কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

তোমরা রেখো গো স্মরণ, একদিন হবে যে মরণ

post title will place here

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

[চ]

বন্ধু আমার! যখন দেহ থেকে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবে, তখন দুনিয়ার সমস্ত ব্যস্ততা, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিমেষেই শেষ হয়ে যাবে। যে দুনিয়ার জন্য আখেরাত সম্পর্কে উদাসীন থেকেছি, সেই দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক এক পলকেই শেষ। কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারব না। কারোর কোনো খবরও জানতে পারব না। আমার বাড়ি, গাড়ি, জমি, জায়গা সবই ব্যবহৃত হবে। আমার মৃত্যুতে দুনিয়া এক সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়াবে না।

—কিন্তু আমি?

—আমি তো এখন শুধু লাশ। কেউ আর আমার নাম ধরে ডাকে না। 

আমাকে গোসল দিয়ে কাফন পরিয়ে কবরে রেখে আসতে পারলেই, তাদের ঘাড় থেকে বোঝা নেমে যায়। তারা ভার মুক্ত হয়। আমাকে কবর দিয়ে তারা চলে যায়— যে যার কাজে। দু-একদিন মনে রাখে আমাকে।

—তারপর। 

তারপর একে একে সবাই ভুলে যায় আমাকে। এটাই বাস্তবতা। এটাই নিয়ম।

কবরের জীবনে আমি সম্পূর্ণ একা। কাছে নেই পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়স্বজন। নেই কোনো বন্ধুবান্ধব, নেই কোনো সান্ত্বনাদাতা, নেই কোনো পরামর্শদাতা। আমি এ কোন জগতে এলাম। কোন জীবনে এলাম। আলো-বাতাসশূন্য মাটির ঘর, মাটির বিছানা। এ তো সেই জীবন, যে জীবনকে আমি উপেক্ষা করেছি। যে জীবন নিয়ে বছরে ৫২ দিন আলোচনা শুনেছি। জালসা-জৌলুসে, মোবাইলে কত বক্তব্য শুনেছি— তার হিসাব নেই। ওলামায়ে কেরামের কবর বিষয়ক বক্তব্যগুলোকে কী কোনোদিন থোড়ায় কেয়ার করেছি?

এখন এজীবনের বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছি আমি। কিন্তু হায়! এখান থেকে বের হওয়ার আর কোনো উপায় আমার নেই। হায়! এখান থেকে পালাবার কোনো সুযোগ নেই আমার। এখন আমার কাছে দুই জন ফেরেশতা আসবেন এবং আমাকে উঠিয়ে বসাবেন। তারপর তাঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘তোমার রব কে?’ আমি যদি মুমিন হই, তার উত্তরে বলব, ‘আমার রব আল্লাহ’। অতঃপর জিজ্ঞেস করবেন, ‘তোমার দ্বীন কী?’ তখন আমি বলব, ‘আমার দ্বীন হলো ইসলাম’। এরপর তাঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘তোমাদের মাঝে যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন তিনি কে?’ আমি বলব, ‘তিনি হলেন আল্লাহর রাসূল’। পুনরায় তাঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘তুমি কী করে জানতে পারলে?’ তখন বলব, ‘আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি, তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করেছি’। 

তখন আসমানের দিক থেকে শব্দ আসবে, ‘আমার বান্দা সত্য বলেছে। সুতরাং তার জন্য জান্নাতের একটি বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাঁকে জান্নাতের একটি লেবাস পরিয়ে দাও। এছাড়া তাঁর জান্নাতের দিকে একটি দরজা খুলে দাও’। তখন আমার প্রতি জান্নাতের সুখ-শান্তি ও জান্নাতের খোশবু আসতে থাকবে এবং আমার কবর দৃষ্টিসীমা বরাবর প্রশস্ত করে দেওয়া হবে।

অতঃপর আমার নিকট এক সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট সুবেশী ও সুগন্ধিযুক্ত ব্যক্তি আসবে এবং আমাকে বলবে, ‘তোমাকে সন্তুষ্ট করবে এমন জিনিসের সুসংবাদ গ্রহণ করো। এই দিবসেরই তোমাকে ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল’। আমি বলব, ‘তুমি কে? তোমার চেহারা তো দেখবার মতো চেহারা! তা যেন কল্যাণের বার্তা বহন করে’। তখন সে বলবে, ‘আমি তোমার নেক আমল, যা তুমি দুনিয়াতে করতে’। আমি বলব, ‘হে আল্লাহ! তাড়াতাড়ি ক্বিয়ামত ক্বায়েম করো। যাতে আমি আমার পরিবার ও সম্পদের দিকে ফিরে যেতে পারি’।

অপরপক্ষে আমি যদি অবিশ্বাসী হই, যখন আমার রূহ দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তখন আমার নিকট দুই জন ফেরেশতা আসবেন এবং আমাকে উঠিয়ে বসাবেন। অতঃপর তাঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘তোমার রব কে?’ আমি বলব, ‘হায়! হায়! আমি তো জানি না’। অতঃপর জিজ্ঞেস করবেন, ‘তোমার দ্বীন কী?’ আমি বলব, ‘হায়! হায়! আমি তো জানি না’। তারপর জিজ্ঞেস করবেন, ‘তোমাদের মধ্যে যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনি কে?’ আমি বলব, ‘হায়! হায়! আমি তাও তো জানি না’।

এ সময় আকাশের দিক হতে এক ঘোষণাকারী ঘোষণা করবেন, ‘সে মিথ্যা বলেছে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং জাহান্নামের দিকে একটি দরজা খুলে দাও’।

আমার দিকে জাহান্নামের উত্তাপ ও লু হাওয়া আসতে থাকবে এবং আমার কবর এত সঙ্কুচিত হবে, যাতে আমার এক দিকের পাঁজরের হাড় অপরদিকে ঢুকে যায়। এ সময় আমার নিকট একটা অতি কুৎসিত চেহারাবিশিষ্ট নোংরাবেশী দুর্গন্ধযুক্ত লোক আসবে এবং বলবে, ‘তোমাকে দুঃখিত করবে এমন জিনিসের দুঃসংবাদ গ্রহণ করো। এই দিবস সম্পর্কেই (দুনিয়াতে) তোমাকে ওয়াদা দেওয়া হতো’। আমি জিজ্ঞেস করব, ‘তুমি কে? কী কুৎসিত তোমার চেহারা, যা মন্দ সংবাদ বহন করে’। সে বলবে, ‘আমি তোমার সেই বদ আমল যা তুমি দুনিয়াতে করতে’। আমি বলব, ‘আল্লাহ ক্বিয়ামত ক্বায়েম করো না’।[1]

আমার জন্য একজন অন্ধ ও বধির ফেরেশতাকে নিযুক্ত করা হবে। যাঁর সাথে থাকবে একটি লোহার হাতুড়ি। যদি এই হাতুড়ি দ্বারা কোনো পাহাড়কে আঘাত করা হয়, তাহলে সেই পাহাড়ও ধুলোয় পরিণত হয়ে যাবে। সেই ফেরেশতা এই হাতুড়ি দ্বারা আমাকে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করবে। আঘাতের চোটে এত বিকট চিৎকার করব, যে মানুষ ও জিন ব্যতীত পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সবকিছুই শুনতে পাবে। এভাবেই শাস্তি চলবে।[2]

[ছ]

হায়রে কবরের জীবন! এই জীবনে আমাদেরকে পদার্পণ করতে হবে জেনেও আমরা উদাসীন। অথচ আমাদের পূর্বসূরিরা এই কবরকে দেখে কতই না ভয় করতেন। কতই না ক্রন্দন করতেন। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি কবরের চেয়ে কঠিনতম স্থান আর কোথাও দেখিনি’।[3]

তাইতো রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি ছালাতের শেষ বৈঠকে কবরের আযাব থেকে পানাহ চাইতেন। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু‘আ করতেন,اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ عَذَابِ النَّارِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার সমীপে পানাহ চাচ্ছি কবরের শাস্তি হতে, জাহান্নামের শাস্তি হতে, জীবন ও মরণের ফেতনা হতে এবং মাসীহ দাজ্জাল-এর ফেতনা হতে’।[4]

উছমান রাযিয়াল্লাহু আনহু কোনো কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এত কাঁদতেন যে, তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা করা হলে তো আপনি এভাবে কাঁদেন না, অথচ এই কবর দর্শনে এত বেশি কাঁদেন কেন? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আখেরাতের মনযিলসমূহের (প্রাসাদ) মধ্যে কবর হলো প্রথম মনযিল। এখান হতে কেউ মুক্তি পেয়ে গেলে তবে তার জন্য পরবর্তী মনযিলগুলোতে মুক্তি পাওয়া খুব সহজ হয়ে যাবে। আর সে এখান হতে মুক্তি না পেলে তবে তার জন্য পরবর্তী মনযিলগুলো আরো বেশি কঠিন হবে’।[5]

বন্ধু আমার! সময় থাকতে সতর্ক হতে হবে। আল্লাহ বলেন, ﴿اقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ مُعْرِضُونَ﴾ ‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, অথচ ওরা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে’ (আল-আম্বিয়া, ২১/১)

এই জীবন একবারই, এই সময়টুকু কাজে লাগাতে হবে সৃষ্টিকর্তার ইবাদতে। মৃত্যুর পর আর কোনো ইবাদত করতে পারব না। সে সুযোগও নেই। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মৃত ব্যক্তির সাথে তিনটি জিনিস যায়। দু’টি জিনিস ফিরে আসে আর একটি জিনিস তার সাথে থেকে যায়। তার সাথে যায় তার পরিবারের সদস্য, সম্পদ ও তার আমল। তার পরিবারের সদস্য ও তার সম্পদ ফিরে আসে। আর আমল তার সাথে থেকে যায়’।[6]

যদি বেপরোয়া জীবনযাপন করে মৃত্যুবরণ করি, তাহলে পরকালে অসৎকর্মশীলদের ভয়াবহ শাস্তি দেখে আতঙ্কিত হয়ে পুনরায় দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তনের জন্য আবেদন করতে থাকব। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘এমনকি যখন তাদের কারো কাছে মৃত্যু এসে হাযির হয়, তখন সে বলে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আবার (দুনিয়াতে) পাঠিয়ে দাও। যাতে আমি সৎ কাজ করতে পারি, যা আমি করিনি। কক্ষনো না, এটা তো তার একটা কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে পর্দা থাকবে পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত’ (আল-মুমিনূন, ২৩/৯৯-১০০)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সেদিন সম্পর্কে আপনি মানুষকে সতর্ক করুন যেদিন তাদের শাস্তি আসবে, যখন সীমালঙ্ঘনকারীরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে কিছু কালের জন্য অবকাশ দাও, আমরা তোমার আহ্বানে সাড়া দিব এবং রসূলদের অনুসরণ করব। (তখন তাদেরকে বলা হবে,) তোমরা কি পূর্বে শপথ করে বলতে না যে, তোমাদের কোনো পতন নেই?’ (ইবরাহীম, ১৪/৪৪)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে যে রূযী দিয়েছি, তোমরা তা হতে ব্যয় করো, তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে (অন্যথা মৃত্যু আসলে সে বলবে,) ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরো কিছু কালের জন্য অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি ছাদাক্বা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম’ (আল-মুনাফিকূন, ৬৩/১০)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সেখানে তারা আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে (এখান হতে) বের করো, আমরা সৎকাজ করব, পূর্বে যা করতাম তা করব না। আল্লাহ বলবেন, আমি কি তোমাদেরকে এত আয়ু দান করিনি যে, তখন কেউ উপদেশ গ্রহণ করতে চাইলে উপদেশ গ্রহণ করতে পারত? তোমাদের নিকট তো সতর্ককারীও এসেছিল। সুতরাং শাস্তি আস্বাদন করো, সীমালঙ্ঘনকারীদের কোনো সাহায্যকারী নেই’ (ফাত্বির, ৩৫/৩৭)

কিন্তু বন্ধু, একবার শ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে দুনিয়াতে পুনরায় প্রত্যাবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং মরণকে স্মরণ করে বুদ্ধিমানের পরিচয় প্রদানেই আছে সফলতা।

এম. এ. (বাংলা), কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, মুর্শিদাবাদ, ভারত।


[1]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৫৩৪, সনদ ছহীহ।

[2]. আবূ দাঊদ, হা/৪৭৫৩, হাদীছ ছহীহ।

[3]. তিরমিযী, হা/২৩০৮, হাসান।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৭৭।

[5]. তিরমিযী, হা/২৩০৮, হাসান।

[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৬০।

Magazine