়টি তোমার সামনে দিবালোকের ন্যায় প্রতিভাত হয়ে উঠবে।
কেউ যদি নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনে। যদি কেউ তার সামনে অবস্থিত সোজা পথটি বাদ দিয়ে বাঁকা পথের দিকে চলতে থাকে, যা কণ্টকাকীর্ণ এবং খুবই পিচ্ছিল। আবার যদি কেউ তার সামনে থাকা মধু ও বিষের মাঝে বিষটাকেই গ্রহণ করে অথবা কেউ যদি নিজেই নিজের সুপ্ত প্রতিভাকে গলা টিপে হত্যা করে, তাহলে তার উপমাটা ‘নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারা’-এর মতো দিলে খুব বড় অত্যুক্তি হবে না বোধ হয়।
চলো, এবার জেনে আসি শিক্ষার্থীরা কীভাবে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারে।
১. কাল থেকে পড়া শুরু করব : ‘কাল থেকে পড়া শুরু করব’ বলাটা বহু শিক্ষার্থীর একটি চিরাচরিত স্বভাব। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় বলে থাকে, আজ থাক, কাল নতুন অধ্যায় শুরু হবে। তাই কাল থেকেই পড়ব অথবা আজ বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দিই, শনিবার থেকে একেবারে পুরো উদ্যমে পড়ালেখা শুরু করব।
কিন্তু কত দিন গুজরান হয়ে যায়, দিবসের কতগুলো পৃষ্ঠা উল্টে যায়, তবুও তার সেই কাল আর আসে না।
২. ফাঁকি দেওয়া : শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে ফাঁকি দিয়ে থাকে। যেমন— ক্লাস ফাঁকি দেওয়া অথবা শিক্ষক যখন বলেন, তোমরা সবাই বাড়ির কাজ করেছ? তখন সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, জি, স্যার। মনে করো, এদের মধ্যে কোনো একজন বাড়ির কাজ করেনি। আর শিক্ষক যদি তার খাতাটি না দেখতে চান, তাহলে তো কপাল ভালো। সে তখন ভাবে, যাক বাবা! বেঁচেই গেলাম। আমি বলি, সে নিতান্তই একটা বোকামির পরিচয় দিল। সে যে তার জীবনটা ক্রমশ নষ্ট করছে এবং দ্রুতগামী অশ্বের ন্যায় এক মহাবিপদ যে তার পানে ধেয়ে আসছে, তা সে ঘুণাক্ষরেও অনুধাবন করতে পারছে না।
৩. অলসতা : অলসতা হলো সফলতার অন্তরায়। এ পৃথিবী এক বিশাল কর্মক্ষেত্র। কর্মমুখর এ জগতে কর্মভীরুদের স্থান নেই। তাই অলসতাকে চিরকালের জন্য আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে হবে। কারণ পৃথিবীটা কোনো ফুলশয্যা নয়, বরং এটা কণ্টকাকীর্ণ। তাই জীবনে কিছু পেতে হলে অনবরত পরিশ্রম করতে হবে। কেননা পরিশ্রমই সফলতার প্রসূতি। সম্রাট বাবর তার সংগ্রামী জীবনে নিজের শ্রমের দ্বারাই মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে কোটি মানুষের হৃদয়ে এক বিশাল স্থান দখল করে আছেন।
পৃথিবী আজ এত সাজে সজ্জিত এ পরিশ্রমের ফলেই। পরিশ্রমের স্বরূপকে আমরা ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কাব্যভাষায় এভাবে পাই— কোনো কাজ ধরে যদি, উত্তম সে জন, হউক সহস্র বিঘ্ন, ছাড়ে না কখন।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, অলসতা বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীর নিত্যসাথী। মানুষের জীবন বিনির্মাণের প্রস্তুতিপর্ব হলো ছাত্রজীবন। যার ছাত্রজীবন আলস্যে পরিপূর্ণ, তার জন্য কোনো কালেই নন্দিত জীবনের তৃপ্তি ভোগ করা সম্ভব নয়।
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধু! সময়গুলো অবহেলায় কেটে যাবে, অবলীলায় পার হয়ে যাবে একটা জীবন, এমনটা কি হতে দেওয়া যায়? তুমি খেয়াল করে দেখবে, সব পাখিরা তাদের সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষ করে গোধূলিলগ্নে তাদের নীড়ে ফিরে যায়, ফুলেরাও একদিন প্রস্ফুটিত হয়, রাত গড়িয়ে একসময় নতুন ভোরের উদয় হয়, নদীরাও নিরন্তর বয়ে চলে, ছুটে যায় সাগর পানে। কিন্তু তুমি কবে ছুটবে তোমার অভীষ্ট লক্ষ্যে? তোমার কি চৈতন্যোদয় হবে না?
অনেক হয়েছে! আর কত? এবার উদাসীন সময়ের পাটাতন থেকে ফিরে এসে নতুন ভোরের সোনারাঙা রোদে ঝেড়ে ফেলো জীবনের সমস্ত আলস্য, দুঃখ ও ক্লান্তি। নতুন করে সাজাও তোমার জীবন। ডুবে যাও জ্ঞানের সাগরে। রিলেশন শুরু করো বইয়ের সাথে। পরিশ্রম করে যাও অনবরত। তুমি দেখে নিয়ো, সাফল্য তোমার পদচুম্বন করবেই, ইনশা-আল্লাহ। আরবীতে একটি প্রবাদ আছে, مَنْ جَدَّ وَجَدَ অর্থাৎ ‘যে চেষ্টা করে, সে পায়’।
সুতরাং, তুমিও পাবে। প্রয়োজন শুধু একটুখানি সদিচ্ছার। প্রতিদিন রাতের শেষ প্রহরে আমাদের মহান প্রতিপালক আল্লাহ প্রথম আকাশে এসে তোমাকে ডাকতে থাকেন। তাই এ গভীর রজনিতে মহান প্রতিপালকের পানে করদ্বয় উত্তোলন করে যত স্বপ্নের কথা, মনের মাঝে লুক্বায়িত যত আশা, যত চাওয়া সব ব্যক্ত করো প্রতিপালকের তরে। নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও। পরিশ্রমকে জীবনের সঙ্গী বানাও৷ সমস্ত বিঘ্নতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সামনে পা বাড়াও। ভুলেও কখনো ঝরে যেয়ো না। কারণ তুমি যদি ঝরা পাতার ন্যায় ঝরে যাও, যদি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারো, তাহলে একদিন দপ করে নিভে যাবে তোমার জীবনপ্রদীপ। তখন চারিদিকে দেখবে শুধু অন্ধকার। সেদিন আফসোস করা ছাড়া কিছুই থাকবে না তোমার কাছে। এসবের আগেই কি তুমি ফিরে আসবে না?
সাবধান! কখনো নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরো না, বন্ধু।
সাব্বির আহমাদ
অধ্যয়নরত, মাদরাসাতুল হাদীস, নাজির বাজার, বংশাল, ঢাকা।