عَنْ سُفْيَانَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ الثَّقَفِيِّ رضي الله عنه قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قُلْ لِي فِي الْإِسْلَامِ قَوْلًا لَا أَسْأَلُ عَنْهُ أَحَدًا غَيْرَكَ قَالَ قُلْ آمَنْتُ بِاللَّهِ ثُمَّ اسْتَقِمْ.
সরল অনুবাদ : সুফিয়ান ইবনু আব্দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বললেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ইসলামের এমন আমল সম্পর্কে বলুন যা সম্পর্কে আপনি ছাড়া আর কাউকেও জিজ্ঞেস করব না। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘বলো, আমি আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম। অতঃপর এর উপর অটল থাকো’।[1]
ব্যাখ্যা : হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর আনুগত্য করো, তাঁর সম্পর্কে সর্বদা জাগ্রত থাকো এবং তাঁর অবাধ্য হয়ো না। জেনে রেখো! নিশ্চয় তোমরা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করবে। তিনি তোমাদের সৎকর্মের প্রতিদান দেবেন এবং অবাধ্যতার শাস্তি প্রদান করবেন। সুতরাং পরকালে পাথেয় সংগ্রহের অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাও। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ يَعْلَمْهُ اللَّهُ وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى وَاتَّقُونِ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ﴾ ‘তোমরা যে ভালো কাজ কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত। আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করো। কেননা সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে তাক্বওয়া। হে জ্ঞানীগণ! তোমরা আমাকে ভয় করো’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৭)।
ইস্তিক্বামাত হচ্ছে একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। দুনিয়া ও পরকালীন জীবনের সকল কল্যাণ এর অন্তর্ভুক্ত। এটি হলো সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আমল। সর্বোচ্চ মর্যাদা ও অফুরন্ত পরকালীন প্রতিদান নিশ্চিত হয়। ঈমানের পূর্ণতা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে যায়। পুনরুত্থান দিবস নিরাপত্তা অর্জিত হয়। কল্যাণ ও বরকত ব্যাপকতা লাভ করে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবন সৌভাগ্যময় হয়ে উঠে। আল্লাহর পথে প্রত্যাবর্তন প্রত্যাশীদের যে সমস্ত গুণাবলি থাকা প্রয়োজন তার মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠতম। এর দ্বারা একজন মানুষ কারামত তথা অলৌকিকত্ব অর্জন করে, মর্যাদার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে যায়, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে একনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়। মোদ্দাকথা, আল্লাহর নৈকট্য লাভের সকল পথ এর অন্তর্ভুক্ত।
ইস্তিক্বামাত হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য ও হারাম বর্জনের মাধ্যমে দ্বীনে ইসলামের অনুসরণ করা, জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে ছিরাতে মুস্তাক্বীমকে আঁকড়ে ধরা, আল্লাহ আদিষ্ট সকল বিষয়কে তাঁর সামনে পালন করা, কথায় ও কাজে সত্যকে চরমভাবে আঁকড়ে ধরা এবং অঙ্গীকার ও চুক্তি বাস্তবায়ন করা। ইসলাম হলো স্রেফ এক আল্লাহকে বিশ্বাস করা আর ইস্তিক্বামাত হলো কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন ব্যতীত নিম্নোল্লিখিত আয়াতের সীমার মধ্যে থেকে আল্লাহর পদ্ধতি ও শরীআত অনুযায়ী জীবনযাপন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ - أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾ ‘নিশ্চয় যারা বলে আল্লাহ আমাদের প্রতিপালক অতঃপর এর উপর অটল থাকে; তাদের ভীত ও চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারাই জান্নাতের অধিবাসী, তারা যে আমল করত তার প্রতিদানস্বরূপ তারা সেখানে স্থায়ী থাকবে’ (আল-আহক্বাফ, ৪৬/১৩-১৪)।
আবূ বকর রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ইস্তিক্বামাতের উপরে তারাই অটল আছে যারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে না এবং অন্য কোনো স্রষ্টার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না। অতঃপর ‘আল্লাহ তাদের রব’ এ কথার উপর অটল থাকে।[2] হাসান বাছরী রহিমাহুল্লাহ বলেন, তারা আল্লাহর নির্দেশের উপর অবিচল ছিল তথা তারা আল্লাহর আনুগত্য করেছে এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে বিরত থেকেছে।[3] উমার রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ইস্তিক্বামাত হচ্ছে, তুমি আল্লাহর আদেশ-নিষেধের উপর নিজেকে অবিচল রাখো আর শিয়ালের মতো বিশ্বাসঘাতকতা করো না।[4] এর দ্বারা তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, যারা মুস্তাক্বীম তারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইস্তিক্বামাত তথা অবিচলতাকে শক্তভাবে ধারণ করে এবং সময় ও অসময়ে কথায় ও কাজের পরিবর্তন ঘটায় না। এজন্যই শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ইস্তিক্বামাত অবলম্বন করাই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ কারামাত।[5]
ইসলামে পূর্ণতা অর্জনের যে দুইটি মূলনীতি আছে তার আলোকে জীবনযাপন করাই হলো ইস্তিক্বামাত। একটি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা আর অপরটি হচ্ছে এর উপর অবিচল থাকা। সুতরাং ঈমান হলো সত্যকে জানা, সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। আল্লাহর রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। প্রজ্ঞাময় প্রতিপালক ও পরিচালনাকারী উপাস্য হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করা। আদেশ ও নিষেধ তথা সর্বাবস্থায় একমাত্র ক্ষমতাধর সত্তা হিসেবে তাঁকে বিশ্বাস করা। এমন বিশ্বাস স্থাপন করা যে, তাঁর ভীতি ও পর্যবেক্ষণের শাসন হৃদয়ে ধারণ করা। তাঁর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকে অন্তরে লালন করা। তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করা। তাঁর উপর পূর্ণমাত্রায় ভরসা রাখা। তাঁকে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির উৎস মনে করা। তাঁর নিকট প্রত্যাবর্তনের জন্য উৎসুক হয়ে থাকা। প্রার্থনার একমাত্র উৎস হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করা। ইচ্ছা বা সংকল্পকে তাঁর জন্য একনিষ্ঠ করা। শিরককে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা এবং আল্লাহ ব্যতীত কারো প্রভুত্ব স্বীকার না করা। আর ইস্তিক্বামাত হলো সীমালঙ্ঘন ও সংকোচন ব্যতীত উক্ত বিশ্বাসের উপর অটল থাকাই। যখন কোনো বান্দা এটি করতে সক্ষম হবে, তখন তার আচার-আচরণে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। মনে প্রশান্তি, হৃদয় সজীবতা এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জিত হবে।
আবূ বকর রযিয়াল্লাহু আনহু-কে ইস্তিক্বামাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহর সাথে শিরক না করলেই ইস্তিক্বামাতের উপর অটল থাকা যায়।[6] তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, ইস্তিক্বামাত হলো- শুধু আল্লাহ তাআলাকে এক মনে করা এবং তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। কিছু সালাফ বলেছেন, আল্লাহর আদেশের আলোকে জীবনযাপন করাই হচ্ছে ইস্তিক্বামাত, যদি তা না হয় তবে এখানে শয়তানের দুটি পথ রয়েছে। একটি হলো সীমালঙ্ঘন অপরটি হলো সংকোচন। কিন্তু আল্লাহর পথে প্রকৃত অটল ব্যক্তি শরীআতের বিষয়ে বাড়াবাড়ি বা সংকোচন নিয়ে অহেতুক ভাবে না।
এর মাধ্যমে একজন মুসলিম ঈমানের স্বাদ, হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার সজীবতা ও অন্তরের প্রশস্ততা অর্জন করে। আল্লাহ বলেন,﴿أَفَمَنْ شَرَحَ اللَّهُ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ فَهُوَ عَلَى نُورٍ مِنْ رَبِّهِ فَوَيْلٌ لِلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُمْ مِنْ ذِكْرِ اللَّهِ أُولَئِكَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ﴾ ‘তোমরা কি লক্ষ করনি? আল্লাহ তাআলা যার হৃদয়কে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন সে তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে প্রাপ্ত আলোকবর্তিকার ওপর থাকে। তবে ওদের জন্য ধ্বংস যাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে থাকায় কঠোর হয়ে গেছে। এরাই হচ্ছে প্রকৃত পথভ্রষ্ট’ (আয-যুমার, ৩৯/২২)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿أَوَمَنْ كَانَ مَيْتًا فَأَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهُ نُورًا يَمْشِي بِهِ فِي النَّاسِ كَمَنْ مَثَلُهُ فِي الظُّلُمَاتِ لَيْسَ بِخَارِجٍ مِنْهَا كَذَلِكَ زُيِّنَ لِلْكَافِرِينَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾ ‘যে মৃত ছিল অতঃপর আমি তাকে জীবিত করলাম এবং তার জন্য আলোর ব্যবস্থা করলাম যা দিয়ে সে মানুষের মধ্যে পথ চলে। সে কি ওই ব্যক্তির মতো হতে পারে, যে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে এবং সেখান থেকে বের হতে পারে না। এমনইভাবে কাফেরদেরকে তাদের কৃতকর্ম সুশোভিত করে দেওয়া হয়’ (আল-আনআম, ৬/১২২)।
সৎকর্ম সম্পাদন, আল্লাহর নিকট প্রত্যাবর্তন, পরকালের জন্য পাথেয় সংগ্রহের চাইতে বড় আর কি ইস্তিক্বামাত হইতে পারে! আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের পর যদি উল্লেখিত আমল সম্পাদিত হয় তা কতই না চমৎকার! এটি হচ্ছে একনিষ্ঠ মুমিনের প্রকৃত অবস্থা। সে পূর্বে প্রেরিত আমলের মোহে প্রতারিত হয় না, সে আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া ব্যতীত অন্য কিছুর আশ্রায় গ্রহণ করে না। কারণ, সে জানে অবাধ্যতা ও দায়িত্বে অবহেলার বিচারে তার আমল খুবই নগণ্য। আল্লাহর নেয়ামত, তাঁর অনুগ্রহ, তাঁর ইহসান, তাঁর দোষত্রুটি গোপন ও তাঁর সাহায্যের তুলনায় তার আমল যতই হোক না কেন তা খুবই তুচ্ছ। তার সকল আমল আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও দয়ার ক্ষুদ্রাংশের সমতুল্য নয়। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মুত্তাক্বীদের নিকট থেকে তাদের আমল গ্রহণ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿إِنَّ الَّذِينَ هُمْ مِنْ خَشْيَةِ رَبِّهِمْ مُشْفِقُونَ - وَالَّذِينَ هُمْ بِآيَاتِ رَبِّهِمْ يُؤْمِنُونَ - وَالَّذِينَ هُمْ بِرَبِّهِمْ لَا يُشْرِكُونَ - وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُونَ - أُولَئِكَ يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَهُمْ لَهَا سَابِقُونَ﴾ ‘যারা তাদের প্রতিপালকের ভয়ে প্রকম্পিত থাকে, যারা তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলিকে বিশ্বাস করে, যারা তাদের প্রতিপালকের সাথে শিরক করে না, যারা তাদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তা থেকে ব্যয় করে; আল্লাহর ভয়ে তাদের হৃদয় ভীত থাকে, তারা তাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরে যায়; এরাই কল্যাণের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয় এবং তারাই অগ্রগামী হয়’ (আল-মুমিনূন, ২৩/৫৭-৬১)।
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কাউকেও তার আমল মুক্তি দেবে না। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার আমল কি আপনাকে মুক্তি দেবে না? আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার আমলও আমাকে মুক্তি দেবে না। তবে আল্লাহ যদি তাঁর অনুগ্রহ ও দয়া দিয়ে আমাকে ঢেকে ফেলেন তবে সেটা ভিন্ন কথা। সুতরাং তোমরা ভালো কাজ করতে থাকো এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে প্রতিযোগিতা করো। সকাল, বিকাল ও রাতের কিছু অংশ ইবাদতে ব্যয় করো। আর মধ্যপন্থা অবলম্বন করো, সীমালঙ্ঘন করো না।[7] এই কারণে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে এই বলে এরশাদ করেছেন, তোমরা ইস্তিক্বামাত অবলম্বন করো আর তোমাদের আমল গণনা করো না। ইবাদতে সঠিক পন্থা অবলম্বনই হচ্ছে প্রকৃত ইস্তিক্বামাত আর তা হচ্ছে কথা, কাজ ও উদ্দেশ্যে সঠিকতা অবলম্বন করা।[8] এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ‘তোমরা আল্লাহর বিধানের উপর অটল থাকো এবং তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকো’ (আল-ফুছছিলাত, ৪১/৬)। এটি হচ্ছে মানবীয় দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতার ফলে সংঘটিত অপরাধের ক্ষতিপূরণের সর্বোত্তম ইলাহী দিকনির্দেশনা।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলকে এবং ছাহাবায়ে কেরামকে ইস্তিক্বামাতের আদেশ করেছেন অথচ তারা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এবং এই উম্মতের উত্তম জনগোষ্ঠি।
আল্লাহ তাআলা বলছেন,﴿فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ - وَلَا تَرْكَنُوا إِلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ أَوْلِيَاءَ ثُمَّ لَا تُنْصَرُونَ﴾ ‘যেভাবে আদেশ দেওয়া হয়েছে সেভাবে তোমরা দৃঢ়তা অবলম্বন করো এবং যারা তোমার সাথে তওবা করেছে তারও। আর তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর সে সম্পর্কে তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। আর ওদের দ্বারস্থ হয়ো না যারা অবিচার করেছে। (যদি তোমরা তাদের দ্বারস্থ হও) তবে আগুন অবশ্যই তোমাদের স্পর্শ করবে। আর আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোনো অভিভাবক থাকবে না এবং তোমারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না’ (হূদ, ১১/১১২-১১৩)। ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর সমগ্র কুরআনে যত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তার মধ্যে এই আয়াতের চাইতে কঠিন এবং প্রভাববিস্তারকারী কোনো আয়াত অবতীর্ণ হয়নি।[9] হাসান রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এই আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে ইবাদতে আত্মনিয়োগ করেন যে, তাঁকে আর কখনোই হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় দেখা যায়নি। যখন তাঁর শরীরে বার্ধক্যের ছাপ দ্রুত প্রতিফলিত হচ্ছিল তখন তিনি ছাহাবীদেরকে বলেছিলেন, সূরা হূদ ও তৎসমগোত্রীয় সূরা আমার চুলকে পাকিয়ে দিয়েছে। সূরা হূদে বর্ণিত আয়াত হলো, ‘তোমাকে যেভাবে আদেশ করা হয়েছে সেইভাবে তোমার রবের আদেশ পালন করা এবং তোমার সঙ্গে যারা রয়েছে তারাও। আর সীমালঙ্ঘন করো না নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমরা যা কর সেই সম্পর্কে প্রত্যক্ষ দৃষ্টি রাখেন’ (হূদ, ১১/১১২-১১৩)।[10]
আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর উপর চলমান জীবন্ত কুরআন ছিলেন। আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা-কে তাঁর ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তার চরিত্র হলো আল-কুরআন, তোমরা কি কুরআন তেলাওয়াত কর না? কেননা কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ﴿وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ﴾ ‘নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (আল-ক্বালাম, ৬৮/৪)।[11]
আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে আল্লাহর দ্বীনের উপর অটল রাখতে বেশি বেশি পড়েন, يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِى عَلَى دِينِكَ ‘হে আমার অন্তরের পরিবর্তনকারী! তুমি আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর অটল রাখো’।[12]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য একটা রেখা টানলেন অতঃপর বললেন, এটি হচ্ছে আল্লাহ রাস্তা। তারপর তার ডানে ও বামে আরও কতগুলো রেখা টানলেন অতঃপর বললেন, এগুলো বিভিন্ন রাস্তা। এই রাস্তাগুলোর প্রত্যেকটির মাথায় একজন করে শয়তান আছে, যে মানুষকে সেই পথে ডাকে। অতঃপর তিনি পাঠ করলেন, নিশ্চয়ই এটি হচ্ছে আমার সরল পথ। অতএব, তোমরা এই পথকে অনুসরণ করো। আর অন্যান্য পথের অনুসরণ করো না। তবে তোমরা আল্লাহ তাআলার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। এভাবে আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা আল্লাহকে ভয় করতে পার।[13]
আর এই সব পথ যার বর্ণনা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন তার প্রত্যেকটির মাথায় একজন করে শয়তান থাকে। সে মানুষ শয়তান হতে পারে অথবা জিন শয়তান। সে নিজের দিকে মানুষকে ডাকতে থাকে। সে যে পথে ডাকে সে পথের পথিক এই যামানায় কত মানুষ! আল্লাহ তাদের সংখ্যা বেশি না করুন! যারা বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের বিপরীতে মানুষকে ডাকতে থাকে। এই পথ থেকে দূরে থাকার উপকারিতাকে তারা খুবই আকর্ষণীয় করে প্রকাশ করে। তারা বক্র পথ অনুসরণের জন্য মানুষকে আহ্বান করে। পাপপূর্ণ পথের দিকে তারা মানুষকে আহ্বান করে। এরা সবাই জাহান্নামের দরজায় মানুষের আহ্বায়ক। যারা এদের ডাকে সাড়া দিবে তারা এদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। জেনে রাখুন! জাহান্নামকে প্রবৃত্তি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। যারা এদের ডাকে সাড়া দেয় তাদের ঈমান কতই দুর্বল!
আল্লাহর বিধানের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত কোনো মুসলিম তাদেরকে ভয় পায় না, তাদের দ্বারস্থ হয় না ও তাদের নিকট জবাবদিহিতার প্রয়োজন অনুভব করে না। বরং তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আদেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করে। জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে একমাত্র ফয়সালাকারী হিসেবে মনে করে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সুন্নাতকে শক্তভাবে ধারণ করে। সন্দেহপ্রবণতা, প্রবৃত্তি ও কামনার ছড়াছড়ির যুগে তারা কুরআন ও হাদীছকে শক্তভাবে ধারণ করে। মানুষ যখন অবক্ষয়ে নিমজ্জিত তখন তারা সংশোধনের পথ অবলম্বন করে। মানুষ যা ধ্বংস বা নষ্ট করে তারা তা ঠিক করে। মানুষ যখন প্রবৃত্তি, প্রতারণা ও অশ্লীলতার জালে আবদ্ধ তখন তারা আগুনের জ্বলন্ত কয়লা হাতে নিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে সম্মুখপানে এগিয়ে চলে। তখনই আল্লাহর বিধানের উপর অটল থাকার সুফল পাওয়া যায়। মর্যাদার বিচারে ইস্তিক্বামাতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।
আনাস ইবনু মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষের নিকট এমন একটা সময় আসবে যখন দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এতটাই কঠিন হবে, যেমন জ্বলন্ত আগুনের কয়লা হাতে ধারণ করা কষ্টকর হবে’।[14] ছাওবান রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সত্যের উপর বিজয়ী থাকবে, যারা তাদের অপমানিত করার চেষ্টা করবে তারা তাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। এমনকি এভাবে ক্বিয়ামতের সময় এসে যাবে, আর তারা সেই অবস্থাই থাকবে’।[15] তামীমদারী রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি ইসলামী দাওয়াহ অবশ্যই ওইভাবে পরিপূর্ণতা অর্জন করবে যেভাবে রাতের পর দিন আসে। আল্লাহ তাআলা মাটি এবং পশমের এমন কোনো বাসা অবশিষ্ট রাখবেন না কিন্তু তিনি সে বাসায় এই দ্বীনের প্রবেশ ঘটাবেন। সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান প্রদান করে অথবা অপমানিত ব্যক্তিকে অপমান করে। ইসলাম গ্রহণের কারণে সে সম্মানিত হবে অথবা ইসলাম বর্জনের কারণে অপমানিত হবে’।[16]
প্রবৃত্তির অনুসরণ, মনের দাসত্ব, স্বেচ্ছাচারিতার আধিপত্য এবং আনুগত্যের যুদ্ধে দ্বীনের উপর সাফল্য, বিজয়, পৌরুষত্ব ও দৃঢ়তা অর্জনকে ইস্তিক্বামাত বলে। কাজেই যারা দ্বীনের উপর অটল থাকবে পার্থিব জীবনে তাদের ওপর রহমতের ফেরেশতা অবশ্যই অবতীর্ণ হবে। তাদের অপমানিত বা ভীত হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। তারা জান্নাতপ্রাপ্তির শুভ সংবাদ লাভ করবে। দুনিয়া ও আখেরাতের বিবেচনায় তাদের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ - نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ - نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ﴾ ‘নিশ্চয়ই যারা বলে আল্লাহ আমাদের প্রতিপালক অতঃপর এর উপর অটল থাকে, তাদের ওপর রহমতের ফেরেশতামণ্ডলী অবতীর্ণ হয়ে বলে তোমরা ভয় পেয়ো না, চিন্তিত হয়ো না আর জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো যার অঙ্গীকার তোমাদের সাথে করা হয়েছিল। দুনিয়া ও আখেরাতে আমরা তোমাদের অভিভাবক। সেখানে তোমাদের মন যা চাইবে এবং তোমরা যা আবেদন করবে তাই পাবে। এটি হচ্ছে ক্ষমাশীল, দয়ালু আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে অবতরণকৃত জান্নাতী খাবার’ (ফুছছিলাত, ৪১/৩০-৩২)।
আমাদের উচিত আল্লাহর আদেশানুযায়ী ইসলামী শরীআতের উপর অটল থাকা, দৃঢ়তার পথ অবলম্বন করা ও সীমালঙ্ঘন না করা। সর্বদা ইস্তিক্বামাতের পথ অবলম্বন করা আর তাদের পথ অনুসরণ না করে যারা জানে না। অতঃপর আমরা যেন আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই ও তওবা করি। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু। আল্লাহ আমাদের সকলকে ইস্তিক্বামাতের পথ অবলম্বন করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল
প্রভাষক (আরবি), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, বরিশাল।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮; মিশকাত, হা/১৪।
[2]. মাদারিজুস সালিকীন, ২/১০৪; বাসাইরু যাবীত তামঈজ, ৪/৩১২।
[3]. মাদারিজুস সালিকীন, ২/১০৯।
[4]. মাদারিজুস সালিকীন, ২/১০৯।
[5]. মাদারিজুস সালিকীন, ২/১০৩।
[6]. মাদারিজুস সালিকীন, ২/১০৪।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৬৩।
[8]. ইবনু মাজাহ, হা/২৭৯; ত্বাবারানী, হা/৮১২৪।
[9]. তাফসীরে ত্বাবারী, ১৫/৪৯৯।
[10]. তিরমিযী, হা/৩২৯৭।
[11]. আহমাদ, হা/২৫৮১৩।
[12]. আহমাদ, হা/২৪৬০৪।
[13]. সূরা আল-আনআম, ৬/১৫৩; আহমাদ, হা/৪১৪২; দারেমী, হা/২০২; সুনানুল কুবরা, হা/১১১৭৪।
[14]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৯; তিরমিযী, হা/২২৬০।
[15]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৯২৩।
[16]. আহমাদ, হা/১৬৯৯৮।