প্রিয় হে! জীবন সায়াহ্নে তোমাকে দু-চারটি কথা বলব, যা আমি বহুদিন যাবৎ বুকে লালন করে এসেছি। প্রতিটি কথাই বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বলব। তুমি ক্ষণিকের জন্য একটু মনোযোগী হও। লেখাপড়ার কালে কখনো ভুল করেও প্রেমরাজ্যের অলিগলিতে হামাগুড়ি দিবে না। এর বিষক্রিয়া তুমি সহ্য করতে পারবে না। সহ্য করার মতো তোমার যে শক্তি-সামর্থ্য নেই। আবারও বলছি, আমার কথাগুলো নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করো। তুমি তোমার আশেপাশে অনেককেই দেখবে প্রেমসাগরে অবগাহন করছে। এই সাগরের চোখ ধাঁধানো শীতল জল থেকে ক্ষণকালের জন্য তনুমন শিহরিত করছে। মাঝেমধ্যে তোমার কাছে এসে শেয়ার করছে উৎফুল্লতার গল্পের ঝুড়ি। অবচেতন মনে তোমারও মন চাইবে প্রেমের শীতলতা থেকে একটু শরীরটা শিহরিত করে নিই, চেখে নিই প্রেমের যৎসামান্য মিষ্টতা। আমিও প্রেমের আলাপ-আড্ডায় মজে থাকি। না, কখনো করা যাবে না। এটা হিমশীতল জল নয়; নরকের অনল। পা দিলেই পরক্ষণেই ভস্মীভূত হয়ে যাবে তোমার গোটা দেহ। কত নিষ্পাপ দেহকে দেখেছি উদ্দীপনার সাথে সদাসর্বদা প্রাণবন্ত হয়ে লেখাপড়ার মজায় মগ্ন থাকত। দুদণ্ড সময় মিলত না কারো সাথে একটু আলাপচারিতায় নিমগ্ন হওয়ার; পড়ালেখা আর পড়ালেখা। কিন্তু কোনো একদিন শয়তানের ফাঁদে পড়ে চলে যায় প্রেমরাজ্যের চোরাবালিতে। শত চেষ্টা করেও আর ফিরে আসতে পারেনি এই চোরাবালির মুখ থেকে। পরিশেষে ভূগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কেউ জানে না তার অস্তিত্বের খবর। কিছুকাল পূর্বেও তার লেখাপড়ার গতি ছিল কিংবদন্তিতুল্য। সময়ের পরিক্রমায় এখন সে মানুষের উপমাতে পরিণত হয়েছে। কত বালককে আমি দেখেছি শেলফের সাথে মাথা ঠুকরে কাঁদতে। ছায়াঘেরা বিকেলে যখন আমরা খুনশুটি আর খোশগল্পে মজে থাকতাম, তখন সে চেহারা কালো করে নীরবে নিভৃতে একা একা বসে থাকত। তার দেহাবয়ব দেখলেই মনে হতো তার ভেতরে লেলিহান অগ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলছে। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় সে কাউকে কিছু বলতে পারত না। চিন্তা, বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তাকে তিলে তিলে আমার চোখের সামনে শেষ করে দিয়েছে। অতএব, ভুলেও এ জগতে পা বাড়াবে না। প্রেমের অগ্নিদহনের যন্ত্রণা যে কত পীড়াদায়ক তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। এটা শুধু তারাই বুঝবে, যারা এই অনলে পা দিয়েছে। তোমাকে সতর্ক করার মানসে আজ এই লেখাটা। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে পড়বে। শুধু তোমাকে নিবৃত রাখার জন্য আমি লিখছি, প্রেমঅগ্নির কিছু কুফল তোমার সাথে শেয়ার করছি।
(১) আল্লাহর কাছ থেকে শাস্তি : আল্লাহ তাআলা বলেন,ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে ফাসাদ প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (আর-রূম, ৩০/৪১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ‘আর অবশ্যই আমি তাদেরকে গুরুতর আযাবের পূর্বে লঘু আযাব আস্বাদন করাবো, যাতে তারা ফিরে আসে’ (আস-সাজদাহ, ৩২/২১)।
আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি দুইভাবে হয়ে থাকে, শারীরিক ও মানসিক। রাত জেগে প্রেয়সীর সাথে অহেতুক প্রণয়ের আলাপে মজে থাকলে ফুটফুটে সতেজ চেহারাও ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাবে। চোখের পাপড়ির নিচে কালো রেখা পড়বে, মুখে ব্রণ দেখা যাবে, চেহারা মলিন হয়ে যাবে, শরীরের ওযন কমে যাবে, চেহারা ভয়ংকর হয়ে যাবে, শরীর ভেঙে যাবে ও যৌন সমস্যা দেখা দিবে। কারণ আল্লাহ তাআলা রাত নির্ধারণ করেছেন ঘুমের জন্য। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি, পরিশ্রমের দরুন দুর্বলতার বড়সড় আস্তরণ ঘুমানোর মাধ্যমে দূর হয়ে যায়, আবার ফিরে আসে হারিয়ে যাওয়া সজীবতা, উদ্যমতা। প্রভাতে ফুরফুরে চাঙ্গা মন নিয়ে আমরা আবার কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ি। বিনিদ্র রাত্রিযাপন করে গোটা দিন ঘুমালেও রাতের ছুটে যাওয়া প্রশান্তির ঘুম আর হবে না। প্রিয় ভাই! রাতকে তো আল্লাহ নির্ধারণই করেছেন ঘুমের জন্য। রাতের ঘুম মহান রবের পক্ষ থেকে পরম অনুগ্ৰহ, যা বেখেয়ালিপনা ও অবহেলায় নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি আমাকে বলো তো সারা রাত ওই তরুণীর সাথে কীসের আলাপ করেছ? রাতের অর্ধেকের বেশি সময় তো শুধু তার সাথে রাগ-অভিমানের ঝুলি উপস্থাপনের মাধ্যমেই কেটেছে। কখনো হেসেছ, কখনো কেঁদেছ, কখনো অভিমান করেছ আবার কখনো প্রেমের দরিয়ায় ডুব দিয়ে খানিকটা শীতলতা অনুভব করেছ। একটু সময় করে মুক্তমনে চিন্তাভাবনার খাতায় আঁকিবুঁকি দাও তো। কী আবোল-তাবোল না বললাম রাতভর! কিছু তো শুরু-শেষ খুঁজে পাচ্ছি না! কী লাভ হয়েছে? বলতে পার সাময়িকের জন্য একটু ভালোবাসার মজা চেখেছি। আমি বলব, এটা হলো শয়তানের বড় ধোঁকা। তুমি তো বুঝতে পারলে না। তুমি তো মরীচিকার পেছনে ঘুরছ। দিনশেষে দেখবে রিক্তহস্তে ফিরতে হচ্ছে। শুধু অযথা তোমার জীবন ও গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হবে। মানসিক শাস্তি কী পাবে জানো? তুমি খেতে পারবে না, বমি আসবে। মনে হবে ভেতর থেকে সব বের হয়ে আসছে। চিন্তা, বিষণ্ণতার কারণে তুমি কিছুই করতে পারবে না। সবকিছু বিরক্তিকর লাগবে। কাছের মানুষগুলোর কথা বিদঘুটে ও তিতা লাগবে। মন-মেজাজ স্বাভাবিক থাকবে না, কিছুটা উগ্র বনে যাবে। পড়ালেখা, কাজকারবার কোনো কিছুতেই মন থাকবে না। এককথায় বলতে গেলে তুমি অস্বাভাবিক হয়ে যাবে। ক্ষণে ক্ষণে তোমাকে তার স্মৃতিগুলো প্রকাণ্ড বিষাক্ত সাপ হয়ে কামড়াতে থাকবে। আর তুমি ভেতরে ভেতরে হাউমাউ করে চিৎকার করতে থাকবে; কিন্তু দেউ দেখবে না, কেউ শুনবে না এই করুণ আর্তনাদের সুর। তুমি একা কষ্ট পেতে পেতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে। মাঝেমধ্যে যদি কোথাও বেড়াতে যাও মনটা একটু প্রাণবন্ত করার মানসে আর সেখানে হুট করে কোনো কথা তোমার কর্ণকুহরে ভেসে আসে, যা তুমি ইতোপূর্বে তোমার প্রেমিকার সাথে সঙ্গোপনে বলেছ তাহলে সাথে সাথে এই কথামালা রশি হয়ে তোমার টুঁটি চেপে ধরবে। মুহূর্তের মধ্যে তোমার আনন্দ-উল্লাস বিলীন হয়ে যাবে। পৃথিবীটা বিশাল প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তোমার কাছে সংকুচিত হয়ে যাবে। এই বসুন্ধরায় তোমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। মানসিক বিষণ্নতা এমন, যা হুট করে চলে আসে। তুমি না চাইলেও আসবেই। কত বন্ধুবান্ধব, পরিবার ও আত্মীয়স্বজন তোমাকে সান্ত্বনার বাণী শুনাবে; কিন্তু তোমার যন্ত্রণার আগুন তাদের সান্ত্বনার জলে নিভবে না। তাই আবারও বলছি, একটু চিন্তাভাবনা করে দেখো।
(২) তুমি অপমানিত হবে : তোমাকে একটা উদাহরণ দিই। ধরো, তুমি অনেক ভালো একজন ছেলে। সত্যি সত্যি একজন তরুণীকে তুমি ভালোবাস। তাকে বিয়ে করার মানসেই প্রেম করেছ। আর মেয়ের বাবা কোনোভাবে জেনে গেছে যে, তুমি তার মেয়েকে ভালোবাস। এরপর তুমি তার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছ। দেখবে তোমার প্রস্তাব নাকচ করে দিবে। কিছুতেই মেনে নিবে না। কারণ প্রেম ভালোবাসাকে অভিভাবকরা অপছন্দ করে। তোমার প্রেমের এই গল্প যদি কেউ জানতে পারে, তাহলে সে তোমাকে নিন্দার চোখে দেখবে। তোমার কোনো কথা শুনবে না। আত্মীয়-স্বজন তোমার পেছনে তোমার সমালোচনা করবে। তুমি যদি শিক্ষক হও, তাহলে ছাত্ররা তোমার কথা শুনবে না। কারণ ইতিহাস তোমাকে ছাড় দিবে না। তুমি যদি বড় জ্ঞানীও হও, তথাপি লোকে বলবে, দেখেছি তাকে কিছুদিন আগেও অমুক মেয়ের সাথে প্রেম করে বেড়াত। সে তো বকধার্মিক, সে তো নিজেই ভালো না। নিজেই তো আমল করে না আবার অন্যদের উপদেশ দেয়। কত কথা যে তুমি শুনতে পাবে, তার ইয়ত্তা নেই। অতএব, সাবধান হও।
(৩) দারিদ্র্য আসবে : রাতভর কথা বলতে তো টাকা খরচ হবে, তাই না? অহর্নিশ কথা বললে তোমার পকেটের টাকা শেষ হয়ে যাবে। আমি একজনকে দেখেছি। অনেক টাকা ছিল; কিন্তু তার রোগ ছিল শুধু প্রেম করা। রিক্সা, সিএনজি ও গাড়ির গ্যারেজ ছিল। সময়ের পালাবদলে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন সে অন্যের সিএনজি চালায়; অথচ কিছুকাল পূর্বে সে নিজেই কয়েকটি সিএনজির মালিক ছিল। এখন কথা হলো দারিদ্র্য আসবে কেন? তাহলে তোমাকে দু-একটা আয়াত শুনাই। আল্লাহ তাআলা বলেন,اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا - يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِدْرَارًا - وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَلْ لَكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَلْ لَكُمْ أَنْهَارًا ‘তোমরা তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি তো ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য আসমান থেকে অজস্র বারি বর্ষণ করবেন, তোমাদের মাল ও সন্তানসন্ততি বৃদ্ধি করে দিবেন এবং উদ্যান দান করবেন ও নদী প্রবাহিত করে দিবেন’ (নূহ, ৭১/১০-১২)।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, যদি ক্ষমা প্রার্থনা করো, তাহলে মালসম্পদ বাড়িয়ে দিব। এখন কথা হলো ক্ষমা প্রার্থনা করলে যদি মাল বাড়িয়ে দেন, তাহলে এর বিপরীতে গুনাহ করলে অবশ্যই মাল কমে যাবে। এজন্যই কেউ প্রেম করলে শাস্তিস্বরূপ তার দারিদ্র্য দেখা দিবে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إنَّ الرجلَ لَيُحرَمُ الرِّزقَ بالذَّنبِ يُصيبُه ‘পাপ করার কারণে ব্যক্তি রিযিক্ব থেকে বঞ্চিত হয়’।[1] প্রেম মারাত্মক পাপ নয় কি?!
(৪) আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হবে : প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে কত প্রাণ যে আত্মহত্যা করেছে! অনেকে তো প্রেমিকা অন্যের ঘরে চলে যাবে এটা দেখে সহ্য করতে পারবে না বিধায় প্রেমিকাকেই চিরতরে এই পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিয়েছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে কয়েক বন্ধু মিলে প্রথমে ধর্ষণ করেছে, তারপর মেরে ফেলেছে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। প্রেমে ছ্যাঁকা খেলে জীবনটা একেবারে বিস্বাদময় হয়ে ওঠে। জীবনের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। শয়তান তো আছে কুমন্ত্রণা দেওয়ার জন্য। সে মনের ভেতর উস্কানি দেয়, কার জন্য বেঁচে থাকবি, যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন লালন করেছিলি সে তো আজ অন্যের ঘরে, এই জীবন রেখে কী লাভ? শেষ করে দে এই জীবন। কুমন্ত্রণা দিয়ে শয়তান চলে গেছে, এবার তুমি পা বাড়াও আত্মহত্যার দিকে। শয়তান তোমার চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়ে গেল। তোমাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে সে বড্ড খুশি আজ। আল্লাহ তাআলা কুরআনে সতর্ক করে বলেছেন,وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর অনুগ্ৰহশীল’ (আন-নিসা, ৪/২৯)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ো না। অনুগ্ৰহ করো। নিশ্চয় আল্লাহ অনুগ্ৰহকারীদের ভালোবাসেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৫)। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মত যেন আত্মহত্যা না করে, এজন্য সতর্ক করে বলেন,مَنَ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ فَحَدِيدَتُهُ فِي يَدِهِ يَتَوَجَّأُ بِهَا فِي بَطْنِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا وَمَنْ شَرِبَ سَمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ يَتَحَسَّاهُ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا وَمَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ يَتَرَدَّى فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا ‘যে ব্যক্তি কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামে সে অস্ত্র দ্বারা নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে, এভাবে তথায় সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে আগুনের মধ্যে অবস্থান করে উক্ত বিষপান করতে থাকবে, এভাবে তথায় সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি নিজে পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি সর্বদা পাহাড় থেকে নিচে গড়িয়ে জাহান্নামের আগুনে পড়তে থাকবে, এভাবে সে ব্যক্তি তথায় চিরকাল অবস্থান করবে’।[2] আর এভাবেই শেষ পর্যন্ত তুমি চিরশত্রু শয়তানের কাছে পরাজিত হলে।
(৫) মা-বাবার অবাধ্য হবে : প্রতিটি বাবা-মা মনে প্রকাণ্ড একটা স্বপ্ন লালন করেন। আমার ছেলেকে ধুমধাম করে বিয়ে করাবো, আমার মেয়েকে লাল টুকটুকে করে বউ সাজিয়ে মহানন্দের সাথে ধুমধাম করে বিয়ে দিব। অথচ মেয়ে তো অপরিচিত এক ছেলেকে নিয়ে উধাও। হুট করে কোথায় যে চলে গেল, দুদিন কোনো হদিস নেই। দুদিন পর জানা গেল বিয়ের খবর। বাবা-মার সারা জীবনের স্বপ্ন নিমেষেই উবে গেল। সন্তানকে নিয়ে কত গৌরব করত মানুষের সাথে। এক অঘটনের তাণ্ডবে সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। একটা ছেলে বা মেয়ের ফাঁদে পড়ে অবাধ্য হলে পরমাত্মীয় পিতা-মাতার। অনেকে তো আবার প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে চিরকুমার হয়ে থাকে। জীবনে আর বিয়ে করবে না। বাবা-মা হাজার বললেও কথা গায়ে মাখে না। এই পাগল! তুমি চিরকুমার থাকলে তোমার প্রেয়সীর বাবা-মা কিন্তু তাকে ঠিকই বিয়ে দিয়ে দিবে বা দিয়ে ফেলেছে। কার জন্য নিজের জীবন নষ্ট করছ তুমি? একটা কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো, কারো জন্য নিজের জীবন নষ্ট করতে নেই। তুমি যার জন্য মুখটা গোমড়া করে বসে আছ, সে কিন্তু দিব্যি হেসেখেলে সময় পার করছে। সে যদি তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারে, তাহলে তুমি তাকে ছাড়া কেন ভালো থাকতে পারবে না? আমি জানি আমার কথাগুলো তোমার কাছে খুব ভারী মনে হচ্ছে। মনে মনে বলছ, আরে মিয়া! আপনি কী বুঝবেন বিরহ যাতনার কথা। উপদেশ দেওয়া খুবই সহজ; কিন্তু পালন করা বহু কঠিন। এই ছেলে! তুমি তো গোড়াতেই ভুল করলে। কেন গেলে ওই টিপাইমুখের ধারে। কোন শয়তানের কথা শুনে এ কাজ করলে? এখন যতই কষ্ট হোক এখান থেকে যে তোমাকে সোজা হয়ে বাড়ির পথে রওনা দিতে হবে। আমার উপর এত রাগ করছ কেন? তুমি তোমার বাবা-মার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু পরখ করো। তাদের নিয়ে একটু ভাবো। তাদের স্বপ্নটা নষ্ট করে দিয়ো না। বাবা-মাকে কষ্ট দিলে কিন্তু এই পৃথিবীতেই তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। আল্লাহ কিছু অপরাধ করলে পৃথিবীতেই শাস্তি দিয়ে থাকেন। এর মাঝে অন্যতম হলো পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। মা-বাবার কথা না শুনে প্রেম করে যাকে বিয়ে করলে সে তো তোমার সাথে মিলবে না। কয়দিন পরপর মনকষাকষি হবে। এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদের কালো আবরণ পড়বে। এজন্যই গবেষণায় দেখা গেছে, প্রেমের বিয়েগুলোর অধিকাংশই পরবর্তীতে টিকেনি, বিচ্ছেদ ঘটেছে। কীভাবে সম্পর্ক অটুট থাকবে বলো তো। এই বিয়েতে তো তোমার মা-বাবার দু‘আ ছিল না। তাই বলছি, বাবা-মার অবাধ্য হয়ো না।
(৬) অন্তর মরে যাবে ও নেক কাজ করতে পারবে না : আল্লাহ তাআলা বলেন, أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ‘জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে’ (আর-রা‘দ, ১৩/২৮)। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,ذاقَ طعمَ الإيمانِ من رضيَ باللهِ ربًّا وبالإسلامِ دينًا وبمحمَّدٍ نبيًّا ‘ওই ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পাবে, যে আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে ও মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট হবে’।[3]
প্রিয় হে! তুমি তো আল্লাহ যে ভালোবাসা পাওয়ার হক্বদার ছিলেন, এটা দিয়ে দিয়েছ এক রমণীকে। তোমার অন্তর তো এ কারণে মরে গেছে। তুমি তো ঈমানের স্বাদ পাবে না। নেক কাজ করতে ভালো লাগবে না। ছালাতে মন বসবে না। কেমন জানি সবকিছু বিরক্তিকর মনে হবে। তোমার হৃদয়ে কারো উপদেশের শীতল বাণী প্রবেশ করবে না। তোমার হৃদয়ের মুখ তো পাপের আবরণে ঢেকে আছে। তুমি দেখবে একপর্যায়ে তুমি উদাসীন হয়ে যাচ্ছ। তোমার মাঝে পরিবর্তন সকলের নযর কাড়বে। কিন্তু তুমি এই উদাসীনতা থেকে ফিরতে পারবে না। কীভাবে তুমি ফিরবে? অন্তর তো উদাসীনতা থেকে ফিরে আসে আল্লাহর স্মরণে। আর তুমি তো এতে নিমগ্নই হতে পারছ না। ছালাতে দাঁড়ালে তার কথা মনে পড়ে। কীভাবে হেসে-খেলে সারা রাত অতিবাহিত করেছ তা মানসপটে ভেসে ওঠে। সবাই দেখবে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। শুধু তুমি একাই সবকিছুতে পিছিয়ে আছ। আমি তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি যদি মসজিদে না আসো, তাহলে তোমার পরিবর্তে আরেকজন কিন্তু ঠিকই আসবে। তুমি কুরআন পড়ে যদি ভুলে যাও, তাহলে অন্য কেউ কিন্তু ঠিকই কুরআন মুখস্থ করবে। তুমি আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে গেলে আরেকজন কিন্তু আল্লাহকে পাওয়ার জন্য অবিরত চেষ্টা করেই যাবে। মাঝখান থেকে তুমি আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে গেলে। তুমি জাহান্নামের আগুনের সন্নিকটে হলে। তুমি পাপ-পঙ্কিলতার আস্তরণে পড়ে রইলে। মনে রেখো, তুমি আল্লাহকে ছেড়ে দিলে আল্লাহর কিছু আসে যায় না। কিন্তু আল্লাহ তোমাকে ছেড়ে দিলে তোমার সমস্যা আছে। তুমি আল্লাহকে না ডাকলেও তোমাকে ছাড়া আল্লাহকে ডাকার মতো অজস্র বান্দা দুনিয়ায় রয়েছে। তোমার পরিণতি নিয়ে এখনো একটু ভাবো। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوا أَمْثَالَكُمْ ‘যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য কাউকে নিয়ে আসবেন, যে না-কি তোমাদের মতো হবে না’ (মুহাম্মদ, ৪৭/৩৮)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيدٍ ‘তিনি ইচ্ছে করলে তোমাদের শেষ করে দিয়ে অন্যদের নতুন করে নিয়ে আসবেন’ (ইবরাহীম, ১৪/১৯)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মাঝে কেউ নিজ দ্বীন থেকে ফিরে চলে গেলে আল্লাহ অচিরেই এমন এক সম্প্রদায়কে নিয়ে আসবেন, যাদের তিনি ভালোবাসবেন ও তারাও তাঁকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি থাকবে কোমল ও কাফেরদের প্রতি থাকবে কঠোর’ (আল-মায়েদা, ৫/৫৪)।
(৭) আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে ও দু‘আ কবুল হবে না : গোপনে প্রেম করলে নিশ্চিত আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে (আল্লাহর কাছে এর থেকে আশ্রয় চাই)। কোনো দু‘আ করলে তিনি তা কবুল করবেন না। চিন্তা, বিষণ্ণতা থেকে দূরে থাকার জন্য দু‘আ করলে তা কবুল হবে না। কারণ মহান রব তো তোমার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন। তুমি খেয়াল করে দেখবে তোমার প্রার্থিত বিষয় তুমি দু‘আ করে পাচ্ছ না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এই পাপ। আমি অনেককে বলতে শুনেছি, কত দু‘আ করছি কোনো দু‘আই তো কবুল হচ্ছে না। দু‘আ কবুল হবে কীভাবে! রাস্তা তো বন্ধ হয়ে আছে। আগে পাপ থেকে বিরত থাকো, তারপর দু‘আ করো। অবশ্যই তোমার দু‘আ কবুল হবে। ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ প্রেমের আরো অনেক কুফল বর্ণনা করেছেন।
পরিশেষে বলব, তুমি আর গাফলতির মাঝে থেকো না। ফিরে এসো আপন নীড়ে। সন্ধ্যা যে ঘনিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আল্লাহ তাআলা সুবোধ দান করুন- আমীন!
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. ইবনু মাজাহ, হা/৪০২২, হাসান।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৯।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৪।