কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসলামী বিধান প্রতিপালন : জীবন, সম্পদ ও ইযযতের গ্যারান্টি

post title will place here

عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضي الله عنهما قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ. فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّ الْإِسْلَامِ وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ»

সরল অনুবাদ : আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ‍ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকারের কোনো মা‘বূদ নেই, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, ছালাত আদায় করে এবং যাকাত প্রদান করে। যখন তারা এসব প্রতিপালন করবে, তখন তারা তাদের জীবন ও সম্পদ হেফাযত করে নেবে। তবে ইসলামের হক্ব (ইসলামী আইন ভঙ্গের শাস্তি) ব্যতীত। আর তাদের হিসাব আল্লাহর উপর ন্যস্ত’।[1]

ব্যাখ্যা : মহান আল্লাহ রাসূলগণ আলাইহিমুস সালামকে প্রেরণ করেছেন এবং তাদের সাথে কিতাবসমূহ নাযিল করেছেন, যাতে তারা তাদের উম্মতের কাছে দ্বীনের প্রচার করতে পারেন এবং ইসলাম যেন অন্য সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ ‘আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফেতনা নির্মূল হয় এবং দ্বীন আল্লাহর জন্য হয়ে যায়’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৩)। অর্থাৎ একমাত্র ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

আল্লাহ তাআলা প্রেরিত সমস্ত নবীআলাইহিমুস সালাম-এর জীবনের একমাত্র অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল এই দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া। তাদের প্রত্যেকেই এই লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামে নিরন্তর সাধনা করেছেন। এজন্য তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্পদ, সম্মান ও জীবন উৎসর্গ করেছেন। দিনে, রাতে, গোপনে ও প্রকাশ্যে তাঁরা আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করেছেন। তাঁদের দাওয়াতে লোকেরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। যাদের হৃদয়ে আল্লাহ তাআলা সত্যের আলো প্রদান করেছিলেন এবং যাদের অন্তর ইসলামের জন্য প্রশস্ত হয়েছিল, তারা প্রতিপালকের একত্বে বিশ্বাস করেছিলেন এবং তাঁর আইন অনুসরণ করেছিলেন। আর অপরটি হলো সেই দল, যাদের অন্তর্দৃষ্টি লোপ পেয়েছিল এবং যাদের হৃদয়ে আল্লাহ তাআলা পর্দা ফেলে দিয়েছিলেন। তাই তারা সত্যের আহ্বানে সাড়াদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আল্লাহ তাআলা দুই দলের অবস্থা স্পষ্ট করেছেন,ذَلِكَ بِأَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا اتَّبَعُوا الْبَاطِلَ وَأَنَّ الَّذِينَ آمَنُوا اتَّبَعُوا الْحَقَّ مِنْ رَبِّهِمْ ‘এটা এ কারণে যে, যারা অবিশ্বাস পোষণ করে, তারা মিথ্যার অনুসরণ করে এবং যারা ঈমান এনেছে, তারা তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সত্যের অনুসরণ করেন’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/৩)

নতুন ধর্মবিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে একজন মানুষের বিশ্বাসী বা মিথ্যাবাদী কিংবা মুমিন বা কাফের হওয়া কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। প্রতিটি নতুন ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে মানুষের এরূপ বিভাজন অনিবার্য। তাই ধর্মবিশ্বাসের বিভাজন বিদ্যমান সমাজে উভয় গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সবার সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক অবশ্যই বজায় রাখতে হবে; যাতে তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো সম্ভব হয়। এটা এমন অবধারিত সত্য, যার অনুমোদন আল্লাহর আইন দিয়েছে।

যারা ইসলামবিমুখ হয় কিংবা মিথ্যার বেড়াজালে আটকা পড়ে, ইসলাম তাদেরকে সবচেয়ে সুন্দর ভাষায় আহ্বান করার আদেশ দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের সাথে সর্বোত্তম পন্থায় বিতর্ক করতে বলেছেন। ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হলে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই; বরং দাওয়াতের অবিরাম সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। ইসলামের আদর্শ বিস্তৃতির এই মহান দায়িত্ব দাঈদের। তাদেরকে এই দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতে হবে, যাতে এই মহান শিক্ষা থেকে কেউ বঞ্চিত না হয়। যদি কেউ এই দাওয়াতী কার্যক্রমকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে এবং এর বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করে, তবে তাকে নিবৃত করা বা অপসারণ করা জরুরী। এই কাঁটার মূলোৎপাটনের কোনো বিকল্প নেই। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকারের কোনো মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল আর তারা ছালাত আদায় করেন ও যাকাত প্রদান করেন’।[2] দ্বীন ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েছেন। প্রত্যেক প্রতিবন্ধকতা ও গোঁড়ামির মূলোৎপাটন করা তাঁর প্রধান দায়িত্ব।

কিন্তু উক্ত ব্যাখ্যা এই ইঙ্গিত বহন করে না যে, ইসলাম রক্তের জন্য তৃষ্ণার্ত এবং নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির জন্য উন্মুখ; বরং এটি রহমত ও করুণার ধর্ম, যেখানে কাউকেও ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করার সুযোগ নেই। তবে এর অর্থ এমন বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা নয়, যার কারণে ইসলামের প্রতি মানুষকে আহ্বানের পথ বন্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ ‘দ্বীনের ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, নিশ্চয় হেদায়াত পথভ্রষ্টতা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে’ (আল-বাক্বারা, ২/২৫৬)

বক্ষ্যমাণ হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন সব বিষয়ের আলোচনা করেছেন, যা সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। সম্পদ ও জীবন রক্ষার উপায় হলো সাক্ষ্যদানের বাক্যদ্বয় বলা, ছালাত ক্বায়েম করা ও যাকাত প্রদান করা। সুতরাং যে কেউ উক্ত কাজগুলো করল, সে তার জীবন ও সম্পদ নিরাপদ করে নিল। ইসলাম প্রবর্তিত এই নিরাপত্তাকে সাধারণ নিরাপত্তা বা ইসলামের নিরাপত্তা বলা যায়। এই নিরাপত্তার মর্মার্থ হলো, যে ব্যক্তি ইসলামে প্রবেশ করল, ইসলামের আদেশ পালন করল এবং ইসলামের বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করল; সে নিজেকে মুসলিমদের তালিকাভুক্ত করল। এখন সে ঐ সকল সুযোগ ভোগ করবে, যা একজন মুসলিম ভোগ করে থাকে এবং তার উপর ঐ হুকুম অর্পিত হবে, যা একজন মুসলিমের উপর অর্পিত হয়।

আর ইসলামী রাষ্ট্র অমুসলিমদের জন্য সীমিত আকারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেছে। একজন কাফের যে সেনাসদস্য নয়, মুসতামিন (নিরাপত্তাপ্রাপ্ত) বা যিম্মী (কর প্রদানের শর্তে নিরাপত্তা গ্রহণকারী) হিসেবে নিরাপত্তা লাভ করবে। অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্র নির্দিষ্ট শর্তে তার সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আলেমগণ ফিক্বহের কিতাবগুলোতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

ইসলামে নিরাপত্তার মর্মার্থ হলো, কোনো ব্যক্তি যদি শাহাদাতের বাক্যদ্বয় উচ্চারণ করে, তবে তার বাহ্যিক বক্তব্য ধর্তব্য হবে এবং তার অন্তরের বিষয় আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ বাহ্যিক বক্তব্যের আলোকে তার উপর ইসলামী বিধান প্রয়োগ করা হবে। কারণ আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মানুষের অন্তর অনুসন্ধান করতে বা তাদের অন্তরের গোপন বিষয় উদ্ঘাটন করতে নিষেধ করেছেন। এমনই সিদ্ধান্ত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এর দ্বারা আল্লাহর দ্বীনের আনুগত্য বর্জন বা তাঁর বিধান অনুযায়ী আমল পরিত্যাগ করা উদ্দেশ্য নয়। কারণ ‘লা ইলাহা’-এর শর্ত হলো আল্লাহর প্রতি অনুগত থাকা এবং এর দাবি অনুযায়ী আমল করা।

ছালাত ক্বায়েম করা হলো দাসত্ব ও আনুগত্য প্রকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। কোনো ব্যক্তি যদি ছালাত পরিত্যাগ করে, তবে তার উপর থেকে ইসলাম নির্ধারিত নিরাপত্তা উঠিয়ে নেওয়া হবে। মহান আল্লাহর বাণী দ্বারা এ কথা প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা বলেন,فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ ‘যদি তারা তওবা করে, ছালাত ক্বায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে; তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই’ (আল-তাওবা, ৯/১১)। এই আয়াতটি এই ইঙ্গিত দেয় যে, যদি তারা ছালাত আদায় না করে, তবে তারা দ্বীনী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবে না। যুল-খোয়াইছারার ঘটনাটিও এমনই ইঙ্গিত বহন করে। গনীমতের মাল বণ্টনের সময় যখন যুল-খোয়াইছারা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর আত্মসাতের অভিযোগ তুলে, তখন খালিদ ইবনু ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার ঘাড়ে আঘাত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেন, ‘না, তাকে হত্যা করো না। কারণ এমন হতে পারে যে, সে ছালাত আদায় করে’।[3] এখান থেকে এটা বুঝা যায় যে, তিনি যদি ছালাত না পড়তেন, তবে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তাকে হত্যা করতে নিষেধ করতেন না।

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তারা যাকাত প্রদান করে’। আল্লাহ তাআলার প্রতি আর্থিক আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো যাকাত। হাদীছে যাকাতের উল্লেখ থাকার অর্থ এই নয় যে, কেবল যাকাত প্রদান থেকে বিরত থাকা এমন কুফরী যা তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। 

যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে উল্লিখিত তিনটি বিষয় পূর্ণমাত্রায় বিরাজ করে, তখন পূর্ণাঙ্গ মাত্রার নিরাপত্তা অর্জনের সুযোগ তার নিশ্চিত হয়। তার রক্ত, সম্পদ ও জীবন সম্পূর্ণভাবে নিরাপত্তা লাভ করে। তবে অপরাধের কারণে ইসলাম নির্ধারিত শাস্তি এর আওতাভুক্ত নয়। যদি কোনো ব্যক্তি এমন কোনো অপরাধ করে, যা তার রক্ত প্রবাহকে বৈধ করে। যেমন: কোনো ব্যক্তি যদি কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে বা বিবাহোত্তর ব্যভিচারে লিপ্ত হয় বা ইসলাম গ্রহণ করার পর পুনরায় ইসলাম ত্যাগ করে; তবে সে নিরাপত্তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

সুতরাং এতে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলাম এমন একটি জীবনবিধান, যা সমস্ত মানুষকে আল্লাহর হুকুম মেনে চলার আহ্বান জানায়। যদি কেউ তার সার্বিক জীবনে ইসলামী আইন অনুসরণ করে, তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তবে ইসলাম তার অধিকার, সম্মান ও সম্পত্তি রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামী আইন অনুযায়ী জীবনযাপন করার তাওফীক্ব দিন- আমীন!

মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল

প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২২; মিশকাত, হা/১২।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯৪৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২১।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৪৩২; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৬৪।

Magazine