কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কুরআন তেলাওয়াত : সার্বিক কল্যাণ লাভের সর্বোত্তম উপায়

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَهُ أَجْرَانِ.

সরল অনুবাদ : আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কুরআন* অধ্যয়নে পারদর্শী ব্যক্তি মর্যাদাবান লিপিকার ফেরেশতাগণের সাথী হবে। আর যে কষ্ট করে কুরআন পাঠ করে, সে দু’টি পুরস্কার পাবে— একটি আবৃত্তির জন্য এবং অন্যটি কষ্টের জন্য’।[1]

ব্যাখ্যা : মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের বিচারে আল-কুরআন অতুলনীয়। এর চমত্কার ভাষা, অতুলনীয় রচনাশৈলী, অপূর্ব শব্দচয়ন, জাদুকরী ঝংকার, অলৌকিক বাক্যগঠন, মর্মস্পর্শী ভাব, অভাবনীয় সম্মোহনী শক্তি প্রত্যেককে আকৃষ্ট করে। সত্যপথের দিশা, আদর্শ জীবন গঠন, উত্তম চরিত্রসমৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় আল-কুরআন হচ্ছে আলোকবর্তিকা ও নির্দেশনাস্বরূপ। আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠ বাণী ও উত্তম বর্ণনা হচ্ছে এই আল-কুরআন। তিনি বলেন,إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا كَبِيرًا ‘নিশ্চয়ই এ কুরআন সেই পথ দেখায়, যা সোজা ও সুপ্রতিষ্ঠিত। আর যারা সৎ কাজ করে সেই মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার’ (বনী ইসরাইল, ১৭/৯)

শরীআতের প্রধান ও মৌলিক উত্স হচ্ছে আল-কুরআন। শারঈ হুকুম-আহকাম এবং ইসলামের মৌলিক আইন-কানুনের বর্ণনা এতে রয়েছে। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য, সান্নিধ্য ও ভালোবাসা লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো কুরআনের তেলাওয়াত, অধ্যয়ন, গবেষণা ও সে অনুযায়ী আমল। আল্লাহ তাআলা বলেন,الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوب ‘তারাই ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। জেনে রেখো, আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমেই অন্তরের সত্যিকারের প্রশান্তি লাভ করা যায়’ (আর-রা, ১৩/২৮)

জীবনের যেকোনো সমস্যার সমাধান বা বিপদ থেকে মুক্তি বা উদ্ভূত সমস্যা মোকাবিলায় কুরআন হলো প্রধান উত্স। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا (হে ঈমানদারগণ!) যদি তোমরা কোনো বিষয়ে মতভেদ কর, তাহলে সেই বিষয়কে আল্লাহ এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে ফিরিয়ে দাও- যদি তোমরা আল্লাহ এবং পরকাল দিবসকে বিশ্বাস করে থাক; এটাই উত্তম এবং সুন্দরতম উপায়’ (আন-নিসা, ৪/৫৯)। অর্থাৎ কুরআনের বিধান অথবা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শের দিকে ফিরে আসো। তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁর প্রতি এবং মৃত্যুর পরে তাঁর সুন্নাতের প্রতি ফিরে আসতে হবে। আল-কুরআন অভ্রান্ত সত্যের উত্স। এটি ফেরেশতা জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যমে সরাসরি শেষ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। তাইতো এটি অদ্যাবধি সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান আছে। এখানে মিথ্যার অনুপ্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ ‘বাতিল এতে অনুপ্রবেশ করতে পারে না, না সামনে থেকে, না পিছন থেকে। এটি প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত (সত্তার) পক্ষ থেকে নাযিলকৃত’ (ফুছছিলাত, ৪১/৪২)। উল্লিখিত আয়াতগুলোতে কুরআন তেলাওয়াত এবং তদনুযায়ী আমল করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

উক্ত হাদীছ আমাদেরকে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন তেলাওয়াতের নিম্নের তিন প্রকার উপকারিতা সম্পর্কে অবহিত করে-

প্রথম উপকারিতা: কুরআন তেলাওয়াত ও মুখস্থ করা আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয়, যদিও এটি একজন মুসলিমের জন্য কষ্টকর হয়। কুরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম স্তরের মানুষ যিনি কুরআন তেলাওয়াত শিখেন ও মুখস্থ করার চেষ্টা করেন। তিনি সাধনা করতে থাকেন এমনকি এটি তার জন্য সহজ হয়ে যায়। তার উচ্চারণ অত্যন্ত চমত্কার এবং মুখস্থ খুব মযবূত হয়। তিনি ঐ সব ফেরেশতার সঙ্গী হওয়ার সুযোগ পাবেন, যাদের ব্যাপারে কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে,فِي صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ - مَّرْفُوعَةٍ مُّطَهَّرَةٍ - بِأَيْدِي سَفَرَةٍ - كِرَامٍ بَرَرَةٍ ‘এটা সংরক্ষিত আছে সম্মানিত ছহীফায়, উন্নত ও পবিত্র ফেরেশতাদের হাতে যারা মহৎ এবং কর্তব্যপরায়ণ’ (আবাসা, ৮০/১৩-১৬)। সুতরাং যিনি দক্ষতার সাথে কুরআন পাঠ করবেন, তিনি ফেরেশতাদের সাথে থাকার সুযোগ পাবেন। কারণ আল্লাহ তার জন্য সহজ করে দিয়েছিলেন, যেমন তিনি মহৎ, ধার্মিক ফেরেশতাদের জন্য সহজ করেছিলেন। তেলাওয়াতের এই স্তর পূর্ণাঙ্গ এবং শ্রেষ্ঠ।[2] এই স্তরের পাঠক হওয়ার সক্ষমতা অর্জনের সাধনা করা প্রত্যেকের উচিত। এই স্তরের পাঠকগণ যদি কুরআনের বাহ্যিক নির্দেশনা এবং অভ্যন্তরীণ দাবির আলোকে জীবন গড়ে তোলেন, তবে তারা কিয়ামতের দিন সৎকর্মশীল সম্মানিত ফেরেশতার সাথে অবস্থানের সুযোগ পাবেন।

দ্বিতীয় স্তরের পাঠক তিনি, যিনি খুব কষ্ট করে কুরআন তেলাওয়াত করেন, উচ্চারণ করতে গিয়ে বারবার আটকে যান, তবুও তেলাওয়াত করতে থাকেন। কুরআনের ইলাহী জ্ঞান আহরণ, এতে নিহিত কল্যাণের অন্বেষণ এবং এর বিধানের আলোকে জীবনযাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার চেষ্টা অব্যাহত থাকে, এ জাতীয় পাঠকের জন্য দ্বিগুণ প্রতিদান রয়েছে। একটা হচ্ছে কুরআন পাঠের প্রতিদান, আরেকটি হচ্ছে কষ্টসাধ্য হওয়ার প্রতিদান।

এটিও আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে মানুষের জন্য একটি বড় অনুগ্রহ। সুতরাং প্রত্যেকের কুরআনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা এবং কুরআনের যা মুখস্থ করা তার জন্য সহজ হয় তা মুখস্থ করা। তাই কুরআনের অর্থ জেনে সে অনুযায়ী আমল করার প্রাণপণ চেষ্টা করাই প্রত্যেকের একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে।

দ্বিতীয় উপকারিতা: পরম দয়ালু ও অসীম করুণাময় আল্লাহ তাআলার বাণী পাঠ করে সৌভাগ্যবানদের তালিকাভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সকাল-সন্ধ্যা কুরআন পাঠ অব্যাহত রাখতে হবে। রাত-দিন সর্বদা কুরআন তেলাওয়াতে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। আল্লাহর বাণীর অর্থ জানার জন্য আমাদের জেগে উঠতে হবে। তাঁর বাণী নিয়ে গবেষণা এবং তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো রকম শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا ‘তারা কি কুরআন সম্পর্কে গবেষণা করে না, না-কি তাদের হৃদয় তালাবদ্ধ?’ (আন-নিসা, ৪/৫৯)

এক্ষেত্রে হাসান ইবনু আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তীগণ কুরআনকে রবের সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তারা তাঁর বাণী নিয়ে রাতে গবেষণা করতেন এবং দিনে এর তাৎপর্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন।[3] ইবনুল ক্বাইয়িম কাঙ্ক্ষিত তেলাওয়াতের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, গবেষণার সাথে তেলাওয়াত করা, অর্থ অনুধাবনের চেষ্টা করা এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সাধনা করা কুরআনের ঐ গবেষকের সমতুল্য যে কুরআনকে মুখস্থ করে এবং এর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, যাতে করে সে আল্লাহর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারে।[4]

কিছু আলেম এ জাতীয় গবেষককে কুরআনের ঐ দক্ষ পাঠকের তালিকাভুক্ত করেছেন, যাদের বৈশিষ্ট্যের কথা এই হাদীছে উল্লিখিত হয়েছে। আল্লামা কুরতুবী ‘আত-তিযকার ফী আফযালিল আযকার’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, যতক্ষণ না একজন মানুষ কুরআন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করবে, ততক্ষণ সে কুরআনের মাহের তথা দক্ষ পণ্ডিত হবে না। এভাবে যে সে কুরআনের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবে, অতঃপর সে আল্লাহর নিকটে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করবে এবং তার ওপর যে ফরয কর্তব্য রয়েছে, তা বুঝে আমল করার চেষ্টা করবে।[5]

তৃতীয় উপকারিতা: প্রত্যেক মুসলিমের কুরআন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং এর বিশুদ্ধ তেলাওয়াত করা অপরিহার্য। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সহযোগিতা এবং কুরআনে কারীমের আয়াত মনোযোগ সহকারে বারবার শোনার মাধ্যমে বর্তমানে এটি আরও সহজ হয়েছে। কুরআনের জ্ঞান অর্জন এবং গবেষণার জন্য যদি একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করা হয়, তবে কুরআন শেখার গুরুত্বের বিবেচনায় এটা তেমন একটা দীর্ঘ সময় নয়। এমন মনোযোগ দিতে হবে এবং বারবার তেলাওয়াত করতে হবে যেন পঠনে দৃঢ়তা এসে যায়। তেলাওয়াতে দূঢ়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পড়তে হবে; যদিও একটি পৃষ্ঠা পাঠে কয়েক ঘণ্টা অতিবাহিত করার প্রয়োজন পড়ে। এমনকি প্রয়োজন হলে কয়েক দিন অতিবাহিত করতেও পিছপা হওয়া যাবে না।

উছমান ইবনু আফফান রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীছে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই, যে নিজে আল-কুরআন শিখে এবং অন্যকে শেখায়’।[6] মুওয়াত্ত্বা ইমাম মালেকের নিকট এই সংবাদ পৌঁছেছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা সূরা আল-বাক্বারা মুখস্থ করার জন্য আট বছর সময় ব্যয় করেছিলেন।[7] বাজি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, মুখস্থ করতে দেরি হওয়ার কারণে এত দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়নি। এত দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন এই কারণে যে, যাতে তিনি এর ফরয বিধান এবং হুকুম-আহকামগুলো ভালো করে জেনে নিতে পারেন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করতে পারেন।[8] আল্লামা ইমাম বায়হাক্বী ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণনা করেন, তিনি সূরা আল-বাক্বারা ১২ বছর পড়েছেন। তারপর যখন পড়া শেষ করেছিলেন, তখন একটি উট কুরবানী করেছিলেন।[9]

দক্ষতার সাথে তেলাওয়াত করা কিংবা সাধারণভাবে তেলাওয়াত করা অথবা তেলাওয়াত করা বা না করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কুরআনের পাঠকের মর্যাদাগত অবস্থান রয়েছে। কিন্তু যিনি কুরআন তেলাওয়াত করেন, তাঁর হৃদয় যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়, তিনি যদি উন্নত চরিত্রের অধিকারী হন, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, চালচলন ও জীবনযাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে যদি তিনি সততা ও ন্যায়পরায়ণতার পরিচয় দেন, তবে বুঝতে হবে যে, তিনি কুরআনের প্রকৃত অর্থ বুঝেছেন, সে অনুযায়ী আমল করেছেন। এই শ্রেণির পাঠকের বিশাল মর্যাদা রয়েছে। কারণ তিনি মানুষকে দ্বীন শিক্ষা দেন এবং তিনি তাদেরকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করেন। তাইতো তাকে তুলনা করা হয়েছে কমলালেবুর সাথে, যা খেতে সুস্বাদু এবং যার সৌরভ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।[10]

আর যদি তার আচার-আচরণ ভালো হয়, যদি তিনি মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করেন, কিন্তু তিনি কুরআন তেলাওয়াত করেন না। তিনি মানুষের নিকট প্রশংসিত হবেন, মানুষ তাকে ভালো হিসেবে জানবে, কিন্তু তার সুনাম-সুখ্যাতি ঐভাবে ছড়িয়ে যাবে না। তাকে তুলনা করা হয়েছে খেজুরের সাথে, যার গন্ধ নেই, কিন্তু তা পুষ্টিকর, সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর ও উপকারী। তবে তার কোনো সুগন্ধ থাকে না। কেননা তিনি মানুষকে কুরআনের জ্ঞান শেখাতে পারেন না।[11]

আর যে মুনাফিক্ব কিন্তু কুরআন তেলাওয়াত করে, সে বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম ও অন্যায় কজে জড়িত। কারণ তার হৃদয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়। তাকে তুলনা করা হয়েছে তুলসী গাছের সাথে, যার গন্ধ আছে তবে স্বাদ তিতো। তেলাওয়াতের কারণে তার সুগন্ধ ছড়ায় আর সে কুরআনের যা শ্রবণ করে তাও পবিত্র। তবে তার হৃদয় অপবিত্র। তার থেকে কুরআনের যে সুগন্ধি ছড়ায় তা পবিত্র। কেননা কুরআন পবিত্র ছাড়া কিছুই ছড়ায় না।[12]

আর যে মুনাফিক্ব কুরআন তেলাওয়াত করে না, মাকাল ফলের মতো অপবিত্র; যার স্বাদ তিক্ত আর কোনো গন্ধ নেই।[13]

আল-কুরআনের তেলাওয়াত পাঠকের জন্য এক মহামূল্যবান নিয়ামত। পাঠকের হৃদয়, মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা ও ভাবনাকে বিকশিত করে কল্যাণের পথে পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি, তার মনোজগতের বিকাশ, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উন্নয়ন এবং তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কুরআনের তেলাওয়াতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন একজন মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। আলোকিত ও কল্যাণকর জীবন লাভ ও নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে কুরআনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই জন্য কুরআন তেলাওয়াতের চর্চা এবং কুরআনের আলোকে আমলের মাধ্যমে নিজেকে সম্মানিত করা ও সমাজে নিজেকে আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া প্রত্যেকের কর্তব্য। প্রত্যেক মুমিনের কুরআনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। জ্ঞান, কর্ম, পথপ্রদর্শন ও মানুষের উপকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার উপর কুরআনের প্রভাব প্রকাশ পাবে। এমনকি তার মধ্যে হাদীছের দৃষ্টান্তটি বাস্তবায়িত হবে। আর তা হচ্ছে সে কমলালেবু ও খেজুরের মতো হবে। যখনই তার কুরআনের জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে, তখনই মানুষকে তার শরীআত সম্পর্কে শিক্ষাদান বৃদ্ধি পাবে আর তার প্রতিদান ও সম্মানও বেড়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে কল্যাণের নির্দেশনা দেবে, সে আমলকারীর সমপরিমাণ ছওয়াব পাবে’।[14] 

মানুষের মান-সম্মান, মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবকিছুই আল-কুরআনের আমলের উপর নির্ভর করে। মানুষ যদি নিয়মিত মনোযোগ দিয়ে আন্তরিকতার সাথে যত্ন সহকারে কুরআন তেলাওয়াত করে তবে সে মর্যাদার শীর্ষস্থানে অবস্থান করবে। অপরপক্ষে যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করবে না অথবা এক্ষেত্রে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে সে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إنَّ اللَّهَ يَرْفَعُ بهذا الكِتَابِ أَقْوَامًا، وَيَضَعُ به آخَرِينَ ‘এই কিতাবের মাধ্যমে একটি সম্প্রদায়কে সম্মানিত করবেন এবং অপর একটি সম্প্রদায়কে অপমানিত করবেন’।[15] ‘এই কিতাবের মাধ্যমে একটি সম্প্রদায়কে সম্মানিত করবেন’ দ্বারা তাদেরকে বোঝানো হয়েছে, যারা এর আলোকে আমল করবে এবং এর বিধান মেনে জীবনযাপন করবে, তারা মর্যাদার শীর্ষস্থানে অবস্থান করবে। আল্লাহ তাদের এই কুরআনের দ্বারা সম্মানিত করবেন এবং তারা যুগশ্রেষ্ঠ আলেম হিসেবে গণ্য হবেন। আর তাঁর বাণী, ‘এই কিতাবের মাধ্যমে অপর একটি সম্প্রদায়কে অপমানিত করবেন’ দ্বারা তাদেরকে বোঝানো হয়েছে, যারা এই কুরআনকে অবমূল্যায়ন করবে এবং এর শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তারা ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের কোনো সম্মান থাকবে না। কারণ, তারা আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করেনি।

কোনো মুমিনের জন্যই শোভনীয় নয় যে, সে কোনো বিষয়ে কারও প্রতি ঈর্ষা করবে। তবে দুইটি বিষয় : একটি কুরআনের জ্ঞান অর্জন, অপরটি আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‏لاَ حَسَدَ إِلاَّ عَلَى اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ الْكِتَابَ وَقَامَ بِهِ آنَاءَ اللَّيْلِ وَرَجُلٌ أَعْطَاهُ اللَّهُ مَالاً فَهْوَ يَتَصَدَّقُ بِهِ آنَاءَ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ ‘দু’টি বিষয় ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে ঈর্ষা করা যায় না। প্রথমত, যাকে আল্লাহ তাআলা কিতাবের জ্ঞান দান করেছেন এবং তিনি তার থেকে গভীর রাতে তেলাওয়াত করেন। দ্বিতীয়ত, যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দান করেছেন এবং তিনি সেই সম্পদ দিন-রাত দান করতে থাকেন’।[16]

উল্লিখিত আলোচনা থেকে বোঝা যায়, একজন মুমিন কুরআন তেলাওয়াত করে দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করবেন। আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করবেন। তিনি আল্লাহর নিকট বিশাল মর্যাদা ও সুমহান শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবেন। কারণ তিনি কুরআনের জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করেছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে একজন মুমিন কুরআন তেলাওয়াত, কুআনের জ্ঞান অর্জন ও আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ে অন্য মুমিনের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হবেন। তিনি চেষ্টা করবেন যে, কুরআন তেলাওয়াত ও দানের ক্ষেত্রে তিনি যেন তার চেয়ে ভালো বা উত্তম হতে পারেন।

সুতরাং উক্ত হাদীছের আলোকে আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। আমাদের সন্তানসন্ততিকে আল-কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে হবে। তাদের আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসকে কুরআন অনুযায়ী গড়ে তুলতে হবে। আমাদের ইহকাল ও পরকালকে স্বার্থক ও অর্থবহ করতে হলে কুরআনের বিধানকে সমাজের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা যদি কুরআনের শিক্ষার ক্ষেত্রে আলোচ্য হাদীছের ব্যাখ্যাকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারি, তবে প্রকৃত অর্থে আমরা দুনিয়া এবং পরকালে সার্থক, সফল ও সম্মানিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারব। আল্লাহ আমাদের সাবাইকে সেই তাওফীক্ব দান করুন- আমীন! ছুম্মা আমীন!!

মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল

প্রভাষক (আরবি), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, বরিশাল।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৯৮; মিশকাত, হা/২১১২।

[2]. কাযী ইয়াযের, ইকমালুল মুআল্লিম বিফাওয়াইদা মুসলিম, ৩/১৬৭।

[3]. তিবয়্যান ফি আদাবি হামালাতিল কুরআন, পৃ. ২৮।

[4]. মাদারিজুস সালিকীন, ৩/৭।

[5]. আততিযকার ফি আফযালিল আযকার, পৃ. ৭৯।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০২৭।

[7]. মুয়াত্ত্বা মালেক, ২৮৭/২, হা/৬৯৫।

[8]. আল্লামা বাজী, আন-তানবিরীল হাওয়ালিক, ১/১৬২।

[9]. শুআবুল ঈমান, ৩/৩৪৬, হা/১৮০৫।

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪২৭।

[11]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪২৭।

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪২৭।

[13]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪২৭।

[14]. আদাবুল মুফরাদ, হা/১৮১।

[15]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮১৭।

[16]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০২৫।

Magazine