عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ «لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ».
সরল অনুবাদ: আনাস ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে’।[1]
হাদীছটির অবস্থান: উপরিউক্ত হাদীছটি ঐ সকল মহান হাদীছের অন্যতম, যার উপর দ্বীনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। মানুষ যদি উপরিউক্ত হাদীছের আলোকে আমল করে, তাহলে তাদের মধ্যকার অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় ও দ্বন্দ্ব-কলহ দূর হয়ে যাবে। সমাজে নিরাপত্তা, কল্যাণ ও শান্তি বিরাজ করবে। এটা তখনই সম্ভব, যখন মানুষের হৃদয় সীমালঙ্ঘন, প্রতারণা ও হিংসা থেকে মুক্ত হবে। মর্যাদার বিচারে কেউ তাকে অতিক্রম করুক বা তার সমকক্ষ হোক হিংসুক তা চায় না। কারণ সে তার গুণাবলি দ্বারা মানুষের উপর বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হতে পছন্দ করে এবং তাদের মধ্যে অনন্য হতে চায়। অথচ ঈমানের দাবি এর বিপরীত। আর তা হচ্ছে, মুমিনরা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত কল্যাণে সবাই অংশগ্রহণ করতে চায়। কারোটা কমিয়ে দেওয়া হোক, তা তারা চায় না।[2]
ব্যাখ্যা: প্রতিপালকের সাথে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক রক্ষার পাশাপাশি মানুষ যেন নিজেদের মধ্যে আন্তরিক এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে, এমন শিক্ষা ও বিধিবিধানের প্রতি ইসলাম গুরুত্বারোপ করেছে। যাতে তারা দুনিয়া ও আখেরাতে সুখ লাভ করতে পারে এবং মুসলিম সমাজে ঘনিষ্ঠতা ও ভালোবাসা বিরাজ করে। এটি কেবল তখনই অর্জন করা সম্ভব, যখন সমাজের প্রতিটি সদস্য অন্যের স্বার্থের প্রতি ঐরূপ আন্তরিক হবে, যেমন সে তার নিজের স্বার্থের প্রতি আন্তরিক হয়ে থাকে। এভাবে ইসলামী সমাজ দৃঢ় বন্ধন ও শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংহতি ও পরার্থপরতার নীতি অর্জনে তাঁর উম্মতকে পথ দেখিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে’।[3] এভাবে মানুষের হৃদয়ে ঈমান পূর্ণতা লাভ করে।
আমরা যদি হাদীছটি নিয়ে চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাই যে, আমাদের হৃদয়ে ঈমানের উক্ত রূপের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব, যখন আমরা একে অন্যের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ হব এবং উক্ত আচরণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে অন্যের সাথে লেনদেনে নৈতিক হব। এজন্য যদি কেউ কোনো মানুষ কর্তৃক কষ্ট পায়, তবে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং তাদের ভুলত্রুটি উপেক্ষা করে তাদের সাথে ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ করতে হবে। যারা আমাদেরকে কষ্ট দিয়েছে, তাদের ক্ষমা করতে হবে এবং তাদের কল্যাণ কামনা করতে হবে। কেবল তাই নয়, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে হবে। তারা অসুস্থ হলে তাদের সেবা-শুশ্রূষা করতে হবে। অভাবগ্রস্ত হলে সহায়তা করতে হবে। ইয়াতীম এবং বিধবাকে সাহায্য করতে হবে। প্রশস্ত হৃদয়ে এবং পবিত্র আত্মা নিয়ে অন্যকে সহায়তা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ত্রুটি করা যাবে না।
তিনি যেমন দুনিয়ায় মানুষের সুখ পছন্দ করেন, তেমনি পরকালে তাদের সুখী হওয়াকে ভালোবাসেন। তাই তিনি সর্বদা মানবজাতিকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করতে চান। নিম্নবর্ণিত আয়াতের শিক্ষার আলোকে তিনি মানুষের সাথে লেনদেন করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আল্লাহকে ডাকে, সৎকর্ম করে এবং বলে যে, আমি মুসলিম। তাদের চেয়ে আর কে অধিক উত্তম হতে পারে?’ (ফুছছিলাত, ৪১/৩৩)।
হাদীছটি অমুসলিমদের প্রতি কল্যাণকামিতাপূর্ণ ভালোবাসাকেও অন্তর্ভুক্ত করে। সুতরাং তাদের সাথে এমন আচরণ করা, যা তাদের জন্য আল্লাহর উপর ঈমান আনার পথকে সুগম করে এবং আল্লাহর সাথে শিরক ও অবাধ্যতার অন্ধকার থেকে রক্ষা করে। উপর্যুক্ত হাদীছের অপর একটি সূত্র তিরমিযীতে বর্ণিত হয়েছে, যা উল্লিখিত অর্থের প্রমাণ বহন করে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আর মানুষের জন্য তাই ভালোবাসো, যা তুমি নিজের জন্য ভালোবাস; তবেই তুমি প্রকৃত মুসলিম হতে পারবে’।[4]
অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন এবং তার কল্যাণকামিতার ক্ষেত্রে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে আমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সর্বোত্তম কল্যাণকামী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ উপদেষ্টা। অন্যের কল্যাণ সাধনে তিনি এমন কোনো উপায় নেই, যা অবলম্বন করেননি এবং তাদের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের জন্য উপকারী এমন কোনো পথ নেই, যা তিনি অনুসরণ করেননি। ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ যার রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বললেন, ‘হে আবূ যার! আমি (প্রশাসনিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে) তোমাকে দুর্বল মনে করছি এবং আমি তোমার জন্য তাই ভালোবাসি, যা আমি নিজের জন্য ভালোবাসি। (নেতৃত্ব দানের উপযোগী গুণাবলির অভাবে তুমি কষ্টের মধ্যে পতিত হবে) কাজেই তুমি যদি দুজন মানুষকে নেতৃত্ব দানের সুযোগ পাও, তবুও তা গ্রহণ করো না এবং ইয়াতীমের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া থেকে বিরত থেকো’।[5]
মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সর্বোত্তম ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, ‘সর্বোত্তম ঈমান হলো আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা আর সর্বদা আল্লাহর স্মরণে জিহ্বা সিক্ত রাখা’। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করা এবং আল্লাহর যিকিরে জিহ্বাকে সিক্ত রাখা বলতে কী বোঝায়? তিনি বললেন, ‘তুমি লোকেদের জন্য যা পছন্দ করো, নিজের জন্য তা-ই পছন্দ করবে এবং তাদের জন্য তা-ই অপছন্দ করবে, যা নিজের জন্য অপছন্দ কর আর ভালো কথা বলবে নতুবা নীরব থাকবে’।[6]
অন্যের প্রতি ভালোবাসাপূর্ণ আচরণের গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, তিনি মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত একে স্মরণে রাখতে বলেছেন। আমর ইবনুল ‘আছ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে পছন্দ করে যে, তাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হোক এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হোক; তার মরণ যেন এমন অবস্থায় হয় যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান রাখে এবং অন্যের প্রতি এমন ব্যবহার দেখায়, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে’।[7]
আমাদের সৎকর্মপরায়ণ পূর্বপুরুষগণ তাদের কাঁধে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই আদেশ বহন করেছেন। সর্বোত্তম উপায়ে এটি পালনের ক্ষেত্রে তারা বিশ্বস্ততার চূড়ান্ত সীমায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, যখন আমি কুরআনের কোনো আয়াতের তাফসীরের উপর দিয়ে অতিবাহিত হই, তখন আমি চাই যে, আমি সেখান থেকে যে শিক্ষা অর্জন করেছি সমস্ত লোক তা থেকে উপকৃত হোক।[8]
মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াসে‘ নামক একজন বিখ্যাত পূর্বপুরুষ যখন তার একটি গাধা বিক্রি করতে চাইলেন, তখন এক লোক তাকে বললেন, আপনি কি এটি আমার জন্য পছন্দ করবেন? তখন তিনি বললেন, যদি এটি আমি আপনার জন্য পছন্দ না করতাম; তবে একে আপনার নিকট বিক্রি করতাম না।[9] এগুলো ও অন্যান্য উদাহরণ তাদের বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি ইঙ্গিত, যেখানে তারা পৌঁছেছেন। যার ফলস্বরূপ আমাদের জন্য এই সম্মানজনক মনোভাব তৈরি হয়েছে।[10]
এই হাদীছের অন্যতম দাবি হলো, একজন মুসলিম তার ভাইয়ের জন্য তাই ঘৃণা করে, যা সে নিজের জন্য ঘৃণা করে। এর ফলে সে অনেক নিন্দনীয় বৈশিষ্ট্য বর্জনে উৎসাহিত হয়। যেমন- হিংসা, বিদ্বেষ, অন্যের প্রতি ঘৃণা, স্বার্থপরতা, লোভ ও অন্যান্য নিন্দনীয় বৈশিষ্ট। যেসব আচরণ মানুষ তার সাথে করুক, তা তিনি চান না।
পরিশেষে এই মহান হাদীছ নিয়ে কাজ করার অন্যতম ফল হচ্ছে— জাতির মধ্যে এমন এক পুণ্যময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যে সমাজের প্রতিটি সদস্য সামাজিক ভালোবাসার গভীর বন্ধন উপভোগ করবে। সমাজের প্রতিটি সদস্য একটি দেহের অঙ্গের মতো পরস্পর সংযুক্ত ও সংহত থাকবে, যা কোনো দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত হবে না কিংবা কোনো বিপদে পরাভূত হবে না। যাতে এমন আদর্শের আলোকে গড়ে ওঠা একটি জাতি চূড়ান্ত সুখ ভোগ করতে পারে। এমন আদর্শে গঠিত সমাজের চূড়ান্ত রূপ হলো ঐটি, যা আমরা বাস্তবে দেখতে পাই। আল্লাহ আমাদের কল্যাণ দান করুন এবং সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল
প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৫।
[2]. ইবনু রজব, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ১৪৫।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৫।
[4]. তিরমিযী, হা/২৩০৫।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৬।
[6]. আহমাদ, হা/৮০৯৫; ইবনু মাজাহ, হা/৪২১৭।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৮৮২।
[8]. ইবনু রজব, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ১৪৫।
[9]. প্রাগুক্ত।
[10]. মাজাল্লাতুল বায়ান, পৃ. ৪৫।