কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আলোর সন্ধানে!

আমরা দুনিয়ার মোহে অন্ধ। এই মোহ শেষ না হতেই যদি মৃত্যু এসে ডাক দেয়, আদৌও কি পরকালের জন্য কিছু করলাম? এই চিন্তায় যখন মন অস্থির হয়ে যাবে। মালাকুল মউত এসে জান ক্ববয করা শুরু করবেন। যন্ত্রণায় দেহ ছটফট করবে। প্রিয়জনদের অশ্রুজল বুকের উপর পড়তে থাকবে, তারপর যখন রূহ কণ্ঠনালিতে পৌঁছে যাবে, আশেপাশে সব অন্ধকারে ছেয়ে যাবে, তখনই মনে হতে থাকবে এই বুঝি এই মিথ্যা জগতের শেষ সময়।

আদৌ কি কোনো কাজে আসবে তখন অর্থ, বিত্ত, দাম্ভিকতা, অহংকার?

স্বল্প জীবনের দুনিয়ার মোহ তখনই হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় বিপদ। আল্লাহর হুকুম ভুলে ইয়াহূদীদের সাজানো জীবন পরিচালনাই হয়ে উঠবে তখন সবচেয়ে বড় বিপদ। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ইয়াহূদীদের সাজানো জীবনপদ্ধতি কেমন? তাহলে আসুন! সে সম্পর্কেই জানি আজ।

আমাদের দৈনন্দিন চলাফেরা, আশেপাশের স্কুল-কলেজ, ব্যাংক, অফিসগুলো পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে যে হারাম পন্থা অবলম্বনে পরিচালিত সবই যেন ইয়াহূদীদেরই সাজানো একেকটি পদ্ধতি। বর্তমান সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনেও এর প্রভাব ব্যাপক। মূলত ইয়াহূদীরা আমাদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব সম্বল এমনভাবে আলাদা করে নিচ্ছে, যেন কেবল তারাই সত্য। সবদিক থেকে আমাদের অধিকার, ঈমান, স্বাস্থ্য সব নিয়েই যেন টানাটানি করছে অনেকটা চালাকির সাথে।

তারপর এই অধিক মূল্যবান সম্পদগুলো বুদ্ধিমত্তার সাথে ছিনিয়ে নিয়ে তারা আমাদের দিল তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়া। এখন আমাদের ভাষ্যমতে, আমাদের সময় কাটানোর জন্য রিলস আছে, রাত ২-৩টার আগে ঘুমই আসে না, শুধু ফেসবুক স্ক্রল করতে ভালো লাগে, আমাদের সবকিছুর স্বাধীনতা আছে, সকালে ১০-১২টায় ঘুম থেকে উঠব। খেয়েদেয়ে আড্ডাবাজি করে চলে যাবে দিন। না হয় একটু কলেজ গেলাম, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলাম, ক্লাস ১-২টা করলে করলাম, না করলে নাই। কারণ আমাদের সবকিছুর স্বাধীনতা আছে।

এই স্বাধীনতার জন্যই কি তাহলে আমাদের রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাথরের আঘাতের শিকার হয়েছিলেন?

স্টোরিতে এখন যুবকেরা ইসলামী ভিডিও দেয়, ব্যাকগ্রাউন্ডে গান দিয়ে। স্কুলে শিক্ষক অভিভাবককে বলে, আপনার মেয়ে তো ভালো নাচতে জানে, মাশা-আল্লাহ! এখন এই তথাকথিত শিক্ষিত শিক্ষককে কে বুঝাবে মাশা-আল্লাহ নয়; আস্তাগফিরুল্লাহ পড়তে হবে ওখানে।

যখন আপনি মানুষকে দেখবেন, ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক দিয়ে ইসলামী ভিডিও দিচ্ছে, তখন বুঝতে পারবেন, এটা তারই অংশ। স্কুল-কলেজগুলোতে ছেলে-মেয়েদের বন্ধুত্ব একদম স্বাভাবিক বলেই বিবেচনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আপনি সূদ পছন্দ না করলেও ব্যাংকিং সিস্টেম এমনভাবে করা হয়েছে যে, আপনি ব্যাংক থেকে দূরে থাকতে না পারলে কোনো না কোনোভাবে সূদের জালে আটকে যাচ্ছেন।

মা-বাবা তাদের মেয়েদের অনেক সময় বলে থাকেন, আরে দুলাভাই-ই তো একটু মশকরা করছে, আরে তোমার তালতো ভাই এসেছে, কথা বলে যাও। এগুলা মা-বাবাই বলে, অথচ এটা কত বড় ফেতনা তা তারা বুঝে না। মা-বাবাও চায় তাদের মেয়ে ফেতনা থেকে দূরে থাকুক, কিন্তু ফেতনাকে তারা এমনভাবে আমাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয় বলে মাথায় ঢুকিয়ে দিল যে, তারা বুঝতেই পারে না পরিবারের সদস্যরা কী করছে।

তারপর রইল গায়রত। গায়রত শব্দটাই যেন ভারী অলংকারে ভরপুর একটি শব্দের মতো। গায়রত মুমিনদের অলংকার।

গায়রত কী? গায়রত হলো নিজের পরিবারের মেয়েদের সর্বোচ্চ সম্মানের চোখে দেখা এবং মেয়েরাও নিজেদের সম্মানিত ব্যক্তিত্ব মনে করে বেগানা পুরুষদের নযর থেকে নিজেদের রক্ষা করা। বর্তমানে আধুনিক স্বামীদের দেখা যায়, বিয়ের পর স্ত্রীর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় না দিলে যেন বিয়ের পূর্ণতাই পায় না (আস্তাগফিরুল্লাহ)।

মানুষ কতটা আত্মমর্যাদাহীন হলে নিজের স্ত্রীর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় সবার দেখার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়! গায়রত সম্পর্কে আরও ভালো করে বুঝার জন্য দুটি ঘটনা বলি।

ঘটনা-১:

একদিন মক্কার এক মুশরিক তার উট যবেহ করছিল। তাকে উটটি যবেহ করার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে সে উত্তর দিল, ‘এই উটটির উপর আমার পরিবারের মহিলারা বসত; বিক্রি করে দিলে এই উটে অন্য পুরুষ বসবে, তা আমার সহ্য হবে না’। একজন মুশরিকের আত্মমর্যাদা এমন হলে, আপনি একজন মুসলিম হয়েও কীসের নেশায় আজ পথভ্রষ্ট? প্রশ্নটা নিজেকেই করুন।

ঘটনা-২:

একদিন এক ব্যক্তি আবূ তালেবকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?’ প্রশ্ন শুনে আবূ তালেব বললেন, ‘যদি তোমার রক্ত হালাল হতো, তাহলে তরবারি দিয়ে আমি তোমার মাথা কেটে ফেলতাম’। এটাই গায়রত।

গায়রতহীনতা আপনাকে দাইয়্যূছ করে তুলবে আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দাইয়্যূছ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।

ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং তাদের প্রতি আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তাকিয়েও দেখবেন না; পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারিণী মহিলা এবং দাইয়্যূছ পুরুষ (যে তার স্ত্রী, কন্যা ও বোনের নোংরামিতে চুপ থাকে এবং বাধা দেয় না)’।[1]

অর্থাৎ যে পুরুষ তার স্ত্রী, বোন ও মেয়েকে অশালীনভাবে চলাচল থেকে বাধা দেয় না।

আর বর্তমান সমাজের পুরুষেরা বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টা নিজেরাই তাদের স্ত্রীর ছবি ফেসবুকে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দেয়। নিজের মায়ের ছবি, কন্যার ছবি নিজেরাই সোশ্যাল মিডিয়ায় সবার সামনে প্রকাশ করে দেয়। এটাই বর্তমান শিক্ষার কুফল।

এক সময় মানুষ দীর্ঘ সময় পড়ার মধ্যে মন দিতে পারত; কিন্তু ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রামের স্বল্প সময়ের রিলসগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, আপনি ওগুলো দেখতে দেখতে তার মধ্যেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা হারিয়ে যাবেন। কোনো জায়গায় দীর্ঘক্ষণ সময় দিতে আপনার মন চাইবে না। আপনি ১০ মিনিটের একটা শিক্ষামূলক ভিডিও পুরো দেখতে চাইলেও ৩ বার স্ক্রল করার কথা ভাববেন।

আন্তর্জাতিক খেলার গভীরে কী পরিমাণ মদ, জুয়া, বেহায়াপনা আছে, সেটা জেনেও রাত ৩-৪টা পর্যন্ত জেগে থাকতে আপনাকে বাধ্য করে। এই খেলার জন্য মুসলিমরা খুব ভোরে নিমেষেই উঠে যায়, কিন্তু ফজরের ছালাতের জন্য তারা উঠতে পারে না!

বন্ধু/বান্ধবীর জন্মদিনে না গেলে তারা মন খারাপ করবে, সেটা আমাদের মাথায় ঢুকানো হয়েছে। ওভাবেই মস্তিষ্কটা ধুয়ে দিল; অথচ জন্মদিনে গেলে যে আল্লাহর বিরোধিতা হবে, সে খেয়ালটা আমাদের মাথায় নেই।

এই দাজ্জালের অনুসারীরা আমাদের মন খারাপের ঔষধ দিয়েছে ফ্রি মিক্সিং অর্থাৎ বিয়ে কঠিন, যেনা সহজ; অথচ একদম যাবজ্জীবন একসাথে থাকার জন্য ইসলাম বিয়েকে সহজ করে দিয়েছে।

তারপর তারা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিল, নারী-পুরুষ বন্ধু হতেই পারে, বন্ধুর সাথে দেখা করতেই পারে, ক্যাফেতে বসতেই পারে। কিন্তু ইসলামে এগুলো স্পষ্ট হারাম বলে বিবেচিত, এটা আমাদের মাথায় থেকেও যেন নাই। এগুলোতে যোগ দিতে না পারলেই এখন মন খারাপ হয়। আপনার কোনো বান্ধবী ফেসবুকে ছবি দিচ্ছে, আপনি দিতে পারছেন না, তাই আপনার খারাপ লাগছে।

ছেলে-মেয়ে একসাথে অনুষ্ঠানে আড্ডা দিচ্ছে, আপনি পারছেন না, কোনো না কোনো কারণে এগুলোর জন্য যদি আপনি মনে কষ্ট পান, তাহলে বুঝবেন, এখনো আপনি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আছেন।

যখন সেই বিষয়গুলোকে অগ্রহণযোগ্য বিষয় হিসেবে নিতে পারবেন, তখনই পুরোপুরি মুক্ত হয়ে এই চক্রান্ত থেকে বের হতে পারবেন।

যাদের খুশি করার জন্য আজ আপনি দুনিয়ার মোহে অন্ধ হয়ে আছেন, পরকালে কি আদৌ তারা আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে?
পরকালে নিজের মা-বাবাও সন্তানদের দেখে পালাতে থাকবে। জন্মদাতা, জন্মদাত্রী মা-বাবাকে দেখে সন্তানরা পালাতে থাকবে। সেদিন কি আদৌ এই তথাকথিত আধুনিক সমাজব্যবস্থার কর্ণধাররা, যারা আপনার চিন্তাভাবনা নিয়ে খেলছে, তারা আপনার কাজে আসবে? নাকি যাদের দেখানোর জন্য, যাদেরকে খুশি করার জন্য এই বিধর্মীদের মতো সমাজব্যবস্থায় নিজেকে মগ্ন রেখেছেন, তারা আপনার পাশে সাহায্যের জন্য ছুটে আসবে?

মনে রাখবেন! আমার প্রিয় ভাইয়েরা, আল্লাহর কসম! ঐদিন শুধু কাজে আসবে ঈমান। উপকারে আসবে নেক আমল, সুন্দর ব্যবহার এবং একটি আদর্শ জীবন। যে আদর্শ জীবনে থাকবে ছোট ছোট কিছু আমল, যা আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে বিপুল আকারে বেড়ে যাবে। তখন শুধু কাজে আসবে উত্তম ব্যবহার। তখন কাজে আসবে মুয়াজ্জিনের ‘হাইয়া আলাছ ছালাহ’ ডাকটা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া। তখন কাজে আসবে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়ে দেখে চোখ নিচে নামিয়ে চলা। তখন কাজে আসবে গায়রত রক্ষা। তখন কাজে আসবে ছোট ছোট কিছু উপদেশ, যা মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। তখন কাজে আসবে মানুষের জন্য কিছু কাজ, যা মানুষের জীবনে কিছু সুন্দর মুহূর্ত তৈরি করে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন এবং সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!

মো. কায়সার আলম

ইসলামপুর, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।


[1]. নাসাঈ, হা/২৫৬২।

Magazine