কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক!

عَنْ أَبِى مَالِكٍ الأَشْعَرِىِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الطُّهُورُ شَطْرُ الإِيمَانِ.

সরল অনুবাদ : আবূ মালেক আল-আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক’।[1]

হাদীছটির অবস্থান : ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, এটি ইসলামের অন্যতম মহান মূলনীত। এটি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালাকে অন্তর্ভুক্ত করে।[2] ইবনু হাজার আল-হায়তামী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ইসলামের মূলনীতিগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ মূলনীতি। কারণ, এটি শুধু দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিকেই ধারণ করে না, বরং এটি দ্বীনের অর্ধেক।[3]

ব্যাখ্যা : আমাদের মহান জীবনবিধান ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পবিত্রতা, পরিছন্নতা, সুগন্ধি ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা। মানবরচিত এমন কোনো আইনকানুন নেই যেটি পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্য অবলম্বনের প্রতি এতটা গুরুত্ব আরোপ করেছে, যতটা ইসলাম করেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য অর্জনে ইসলাম মানুষকে সৌন্দর্য বর্ধন ও আকর্ষণীয় পন্থা অবলম্বনের প্রতি উৎসাহিত করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ ‘হে আদম সন্তান! তোমরা মসজিদে প্রবেশের সময় সৌন্দর্য অবলম্বন করো’ (আল-আরাফ, ৭/৩১)

পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার উপর মুসলিম ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলাম ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছে। ব্যক্তি ও সমাজের জন্য আদর্শবান ব্যক্তিত্বের অনুসন্ধানে পবিত্রতার অধ্যায়গুলোতে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। পবিত্রতাকে একজন আদর্শ মুমিনের বৈশিষ্ট্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে একজন মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মধ্যে আচরণগত পার্থক্য হচ্ছে এই যে, এটি কল্যাণ অর্জন অথবা শাস্তি লাভের দ্বীনী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لَا يُحَافِظُ عَلَى الْوُضُوءِ إِلَّا مُؤْمِنٌ ‘মুমিন ছাড়া ওযূর হেফাযত কেউই করে না’।[4]

ইবাদতের জন্য পরিষ্কার-পরিছন্নতা ও সৌন্দর্য অবলম্বন : ফিক্বহের কিতাবগুলোতে ওযূ, গোসল ও পবিত্রতা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণ অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা লাভের জন্য ওযূ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা পবিত্রতার প্রতি উৎসাহ প্রদানের জন্য যথেষ্ট। কেননা, এর আভিধানিক অর্থ ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্য।[5] প্রাকৃতিক ও জৈবিক অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা লাভের জন্য ব্যবহৃত শব্দ ইস্তিঞ্জা ও গোসল। উক্ত বিষয় সংক্রান্ত দলীলের আধিক্যতা প্রমাণ করে যে, শরীআত এর প্রতি কতটা গুরুত্ব প্রদান করেছে। উক্ত বিষয়ের প্রমাণ খোঁজার জন্য ফক্বীহদের ব্যাপক চেষ্টা এবং বড় বড় অধ্যায় রচনা করা প্রমাণ করে, তারা এ সম্পর্কে কতটা সচেতন ছিলেন। আধুনিক সভ্যতার যুগে পবিত্রতার পরিভাষা (ত্বহারাত, ওযূ, গোসল ও ইস্তিঞ্জা) হিসেবে ইসলাম যে শব্দ চয়ন করেছে, তা কতইনা চমত্কার! পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব প্রমাণে ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতই যথেষ্ট। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, طَهِّرُوا هَذِهِ الْأَجْسَادَ طَهَّرَكُمُ اللَّهُ، فَإِنَّهُ لَيْسَ مِنْ عَبْدٍ يَبِيتُ طَاهِرًا إِلَّا بَاتَ مَعَهُ فِي شِعَارِهِ مَلَكٌ، لَا يَنْقَلِبُ سَاعَةً مِنَ اللَّيْلِ إِلَّا قَالَ: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِعَبْدِكَ فَإِنَّهُ بَاتَ طَاهِرًا ‘তোমরা এই শরীর পবিত্র করো, তবে আল্লাহ তোমাদের পবিত্র করবেন। কেননা, এমন কোনো ব্যক্তি নাই যে, পবিত্র অবস্থায় রাত্রিযাপন করে, কিন্তু তার মাথার পাশে একজন ফেরেশতা অবস্থান করে। যে সর্বক্ষণ বলতে থাকে, ‘হে আল্লাহ! তোমার বান্দাকে ক্ষমা করো, কারণ সে পবিত্র অবস্থায় রাত্রিযাপন করেছে’।[6]

সফর অবস্থায় কীভাবে পবিত্রতা লাভ করতে হবে, পানি না পাওয়া গেলে করণীয় কী হবে, সে সম্পর্কে ইসলাম দিকনির্দেশনা দান করেছে। পানির হুকুম-আহকাম, ফরয গোসল, মোজার উপর মাসাহ ও তায়াম্মুম করা ইত্যাদি সম্পর্কে বিবরণ পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوا وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ مِنْهُ. مَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ حَرَجٍ وَلَكِنْ يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ‘(হে মুমিনগণ!) যদি তোমরা অপবিত্র হও, তবে সমস্ত শরীর পবিত্র করো আর যদি অসুস্থ হও, অথবা ভ্রমণে থাক, অথবা তোমাদের কেউ প্রস্রাব-পায়খানা সেরে আসে, অথবা স্ত্রী সহবাস করো, অতঃপর পানি না পাও, তবে ভূপৃষ্ঠের পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করো। অতঃপর তোমাদের মুখমণ্ডল এবং হস্তদয় মাসাহ করো। আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করতে চান না, বরং তিনি তোমাদের পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহকে পরিপূর্ণ করতে চান। যেন তোমরা তাঁর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো’ (আল-মায়িদাহ, ৫/৬)

মাসিক ও সন্তান প্রসাবোত্তর সময়ে মুসলিম নারী যে সমস্ত মাসআলা-মাসায়েলের সম্মুখীন হয়, তার স্পষ্ট বর্ণনা ইসলামে দেওয়া আছে। সে কীভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে, মাসিক ও ইস্তিহাযায় আক্রান্ত হলে কীভাবে পবিত্রতার সময় গণনা করবে তার ব্যাখ্যাও শরীয়তে বর্ণিত হয়েছে। ফাতিমা বিনতে হুবাইশ রাযিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিত রেওয়ায়েতে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ان فَاطِمَةَ بِنْتِ أَبِي حُبَيْشٍ كَانَتْ تُسْتَحَاضُ، فَقَالَ لَهَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا كَانَ دَمُ الْحَيْضَةِ فَإِنَّهُ أَسْوَدُ يُعْرَفُ، فَإِذَا كَانَ ذَلِكَ فَأَمْسِكِي عَنِ الصَّلَاةِ، فَإِذَا كَانَ الْآخَرُ فَتَوَضَّئِي وَصَلِّي فَإِنَّمَا هُوَ عِرْقٌ.

ফাতেমা বিনতে হুবাইশ রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর ইস্তিহাযা (মাসিকের নির্দিষ্ট সময়ের পরও রক্ত প্রবাহিত হওয়া) এর অসুখ ছিল। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘ঋতুস্রাবের রক্তের বর্ণ কালো হবে, যেটা দেখলে বোঝা যাবে। তখন তুমি ছালাত থেকে বিরত থাকবে। এ ব্যতীত অন্যান্য সময় তুমি ওযূ করে (ছালাত আদায় করবে)। কারণ তা শিরা থেকে নির্গত রক্ত’।[7]

পবিত্রতা কার্যকর থাকা বা নষ্ট হয়ে যাওয়া— এই নিয়মকানুন অনুসরণ এবং সর্তকতা অবলম্বন করা প্রত্যেকের জন্য অপরিহার্য। এটি প্রত্যেক ধর্ম ও মানুষের অত্যন্ত প্রসিদ্ধ বিষয়, যার সাথে ইসলামী ফিক্বহের মাসআলা-মাসায়েল জড়িত। এটি ব্যতীত ইসলামের অন্যান্য বিধানের সাথে কোনো জাতি বা ধর্মের সংশ্লিষ্টতা নেই।

ইউরোপের মানুষের পবিত্রতা সম্পর্কিত একটি ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে, যেটা অন্ধকারের যুগে অত্যন্ত আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাদের বাসভবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য কোনো শৌচাগার ছিল না। তারপর তাদের নিকট মুসলিমরা এসে উপস্থিত হলো। ঐ সময় মুসলিমদের বাড়িতে শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকায় তাদেরকে বাঁকা চোখে দেখা হতো। কিন্তু তাদের প্রতিবেশী অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বাসায় এই ব্যবস্থা ছিল না।[8]

মসজিদে প্রবেশের পূর্বে পবিত্রতা : মসজিদে প্রবেশকে ইসলামে খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয়েছে। কেননা এটি একজন মুসলিমের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ তাকে আল্লাহ এবং ফেরেশতামণ্ডলী প্রত্যক্ষ করে থাকে। আর মসজিদে প্রবেশের জন্য পবিত্রতা অর্জনের একটি নির্দিষ্ট মুহূর্ত রয়েছে। আর তা হচ্ছে অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের পর সৌন্দর্য অবলম্বনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। মসজিদের উদ্দেশ্যে সৌন্দর্য অবলম্বনের উপকারিতা বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ ‘হে আদম সন্তান! মসজিদে প্রবেশের সময় তোমাদের সৌন্দর্য অবলম্বন করো’(আল-আরাফ, ৭/৩১)। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছালাতের গ্রহণযোগ্যতাকে এই পবিত্রতার উপর নির্ভরশীল করে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لاَ تُقْبَلُ صَلاَةٌ بِغَيْرِ طُهُورٍ وَلاَ صَدَقَةٌ مِنْ غُلُولٍ ‘পবিত্রতা ছাড়া ছালাত এবং খেয়ানতের মাল দিয়ে ছাদাক্বা গ্রহণযোগ্য হবে না’।[9]

কুরআন তিলাওয়াতের পূর্বে পবিত্রতা : কুরআন তিলাওয়াতের সময় পবিত্রতা অবলম্বন করা, পবিত্রতা নষ্ট হতে পারে এমন সব বিষয় থেকে বিরত থাকা, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে উপযুক্ত সর্তকতা অবলম্বন করা, মেসওয়াক করা, পবিত্র স্থানে উপবেশন করা, কেবলামুখী হওয়া এবং আল্লাহ তাআলার কিতাব পাঠের জন্য উপযুক্ত আড়ম্বরের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কুরআন তিলাওয়াতের আদব। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيمٌ - فِي كِتَابٍ مَكْنُونٍ - لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ ‘নিশ্চয়ই এটি সম্মানিত কুরআন। সংরক্ষিত গ্রন্থে এটি লিপিবদ্ধ। পবিত্র ছাড়া কেউ একে স্পর্শ করবে না’ (আল-ওয়াক্বিআহ, ৫৬/৭৭-৭৯)। যদিও মাসিক ও নিফাসজনিত কারণে নির্দিষ্ট সময়ে ছালাত আদায়, কুরআনের ছহীফা স্পর্শ করা, বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করা ইত্যাদি বিষয় থেকে নারীদের বিরত থাকতে হয়; তবুও ঈদের ছালাতে তাদের উপস্থিতি পছন্দনীয়, যদিও ঐ সময়ে হায়েয অথবা নিফাসজনিত কারণে রক্তপ্রবাহ সমস্যায় তারা ভোগেন। উম্মে আত্বিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহা ঈদের ছালাতে নারীদের উপস্থিতি সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা বর্ণনা করে বলেন,أُمِرْنَا أَنْ نَخْرُجَ فَنُخْرِجَ الْحُيَّضَ وَالْعَوَاتِقَ... فَأَمَّا الْحُيَّضُ فَيَشْهَدْنَ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَدَعْوَتَهُمْ وَيَعْتَزِلْنَ مُصَلاَّهُمْ উম্মে আত্বিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, আমরা যেন ঋতুবতী ও যুবতী নারীদেরকে ঈদের ছালাতে নিয়ে যায়। ঋতুবতী নরীগণ মুসলিম জামাআত এবং তাদের দু‘আয় শরীক হবে, তবে ঈদগাহ থেকে দূরে থাকবে’।[10]

পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি ইসলামের গুরুত্বারোপের প্রমাণ হলো এই যে, পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি সম্পর্কে হাদীছগুলোতে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হয়েছে। ফিক্বহ শাস্ত্রের গবেষকগণ এর বিধিবিধান সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। এরমধ্যে স্বভাগত বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত হাদীছ এসেছে। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ قَصُّ الشَّارِبِ وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ وَالسِّوَاكُ وَالاِسْتِنْشَاقُ بِالْمَاءِ وَقَصُّ الأَظْفَارِ وَغَسْلُ الْبَرَاجِمِ وَنَتْفُ الإِبِطِ وَحَلْقُ الْعَانَةِ وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ. يَعْنِى الاِسْتِنْجَاءَ. قَالَ زَكَرِيَّا قَالَ مُصْعَبٌ وَنَسِيتُ الْعَاشِرَةَ إِلاَّ أَنْ تَكُونَ الْمَضْمَضَةَ ‘মানুষের প্রকৃতিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয় হচ্ছে ১০টি: গোঁফ কাটা, দাড়ি ছেড়ে দেওয়া, মেসওয়াক করা, পানি দিয়ে কুলি করা, নখ কাটা, অঙুলের গিরাগুলোকে ভালোভাবে ধৌত করা, বগলের নিচের লোম তোলা, নাভির নিচের লোম কামানো, শৌচকর্ম তথা ইস্তিঞ্জা করা’। যাকারিয়া বলেন, মুছআব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘আমি ১০ নম্বারটা ভুলে গেছি। তবে আমার মনে হয় সেটি হবে কুলি করা’।[11]

ব্যক্তিগত পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা : মানুষের উপর তাই দৃশ্যমান হওয়া উচিত, যা তার সৌন্দর্যের প্রমাণ বহন করে। আল্লাহর আদেশ অনুসরণে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থা এমনই ছিল। আল্লাহ বলেন, وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ ‘(হে রাসূল!) আপনি আপনার কাপড় পরিষ্কার করুন’ (আল-মুদ্দাছছি, ৭৪/৪)। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াতটির অর্থের এই নির্দেশনা তাঁর ছাহাবীদের শিখিয়েছেন। জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা বর্ণনা করেন,

عَنْ جَابِرٍ قَالَ أَتَانَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَائِرًا فِي مَنْزِلِنَا فَرَأَى رَجُلًا شَعِثًا فَقَالَ أَمَا كَانَ يَجِدُ هَذَا مَا يُسَكِّنُ بِهِ رَأْسَهُ وَرَأَى رَجُلًا عَلَيْهِ ثِيَابٌ وَسِخَةٌ فَقَالَ أَمَا كَانَ يَجِدُ هَذَا مَا يَغْسِلُ بِهِ ثِيَابَهُ.

জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাসায় দর্শনে আসলেন। এসে এলোমেলো চুলবিশিষ্ট এক ব্যক্তিকে দেখে বললেন, এই লোক কি এমন কিছু পায় না, যা দিয়ে সে তার চুল আঁচড়াবে? আর একজন লোককে ময়লাযুক্ত পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখে বললেন, এ ব্যক্তি কি এমন কিছু পায়নি, যা দিয়ে সে তার পোশাক ধৌত করতে পারে?[12]

সামাজিক পবিত্রতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে ইসলামে ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মসজিদে বা কোনো মজলিসে সাধারণ মানুষ যেন কষ্ট না পায়, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখার কথা বলা হয়েছে। জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ أَكَلَ مِنْ هَذِهِ الْبَقْلَةِ الثُّومِ - وَقَالَ مَرَّةً مَنْ أَكَلَ الْبَصَلَ وَالثُّومَ وَالْكُرَّاثَ - فَلاَ يَقْرَبَنَّ مَسْجِدَنَا فَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ تَتَأَذَّى مِمَّا يَتَأَذَّى مِنْهُ بَنُو آدَمَ ‘যে ব্যক্তি এই সবজি খায় অথাৎ রসুন; আরেকবার তিনি বলেন, যে ব্যক্তি পিয়াজ, রসুন ও রসুন জাতীয় সবজি খায়, সে যেন মসজিদে না আসে। কেননা ফেরেশতামণ্ডলী ঐ সব বিষয়ে কষ্ট পায়, যেসব বিষয়ে আদম সন্তান কষ্ট পায়’।[13]

পরিবেশ পবিত্র রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পানি, মাটি ও বাতাস পরিবেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এগুলো যেন দূষিত না হয়, সেদিকে ইসলাম সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রেখেছে। বাসা, বাড়ির আঙিনা ও বাসার আশপাশ পবিত্র রাখা ইসলামের সুমহান নীতিমালার অন্যতম। রাস্তাঘাট, গাছের ছায়া, মানুষের বসবাসের স্থান, নদী ও পুকুরের ঘাট ইত্যাদিকে পবিত্র রাখার নির্দেশ ইসলাম দিয়েছে। জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, أَنَّهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى أَنْ يُبَالَ فِي الْمَاءِ الرَّاكِدِ ‘আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদ্ধ পনিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন’।[14] আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,اتَّقُوا اللَّاعِنَيْنِ قَالُوا وَمَا اللَّاعِنَانِ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ الَّذِي يَتَخَلَّى فِي طَرِيقِ النَّاسِ أَوْ فِي ظِلِّهِمْ ‘অভিশাপের কারণ হয় এমন দুইটি কাজ থেকে বিরত থাকো’। ছাহাবীগণ রাযিয়াল্লাহু আনহুম জিজ্ঞেস করলেন, অভিশাপের কারণ হয় এমন বস্তুদ্বয় কী? আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি মানুষের রাস্তায় অথবা তাদের বসার ছায়ায় পায়খানা করলে (সে অভিশাপের কারণ হয়, অথাৎ মানুষ তাকে অভিশাপ করে)’।[15]

পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবলম্বনের জন্য ইসলাম মানুষকে পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যাতে মুসলিমরা মর্যাদাগত ও অবস্থানগত দিক থেকে সমাজের অন্যান্য জাতির নিকট নিজেদেরকে আদর্শ হিসেবে উপস্থান করতে পারে। আমরা যেন আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি, সেই তাওফীক্ব আল্লাহ আমাদের দান করুন- আমীন! ছুম্মা আমীন!

* প্রভাষক (আরবি), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, বরিশাল।


১. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৩; মিশকাত, হা/২৮১।

২. শারহে মুসলিম লিন নবাবী, ৩/৮৫।

৩. ফাতহুল মুবীন, পৃ. ১৬৯

[4]. ইবনু মাজাহ, হা/২৭৭; মিশকাত, হা/২৯২, হাদীছ ছহীহ।

[5]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, ২/১০৩৮।

[6]. ত্ববারানী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৫০৮৭

৭. ইরওয়াউল গালীল, ১/২২৩, হাদীছ ছহীহ।

[8]. Paige, John C; Laura Woulliere Harrison (১৯৮৭)। Out of the Vapors: A Social and Architectural History of Bathhouse Row, Hot Springs National Park.

[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৪

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৮১।

[11]. ইবনু মাজাহ, হা/২৪১, হাদীছ ছহীহ।

[12]. আহমাদ, হা/১৪৮৯৩।

[13]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৬৪।

[14]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯।

[15]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৮।

Magazine