মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো বান্দা অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি অপরাধ করেছি, তুমি তা ক্ষমা করো। তখন আল্লাহ বলেন, (হে আমার ফেরেশতাগণ!) আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দিবেন? (তোমরা সাক্ষী থাকো) আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর আল্লাহ যতদিন চাইলেন ততদিন অপরাধ না করে থাকল। আবার অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আবার অপরাধ করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেবেন? আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর সে অপরাধ না করে থাকল যতদিন আল্লাহ চাইলেন। আবার অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আবার আর এক অপরাধ করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেন? আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। সে যা ইচ্ছা করুক।[1]
এই হাদীছ দ্বারা বুঝা গেল অপরাধ যতবারই হোক নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহ ক্ষমা করেন এ বিশ্বাস রেখে একাধিকবার অপরাধ করেও ক্ষমা চাইলে ক্ষমা হবে। হাদীছের অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ গুনাহ করার আদেশ করলেন; বরং আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার মাহাত্ম্য দেখানো হয়েছে।[2]
উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী বলেন, বান্দা যদি একশবার বা হাজারবার বা তার চেয়ে বেশিবারও পাপ করে আর প্রত্যেকবার তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। এমনকি সকল পাপের জন্য একবার তওবা করলেও তার তওবা শুদ্ধ হবে।[3] অতএব, নিরাশ না হয়ে পুনরায় পাপ না করার দৃঢ় ইচ্ছার সাথে তওবা করতে হবে। সাথে সাথে ভালো মানুষদের সাথে উঠা-বসা করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তুমি নিজেকে ধরে রাখো তাদের সাথে যারা সকালে ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে ডাকে তাঁর দীদার লাভের কামনায় এবং তুমি তাদের থেকে তোমার দু’চোখ ফিরিয়ে নিয়ো না পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায়’ (আল-কাহফ, ১৮/২৮)।[4]
বন্ধু আমার! একটি হাদীছ শোনো।
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে সত্তরবারেরও অধিক ইসতিগফার ও তওবা করে থাকি’।[5]
বন্ধু! লক্ষ্য করো— উক্ত হাদীছটিতে প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিনি নিজে দৈনিক সত্তরবার তওবা করে থাকেন। এখন প্রশ্ন হলো, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মাসূম অর্থাৎ পাপ থেকে মুক্ত, তারপরও তিনি কেন তওবা করেছেন? কারণ, (১) তিনি উম্মতকে ইসতিগফার ও তওবার গুরুত্ব অনুধাবন করানোর জন্য নিজে তা আমল করেছেন। (২) পাপ না থাকলেও তওবা ও ইসতিগফার করা যায়। এটা বুঝাতে তিনি এ আমল করেছেন। আর তখন তওবা ও ইসতিগফারের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে মর্যাদা বৃদ্ধি হয়। (৩) ইসতিগফার ও তওবা হলো ইবাদত। পাপ না করলে তা করা যাবে না এমন কোনো নিয়ম নেই। কেউ যদি তার নযরে কোনো পাপ নাও দেখে, তবুও সে যেন ইসতিগফার ও তওবা করতে থাকে। হতে পারে অজান্তে কোনো পাপ তার দ্বারা সংঘটিত হয়ে গেছে বা কোনো পাপ করে সে ভুলে গেছে। (৪) সত্তর সংখ্যাটি আধিক্য বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝাতে নয়। (৫) ইসতিগফার ও তওবা আমলটি সর্বদা অব্যাহত রাখা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত।[6]
বন্ধু আমার! পাপ করো না, কিন্তু পাপ হয়ে গেলে তওবা করো। তোমাকে জানিয়ে রাখি, তওবাকারীর মর্যাদা কী? মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর যারা অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজেদের প্রতি যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনেশুনে তা তারা বারবার করে না বা এর উপরে তারা অটল থাকে না। এরাই তারা, যাদের প্রতিদান তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং জান্নাতসমূহ যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। যেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর আমলকারীদের প্রতিদান কতই না উত্তম’ (আলে ইমরান, ৩/১৩৫-১৩৬)। হাদীছে কুদসীতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে আমার বান্দারা! তোমরা রাতদিন পাপ করে থাক। আর আমি সমস্ত পাপ ক্ষমা করে থাকি। সুতরাং তোমরা আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিব’।[7]
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তবে যারা তওবা করে, বিশ্বাস ও সৎকাজ করে, আল্লাহ তাদের পাপকর্মগুলোকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আর আল্লাহ অসীম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আল-ফুরকান, ২৫/৭০)। হাদীছে এসেছে, আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বান্দার তওবার কারণে সেই লোকটির চেয়েও অধিক খুশী হন, যে লোকটি মরুভূমিতে তাঁর উট হারিয়ে পরে তা পেয়ে যায়’।[8]
বন্ধু আমার! যারা তোমরা উদাসীন হয়ে আল্লাহর বিধানকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছ। আধুনিকতার দোহাই পেড়ে মদ-জুয়া, গান-বাজনা, ও হারাম কাজে সময় অতিবাহিত করছ। প্রগতির স্রোতে ভাসমান হয়ে অবৈধ প্রেম আর ভালোবাসার নামে ব্যভিচারে লিপ্ত হচ্ছ। শিরক ও বিদআতসহ আরও হাজারো পাপে জড়িত হচ্ছ— তোমরা কি দেখতে পাও না, তোমাদের চোখের সামনে অসংখ্য দুর্ঘটনায় কত মানুষ মারা যাচ্ছে? তা থেকে তুমি কি শিক্ষা গ্রহণ করতে চাও না? মানুষের মৃত্যু তোমাদের অন্তরে কি রেখাপাত করে না? তুমি কি ভেবেছ, চিরদিন এই ধরাতে থাকবে? মৃত্যু কি তোমাকে গ্রাস করবে না? তোমার মৃত্যু দেখে তোমারই অন্য কোনো বন্ধু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। মহান আল্লাহর কাছে তওবা করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্তু তুমি? তুমি তো এখন মৃত। তুমি এখন শুধুই লাশ। মৃত্যুর পর তওবার দরজা একেবারেই বন্ধ; ফলে তওবা করার কোনো সুযোগ তোমার এখন আর নেই। কিন্তু বেঁচে থাকা তোমার একই টেবিলের বন্ধুর রয়েছে। কারণ, সে বেঁচে আছে। তোমার পরকাল ধ্বংস সুনিশ্চিত। তবে কী তুমি অন্যদের দেখে শিক্ষা গ্রহণ করবে না?
তবে কেন দেরি করছ? তোমার প্রতিপালক জানান দিচ্ছেন, ‘বলো, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আয-যুমার,৩৯/৫৩)।
তবে তিনি শর্ত প্রদান করেছেন পরের আয়াতে, ‘আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পন করো, তোমাদের নিকট শাস্তি আসার পূর্বে, তৎপর তোমাদের সাহায্য করা হবে না’ (আয-যুমার, ৩৯/৫৪)।
বন্ধু আমার! তওবার সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পূর্বেই আমাদের তওবা করা আবশ্যক। কারণ, তওবার জন্য নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হবার পরে আল্লাহ তাআলা আর তওবা কবুল করবেন না। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ বান্দার তওবা কবুল করেন যতক্ষণ না কণ্ঠনালীর নিকট দম আসে, কিন্তু কণ্ঠনালীর নিকট দম এসে গেলে তখন আর তওবা কবুল করা হয় না’।[9] আল্লাহ বলেন, ‘ঐ সব লোকের জন্য তওবা নেই, যারা পাপ করতে থাকে, এমনকি যখন মৃত্যু এসে যায় তখন বলতে থাকে, এখন তওবা করছি’ (আন-নিসা, ৪/১৮)। প্রখ্যাত ছাহাবী আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পশ্চিমদিক হতে সূর্যোদয়ের পূর্বে (কিয়ামতের পূর্বে) যে তওবা করে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন’।[10]
সুতরাং, আমরা কি জানি কখন মৃত্যুদূত আমাদের দুয়ারে এসে উপস্থিত হয়? এখন এমনও তো হতে পারে যে, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব না— এমনকি এই লেখাটিও পড়ে শেষ করার পূর্বেই তোমার ও আমার দেহ হতে প্রাণপাখি উড়ে যাবে। অতএব, এসো আমরা দ্রুত তওবা করি। তওবার পথ এখনো খোলা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন।[11]
পরিশেষে, তোমাকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিদায় নিই— বন্ধু আমার! পাপ করো না, কিন্তু পাপ হয়ে গেলে সত্বর তওবা করো। তাতে পরকালে তোমার সফলতা সুনিশ্চিত।
জাবির হোসেন
এম. এ. (অধ্যয়নরত), বাংলা বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, মুর্শিদাবাদ, ভারত।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৫০৭।
[2]. আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ, কে বড় লাভবান (নিবরাস প্রকাশনী, তৃতীয় সংস্করণ), পৃ. ২৬-২৭।
[3]. নববী, শারহে মুসলিম, ২/২৭৫৭, ১৭/৭৫; ফাতহুল বারী, ১৩/৪৭২।
[4]. মাসিক আত-তাহরীক (ডিসেম্বর-২০১৯), পৃ. ৫০।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩০৭।
[6]. আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান, তাওবা : কেন ও কিভাবে (Islamhouse.com), ‘হাদীছ-১৩’-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৭৩।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩০৯।
[9]. তিরমিযী, হা/৩৫৩৭, হাদীছ হাসান।
[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭০৩৬।
[11]. আব্দুল্লাহিল হাদী, একশত কাবীরা গুনাহ (মাকতাবাতুস সুন্নাহ), পৃ. ১৬।