কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তিই একজন মুমিনের সাফল্যের সোপান!

عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضي الله عنهما قَالَ أَخَذَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمنْكبيَّ فَقَالَ كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيْبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيْلٍ وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ رضي الله عنهما يَقُوْلُ إِذَا أَمْسَيْتَ فَلا تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلا تَنْتَظِرِ المَسَاءَ وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لمَوْتِكَ. *

সরল অনুবাদ : ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাঁধ ধরে বললেন, ‘দুনিয়ায় তুমি এমন হও, যেন তুমি অপরিচিত ব্যক্তি অথবা পথিক’। আর ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলতেন, যখন তুমি সন্ধ্যা করবে, তখন সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার অপেক্ষা করো না। আর যখন সকাল করবে, তখন সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকার অপেক্ষা করো না। আর তোমার সুস্থ সময়ে অসুস্থ সময়ের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করো এবং তোমার জীবনকে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের (প্রস্তুতির) জন্য গ্রহণ করো।[1]

হাদীছটির অবস্থান : ইবনু দাক্বীক আল-ঈদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কল্যাণের সকল অর্থ ও মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার সকল উপাদান হাদীছটিতে বিদ্যমান।[2]

আল্লামা মুনাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, দুনিয়াসক্ত না হওয়া এবং দুনিয়াকে স্থায়ী বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ না করার ক্ষেত্রে এটি একটি মৌলিক হাদীছ; বরং পরকালীন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ভ্রমণের জন্য এক অনুপম প্রেরণা দেওয়া হয়েছে এই হাদীছে।[3]

জুরদানী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, দুনিয়াবী চাহিদা সংক্ষিপ্ত করার ক্ষেত্রে এটি একটি মৌলিক হাদীছ। এখানে দুনিয়ার চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং পরকালের বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে আদেশ করা হয়েছে।[4]

 ইবনু হাজার হাইতামী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং ব্যাপক উপকারিতা সমৃদ্ধ একটি হাদীছ এটি। এটি সকল কল্যাণকে ধারণ করে এবং সব ধরনের উপদেশ অন্তর্ভুক্ত করে।

এর শব্দের দিকে লক্ষ্য করুন— শব্দগুলো কত সুন্দর! কত আকর্ষণীয়! বরকতের দিক থেকে কত মহিমময়! কল্যাণকর গুণাবলিকে অন্তর্ভুক্তকরণের ক্ষেত্রে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ! সুস্থতার সময় এবং জীবিত থাকা অবস্থায় সৎকর্ম সম্পাদনে উৎসাহ প্রদানে হাদীছটি কতটা অর্থবহ![5]

আল্লামা শানফী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি হাদীছ। সকল কল্যাণের বর্ণনা এখানে স্থান পেয়েছে। উপদেশ গ্রহণ করতে চায় এমন ব্যক্তির জন্য হাদীছটিকে নছীহা ও উপদেশমূলক শব্দ দিয়ে শুরু করা হয়েছে। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের প্রত্যেকের প্রতি কল্যাণ পৌঁছানোর জন্য উৎসাহিত করেছেন। কেননা, এই বাণী কেবল উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে কল্যাণের প্রতি উৎসাহিত করে না; বরং সকলকে কল্যাণের প্রতি উৎসাহিত করে।[6]

আল্লামা তুফী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, দুনিয়াসক্ত হওয়া থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি মৌলিক হাদীছ। দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হওয়া, দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে করা এবং সামান্য সন্তুষ্ট থাকার ক্ষেত্রে এটি অমিয় বাণী।[7]

হাদীছটির ব্যাখ্যা : পৃথিবীর বাস্তবতা সম্পর্কে ভাবলে বোঝা যায়, এটি বসবাসের বা শান্তিপূর্ণ জীবন ধারণের কোনো নিরাপদ স্থান নয়। যদিও এর বাহ্যিক সৌন্দর্য, নয়নাভিরাম দৃশ্য, সবুজে ঘেরা চমত্কার শোভা, মনমাতানো রূপ আমাদের সাময়িকভাবে মোহিত করে। এর প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য আমাদের ক্ষণিকের জন্য মুগ্ধ করে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এটি ধ্বংসশীল। এর কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। এর সকল উপভোগ্য বস্তু ক্ষয়িষ্ণু। এর সকল রূপ আর ঐশ্বর্য বিলীন হওয়ার জন্য। এর দৃষ্টান্ত ঐ ফুলের ন্যায়, যেটি খুব উজ্জ্বল এবং চমত্কার দেখায়। ফুলের তাত্ক্ষণিক দৃশ্য সবার নিকট খুব উপভোগ্য মনে হয়। এটি সাময়িকের জন্য সবাইকে মুগ্ধ করে। কিন্তু তা বেশি সময় স্থায়ী হয় না; বরং আস্তে আস্তে মলিন হয়ে যায় এবং এর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়।

এটা সেই দুনিয়া, যার ধোঁকায় পড়ে মানুষ ভুল পথে হাঁটছে, যে দুনিয়া তাকে আখেরাত থেকে ভুলিয়ে রেখেছে। ফলে মানুষ একে আপন জন্মভূমি এবং স্থায়ী বসবাসের একমাত্র আবাসস্থল হিসেবে গ্রহণ করেছে। মানুষ এর গোলকধাঁধা ও চাকচিক্যের বেড়াজালে ঘুরপাক খাচ্ছে। একে না পাওয়ার বেদনায় মর্মাহত হয়ে সে হাঁপাচ্ছে। অথচ এখানকার কোনো জীবনই সুখের নয়। এখানে কোনো আনন্দই মধুর হয় না। এমন সময় হঠাৎ যখন তার মৃত্যু এসে যায়, তখন তার নিকট দুনিয়ার বাস্তব রূপ প্রতীয়মান হয়। স্পষ্ট হয়ে যায়, আসলে সে এতদিন মরীচিকার পেছনে ছুটেছে। আলেয়ার পিছনে হন্যে হয়ে ঘুরে ফিরেছে, যার কোনো বাস্তবতা নাই। আল্লাহ তাআলা যথার্থই বলেছেন, ‘দুনিয়া ধোঁকার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়’ (আলে ইমরান, ৩/১৮৫)

দুনিয়ায় একজন মুসলিমের জীবনধারা কেমন হবে, সে সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদের অবহিত করেছেন। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে তাদের জীবনপদ্ধতি, তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও আদর্শ কী বা কেমন হবে, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত করেছেন। তাদের জন্য কল্যাণকর কোনো উপদেশ দিতে তিনি ভুলেননি। পরকালীন জীবনের পাথেয় সংগ্রহের সহায়ক কোনো নির্দেশনা তাদের প্রদান হতে বিরত থাকেননি। তাদের জন্য শোভা পায় না এমন অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক করতে তিনি ছাড়েননি। তিনি তাদের দুনিয়ার প্রতি মোহাচ্ছন্ন হতে নিষেধ করেছেন। কাঙ্ক্ষিত পথনির্দেশনার জন্য আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত ছিলেন তিনি। মানবতার মুক্তির জন্য তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত কল্যাণকামী। তিনি অবিরাম উপদেশ দিয়ে গেছেন। তিনি প্রত্যেকটি বস্তুকে দৃষ্টান্ত দিয়ে জীবন্ত করে তাদের নিকট পেশ করেছেন। তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও চিরন্তন উপদেশের অন্যতম উল্লিখিত হাদীছসহ নিম্নের হাদীছটি। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দুনিয়ায় আমার দৃষ্টান্ত ঐ ভ্রমণকারীর ন্যায়, যে একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিয়েছে। অতঃপর সে স্থানটি ছেড়ে চলে গেছে’।[8]

আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা-কে উপদেশ দেওয়ার সময় তার কাঁধ ধরে ছিলেন, যাতে করে উপদেশের প্রতি তার অনুভূতি জাগ্রত থাকে। তার চিন্তন জগতে একাগ্রতা সৃষ্টি হয়। তাঁর বাণী যেন তার আবেগ-অনুভূতিতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। উপদেশের বাক্যগুলো যাতে তার হৃদয়ে স্থায়িত্ব লাভ করে। যেমন- দুনিয়ায় এমন হও যেন তুমি অপরিচিত ব্যক্তি অথবা পথিক! চরম আবেগময় এবং অত্যন্ত আবেদনময় একটি অসাধারণ বাক্য।

এই দুনিয়ায় একজন মুমিনকে অপরিচিত ব্যক্তি বা পথিকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কেননা একজন অপরিচিত ব্যক্তি দুনিয়ার কোনো বিষয়কে নিয়ে ভাবে না। কোনো শহরে অবস্থানকালে সে কারও সাথে পরিচিত হতে চায় না। অপরিচিত স্থানে ভিন্ন পোশাকে অবস্থান তাকে বিচলিত করে না; বরং সর্বদা তার মাথায় ঐ আবাসভূমির চিন্তা থাকে যেখানে সে যেতে চায়।[9] আর পথিক যতক্ষণ না গন্তব্যে পৌঁছে সর্বদা চলতেই থাকে। পরকালে স্থায়ী বাসস্থানের চিন্তা তাকে তাড়িত করে। দুনিয়ার সামান্য প্রাপ্তিতে সে সন্তুষ্ট থাকে।

এই হাদীছে একজন মুমিনকে দুনিয়াতে অপরিচিত পথিক বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যা তাকে দ্বীনের বিধান পালনে উৎসাহিত করে। আল্লাহ তাআলার বিধানকে স্থায়ীভাবে ধারণ করতে অনুপ্রাণিত করে। জীবন চলার প্রতিটি মুহূর্তে সে দৃঢ়তার পন্থা অবলম্বন করে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহর আইনের বাস্তবায়নই হয় তার একমাত্র কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন। এমনকি বিপথগামী মানবতা অথবা পাপের পথে ধাবমান ব্যক্তিকে হেদায়েতের পথ দেখানোই তার একমাত্র মিশন হয়ে যায়। এমন ব্যক্তিকে পথ দেখানোর অবিরাম চেষ্টায় সে লেগে থাকে। সে এমন পন্থা অবলম্বন করে, যা তার অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে সহায়ক হয়। মানুষের দুর্নাম অথবা দুনিয়ার জীবনের সাময়িক সুখ অথবা আনন্দ তাকে প্রভাবিত করে না। আর গরীব বা অপরিচিত পথিকের বাস্তব চিত্র তো এটাই, যার প্রতি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নের বাণীতে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অপরিচিত অবস্থায় ইসলামের সূচনা হয়েছিল। শীঘ্রই ইসলাম পুনরায় সে অবস্থায় ফিরে যাবে, যে অবস্থায় তার সূচনা হয়েছিল। কাজেই এইরূপ অপরিচিত পথিকের জন্য শুভ সংবাদ’।[10]

যখন কোনো মুসলিম দ্বীনের উপর অটল থাকার চেষ্টা করে, তখন তাক্বওয়াহীন বা দ্বীনের ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যক্তির মিশ্রণ থেকে নিজেকে দূরে রাখে। ফলে তার সাথে মেলামেশার কোনো খারাপ আচরণের অনুপ্রবেশ তার মধ্যে ঘটে না। আর এ জাতীয় অন্যান্য আচরণ; যেমন— হিংসা, বিদ্বেষ, পরনিন্দা, খারাপ ধারণা পোষণ ইত্যাদি নিন্দনীয় আচরণ থেকে সে নিজেকে হেফাযত করতে পারে, যার সম্পর্কে শরীআত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বা সতর্ক করেছে।

উল্লিখিত আলোচনা থেকে এ কথা বোঝা যায় না যে, মানুষের সংস্পর্শে আসা সামগ্রিকভাবে নিন্দনীয় অথবা মানুষ থেকে দূরত্ব বজায় কিংবা তাদের মিশ্রণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা মৌলিক কোনো আদর্শের বিষয়। কেননা এটি শরীআতের ওই মূলনীতির বিরোধী, যেখানে মানুষের সাথে মেশার এবং তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আহ্বান করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয় আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও নারী হতে এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে করে তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পারো’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১৩)। আর হাদীছে এসেছে, ‘কোনো মুসলিম যখন মানুষের সাথে মিশে এবং তাদের খারাপ আচরণে ধৈর্যধারণ করে, সে ওই মুসলিমের চাইতে উত্তম, যে মানুষের সাথে মিশে না এবং তাদের খারাপ ব্যবহারে ধৈর্যধারণ করে না’।[11] আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন তো আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। তিনি মানুষের সাথে মিশেছেন এবং তাদের কর্কশ আচরণে ধৈর্যধারণ করেছেন। তিনি কখনই নিজেকে তাদের থেকে আড়াল করে রাখেননি।

তবে মেলামেশার ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, একজন মানুষ অবশ্যই এমন সব লোকের সংশ্রব বা উঠাবসা থেকে বিরত থাকবে, যারা তার দ্বীনের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে অথবা এই কারণে সে পরকাল থেকে বিমুখ হয়ে যেতে পারে। আর এর বিপরীতে যদি কারো সাথে মেলামেশার কারণে আল্লাহর যিকিরের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়, পরকালের কথা স্মরণ হয় এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়, তাহলে এই জাতীয় মেলামেশা অবশ্যই প্রশংসনীয়।

আমরা আবার আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী, ‘অপরিচিত অথবা পথিক হও’-এর দিকে ফিরে আসি। এখানে মুমিনের অপরিচিত থেকে পথিককে ফিরে আসার কথা বলা হয়েছে। পথিক বাহন ব্যবহার এবং গন্তব্যে পৌঁছার জন্য যতটুকু পাথেয় প্রয়োজন মনে করে, শুধু ততটুকু নেয়। তার চেয়ে অতিরিক্ত পাথেয় সঙ্গে নেয় না। সে কোনো জায়গায় অবস্থান করে না। সে গন্তব্যে পৌঁছার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা অথবা ব্যস্ততাকে বাধা মনে করে না; বরং জন্মভূমি কিংবা আবাস ভূমিতে পৌঁছা পর্যন্ত সে অবিরাম গতিতে চলতে থাকে।

ইমাম আবূ দাঊদ আত্ব-ত্বয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, রাত এবং দিন মানুষের জীবন পরিক্রমার দুটি পর্যায়। এই পর্যায়গুলোতে মানুষ একটা একটা করে স্তর পার হয় আর সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এইভাবে যখন সে ভ্রমণের সর্বশেষ প্রান্তে পৌঁছে যাবে, তখন রাত-দিনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। যদি আমরা প্রত্যেকটি পদক্ষেপে পরকালের জন্য পাথেয় পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হই, তবে সেটা করতে হবে। কারণ এটাই আমাদের জন্য একমাত্র কল্যাণকর নির্দেশনা। কেননা আমাদের এই ভ্রমণের পথযাত্রা শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। আর আমরা যা ভাবছি, তা (কিয়ামত) তার চেয়ে আরও সন্নিকটে। সুতরাং আমাদের ভ্রমণের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করে নিতে হবে। আর আমাদের যে কাজগুলো করার সেগুলো এক্ষুনি করে ফেলতে হবে।

মুমিন তো এমনই হয়ে থাকে, যে আনুগত্যের মাধ্যমে তার প্রতিপালকের অনুগামী হয়। রবের সন্তুষ্টির জন্য সে তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য সময় ও চিন্তা-চেতনা ব্যয় করে। দুনিয়ার কোনো সমস্যাই তাকে পরকালের প্রস্তুতি সম্পর্কে অসচেতন করতে পারে না। দুনিয়ায় সে নিজেকে বাহনের উপর আরোহিত অপরিচিত পথিক মনে করে। সুতরাং দুনিয়া তার নিকট পরকালে উপনীত হওয়ার জন্য একটি বাহন মাত্র। সে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করে। আনাস ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পরকালীন চিন্তাই হবে যার একমাত্র চিন্তা, আল্লাহ তাআলা তার হৃদয়কে অভাবমুক্ত করে দিবেন। তার জন্য সবকিছুর ব্যবস্থা তিনি করবেন। তার নিকট দুনিয়া হামলিয়ে পড়বে কিন্তু সে দুনিয়া বিমুখ হবে’।[12]

উল্লিখিত ব্যাখ্যাই আলোচ্য হাদীছের প্রকৃত মর্মার্থ, যা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা -কে উপদেশ দেওয়ার সময় বলেছিলেন। আর এই মর্মার্থই ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এর স্পষ্ট প্রমাণ তার জীবনধারায় প্রতীয়মান হয়। 

তিনি কখনো দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হননি কিংবা মনোনিবেশ করেননি; বরং তিনি সময়ের সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই সজাগ ছিলেন। যেমনটা আমরা তার চিরন্তন উপদেশ থেকে জানতে পারি। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন সন্ধ্যা কর, তখন সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার অপেক্ষা করো না আর যখন সকাল কর, তখন সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকার অপেক্ষা করো না। আর তোমার সুস্থতার সময়কে (কাজে লাগিয়ে) অসুস্থতার সময়ের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করে নাও। আর জীবন থেকে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের (প্রস্তুতির) জন্য কিছু সময় নির্ধারণ করে নাও’।

সুন্দর জীবন, আদর্শ পরিবার এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে আলোচ্য হাদীছটির গুরত্ব অপরিসীম। একটি জাতিকে আদর্শ ও শান্তিপূর্ণ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে উক্ত হাদীছের কোনো বিকল্প নেই। এটি এমন একটি মৌলিক হাদীছ, যেটি মানুষকে দুনিয়া সম্পর্কে এমনভাবে সতর্ক করে যে, সে কখনই অর্থ উপার্জনের পেছনে ছুটবে না। দুনিয়া লাভের আশায় হাহাকার করবে না; বরং সে মনে করবে এই দুনিয়ায় সে একজন আগন্তুক। সাময়িক সময়ের জন্য এখানে তার আগমন। এক সময় এই জায়গা তাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। কাজেই এই অস্থায়ী জায়গায় ভালো কিছু পাবার, ভালো কিছু দেখবার, ভালো কিছু ভোগ করার প্রত্যাশা সে করবে না; বরং সে যা পাবে তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে এবং পরকালীন জীবনের জন্য এই দুনিয়াকে প্রস্তুতির ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে এই হাদীছের শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করার এবং এর আলোকে জীবনযাপন করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!


মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল

প্রভাষক (আরবি), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, বরিশাল।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১৬।

[2]. ইবনু দাক্বীকুল ঈদ, শারহুল আরবাঈন, পৃ. ১২৬।

[3]. ফায়যুল ক্বাদীর, ৫/৬৭।

[4]. জাওয়াহিরুল লুলুইয়্যাহ শারহুল আরবাঈন আন-নাবাবিয়্যাহ, পৃ. ৩৬৩।

[5]. ফাতহুল মুবীন, পৃ. ২৪৮।

[6]. মাজালিসুস সুন্নিয়্যাহ, পৃ. ২৫৬।

[7]. আত-তাআঈন, শারহুল আরবাইন আত-তুফী, পৃ. ৩২৯।

[8]. সুনানে তিরমিযী, হা/২৩৫৩।

[9]. ইবনু হুবাইরা, আল-ইফসহাই, ৪/২৪৭।

[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৫; ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৮৬।

[11]. ছহীহুল জামে‘, হা/৬৬৫১; ইবনু মাজাহ, হা/৪০৩২।

[12]. তিরমিযী, হা/২৪৬৫।

Magazine