কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

পরকালকে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের সুফল

post title will place here

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ كَانَتِ الآخِرَةُ هَمَّهُ جَعَلَ اللهُ غِنَاهُ فِى قَلْبِهِ وَجَمَعَ لَهُ شَمْلَهُ وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِىَ رَاغِمَةٌ وَمَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ جَعَلَ اللهُ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ وَفَرَّقَ عَلَيْهِ شَمْلَهَ وَلَمْ يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ مَا قُدِّرَ لَهُ.

সরল অনুবাদ : আনাস ইবনু মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে আখেরাতের চিন্তা করবে, আল্লাহ তার অন্তরে অভাবমুক্তি স্থাপন করবেন, তার এলোমেলো কাজগুলো সুবিন্যস্ত করবেন এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও পৃথিবী তার নিকট এসে ধরা দিবে। আর যার চিন্তার বিষয় দুনিয়া হবে, আল্লাহ দরিদ্রতাকে তার কপালে লিখে দেবেন, তার সাজানো কাজগুলো বিক্ষিপ্ত করে দিবেন এবং দুনিয়ায় তার জন্য যা নির্ধারিত তার চেয়ে অতিরিক্ত কিছুই সে পাবে না’।[1]

ব্যাখ্যা : উক্ত হাদীছে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, পরকাল তাদের একমাত্র কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য আর দুনিয়া তাদের পাথেয় সংগ্রহের স্থান। ফলে এই পৃথিবীতে মানব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হলো পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করা, তার একমাত্র উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় হলো পরকালে সাফল্য লাভের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো। কোনো অবস্থাতেই দুনিয়ার চাকচিক্য বা ভালোবাসা যেন তার হৃদয়কে আসক্ত না করে। তাই প্রত্যেকের একমাত্র কাজ হবে পাথেয় সংগ্রহের সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া।

একজন মুমিনের জীবন ও কর্মের প্রধান লক্ষ্য অবশ্যই পরকাল। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, সে পার্থিব জীবনকে সম্পূর্ণ বর্জন করবে। কেননা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রিযিক্ব অন্বেষণ, ব্যক্তিগত কার্যক্রম সম্পাদন, পারিবারিক প্রয়োজন মিটানো, সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদি করা সম্ভব নয়। পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু পরকালীন বিষয়ে আসক্ত হওয়া বৈরাগ্যবাদ ছাড়া কিছুই নয়, যা ইসলাম সমর্থন করে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ ‘আর বৈরাগ্য, তারা নিজেরা আবিষ্কার করেছে, আমরা তা তাদের উপর আবশ্যক করিনি’ (আল-হাদীদ, ৫৭/২৭)। তবে জীবনের অধিকাংশ সময় অবশ্যই পরকালের রাস্তায় কাটাতে হবে।

একজন মুমিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। জীবনের প্রতিটি কাজের পিছনে তার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে পরকালীন সাফল্য। প্রতিটি কাজ সে সৎ নিয়্যতে করে, যাতে উত্তম প্রতিদান পায়। এজন্য আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু‘আ করেছেন, ‘হে আল্লাহ! দুনিয়ার চিন্তাই আমাদের চিন্তার একমাত্র মাধ্যম বানিয়ো না, এটিকেই আমাদের জানার বা আলোচনার একমাত্র উৎস বানিয়ো না এবং এমন ব্যক্তিকে আমাদের উপর আধিপত্য দিয়ো না, যে আমাদের উপর দয়া করবে না’।[2]

হে আল্লাহর বান্দা! যে পরকালকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্যবস্তু বানায় তার সবচেয়ে বড় সার্থকতা হলো, সে আল্লাহর নিকট থেকে এমন জীবিকা পায়, যা তাকে পরিতৃপ্ত করে, যা তার জীবন সুন্দর করে, যা সাধারণ জীবন যাপনের জন্য যথেষ্ট যদিও সেটা পরিমাণে কম হয়। কেননা আল্লাহ তাকে এমন পরিতৃপ্তি ও পূর্ণতা দান করেন, যা তার চাহিদাকে মিটিয়ে দেয়। এজন্যই তো আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ‘ঐ ব্যক্তি সফলকাম, যে ইসলাম গ্রহণ করেছে আর তাকে পরিমিত পরিমাণ রিযিক্ব দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যে রিযিক্ব দিয়েছেন তাতে তিনি সন্তুষ্ট’।[3]

পার্থিব জীবনের সাধারণ অবস্থা কিংবা অতিসাধারণ জীবন যাপন মোটেও লজ্জাজনক কিংবা তাচ্ছিল্যের নয়। কেননা অমুখাপেক্ষিতা, স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার গুণে সমৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব এমন বিশেষত্ব লাভ করে, যা তাকে স্বাতন্ত্র্য দান করে। পার্থিব জীবনের সুখ কিংবা সমৃদ্ধি কোনোভাবেই তার নিকট মূল্যবান নয়। কেননা সে জানে, দুনিয়ার প্রতি আসক্তিই মানুষের লাঞ্ছনার কারণ। হাসান বাছরী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি এমন সব লোককে দেখেছি, যারা দুনিয়ার প্রাপ্তিতে মোটেও আনন্দিত হয় না। কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হলে বা কোনো কিছু হারিয়ে গেলে তারা মোটেও আফসোস করে না বা হতাশ হয় না। তার দৃষ্টিতে দুনিয়ার সবকিছু মাটির চেয়েও তুচ্ছ।[4]

হে আল্লাহর বান্দাগণ! সত্য কথা হলো, সম্পদের আধিক্যই ধনাঢ্যতা নয়, যদিও মানুষের নিকট তা ধনাঢ্যতা; বরং আত্মার অভাবমুক্তি ও হৃদয়ের অমুখাপেক্ষিতাই হলো প্রকৃত অভাবমুক্তি ও ধনাঢ্যতা। যেমন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সম্পদের আধিক্যই অভাবমুক্তি নয়; বরং আত্মার অভাবমুক্তিই প্রকৃত অভাবমুক্তি’।[5]

এভাবে মানুষ উত্তম জীবন লাভে ধন্য হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘যে ব্যক্তি সৎ আমল করবে, সে পুরুষ হোক কিংবা নারী এমতাবস্থায় যে সে একজন প্রকৃত মুমিন; আমি (আল্লাহ) অবশ্যই (দুনিয়ায়) তাকে উত্তম জীবন দান করব এবং (পরকালে) অবশ্যই তাদের কর্মের সর্বোত্তম প্রতিদান দিব’ (আন-নাহল, ১৬/৯৭)[6] আলী ও ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এখানে উত্তম জীবন বলতে পরিতৃপ্ত জীবনকে বুঝানো হয়েছে।[7]

পরকালের চিন্তায় বিভোর হওয়া চিরন্তন আবাস, পরম সুখ ও আল্লাহ তাআলার স্থায়ী নেয়ামত লাভের মাধ্যম। এতে জীবিকা এমন প্রশস্ত হয় যে, সে কোনো ধরনের অভাব-অনটন বোধ করে না। আর নশ্বর দুনিয়ার চাকচিক্যে আসক্তি ও ব্যস্ততা তাঁর মধ্যে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে, তাকে সর্বদা অস্থির রাখে এবং তার রিযিক্বকে সঙ্কুচিত করে দেয়। আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী, ‘যে শুধু পরকালের কথা ভাবে’ অর্থাৎ যার সকল চিন্তা-ভাবনা একমাত্র পরকালের উদ্দেশ্যে হয়, আল্লাহ তাআলা তার সকল কাজ সহজ করে দেন। তার জীবনে সচ্ছলতা ও প্রশস্ততা এনে দেন। তার হৃদয়কে অভাবমুক্ত করে দেন। তাকে ততটুকু রিযিক্ব দেন, যা তার জন্য যথেষ্ট হয় এবং তাঁর যা আছে তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। সে অমুখাপেক্ষী হয়ে যায়। ফলে সে অন্যের সম্পদের প্রতি লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায় না। তার জীবনের সকল এলোমেলো কাজ বিন্যস্ত হয়ে যায়। সে এমন সাজানো ও শান্তিপূর্ণ জীবন লাভ করে, যেখানে পূর্ণ স্থিতিশীলতা বিরাজ করে। তার আত্মা এমন স্বচ্ছতা ও নির্মলতা লাভ করে, যা তাকে অফুরন্ত মানসিক শান্তি লাভ করতে সাহায্য করে। ফলে আত্মার উৎফুল্লতা ও আনন্দঘন পরিবেশে তার জীবন হয়ে উঠে আনন্দময়। পরিবার, সন্তান, প্রতিবেশী ও সাধারণ মানুষ সবাই তাকে সম্মান করে। তারা তাকে অভ্যর্থনা জানানোর অপেক্ষায় থাকে। কেননা যার সকল নিয়্যত একমাত্র পরকালের উদ্দেশ্যে হয়, সে আল্লাহর অফুরন্ত ভালোবাসায় সিক্ত হয়। আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তার প্রতি আকাশবাসীর হৃদয়ে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। ফলে পৃথিবীবাসী তাকে গ্রহণ করার জন্য অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকে। যেমন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন তিনি জিবরীল আলাইহিস সালামকে ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন। অতএব, তুমি তাকে ভালোবাসো’। অতঃপর জিবরীল আলাইহিস সালাম তাকে ভালোবাসেন এবং আকাশবাসীকে ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন। অতএব, তোমরাও তাকে ভালোবাস। তখন আকাশবাসী তাকে ভালোবাসে এবং তারপর পৃথিবীতে তার জন্য গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়।[8]

পরকালে আসক্ত ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় দয়া এই কারণে যে, তিনি দুনিয়ার বিষয়, বিভিন্ন সমস্যা ও ব্যাপক ব্যস্ততা ইত্যাদিতে তার জীবনকে বিক্ষিপ্ত করেন না। ফলে আল্লাহ তার সবকিছু সহজ করে দেন, সব ধরনের সংকীর্ণতা ও আশঙ্কা থেকে মুক্তিদান করেন। কেননা যার সকল চিন্তা একমাত্র আখেরাত ভিত্তিক হয়, সে মুত্তাক্বীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا - وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا﴾ ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য মুক্তির ব্যবস্থা করেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিযিক্ব দেন, যা সে ধারণা করতে পারে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজকে অবশ্যই পূর্ণ করবেন আর তিনি সবকিছুর জন্য একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন’ (আত-তালাক, ৬৫/২-৩)। এর পরের আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا﴾ ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন’ (আত-ত্বালাক, ৬৫/৪)। অতঃপর দুনিয়ার সবকিছু তার করায়ত্তে চলে আসে অথচ সে দুনিয়াসক্ত নয়। পৃথিবীর সবকিছু তার কাছে অনুগত হয়ে ধরা দেয়। 

এর মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান যে, কেউ দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হোক অথবা পরকালের প্রতি আসক্ত হোক, সে দুনিয়ার ততটুকুই পাবে যতটুকু তার ভাগ্যে লিখা আছে; কিন্তু পরকাল যার একমাত্র লক্ষ্য দুনিয়া তার নিকট বশীভূত হয়ে উপস্থিত হবে। কেননা সে দুনিয়ায় নিজেকে জড়ায়নি বা সে দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়নি; বরং সে দুনিয়ায় যা পেয়েছে তার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে এবং যা হালাল তা ব্যবহার করেছে। আর যা সে হারিয়েছে বা যা তার ক্ষতি হয়েছে তাতে সে হতাশ হয়নি। কারণ সে জানে এটি তার জন্য নয়। এই কারণে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং চাওয়ার ক্ষেত্রে সুন্দর পন্থা অবলম্বন করো। কেননা কোনো মানুষই তার (নির্ধারিত) রিযিক্ব সম্পূর্ণ ভোগ না করে মরবে না; যদিও দেরিতে হয়। কাজেই আল্লাহকে ভয় করো আর সুন্দরভাবে চাও। যা হালাল তা গ্রহণ করো আর যা হারাম তা বর্জন করো’।[9]

অর্থাৎ নম্রভাবে রিযিক্ব চাও তথা হালাল উপায়ে রিযিক্ব উপার্জন করো আর হারাম উপায়ে রিযিক্ব অন্বেষণ করা থেকে বিরত থাক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,﴿وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا﴾ ‘তোমাকে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তার মাধ্যমে পরকালের বাসস্থান অনুসন্ধান করো। আর দুনিয়ায় তোমার অংশ পেতে ভুলো না’ (আল-ক্বাছাছ, ২৮/৭৭)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনু কাছীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছেন, তার অধিকাংশ তোমার প্রতিপালকের আনুগত্য ও তাঁর নৈকট্য লাভের খাতে ব্যয় করো; যার মাধ্যমে তুমি দুনিয়া ও পরকালে প্রতিদান লাভ করবে। আর খাবার, পানীয়, পোশাক, আবাসন ও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি যা আল্লাহ তোমার জন্য হালাল করেছেন তা ভোগ করো; কেননা তোমার উপর তোমার শরীর ও পরিবারের অধিকার আছে। প্রত্যেক অধিকারীকে তার অধিকার দিয়ে দাও।[10]

ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, ‘দুনিয়ায় তোমার অংশ পেতে ভুলো না’-এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, দুনিয়ায় পরকালের উদ্দেশ্যে আমল করতে ভুলো না। আউন ইবনে আব্দুল্লাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, একদল মানুষ আয়াতটিকে এমন অর্থে ব্যবহার করছেন, যেটি তার উদ্দিষ্ট অর্থ নয়। কেননা ‘দুনিয়ায় তোমার অংশ ভুলো না’-এর অর্থ দুনিয়ায় আল্লাহর আনুগত্যের উদ্দেশ্যে আমল করতে ভুল করো না। আয়াতটি আমাদেরকে দুনিয়ার উপর পরকালকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করে। বিশেষভাবে যখন দুনিয়া ও আখেরাতের তুলনা করা হয়, তখন অবশ্যই পরকালকে প্রাধান্য দিতে হবে। হে বন্ধু! তুমি যদি সকল চিন্তাকে পরকালভিত্তিক করো; তবে আল্লাহ তাআলা তোমার দুনিয়ার জন্য যথেষ্ট হবেন। কেননা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার সকল চিন্তাকে একমাত্র পরকালের উদ্দেশ্যে করবে, তার দুনিয়ার কাজকর্মের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’।[11]

‘যার চিন্তা একমাত্র দুনিয়াকে ঘিরে হয়’ অর্থাৎ তার উদ্দেশ্য এবং ব্যস্ততা শুধু পার্থিব জীবনের জন্য হয়। এক্ষেত্রে যদি সে শুধু প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তখন আল্লাহ তাআলা তার কপালে দারিদ্র্য লিখে দেন। অর্থাৎ আল্লাহ তার অভাব ও চাহিদাকে তার চোখের সামনে এমনভাবে এনে দেন যে, ধনী হওয়া সত্ত্বেও সে অভাব ছাড়া কিছুই দেখে না। আল্লাহ তাআলা তার জীবনকে বিক্ষিপ্ত করে দেন। ফলে তার সাজানো জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। তার জীবন সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অথচ পৃথিবীতে তার প্রাপ্তি তাই থাকে, যা তার জন্য নির্ধারিত ছিল। অর্থাৎ শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, তার চেয়ে বেশি কিছুই সে অর্জন করতে পারে না।

পরকালকে ইহকালীন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করার সাফল্য, সার্থকতা ও ফলাফল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। ঝামেলামুক্ত, সাচ্ছন্দ্যময় ও শান্তিপূর্ণ জীবন প্রত্যেকে লাভ করতে চায়। কিন্তু এই নশ্বর পৃথিবীর প্রভাব, সাময়িক ক্ষমতা, অস্থায়ী চাকচিক্য ও কৃত্রিম সৌন্দর্য আমাদেরকে মোহাচ্ছান্ন করে ফেলে। ফলে আমরা বিক্ষিপ্ততা, দুশ্চিন্তা, বিপদ-আপদ, সমস্যা, প্রতিকূলতা, সংকীর্ণতা ও অভাব-অনটনের সম্মুখীন হই। দুনিয়ায় উত্তম জীবন লাভ ও পরকালে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জনের জন্য হাদীছের শিক্ষাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। হাদীছের আলোকে আমরা যদি এ জীবনকে গড়তে পারি, তবে আমাদের জীবন এমন শান্তিপূর্ণ, এমন অভাবমুক্ত ও সচ্ছল হবে, যেখানে আমরা কখনও অভাব-অনটন, অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা অনুভব করব না। আমাদের জীবন এমন অনুপম, নির্মল, স্বচ্ছ হবে, যেখানে শুধু শান্তি আর শান্তি বিরাজ করবে। আল্লাহ আমাদের শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও সুন্দর জীবন লাভ করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল

 প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।

[1]. তিরমিযী, হা/২৪৬৫, হাদীছ ছহীহ।

[2]. তিরমিযী, হা/৩৫০২, হাসান।

[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৫৪।

[4]. আহমাদ, ‘আয-যুহদ’ অধ্যায়, পৃ. ২৩০।

[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৪৬।

[6]. তাফসীর ইবনু কাছীর (দারুল মুফীদ, বৈরূত, লেবানন), ৩/৩৭৩।

[7]. তাফসীর ইবনু কাছীর (দারুল মুফীদ, বৈরূত, লেবানন), ৪/৫৩৮।

[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৩৭।

[9]. ইবনু মাজাহ, হা/২১৪৪, হাদীছ ছহীহ।

[10]. তাফসীর ইবনু কাছীর (দারুল মুফীদ, বৈরূত, লেবানন), ৩/৩৭৩।

[11]. ইবনু মাজাহ, হা/৪১০৬, হাসান।

Magazine