দুনিয়ার জীবনটা চাকচিক্য আর শয়তানের ধোঁকবাজিতে পূর্ণ। আমরা যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করি, তাদের অধিকাংশের জীবনটা চলছে নিম্নোক্ত ধারায় :
১. শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের একটা অংশ শিক্ষা অর্জন।
তা-ও আবার দুনিয়াবী জ্ঞান অর্জন, চাকরি পাওয়া অথবা ব্যবসাবাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে। ২. চাকরি খোঁজা ও পাওয়া অথবা কোনো ব্যবসায় জড়িত হওয়া। ৩. বিয়ে-শাদী করা। ৪. সংসার পরিচালনা করা, সন্তানসন্ততি লালনপালন, তাদের শিক্ষা দান সেই একই, যাতে তারা চাকরি পায় অথবা ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারে। ৫. সন্তানাদির বিয়ে-শাদী দেওয়া। ৬. কর্মজীবন থেকে অবসর। ৭. মৃত্যুর অপেক্ষা অতঃপর জীবনাবসান।
উপরিউক্ত ধারায় জীবন চালাতে গিয়ে মুসলিম হওয়ার দাবিদারগণ ধর্ম পালন বলতে যা করেন, তা হলো:
১. ছালাত পড়া (অধিকাংশই ধর্মীয় অনুশাসন পালনের মতো মনোনিবেশ ও একাগ্রতাবিহীন, যার দরুন ছালাত হয় শুধু শারীরিক ব্যায়াম। আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ বলতে যা বোঝায় তা হয় না মোটেও।) ২. ছিয়াম রাখা (যেভাবে ছিয়াম আদায় করলে সত্যিকার আল্লাহভীতি অর্জন হয়, সেভাবে নয়।) ৩. যাকাত দেওয়া— যথেষ্ট অবহেলা সহকারে। ৪. হজ্জ পালন— অনেকেরই সামর্থ্য ও সুযোগ হয় না। ৫. ঈদুল আযহায় কুরবানী দেওয়া। ৬. নিকটাত্মীয় কেউ মারা গেলে মীলাদ পড়ানো, কুলখানি করা। ৭. মৌলভী মারফত বিয়ে পড়ানো ইত্যাদি।
এই পৃথিবীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় মহাগ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হওয়া আর প্রিয় নবী মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সর্বশেষ রাসূল ও নেতা হিসেবে পাঠানোর উদ্দেশ্য কি শুধু উপরিউক্ত কয়েকটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের মুসলিম বলে ধরে নেওয়ার জন্য? কক্ষনই নয়।
আল্লাহ তাআলা যে উদ্দেশ্যে আমাদের দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন আমরা সে উদ্দেশ্যের অনেক দূর দিয়ে চলছি, জীবন পরিচালনা করছি। আর এতে যা হচ্ছে তা হলো, আমাদের দুনিয়ার জীবনে প্রতিনিয়ত অশান্তির মধ্যে কাটছে। সুখ বা শান্তি যা ভোগ করছি বলে মনে হয়, তা একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। আর পরকাল পুরোপুরি অন্ধকার।
যদি এমনটিই হয়, তাহলে যেভাবে যে ধারায় আমরা জীবন চালাচ্ছি তা কি সম্পূর্ণ অর্থহীন নয়? তাই আমাদের এখনই ভাবতে হবে। যে অবস্থায়, বয়সের যে স্তরেই থাকি না কেন বাকী জীবনটা আল্লাহর নির্দেশিত উপায়ে পরিচালনা করে অতীতের ভুলভ্রান্তির জন্য শুদ্ধ নিয়্যতে তওবা করলে মুক্তির আশা এখনও করা যেতে পারে। কারণ আল্লাহ রহমানুর রহীম, তিনি গফূরুর রহীম। কিন্তু পরকালে কোনো উপায়ই থাকবে না। শত কান্নাকাটি বা মিনতি করেও কঠোর শাস্তির হাত থেকে বাঁচা যাবে না।
আমরা যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করি, তারা সবাই পবিত্র কুরআনকে আমাদের ধর্মগ্রন্থ এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করি। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَمَا كَانَ هَذَا الْقُرْآنُ أَنْ يُفْتَرَى مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ الْكِتَابِ لَا رَيْبَ فِيهِ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ ‘আর এই কুরআন কল্পনাপ্রসূত নয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে। এটা তো সেই কিতাবের সত্যতা প্রমাণকারী, যা এর পূর্বে (নাযিল) হয়েছে এবং আবশ্যকীয় বিধানসমূহের বিশদ বর্ণনাকারী, (এবং) এতে কোনো সন্দেহ নেই (এটা) বিশ্বের রবের পক্ষ হতে (নাযিল) হয়েছে’ (ইউনুস, ১০/৩৭)।
সন্দেহের ঊর্ধ্বে অবস্থিত পবিত্র কুরআনে দুনিয়া ও আখেরাত সম্বন্ধে কুরআনে এসেছে,وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ ‘এই পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছুই নয়। পারলৌকিক জীবনই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৬৪)।
স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ‘হায়’ বলে যাদের ব্যাপারে আফসোস প্রকাশ করেছেন— দুনিয়া ও পরকালের আসল রূপটা অনুধাবন করতে পারল না বলে। ভেবে দেখুন, আমরা সেই দুর্ভাগাদের দলেই পড়ে গেছি কিনা! দুনিয়ার জীবন যদি আমাদের কাছে নিছক খেলা ও মন ভুলানোর বিষয় না হয়ে থাকে, সম্পত্তি ও প্রতিপত্তি অর্জনের নিরন্তর স্বপ্ন দেখা ও সেজন্য অবিরাম চেষ্টা চালানোর ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে তো আমরা চরম দুর্ভাগা।
এবার আপনি আপনার জীবনের গোটা কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করুন। দেখুন, আপনি দুনিয়ার জীবন পরিচালনা করছেন দুনিয়া পাবার জন্য নাকি আখেরাত পাবার জন্য? জবাব আপনি খুঁজে পাবেন সহজেই। যদি অনুধাবন করেন দুনিয়ার জন্যই সব ব্যস্ততা আপনার, তাহলে শুধরে নিন নিজেকে। কারণ আমরা মূলত দুনিয়ার চাকচিক্যের কাছে নিজেদেরকে লুটিয়ে দিয়েছি।
চোখ দুটো বন্ধ হলেই কিন্তু অন্য জগৎ— পরকাল। চিরতরে চোখ বন্ধ হবে যেদিন, পরকালে প্রবেশ সেই দিনেই। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ নেই আর। সুযোগ নেই ঐ জগতে আপনার সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য নিজের কোনো সম্পদ বা স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পরিজনকে, যাদের জন্য জীবনটা উৎসর্গ করেছেন।
অতএব, দুনিয়ার জীবন শুধু দুনিয়া পাবার জন্য নয়। আসুন, দুনিয়ার জীবন কাজে লাগাই পরকাল পাবার জন্য। আর মহান আল্লাহ তাআলা যাদের দুর্ভাগা বোঝাতে চেয়েছেন সূরা আল-আনকাবূতের ৬৪ আয়াতে, সেই দুর্ভাগাদের তালিকা থেকে নিজেদের নামটা কাটাবার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মোশতাক আহমাদ
বনানী, ঢাকা।