[১]
আজকাল আমাদের কোনো বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিচিত কারো সফলতার কথা শুনলেই আমরা তাকে Congratulations জানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগি। সোস্যাল মিডিয়ায় তো রীতিমতো Congratulations জানানোর এক ধুম পড়ে যায়। পক্ষান্তরে, অনেকে আবার অভিনন্দনটুকুই জানান না। বরং অন্যের সফলতা দেখে তাদের মধ্যে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যেন তাদের ভেতর জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, তাদের যেন সহ্যই হচ্ছে না। ফলে তাদের মধ্যে কেমন জানি এক অশান্তির সৃষ্টি হয়। যার নেপথ্যে রয়েছে হিংসা আর হিংসা। এই হিংসাই মানুষকে পিছনের দিকে নিয়ে যায়, নিয়ে যায় ধ্বংসের দিকে।
কারো সফলতায় Congratulations জানানো মন্দ কিছু নয়। এটা বলা যেতেই পারে। কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের এমন কিছু অবলম্বন করা দরকার, যা তার চেয়েও অনেক বেশি উত্তম। এই Congratulations জানানো মানুষের ভিড় থেকে আমরা নিজেদেরকে আলাদা করে রাখতে পারি। এমন এক কাজ করতে পারি, যা আল্লাহর কাছেও অনেক প্রিয় করে তুলবে।
আমরা চাইলেই কারো সফলতাতে প্রকাশ্যে অভিনন্দন জানানোর পরিবর্তে এমন এক স্পেশাল উপায়ে অভিনন্দন জানাতে পারি, যা ঐ ব্যক্তি কোনোভাবে জানতে পারলে বিষয়টি তাকে রীতিমতো অবাক করে দিবে! এমনকি আবেগ-আপ্লুত পর্যন্তও করে দিতে পারে! সবচেয়ে বড় কথা, আল্লাহ তাআলা যদি ঐ ব্যক্তিকে ক্বিয়ামতের মাঠে দেখান যে, হে অমুক! দুনিয়ার জীবনে যেখানে তুমি বাছবিচারহীনভাবে অমুক-তমুককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলে, যাকে-তাকে বেস্ট ফ্রেন্ড মনে করেছিলে, সেখানে এই দেখো তোমার প্রকৃত বন্ধু কে ছিল, কে ছিল তোমার প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী! সেই মুহূর্তে প্রকাশ্যে Congratulations জানানো মানুষদের কারো নাম না এসে যখন আপনার নাম চলে আসবে, তখন সে দৃশ্য দেখে আপনার বন্ধু কী পরিমাণ খুশি হবে কিংবা আপনার নিজের মধ্যে কতোটা উৎফুল্লতা কাজ করবে, সেটা কি আপনি এই মুহূর্তে ভাবতে পারছেন?
আপনার কোনো বন্ধুর কোনো সফলতাতে যখন তার অন্যান্য বন্ধুরা তাকে Congratulations জানাতে তার ইনবক্সে কিংবা কমেন্ট বক্সে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, ঠিক তখন আপনি তাদের মতো উইশ না করে আপনি আপনার বন্ধুর জন্য যে কাজ করতে পারেন তা হচ্ছে, আপনি গোপনে আল্লাহর দরবারে তার জন্য এভাবে দু‘আ করতে পারেন, হে আমার রব! আপনি আমার এই বন্ধুকে আরও ভালো অবস্থায় এবং ভালো অবস্থানে রাখুন। তাকে এমন অবস্থায় রাখুন, যে অবস্থায় থাকলে আপনি রব, তার উপর সবসময় সন্তুষ্ট থাকবেন।
হে আমার প্রতিপালক! আমি চাই না, আমি ভালো অবস্থানে থাকি আর আমার বন্ধু খারাপ অবস্থানে থাকুক। কারণ নিজে ভালো অবস্থায় থেকে আমার বন্ধুর খারাপ অবস্থা দেখে যেতে আমি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারব না মা‘বূদ! এভাবে আপনি আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে তার জন্য অন্তর থেকে দু‘আ করতে পারেন।
জানেন, গোপনে কারো জন্য একদম মন থেকে কল্যাণ কামনা করা অর্থাৎ দু‘আ করাতে এক অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি রয়েছে, তা অন্তত একবার না করে দেখলে বুঝবেন না। সফল হওয়া ব্যক্তিটি কিংবা যার জন্য আপনি দু‘আ করছেন, সে ব্যক্তি আপনাকে যতই এড়িয়ে চলুক না কেন, আপনি কিন্তু তার জন্য দু‘আ করেই যাবেন এমন মানসিকতা রাখবেন। বিশ্বাস করুন, তাতে আপনার মনের মধ্যে সত্যিই অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করবে, অন্য রকম এক শান্তি অনুভূত হবে।
সত্যি কথা বলতে কি! কারো সামনাসামনি মঙ্গল কামনা করাকে প্রকৃত অর্থে মঙ্গল কামনা করা বলে না। কেননা প্রকাশ্য কারো মঙ্গল কামনা করাতে বিশেষ কোনো স্বার্থও থাকতে পারে। ফলে এমন কামনার বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কিন্তু কারো জন্য গোপনে মঙ্গল কামনা করাতে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তার প্রিয় বান্দা হয়ে ওঠার স্বার্থ ব্যতীত আর কোনো স্বার্থ থাকার সুযোগ নেই। ফলে এর বিশুদ্ধতা নিয়েও আর কোনো প্রশ্নের ফাঁক থাকে না।
মূলত, সেটাকেই প্রকৃত মঙ্গল কামনা বলে, যেখানে গোপনে কারো জন্য মঙ্গল কামনা করা হয়। আজকের যুগে যেখানে মানুষের হিংসা-অহংকার এর মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে, যেখানে একজন আরেকজনের ভালোটুকু সহ্য করতে পারে না, সেখানে কারো প্রতি গোপনে কল্যাণ কামনা করতে পারাটা আসলেই অনেক বড় এক আল্লাহওয়ালার পরিচয়। আল্লাহ তার এমন বান্দাদের জন্যেই তো অকল্পনীয় নেয়ামতে ভরপুর জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন।
[২]
একজন মানুষের জন্য আপনার সবচেয়ে বড় উপহার কী জানেন? গোপনে মন খুলে দু‘আ করতে পারাই হচ্ছে কারো জন্য আপনার সবচেয়ে বড় উপহার। এর চেয়ে দাবী উপহার আর কিছুই হতে পারে না। এটি এমনই এক উপহার, যার কোনো মূল্য হয় না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দু‘আ করে, তখন ফেরেশতাগণ বলেন, আমীন এবং তোমার জন্যও অনুরূপ হবে’।[1]
উক্ত হাদীছ থেকে বুঝা যাচ্ছে, আপনি যদি আল্লাহর কাছে বলেন যে, হে আমার রব! আমার অমুক ভাইকে বা বোনকে ভালো ফলাফল করিয়ে দিন, তার হালাল উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিন, তার বিয়ে সহজ করে দিন, তার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে শ্রেষ্ঠ হয় এমনই এক উত্তম সঙ্গী মিলিয়ে দিন, তবে এই দু‘আ শুনে ফেরেশতাগণ কী করবেন জানেন? তারাও আপনার প্রতি খুশি হয়ে আপনার জন্য বলবেন, হে আমাদের রব! আপনার এই দু‘আকারী বান্দার জন্য একই বিষয় কবুল করে নিন। অর্থাৎ আপনি তাকেও ভালো ফলাফল করিয়ে দিন, হালাল উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিন, তার বিয়ে সহজ করে দিন, তার জন্যও দুনিয়া ও আখেরাতে শ্রেষ্ঠ হয় এমনই এক উত্তম সঙ্গী মিলিয়ে দিন।
এবার বুঝতেই তো পারছেন, কারো জন্য মঙ্গল কামনা করা মানে আল্টিমেটলি নিজের জন্যই মঙ্গল কামনা করা। আপনি যার জন্য যেমন দু‘আ করছেন, সেই একই দু‘আ কিন্তু আপনার নিজের জন্যও করা হয়ে যাচ্ছে। তাও আবার যেনতেন কেউ দু‘আ করে দিচ্ছেন না, স্বয়ং আল্লাহর নিষ্পাপ ফেরেশতাগণ আপনার জন্য দু‘আ করে দিচ্ছেন। আর তা কতই-না সৌভাগ্যের বিষয়! সুবহানাল্লাহ! এমন বিষয় ভাবতেই তো কত ভালো লাগে! ইসলামের সৌন্দর্য আরও উপলব্ধি হয়।
অধিকন্তু, বিষয়টি অনেকটা এরকমও দাঁড়ায় যে, আপনি যদি অন্যের জন্য গোপনে দু‘আ করার মাধ্যমে অন্যকে congratulate করেন, তাহলে ফেরেশতারাও আপনার জন্য দু‘আ করার মাধ্যমে আপনাকে Congratulations জানানোর অপেক্ষায় আছেন। এখন আপনিই বলুন, আপনি কি ফেরেশতাদের congratulations পেতে চাইবেন না? নিশ্চয়ই আপনি তা পেতে চাইবেন। তাহলে অন্তরকে হিংসামুক্ত করে অন্যের জন্য মন থেকে দু‘আ করতে কীসের এত কার্পণ্য? ফেরেশতাদের congratulations পাওয়ার জন্য নিজেকে পুরোদমে প্রস্তুত করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
কোনো মানুষ কোনো কিছুতে সফলতা অর্জন করলে দুনিয়ার নিয়মে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত না হয়ে আমরা যেন তার জন্য অন্তর থেকে দু‘আ করি। যিনি সফল হয়েছেন তার সাথে আমরা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে অনুপ্রেরণামূলক কিছু কথা বলতে পারি। একইসাথে, আমরা সফল হওয়া ব্যক্তিকে আমাদের মালিকের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নছীহত করতে পারি, যেন সে দুনিয়ার মোহে পড়ে, সফলতার ছোঁয়া পেয়ে তার আসল মালিককে ভুলে না যায়, মালিকের হক্বের ব্যাপারে যেন সে গাফেল না থাকে। সর্বোপরি মালিকের প্রতি যেন অকৃতজ্ঞ না হয়। অন্যদিকে, আমরা যারা এখনও সফল হতে পারিনি, তাদের জন্যও যেন আমরা দু‘আ করি, যাতে রব প্রত্যেকের মনের নেক আশা পূরণ করেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের পরোপকার করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
রাকিব আলী
আম্বরখানা, সিলেট।
[1]. সুনান আবূ দাঊদ, হা/১৫৩৪, ছহীহ।