প্রথমত: ‘তিনি তাদের জন্য হালাল করেন যাবতীয় পবিত্র বস্তু এবং হারাম করেন অপবিত্র বস্তু’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৫৭)। আর ধূমপান হলো একটি ক্ষতিকর, অপবিত্র ও দুর্গন্ধময় বস্তু।
দ্বিতীয়ত: ‘নিজের হাতে নিজেদের তোমরা ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৫)।
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপানের ফলে স্বাস্থ্যের যে ক্ষতিগুলো হয়, তা হলো :
১. ‘ফুসফুসের ক্যান্সার, হাঁপানি বা অ্যাজমার প্রকোপ বাড়ে, শিশুদের হাঁপানি হতে পারে, এমফাইসেমা, ফুসফুসের যেসব সংক্রামক রোগ হয় যেমন : টিবি, নিউমোনিয়া সেসবের ঝুঁকি বাড়ে, স্মোকার্সকফ, ফুসফুস স্থিতিস্থাপকতা হারায়, এমফাইসেমা হয়।
২. হার্টের করোনারি অসুখ, অ্যানজাইমা বা বুকে ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, বারবার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে, নাড়ীর ছন্দ নষ্ট করতে পারে। ধমনীতে রক্ত জমাট বেঁধে প্রদাহ হতে পারে (একে বলে বার্জারস ডিজিজ)।
৩. কম বয়সেই চামড়া কুঁচকে যায়, আঙ্গুলের নখের স্বাভাবিক রঙ নষ্ট হয়।
৪. ধূমপানের ফলে মুখ, ফুসফুস, অন্ননালী, শ্বাসনালী, মূত্রাশয়, কিডনী, পাকস্থলী, প্যানক্রিয়াস, কোলন, মলভান্ড, মেয়েদের জরায়ুমুখ (সারডিকস) ও যোনিদ্বার প্রভৃতির ক্যান্সার হতে পারে।
৫. আর্থাইটিস বা অস্তিসন্ধির প্রদাহ, হাড় ভাঙলে জোড়া লাগতে দেরি, মাংসপেশি ও হাড়ে আঘাতের ঝুঁকি বাড়ে, হাড় ভাঙার ঝুঁকি বাড়ে।
৬. বন্ধ্যাত্ব, যৌন উদ্দীপনা কমে যায় বা হারিয়ে যায়, বীর্য শুক্রাণুর নড়াচড়া বা ঘনত্ব কমে, গর্ভপাত, সময়ের আগে রজোনিবৃত্তি ঘটে। এছাড়াও স্ট্রোক, বিস্মরণ, প্রভৃতি সমস্যা সৃষ্টি হয়। ছানি, নাকডাকা, দাঁতের অসুখ, পাকস্থলী ও ডিওডেনামের আলসার বা ক্ষত, শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে’।[1]
আহমাদ থামল। আমি আহমাদকে বললাম, ‘কোনো রোগ দেখছি বাদ থাকছে না ধূমপানের ফলে’।
আহমাদ জোরে নিঃশ্বাস টেনে বলল, ‘মেডিকেল সায়েন্স তো তাই বলছে’।
আহমদ পুনরায় বলতে লাগলো, তৃতীয়ত: ‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না’ (আন-নিসা, ৪/২৯)।
ধূমপান হলো নীরব ঘাতক। এক ধরনের ধীর গতির বিষক্রিয়া। যার ফলে মানুষ নিজে নিজেকেই ধীরে ধীরে হত্যা করে। প্রতিটি কোম্পানির বিড়ি-সিগারেটের প্যাকেটে লেখা থাকে, ‘Cigarette smoking injurious to health. অথবা Smoking kills’.
‘এক মিনিট’! এই বলে আহমাদ বাপীদার কাছে একটি সিগারেটের প্যাকেট চাইল। তারপর প্যাকেটটি হাতে নিয়ে আমাদেরকে দেখাল। যেখানে লেখা আছে, ‘Warning’ বলে ‘Smoking kills’.
এবার আহমাদ হাতে থাকা মোবাইল থেকে ইংরেজি কুরআন ওপেন করে সূরা নিসার ২৯ নম্বর আয়াতটি দেখালো। যেখানে লেখা আছে, ‘And do not kill yourselves [or one another]’.
‘দেখ, ভালো করে দেখ। কুরআনে ও সিগারেটের প্যাকেটে একই শব্দ ব্যবহার হয়েছে ‘Kill’; মহান আল্লাহ নিজে ওয়ার্নিং দিচ্ছেন আমাদেরকে যে, তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। আর সিগারেটের প্যাকেট জানান দিচ্ছে যে, সিগারেট হত্যা করে। এখন কেউ যদি জেনে বুঝে তা পান করে, তা হবে আত্মহত্যা করার শামিল।
পরিসংখ্যান বলছে, তামাক সেবনের ফলে বিশ্বে ৮ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।[2] শুধুমাত্র আমেরিকায় সিগারেট বা ধূমপানের ফলে মারা যায় প্রতিবছর ৪৮ হাজার মানুষ।[3] বিশ্বে প্রতি ১০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয় ধূমপানের কারণে।[4] পরিসংখ্যান আরও বলছে, একটি সিগারেট ১১ মিনিট করে জীবন কমিয়ে দেয়। আমাদের দেশে প্রতি ঘণ্টায় তামাক সেবনের জেরে মৃত্যু হয় ১৩৭ জনের। আর বিশ্বে প্রতি ৬ সেকেন্ডে একজনের।[5] আমরা মনোযোগ দিয়ে আহমাদের কথা শুনছি। আমি আহমাদকে থামিয়ে আবার চায়ের অর্ডার দিলাম। তারপর আহমাদ বলতে শুরু করল, চতুর্থত: মদ্যপানের ক্ষতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলুন, এ দুইয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। তবে মানুষের জন্য উপকারও আছে। কিন্তু এগুলোর পাপ উপকারের চেয়ে অনেক বড়’ (আল-বাক্বার, ২/২১৯)।
আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন যে, মদে কিছু উপকার রয়েছে। তবে ক্ষতির ভাগ বেশি। অথচ ধূমপান পুরোটাই ক্ষতিকর। ধূমপানের কোম্পানিগুলো প্যাকেটে ধূমপানের উপকারিতা বিষয়ে কিছুই লিখে রাখেনি। উল্টো তারাও উল্লেখ করেছে যে, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
পঞ্চমত: ‘আর কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় যারা অপব্যয় করে, তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ’ (বানী ইসরাঈল, ১৭/২৬-২৭)। এ আয়াত প্রমাণ করছে যে, কোনো সম্পদ অকারণে বিনষ্ট করা বা অপচয় ও অপব্যয় করা যাবে না।
আমি বললাম, ‘কোনটা অপব্যয় বুঝব কীভাবে?’
‘গুড কোশ্চেইন’ আহমদ বলল।
অপব্যয় বা অপচয় হলো, যেখানে খরচ করার মধ্যে দ্বীনের কল্যাণ নেই এবং মানুষের কল্যাণ নেই, সেখানে খরচ করা হলো অপচয়। আর কুরআনের ভাষায় অপচয়কারী হলো শয়তানের ভাই।[6]
আর যখন জানা গেল যে, ধূমপানে কোনো উপকার নেই; বরং তাতে ক্ষতি রয়েছে, তখন এটা আসলে অপচয় ছাড়া কিছু নয়। ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম যে, একজন একশ টাকার একটি নোট নিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল। যখন কোনো ধূমপায়ী সিগারেটে আগুন ধরায়, সে আসলে নিজের টাকাকে পুড়িয়ে ফেলে। এটা অপচয়, যা ইসলামে হারাম। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে ‘বিশ্ব তামাক বিরোধী দিবস’-এর আগে মুম্বাই, আহমেদাবাদ, লখনৌ, হায়দারাবাদ ও কলকাতায় সমীক্ষা করে জানা গেছে যে, প্রতি সপ্তাহে ধূমপায়ীদের গড় খরচ ৩৪৮ টাকা।[7]
ষষ্ঠত: ‘তোমরা নিজেদের এবং অপরের ক্ষতি সাধন করো না’।[8]
আর ধূমপান শুধু ধূমপায়ীদের ক্ষতি করে না; বরং যারা ধূমপান করে না অর্থাৎ অধূমপায়ী, তাদেরও ক্ষতি করে। কারণ, ধূমপায়ীরা যে ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে দেয়, সেই ধোঁয়া কাছের লোকেরা প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে। ফলে অধূমপায়ী ব্যক্তির শরীরেও ওই ধোঁয়া প্রবেশ করে। একে বলে পরোক্ষ ধূমপান (Passive Smoking)। পরোক্ষ ধূমপায়ীদের দেহের ক্ষতি সক্রিয় ধূমপায়ীদের চেয়ে বেশি হয়। কারণ এই ধোঁয়া অপরিশোধিত। তাই, নিকোটিনের মাত্রা বেশি থাকে।[9]
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ মারা যায় পরোক্ষ ধূমপানের কারণে।[10]
আর ধূমপানে কষ্ট দেওয়া হয় পরিবারের সকলকে, প্রতিবেশীদের, সঙ্গী-সাথীদের, ইভেন মসজিদের মুছল্লীদেরকেও।
সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিংয়ের ফলে বাচ্চার অত্যন্ত সংবেদনশীল শ্বাসনালী আর ফুসফুস ‘ইরিটেটেড’ হয়ে পড়ে। শুরু হয় সর্দি-কাশি। এ রকম চলতে থাকলে বারবার শ্বাসনালী ও ফুসফুসের প্রদাহ হয়ে ক্রনিক সর্দি- কাশি, বঙ্কাইটিস, হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ে। যেসব শিশুর অ্যাজমা আছে, তামাকের ধোঁয়া তাদের বারবার অ্যাটাক করে। অনেক সময় ইনহেলার বা ওষুধে কোনো কাজ হয় না। নিউমোনিয়ায় কাহিল হয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। বাচ্চার ভোগান্তির শেষ থাকে না। হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করে রিলিফ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বরাবরের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শ্বাসযন্ত্র।[11]
ততক্ষণে চা চলে এসেছে। আহমাদ চায়ে চুমুক দিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করল, সপ্তমত: নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সম্পদ বিনষ্ট করা হারাম করেছেন’।[12]
আর ধূমপান সম্পদ ধ্বংসকারী, যা আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন না। ধূমপানের ফলে যেমন নিজের সম্পদ নষ্ট হয়, তেমনি সিগারেটের ছুড়ে ফেলে দেওয়া জ্বলন্ত টুকরো অথবা দিয়াশলাই কাঠি থেকে অনেক ক্ষতি হতে পারে। এরকমই একটি পরিসংখ্যান হলো :
যুক্তরাষ্ট্রে হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতিবছর প্রায় ১০০০ লোক পুড়ে মারা যায় আগুনে, যে আগুন ছড়ায় ধূমপায়ীদের হাত থেকে। বিশ্বাস করারও সঙ্গত কারণ আছে যে, সিগারেটের আগুন লেগে পুড়ে মৃত্যুর হার সব দেশে একই রকম। হয়তো বা কোথাও একটু বেশি বা কম হবে।
যত অগ্নিকাণ্ড হয়, তার ২৫ শতাংশের মূলেই ধূমপায়ীরা। এ পরিসংখ্যানও যুক্তরাষ্ট্রের। এভাবে ওই দেশে ১৯৭০ সালে ১০,৭২০টি বাড়িতে আগুন লেগেছিল। যার ফলে নষ্ট হয়েছিল সাড়ে ৯ কোটিরও বেশি ডলারের সম্পত্তি। ধূমপানের খেসারত হিসাবে তার আগের বছর দাবানলে নষ্ট হয়েছিল ১০ কোটি ডলার। এ ক্ষতি ফি বছর হচ্ছে।[13]
আহমাদ থামল। আমি বললাম, ‘যাক! বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা ক্লিয়ার হলো। এতো সুন্দরভাবে বলবি জানলে আগে রেকর্ডার অন করে রাখতাম। আমাকে বইটি দিস দলীলগুলো মুখস্থ করব’।
আহমাদ বলল, ‘ঠিক আছে। ঘরে চল, আমি তোর হোয়াটসঅ্যাপে পিডিএফ ফাইল সেইন্ড করে দিচ্ছি’।
সুরজ একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘আচ্ছা ভাই! ধূমপান হারাম বুঝতে পারলাম। ঠিকই আছে। আমার বিবেকও বলছে। তবে অনেক মৌলবীরা কেন ধূমপান করছে?’
আহমাদ বলল, ‘দেখ, এখানে একটি জিনিস বুঝতে হবে যে, মৌলবীরা কিন্তু ফেরেশতা নয়। তারাও মানুষ। আমাদের মতো রক্ত-মাংসের মানুষ। তাদেরও ভুল হতে পারে। তবে তারা ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে তেমন গুরুত্ব দিতে চায় না। যেমন : অনেক মেডিক্যাল ডাক্তার আছে, যারা ধূমপানের বিরোধিতা করে; এমনকি পেশেন্টদের ধূমপান করতে বারণ করে, অথচ তারা নিজেরা ধূমপান করে। কারণ, তারা ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং এই অভ্যাস তারা ত্যাগ করতে পারছে না বা ত্যাগ করার কোনো চেষ্টা করেন না’।
আমাদের আলোচনা চলছে...
পাশ থেকে সাহিল বলে উঠল, ‘তোদের হারাম-হালাল ছাড়া আর কোনো কাজ নেই? এটা হারাম, সেটা হারাম, ওই করেই তোরা শেষ হলি!
এই স্টুডেন্ট লাইফে, ইয়ং ব্লাডে একটু-আধটু এন্টারটেইনমেন্ট না করলে আর কখন করব?’
আমরা সবাই সাহিলের দিকে তাকালাম। এতক্ষণ তো ব্যাটা পেপারে মুখ গুঁজে ছিল, এর আবার হঠাৎ কী হলো? তবে, সাহিল খুব জোসের সাথে কথা বলছে।
আহমাদ বলল, ‘বাপু, একটু-আধটু কেন, পুরোপুরি স্ফুর্তি করো, কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু তোমার জন্য কেন অন্য কেউ ভুক্তভোগী হবে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং-এর রিপোর্টগুলো একবার দেখ। আর নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে, ধীরে ধীরে আত্মহত্যা করাকে আর যাই হোক এন্টারটেইনমেন্ট বলা অন্তত যুক্তিসঙ্গত নয়। এতো লেখাপড়া শিখে এইটুকু উপলব্ধি করার মতো বুদ্ধি হলো না বাপু’।
‘আচ্ছা তোরা কেন ধূমপান করিস?’ আহমদ বলল।
‘আমাদেরকে স্মার্ট লাগে। আমাদের টেনশন দূরীভূত হয়। আমাদের একঘেয়েমি কাটাতে সাহায্য করে’।
‘নেশা করে আবার স্মার্টনেসের পরিচয়, হাউ ফানি!’ আহমাদ বলল।
সাহিল বলল, ‘ধূমপান করলে আবার নেশা হয় নাকি? কই ধূমপান করে তো কেউ আবোলতাবোল বকে না?’
‘ধূমপান অর্থাৎ বিড়ি, সিগারেট, জর্দা প্রভৃতি অল্প পরিমাণে পান করা হয়। ফলে নেশার সৃষ্টি হয় না। কিন্তু যদি একসঙ্গে একশ সিগারেট বা এক কেজি জর্দা কাউকে খাইয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তার অবস্থা কী হবে ভাবতে পারিস।
আর জেনে রাখ, যারা নিয়মিত মদ খায়, তাদের কারও এক গ্লাস বা দুই গ্লাস মদ খেলে কোনো নেশা হবে না। কারণ তারা আসক্ত হয়ে পড়েছে। তাহলে কি বলবি যে, মদ খেলেও তো নেশা হয় না!’ আহমাদের জবাব।
সাহিল চুপ মেরে গেল। আহমাদ বলতে শুরু করল, ‘আফটার অল ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, মেডিকেল সায়েন্স একাধিক রোগের তালিকা দিচ্ছে ধূমপানের জন্য’।
‘ধূমপানের ফলে যে রোগগুলো হয়, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে অনেকে তো ধূমপান করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কই তাদের তো মৃত্যু হচ্ছে না?’ সাহিল বলল।
আহমাদ বলল, ‘প্রশ্নটা কেমন শিশুসুলভ হয়ে গেল না? এটা নিশ্চয় জানিস যে, ধূমপান হলো নীরব ঘাতক। ধূমপান ধীরে ধীরে বিষক্রিয়া ঘটায়। ধূমপান করলেই সঙ্গে সঙ্গে বা কয়েক দিনের মধ্যেই ধূমপায়ী মারা যায় না। তার কারণ হলো মরে যাওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ নিকোটিন কেউ একেবার গ্রহণ করে না। ধূমপানে থাকে নিকোটিন। বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে ৭ হাজার ক্ষতিকর রাসায়নিক। যার মধ্যে ১০০টি অত্যন্ত ক্ষতিকর। ৭০টি কার্সিনোজেনিক, অর্থাৎ ক্যান্সার ডেকে আনতে সিদ্ধহস্ত।[14]
ধূমপান করলেই মানুষ দুম করে মারা যায় না। তাই আমরা ভাবি কত জনই-বা মরল? কিন্তু, এই ধারণা ভুল। যারা ধূমপায়ী, তারা প্রত্যেকেই ধূমপানের কুফল ভোগ করে। আর ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এটি বৈজ্ঞানিক সত্য। এখন কেউ যদি তা অস্বীকার করে, তাহলে তো আর মিথ্যা হয়ে যায় না।
পরিসংখ্যান বলছে, ‘যেসব দেশে ধূমপান মৌরসীপাট্টা বিছিয়েছে, সেখানে ৬৫ বছর বয়সের নিচের পুরুষদের ফুসফুসের ক্যান্সারে মৃত্যুর ৯০ শতাংশের জন্য সে দায়ী; ৭৫ শতাংশ দায়ী ব্রনকাইটিসে মৃত্যুর জন্য, ২৫ শতাংশ দায়ী হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর জন্য। ব্রিটেনে হিসাব করে দেখা গেছে, ধূমপানের প্রত্যক্ষ বলি ৬৫ বছর বয়সের নিচে ২৫ হাজার লোক প্রতিবছরে মারা যান। ধূমপান না করলে ক্যান্সারের মোট মৃত্যুর হার ¼ অংশ কমে যেত।
ধূমপানই যে মৃত্যুর জন্য দায়ী, এর সব থেকে বড় প্রমাণ হলো, ধূমপান বন্ধ করলে ওই সব অসুখে মৃত্যুর হার কমে যায়।[15]
আর একটা কী যেন বললি, ধূমপান স্মার্টনেসের পরিচায়ক, তাই না? যদি তাই হয়, তাহলে তুই তো চাইবি যে, তোর ছেলে-মেয়েও যেন স্মার্ট হয়। তাহলে কী তাদেরকে ছোট থেকে সিগারেট খাওয়ার ট্রেনিং দিবি? কতজন পিতা-মাতা এমন রয়েছেন, যারা নিজ বাচ্চাকে এই শিক্ষা দেয়? যেমন : সততা, বিনয় ও নম্রতাসহ আরও অসংখ্য আদেশ-নিষেধের শিক্ষা দেয়।
আর টেনশন দূরীভূত হয়, একথারও কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। উল্টো গবেষণা অন্য কথা বলে, ‘ধূমপায়ীদের মতে, ধূমপানের ফলে মানসিক প্রশান্তি, ক্ষিপ্রতা ও তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। তবে, গবেষণায় দেখা গেছে, অধূমপায়ীর তুলনায় একজন ধূমপায়ী বেশি মানসিক চাপে ভুগে থাকেন। একদম নতুন ধূমপায়ীর ক্ষেত্রে প্রথমে বমি বমি ভাব, মাথা ঝিমঝিম, রক্তচাপ ও হার্টবিট বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়াও ধূমপায়ীরা অপেক্ষাকৃত বেশি মানসিক চাপে ভোগে। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীর মানসিক চাপ আস্তে আস্তে বাড়ে এবং ধূমপান পরিত্যাগ করার পর তা ক্রমশ হ্রাস পায়।[16]
ধূমপান টেনশন তো মুক্ত করে না; বরং ধূমপায়ীর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে বাড়ির সকলের টেনশন বৃদ্ধি করে’।
সাহিল আর কিছু না বলে পত্রিকাটি বেঞ্চে রেখে বাপীদাকে চায়ের বিল মিটিয়ে চলে গেল।
সুরজ আহমাদকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি জানতাম না যে, ধূমপান হারাম। ভাবতাম মাকরূহ, খেলে কোনো পাপ হবে না। কিন্তু, আজকে আমার সেই ভুল ধারণা ভেঙে গেল। আমি এখন ধূমপান ছাড়তে চাই; আমাকে কী করতে হবে পরামর্শ দে?’
আহমাদ বলল, ‘এখন আমাকে উঠতে হবে, ধূমপান ছাড়ার অনেক কৌশল গুগলে সার্চ দিলে পেয়ে যাবি। তবে, আমি যেটা মনে করি, সেটি হলো, মহান আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে এই বলে দু‘আ করা, ‘হে আমার রব! আমি এতদিন জানতাম ধূমপান মাকরূহ। কিন্তু আজকে যখন আমি জানতে পারলাম, ধূমপান হারাম, তখন আমি এই কাজ পরিত্যাগ করতে চাই। তুমি যখন আমাকে হারাম জানার তাওফীক্ব দিয়েছ, তখন তুমিই আমাকে সাহায্য করো। আমি আজ থেকে এই জিনিস আর কোনো দিন পান করতে চাই না। তুমি বড় দয়াময়, তুমি বড় ক্ষমাশীল, তুমি শ্রেষ্ঠ কৌশলকারী; তোমার কৌশলে আমাকে এই অন্ধকার জগৎ থেকে উদ্ধার করো’।
সুরজ কাফিলের দিকে চেয়ে বলল, ‘তুই তো স্মোকিং করিস না!’
কাফিল বলল, ‘আমি স্মোকিং করি না, কিন্তু আমি স্মোকিং-কে মাকরূহ মনে করতাম। তবে, আজকে আমারও ভুলের সংশোধন হলো’।
আহমাদ আমাদের দিকে চেয়ে বলল, ‘মনে আছে, ইসলামে যখন মদ হারাম ঘোষণা হলো, তখন ছহাবীগণ কী করেছিলেন?’
আমি বললাম, ‘আছে।’
সুরজ ও কাফিল বলল, ‘কী ঘটনা?’
আহমাদ বলল, ‘মদ যখন হারাম করা হলো, তখন ছাহাবীগণ মদের বড় বড় পাত্র ভেঙে দিলেন এবং কোনো কোনো পাত্র থেকে ঢেলে ফেলে দিলেন। আর তার ফলে মদীনার গলিতে মদ প্রবাহিত হলো।[17] অতঃপর সেই অভ্যাসগত নেশার জিনিস আর কেউ ভক্ষণ করলেন না।[18] কারণ, ছাহাবীগণ ছিলেন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একান্ত অনুগত অনুসারী। তারা তাঁর আদেশ-নিষেধ নিঃসংকোচে মান্য করতেন। ‘ক্বলু সামি‘না ওয়া আত্ব‘না’ অর্থাৎ ‘আমরা শুনলাম ও অনুসরণ করলাম’। এই ছিল ছাহাবীগণের আদর্শ’।
সুরজ তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে এক বান্ডিল বিড়ির প্যাকেট বের করল, অতঃপর হাত দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে বলল, ‘ক্বলূ সামি‘না ওয়া আত্ব‘না’।
এম. এ. (অধ্যয়নরত), বাংলা বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, মুর্শিদাবাদ, ভারত।
[1]. ডা. অমিয় কুমার হাটি, ধূমপান, পৃ. ৪৬।
[2]. https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/tobacco.
[3]. https://www.cdc.gov/tobacco/data_statistics/fact_sheets/health_effects/effects_cig_smoking/index.htm
[4]. https://eisamay.indiatimes.com/lifestyle/health-fitness/tobacco-killing-137-people-per-day-in-india/articleshow/58913652.cms.
[5]. https://eisamay.indiatimes.com/lifestyle/health-fitness/tobacco-killing-137-people-per-day-in-india/articleshow/58913652.cms.
[6]. ইসলামকে জানতে হলে, পৃ. ৩০৭
[7]. https://www.anandabazar.com/lifestyle/kolkatan-are-far-ahead-of-smoking-cigarettes-survey-dgtl-1.808517.
[8]. মুসনাদে আহমদ, হা/২৮৬৭।
[9]. চক্রবর্তী-ভট্টাচার্য-ঘোষ, উচ্চমাধ্যমিক জীববিদ্যা (একাদশ শ্রেণি), (প্রকাশনী : রুবি পাবলিশার্স, কলকাতা, এপ্রিল-২০০৭), পৃ. ২০০।
[10]. https://www.who.int/gho/phe/secondhand_smoke/en/.
[11]. https://www.anandabazar.com/lifestyle/do-not-go-to-the-baby-within-four-hours-of-smoking-dgtl-1.807008.
[12]. বুখারী, ৯/৪৩; মুসলিম, হা/৫৯৩।
[13]. ডা. অমিয় কুমার হাটি, ধূমপান (প্রকাশক : অ্যাসোসিয়েশন অফ কনসার্নড টিচারস [ACT]), পৃ. ৮।
[14]. https://www.anandabazar.com/lifestyle/do-not-go-to-the-baby-within-four-hours-of-smoking-dgtl-1.807008.
[15]. ডা. অমিয় কুমার হাটি, ধূমপান (প্রকাশক : অ্যাসোসিয়েশন অফ কনসার্নড টিচারস [ACT]), পৃ. ২০।
[16]. www.wikipedia.com/ স্বাস্থ্যের উপর তামাকের প্রভাব।
[17]. বুখারী, হা/৪৬১৭, ৪৬২০।
[18]. আব্দুল হামীদ মাদানী, হাদীস ও সুন্নাহর মূল্যমান (প্রকাশনী : তাওহীদ প্রকাশনী [বর্ধমান]), পৃ. ৪০।