কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ভ্রূণ সৃষ্টির পর্যায় সম্পর্কে ইসলামী দিকনির্দেশনা

post title will place here

عَنْ عَبْدِ اللهِ بنِ مَسْعُوْدْ رضي الله عنه قَالَ حَدَّثَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ الصَّادِقُ الْمَصْدُوقُ «إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ فِى بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا ثُمَّ يَكُونُ فِى ذَلِكَ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ ثُمَّ يَكُونُ فِى ذَلِكَ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ ثُمَّ يُرْسَلُ الْمَلَكُ فَيَنْفُخُ فِيهِ الرُّوحَ وَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ بِكَتْبِ رِزْقِهِ وَأَجَلِهِ وَعَمَلِهِ وَشَقِىٌّ أَوْ سَعِيدٌ فَوَالَّذِى لاَ إِلَهَ غَيْرُهُ إِنَّ أَحَدَكُمْ لَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ الْجَنَّةِ حَتَّى مَا يَكُونَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهَا إِلاَّ ذِرَاعٌ فَيَسْبِقُ عَلَيْهِ الْكِتَابُ فَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ النَّارِ فَيَدْخُلُهَا وَإِنَّ أَحَدَكُمْ لَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ النَّارِ حَتَّى مَا يَكُونَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهَا إِلاَّ ذِرَاعٌ فَيَسْبِقُ عَلَيْهِ الْكِتَابُ فَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَيَدْخُلُهَا».

সরল অনুবাদ : আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -যিনি সত্যবাদী এবং সত্যায়িত ব্যক্তিত্ব- আমাদেরকে বলেছেন, ‘তোমাদের সৃষ্টি নিজের মায়ের পেটে ৪০ দিন যাবৎ শুক্ররূপে জমা হওয়ার মাধ্যমে শুরু হতে থাকে, পরবর্তী ৪০ দিন জমাটবাঁধা রক্তরূপে থাকে, পরবর্তী ৪০ দিন গোশতপিণ্ড রূপে থাকে, তারপর তার কাছে ফেরেশতা পাঠানো হয়। অতঃপর সে তার মধ্যে রূহ প্রবেশ করায় এবং তাকে চারটি বিষয় লিখে দেওয়ার জন্য হুকুম দেওয়া হয়— তার রূযী, বয়স, কাজ এবং সে কি সৌভাগ্যবান, না দুর্ভাগ্যবান। অতএব, আল্লাহর কসম, যিনি ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই! তোমাদের মধ্যে কেউ জান্নাতবাসীর মতো কাজ করে, এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাত ব্যবধান থাকে। এ অবস্থায় তার লিখন তার উপর প্রভাব বিস্তার করে বলে, সে জাহান্নামবাসীর মতো কাজ শুরু করে এবং তার ফলে তাতে প্রবেশ করে। পক্ষান্তরে তোমাদের মধ্যে কেউ জাহান্নামীদের মতো কাজ শুরু করে দেয়, এমনকি তার ও জাহান্নামের মধ্যে মাত্র এক হাত ব্যবধান থাকে। এ অবস্থায় তার লিখন তার উপর প্রভাব বিস্তার করে বলে সে জান্নাতবাসীদের মতো কাজ শুরু করে আর সে তাতে প্রবেশ করে’।[1]

‘ছাদেক্ব’ (সত্যবাদী) মাছদূক্ব’ (সত্যায়িত)বলতে যা বোঝায়: আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সংবাদ দিয়েছেন তাতে তিনি সত্যবাদী ও সত্যায়িত। যদি বলা হয়, যায়েদ এসেছে এবং তার আসা যদি সত্য হয়, তবে সংবাদদাতাকে সত্যবাদী বলা হবে। আর যদি কেউ আমাকে যায়েদের আগমন সম্পর্কে সংবাদ দেয় এবং তার আসা যদি সত্য হয়, তবে আমাকে সত্যায়িত বলা হবে। অর্থাৎ আমাকে সত্য সংবাদ জানানো হয়েছে।[2] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন ও হাদীছের প্রতিটি বাণী ঠিক ঐভাবে বর্ণনা করেছেন, যেভাবে তাঁর নিকট এসেছে। এক্ষেত্রে তাঁর পরিবেশিত সংবাদে তিনি সত্যবাদী এবং তাঁর উপর অবতীর্ণ অহীর ক্ষেত্রে তিনি সত্যায়িত।

ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ছাদেক্ব ও মাছদূক্ব বলার কারণ: যেহেতু মাতৃগর্ভে ভ্রূণের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া এবং এর পর্যায় সম্পর্কে মানুষের ইন্দ্রিয় এবং তৎকালীন তাদের লব্ধ জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি সম্ভব ছিল না। এছাড়াও অন্যান্য বিষয় যেমন— জীবিকা, আয়ুষ্কাল, মৃত্যুর সময়সীমা, কর্মসংস্থান ও হতভাগ্য বা ভাগ্যবান হওয়া সম্পর্কে কোনো তথ্য তাদের হাতে নেই; তাই আলেমগণ হাদীছটিকে তাঁর নবুঅতের নিদর্শন এবং তাঁর রিসালাতের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এজন্যই আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই হাদীছে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ছাদেক্ব ও মাছদূক্ব বলেছেন।

হাদীছটির ব্যাখ্যা: মাতৃগর্ভে মানুষের ভ্রূণের সৃষ্টি প্রক্রিয়া চারটি পর্যায়ে হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায় হলো, ডিম্বাশয়ে (ফেলোপিয়ান নালিতে) শুক্রাণুর ডিম্বাণুর সাথে নিষেকের পর পুং ও স্ত্রী জননকোষ মিলনের ফলে উৎপন্ন কোষকে জাইগোট বলে। একে শুক্রাণুর সাথে ডিম্বাণুর নিষিক্ত হওয়ার পর্যার বলে। নিষিক্ত হওয়ার পর ৪০ দিন পর্যন্ত জাইগোট জরায়ুতে তার অবস্থান দৃঢ় করতে থাকে।

পরবর্তী ৪০ দিনে জাইগোট লার্ভা বা ভ্রূণে পরিণত হয়, যা দেখতে গাঢ় জমাটবাঁধা রক্তের মতো। একে গাঢ় রক্তে পরিণত হওয়ার স্তর বলে। রক্তের পরিবর্তন হঠাৎ করে হয় না, বরং ধীরে ধীরে তার অবস্থা গাঢ় হতে থাকে। শুক্রাণু লাল আকার ধারণ করতে থাকে, এক পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ জমাট রক্তে পরিণত হয়। জমাট রক্তে পরিণত হওয়া ভ্রূণটি দেখতে জোঁকের মতো। একে ‘আলাক্বা’ বলার কারণ হলো এটি জরায়ুর সাথে লেগে থাকে।

অতঃপর দিন বৃদ্ধির সাথে সাথে ভ্রূণের ঘনত্ব ও গাঢ়ত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তী ৪০ দিনে ভ্রূণটি চর্বিত গোশতপিণ্ডের আকৃতি ধারণ করে। এভাবে ধীরে ধীরে ভ্রূণটির গঠনের এ পর্যায়ে পৌঁছাতে ১২০ দিন সময় লাগে। এ ধারাবাহিকতার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُضْغَةٍ مُخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ﴾ ‘আমি তোমাদেরকে মৃত্তিকা, এরপর শুক্রাণু, তারপর জমাট রক্ত এবং এরপর পূর্ণ ও অপূর্ণ আকৃতিবিশিষ্ট গোশতপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করেছি’ (আল-হাজ্জ, ২২/৫)

অতঃপর সে চতুর্থ পর্যায়ে পৌঁছালে আল্লাহ তাআলা তার নিকট একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। অতঃপর তার মধ্যে আত্মার সঞ্চার করা হয় এবং সে জীবন্ত রূপ লাভ করে। ফলে সে নড়াচড়া করতে পারে এবং তার মধ্যে ব্যথার অনুভূতি তৈরি হয়।

হাদীছে বর্ণিত ভ্রূণের গঠনগত চিত্রের সাথে কুরআনের বর্ণনার মিল রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি মানুষকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। অতঃপর শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে চর্বিত গোশতে পরিণত করেছি। এরপর সেই গোশতপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি। অতঃপর হাড়গুলোকে গোশত দিয়ে ঢেকে দিয়েছি। অতঃপর নতুন সৃষ্টিরূপে দাঁড় করেছি। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা কতইনা বরকতময়!’ (আল-মুমিনূ, ২৩/১২-১৪)

সুধী পাঠক! ‘হও’ নামক নির্দেশজ্ঞাপক শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহ তাআলা মানুষকে এক মুহূর্তে সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু পর্যায়ক্রমে সৃষ্টির পেছনে হিকমত হলো, যেকোনো কাজে ধীরস্থিরতা অবলম্বনের ইলাহী প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং যেকোনো কাজের ফলাফলের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো না করা। তাছাড়া কারণ ও ফলাফলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রক্ষা এবং মহাবিশ্বের নিয়ম-শৃঙ্খলার অমোঘ ধারা বিবেচনায় রাখা।

রূহ বা আত্মা হলো একটি রহস্যময় সত্তা, যার বাহ্যিক অবস্থা সম্পর্কে মানুষকে জানানো হয়নি। রূহ-এর পরিচয় সম্পর্কে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রশ্ন করা হলে আল্লাহ তাআলা উত্তর দেন। তিনি বলেন, ‘হে রাসূল! লোকেরা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলুন, রূহ হলো আল্লাহ তাআলার বিষয়’ (আল-ইসরা, ১৭/৮৫)। আর রূহকে আল্লাহ তাআলার বিষয় বলে প্রশ্নকর্তাকে ধমক দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সামান্য পরিমাণ জ্ঞান নিয়ে রূহের মতো রহস্যময় বিষয় সম্পর্কে কেন প্রশ্ন করো? এই জন্যই খিযির আলাইহিস সালাম মূসা আলাইহিস সালাম-কে বলেছিলেন, আমার ও আপনার জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় অতটুকু, যতটুকু পানি একটি চড়ুই পাখি সমুদ্র থেকে পান করে। সমুদ্রের পানির তুলনায় পাখিটির পানকৃত পানির পরিমাণ যেমন যৎসামান্য, তেমনি আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় মানুষের জ্ঞান যৎসামান্য।[3]

ফেরেশতাকে যে চারটি বিষয় লিখার আদেশ দেওয়া হবে, সেগুলো হলো— জীবিকা, আয়ুষ্কাল, আমল ও ভাগ্যবান বা হতভাগ্য হওয়া। এখানে লিখার আদেশদাতা আল্লাহ তাআলা।

মানুষ যা ভোগ করে, তাই রিযিক্ব। রিযিক্ব দুই প্রকার। এক প্রকার- যার মাধ্যমে মানুষের দেহ টিকে থাকে। আর আরেক প্রকার- যার মাধ্যমে মানুষের নৈতিক আদর্শ বজায় থাকে। যে রিযিক্বের মাধ্যমে মানুষের শরীর টিকে থাকে, তা হলো— খাদ্য, পানীয়, পোশাক, আবাসভবন, যানবহন ইত্যাদি। যে রিযিক্বের মাধ্যমে তার দ্বীনী আদর্শ বজায় থাকে, সেটা তার জ্ঞান ও ঈমান। উভয় রিযিক্বই এই হাদীছে উদ্দেশ্য।[4]

আয়ুষ্কাল বলতে দুনিয়ায় তার অবস্থানের সময়সীমা। দুনিয়ায় মানুষের অবস্থানের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। কারও মৃত্যু হয় জন্মের সময় আর কেউ ১০০ বছর বা তারচেয়েও বেশি সময় বেঁচে থাকে। আমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যে এমন অনেক উম্মত ছিল, যারা দীর্ঘকাল বয়স পেত। যেমন নূহ আলাইহিস সালাম ৯৫০ বছর বেঁচেছেন।[5]

আয়ুষ্কালের দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত হওয়া মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়। কেননা, অনেক সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এমন বয়সে মানুষের মৃত্যু হয়, যখন সে শারীরিকভাবে শক্তিশালি থাকে। তার রূপলাবণ্য এবং জৌলুস তখনও বিদ্যমান থাকে। কিন্তু আয়ুষ্কাল আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। এটিকে এক মুহূর্ত এগিয়ে আনা বা পেছানো সম্ভব নয়। আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার সাথে সাথে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে।[6]

এখানে ফরিদ নামক এক ব্যক্তির দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য। মোটরসাইকেলে রাস্তা পার হওয়ার সময় তার সামনে দিয়ে একজন কারচালক যাচ্ছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে তারা একে অপরের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে তারা একসাথে চলা শুরু করে। কারটি মোটরসাইকেল চালককে চাপা দিলে চালক ও তার পেছনের আরোহী উভয়ে মারা যায়। এখন ভেবে দেখুন! তাদের দুর্ঘটনা ঘটার কারণ হলো তারা তাদের আয়ুষ্কাল পূর্ণ করে ফেলেছিল অর্থাৎ তাদের মৃত্যুর সময় এসে গিয়েছিল। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর নির্ধারিত সময় এসে যাবে, তখন আল্লাহ তাকে অবকাশ দেবেন না’ (আল-মুনাফেকূন, ৬৩/১১)[7] আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি তার রিযিক্ব সম্পূর্ণ ভোগ না করে মারা যাবে না’।[8]

এখানে একটি জিজ্ঞাসা হলো, আয়ুষ্কাল কি উত্তরাধিকার সূত্রে নির্ধারিত? না, আয়ুষ্কাল উত্তরাধিকার সূত্রে নির্ধারিত নয়। এমন অনেক মানুষ আছে, যারা যৌবনে মারা গেছে অথচ তাদের পূর্বপুরুষগণ দীর্ঘকাল বেঁচেছেন। আবার এমন অনেক যুবক আছে, যারা দীর্ঘ জীবন পেয়েছে অথচ তাদের পূর্ব পুরুষের আয়ুষ্কাল সংক্ষিপ্ত ছিল।[9]

তার আমল বলতে সেসব কাজকে বোঝায়, যেগুলোর স্বীকৃতি সে অন্তরে দেয়, মুখে উচ্চারণ করে ও বাস্তব জীবনে আদায় করে। তার আমল আনুযায়ী প্রতিদান দেওয়া হবে। সে ভাগ্যবান হবে নাকি হতভাগ্য হবে— তার ফয়সালা দেওয়া হবে। ভাগ্যবান ঐ ব্যক্তি, যে আনন্দ করার সুযোগ পাবে আর হতভাগা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যেদিন আসবে সেদিন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। অতঃপর কিছু লোক হতভাগা হবে আর কিছু লোক হবে সৌভাগ্যবান। অতএব, যারা হতভাগা তারা দোযখে যাবে, সেখানে তারা চিৎকার ও আর্তনাদ করতে থাকবে। তারা সেখানে অনন্তকাল থাকবে, যতদিন আকাশ ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক অন্য কিছু ইচ্ছা করলে ভিন্ন কথা। নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন, তা করেন। আর যারা সৌভাগ্যবান, তারা বেহেশতে থাকবে। তারা সেখানেই অনন্তকাল থাকবে, যতকাল আকাশ ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক অন্য কিছু করলে সেটা ভিন্ন কথা। এ হবে অফুরন্ত অনুদান’ (আল-হূদ, ১১/৫-৮)। ফলাফল যখন চূড়ান্ত হবে, তখন হয় ভাগ্যবান, না হয় হতভাগা হবে। আমরা আল্লাহ তাআলার নিকট চাই, তিনি যেন আমাদেরকে ভাগ্যবানদের তালিকাভুক্ত করেন।

আল্লাহর শপথ! ‘তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই’। এটি তাওহীদে বিশ্বাসের একটি নির্দিষ্ট শপথ। এর মাধ্যমে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য উপাস্য নেই; যদিও আল্লাহ ব্যতীত উপাস্য রয়েছে, কিন্তু তারা প্রকৃতপক্ষে উপাস্য নয়। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তবে কি আমি ব্যতীত তাদের এমন উপাস্য আছে, যারা তাদের রক্ষা করবে? তারা তো নিজেদেরকেই সাহায্য করতে সক্ষম নয় এবং আমার মোকাবিলায় তারা সাহায্যকারীও পাবে না’ (আল-আম্বিয়া, ২১/৪৩)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘এটাই প্রমাণ যে, আল্লাহই সত্য এবং তিনি ব্যতীত তারা যাদের পূজা করে, সব মিথ্যা। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বোচ্চ, মহান’ (লুক্বমান, ৩১/৩০)

তোমাদের কেউ তার ও তার আমলের মধ্যে এক হাত পরিমাণ ব্যবধান থাকা পর্যন্ত জান্নাতের আমল করতে থাকে অর্থাৎ তার আয়ুষ্কালের চূড়ান্ত সময় ঘনিয়ে আসা পর্যন্ত উক্ত আমল করতে থাকে। এর অর্থ তার ও আমলের মধ্যে দূরত্ব উদ্দেশ্য নয়। কারণ, সে যে কাজ করছে তা বাহ্যিকভাবে ভালো মনে হলেও বাস্তবে ভালো নয়। যেমনটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তোমাদের মধ্যে কেউ এমন কাজ করে যা মানুষের কাছে মনে হয় সে জান্নাতবাসীদের কাজ করছে; অথচ সে জাহান্নামবাসীদের অন্তর্ভুক্ত। এই বিষয়টি কিছু লোকের নিকট প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। আর যদি সে জান্নাতবাসীদের কাজ করতে থাকে এবং জান্নাত থেকে এক হাত পরিমাণ ব্যবধানে থাকে, তবে এমতাবস্থায় তার উপর আল্লাহর অবধারিত সিদ্ধান্ত কীভাবে কার্যকর হবে এবং সে কীভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে?[10]

আমরা বলি, বাহ্যিকভাবে প্রতীয়মান হবে সে জান্নাতবাসীদের কাজ করছে আর তার বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত এখনোও নির্ধারিত হয়নি। এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে এক হাত পরিমাণ ব্যবধান থাকবে অর্থাৎ তার মৃত্যুর সময়সীমা ঘনিয়ে আসবে। অতঃপর তার উপর আল্লাহর অবধারিত সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। ফলে সে জাহান্নামীদের আমল করবে এবং পূর্বে যে আমল করত তা ছেড়ে দেবে। অন্তরে কলুষতা থাকার কারণে সে এমনটি করবে এবং জাহান্নামে যাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ অবস্থা থেকে রক্ষা করুন!

উক্ত ব্যাখ্যা বর্ণনার কারণ হলো, কেউ যেন আল্লাহ সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ না করে যে, আল্লাহ তাআলা মানুষের উপর অবিচার করেন। আল্লাহর কসম! কেউ আন্তরিকভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করলে এবং জান্নাতবাসীদের কাজ করলে আল্লাহ কখনোই তাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার উপর অধিক দয়ালু কিন্তু তার মনের কলুষতা তার জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে।

এখানে ঐ ব্যক্তির ঘটনা স্মরণযোগ্য, যিনি এক যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলেন। তিনি এত সাহসী ছিলেন যে, এমন কোনো শত্রু ছিল না যার মূলোৎপাটন তিনি করেননি। লোকেরা তাকে দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন, এ তো ঐ ব্যক্তি, যে যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জাহান্নামী। ঘটনাটি ছাহাবীদের জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল। তাদের প্রশ্ন ছিল, এমন একজন ব্যক্তি কীভাবে জাহান্নামী হতে পারে?

(আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভবিষ্যদ্বাণীর ফলাফল সম্পর্কে জানার জন্য) এক ব্যক্তি তার পিছু অনুসরণ করলেন। তিনি দেখলেন, শত্রুর তিরের আঘাতে সাহসী লোকটি কাতর হয়ে পড়েছেন। তিনি কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তলোয়ারের ধারালো অংশ বুকে এবং হাতল মাটিতে রেখে তরবারির উপর চাপ দিয়ে নিজেকে হত্যা করলেন। এ ঘটনার পর লোকটি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,

আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কীভাবে (আমার রিসালাতের সত্যতা সম্পর্কে) জানলে? তখন তিনি বললেন, আপনি যে লোকটিকে জাহান্নামী বলে অভিহিত করেছেন, তার দ্বারা এমন এমন কাজ (আত্মহত্যা করা) সংঘটিত হয়েছে। অতঃপর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ব্যক্তি এমন আমল করে, যা দেখে মানুষ মনে করে সে জান্নাতী কিন্তু বাস্তবে সে জাহান্নামী’ (ছহীহ বুখারী, হা/২৮২৯)

এখানে আমরা ইবনু উক্বাইশের ঘটনা স্মরণযোগ্য। তিনি ইসলামের দাওয়াতকে ঘৃণ্য কাজ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু যখন লোকেরা উহুদের যুদ্ধে বের হয়েছিল, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর অন্তরে ঈমান ঢেলে দিয়েছিলেন। ফলে তিনি ঈমান এনেছিলেন এবং জিহাদে অংশগ্রহণ করে শহীদ হয়েছিলেন। যুদ্ধের পর লোকেরা তাদের মৃত ব্যক্তিদের খোঁজ নিতে এসেছিলেন। তারা লোকটিকে দেখতে পেয়ে বলেছিলেন, হে আগন্তুক! আপনি কি আপনার লোকদের খোঁজে এসেছেন, না-কি ইসলামের প্রতি আগ্রহের কারণে এসেছেন? তিনি বলেছিলেন, না; বরং ইসলামের আকাঙ্ক্ষার জন্য। অতঃপর তিনি তাদেরকে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট তার সালাম পৌঁছে দিতে বললেন। তাঁর শেষ পরিণতি এমন ছিল যে, তিনি শহীদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, যদিও তিনি ইসলামী দাওয়াতের চরম শত্রু ছিলেন (আবূ দাঊদ, হা/২৫৩৭)

মানবসৃষ্টির ইতিহাস, তার জীবিকা, আয়ুষ্কাল, আমল এবং ভাগ্যবান হওয়া বা না হওয়া সম্পর্কে রাসূল ‍ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ধারাবাহিক নিখুঁত বর্ণনা রিসালাতের প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে গভীর করে। আল্লাহ তাআলার প্রতি আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ও অটল ভরসা অর্জনে সহায়ক হয়। আল্লাহর রাসূল a-এর প্রতি গভীর আনুগত্য এবং আল্লাহ তাআলার উপর দৃঢ় বিশ্বাস অর্জনে অদৃশ্য জগতের বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। অদৃশ্য জগতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন ইহকাল ও পরকালে সাফল্য অর্জনে আল্লাহ তাআলা আমাদের সহায় হউন- আমীন!


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২০৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৪৩; মিশকাত, হা/৮২।

[2]. ছালেহ আল-উছায়মীন, কিতাবু শারহিল আরবাঈন আন-নাবাবিয়্যাহ, পৃ. ৮৪।

[3]. ছালেহ আল-উছায়মীন, কিতাবু শারহিল আরবাঈন আন-নাবাবিয়্যাহ, পৃ. ৮৫।

[4]. প্রাগুক্ত।

[5]. প্রাগুক্ত।

[6]. ছালেহ আল-উছায়মীন, কিতাবু শারহিল আরবাঈন আন-নাবাবিয়্যাহ, পৃ. ৮৬।

[7]. প্রাগুক্ত।

[8]. ইবনু মাজাহ, হা/২১৪৪।

[9]. ছালেহ আল-উছায়মীন, কিতাবু শারহিল আরবাঈন আন-নাবাবিয়্যাহ, পৃ. ৮৬।

[10]. ছালেহ আল-উছায়মীন, কিতাবু শারহিল আরবাঈন আন-নাবাবিয়্যাহ, পৃ. ৮৭।

Magazine