عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ tقَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «مِنْ حُسْنِ إِسْلاَمِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لاَ يَعْنِيهِ
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অনর্থক বিষয় বর্জন করা কোনো ব্যক্তির সুন্দর ইসলামের পরিচায়ক’।[1]
হাদীছটির অবস্থান : এটি একটি মহান হাদীছ। ত্রুটি ও অশ্লীলতা থেকে আত্মার সংরক্ষণ, বিশুদ্ধকরণ ও উত্তম চরিত্রে সমৃদ্ধকরণ এবং উপকারবিহীন ও অপ্রয়োজনীয় কথা ও কাজ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় মূলনীতি।[2] ইবনু রজব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘হাদীছটি শিষ্টাচারের মূলনীতিগুলোর অন্যতম’।[3] হামযাহ কিনানী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘এই হাদীছটি ইসলামের এক-তৃতীয়াংশ’।[4] ইবনু আব্দিল বার রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘এটি হলো মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপক অর্থবোধক তাৎপর্যপূর্ণ বাণীর অন্তর্ভুক্ত, যা সংক্ষিপ্ত বাক্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি এমন এক চিরন্তণ বাণী, যা ইতোপূর্বে কেউ বলেনি’।[5] ইবনু হাজার আল-হায়তামী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘আবূ দাঊদ রাহিমাহুল্লাহ-এর ভাষ্য অনুযায়ী এটি ইসলামের এক-চতুর্থাংশ। আর আমি বলি, এটি ইসলামের অর্ধেক বরং ইসলামের সম্পূর্ণ আদর্শ ও শিক্ষা এই একটিমাত্র হাদীছে নিহিত আছে’।[6] আল্লামা ছানআনী রাহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন, ‘হাদীছটি মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপক অর্থবোধক বাণীর অন্তর্ভুক্ত, যা তাঁর বাণী ও কর্মকে শামিল করে’। ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র ধার্মিকতাকে একটি মাত্র বাক্যে একত্রিত করেছেন। তাঁর বাণী, ‘একজন সুন্দর মুসলিমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অনর্থক বিষয় বর্জন করা’। এই হাদীছের অর্থ অনর্থক সবকিছুর বর্জনকে শামিল করে। যেমন— কথা বলা, দেখা, শোনা, ধরা, হাঁটাচলা, চিন্তা করা এবং অন্যান্য দৃশ্যমান ও অভ্যন্তরীণ গতিবিধি। এটি ধর্মপরায়ণতার একটি পূর্ণাঙ্গ শব্দ’।[7]
ব্যাখ্যা : অনেক লোক অন্যের সাথে তাদের কথোপকথনে ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করে এবং নৈতিকতা বা নম্রতার বিবেচনা করে না। মহান নৈতিক আচরণে সমৃদ্ধ হওয়ার মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং উত্তম গুণাবলির প্রতি আগ্রহের অভাবে তারা এমনটা করে। যার কারণে তাদের উদ্বেগের বিষয় নয় এমন বিষয়ে তারা হস্তক্ষেপ করে এবং মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে জানতে প্রশ্ন করে।
প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের সাথে এই হাদীছের সম্পর্ক সুস্পষ্ট। কারণ, একজন মুমিন আল্লাহ তাআলাকে সর্বদা উপস্থিত মনে করেন। তিনি মনে করেন আল্লাহ তাআলা তাকে দেখছেন, তার কথা শুনছেন এবং তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ﴾ ‘মানুষ যে কোনো কথাই উচ্চারণ করে না কেন, তা সংরক্ষণ করার জন্য সদাপ্রস্তুত প্রহরী আছেন’ (ক্বাফ, ৫০/১৮)। একজন উত্তম মুসলিম যা জানেন, তা ব্যতীত তিনি কথা বলেন না। তিনি এমন বক্তব্য দেন, যা তার উপকারে আসে এবং তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। আর যখন তিনি কোনো কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন তিনি দেখেন যে, এই কাজটি কি তাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করবে, না-কি তার পরকালকে ক্ষতির মুখে ফেলবে?
উক্ত হাদীছে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সেই পথে চলার নির্দেশনা প্রদান করেছেন, যে পথে চললে একজন বান্দা তার দ্বীনের পূর্ণতা, ইসলামের সৌন্দর্য ও সৎকর্মের পরিশুদ্ধতা অর্জন করতে পারবে। তিনি বুঝিয়েছেন যে, একজন ব্যক্তির ইসলাম যে কারণে আরও উত্তম, আরও চমৎকার হয়, তা হলো এমন কিছু কথা-কাজ বাদ দেওয়া, যা অর্থহীন এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না।
‘অনর্থক বিষয় বর্জন করা কোনো ব্যক্তির সুন্দর ইসলামের পরিচায়ক’- এই বাণীতে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে ইসলামের জন্য এমন কিছু ত্যাগ করার নির্দেশনা দিয়েছেন, যা তার কোনো উপকারে আসে না, বরং পালনকর্তার নৈকট্য অর্জনে অন্তরায় হয়। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে বলা হয়েছে, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যা কল্যাণকর তোমরা তা করতে আগ্রহী হও’।[8] তিনি এখানে কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে সময় ব্যয় করাকে সৌভাগ্যের বিষয় বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ, দুনিয়া পরকালের শস্যক্ষেত্র। দুনিয়ার জীবন ঐ রকম সংক্ষিপ্ত, যেমন গাছের ছায়া ক্ষণিকের, যা খুব দ্রুত সরে যায়। কাজেই জ্ঞানী সেই ব্যক্তি, যে পরকালকে তার চিন্তার খোরাক বানায় এবং জান্নাতকে তার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। সে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সময়ের সদ্ব্যবহার করে। এ ব্যাপারে কবি খুবই চমৎকার কথা বলেছেন, ‘রাতের অন্ধকারে যখন তুমি অবসরে বিশ্রাম নাও, তখন দুই রাকআত ছালাত আদায়কে গনীমত মনে করো আর যখন তুমি অনর্থক কাজে লিপ্ত হওয়ার সংকল্প করো, তখন আল্লাহ তাআলার তাসবীহ পাঠে মনোযোগী হও’।[9]
গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ দেওয়া এবং অর্থবহ কাজে ব্যস্ত হওয়ার উপকারিতা ব্যাপক। আত্মা যদি আনুগত্যের কাজে সম্পৃক্ত না হয়, তবে সে পাপে জড়িয়ে পড়ে। যারা মানুষের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করে, তারা নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে গাফেল হয়ে যায়। তারা পরনিন্দা ও পরচর্চায় লিপ্ত হয়ে তাদের সম্মান ক্ষুণ্ণ করে। পক্ষান্তরে ব্যক্তির দায়িত্ববোধ এবং অর্থবহ কাজে সম্পৃক্ততা তার সময় সাশ্রয় করে এবং তার কল্যাণকর কাজকে গতিশীল করে। তাছাড়া সম্পদ সংরক্ষণ, উপার্জন বৃদ্ধি, সৎকর্ম সম্পাদন ও দৃঢ়তাপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ভ্রাতৃত্ব স্থাপন ও পারস্পরিক সহযোগিতা করা ইত্যাদি কাজ সম্পাদন সমাজে তাঁর উচ্চাসন নিশ্চিত করে।
উক্ত হাদীছের উদ্দীষ্ট অর্থ অনেক বিষয়কে শামিল করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো দুনিয়ার তুচ্ছ বস্তুর প্রতি লোভাতুর দৃষ্টি না দেওয়া। কেননা দুনিয়ার সম্পদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি হৃদয়কে কলুষিত করে এবং মূল্যহীন বস্তুর প্রতি মনকে আবদ্ধ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿لَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ﴾ ‘আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে ভোগবিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি আপনি আপনার চক্ষুদ্বয় প্রসারিত করবেন না; তাদের জন্য আপনি দুঃখ করবেন না, আপনি মুমিনদের জন্য আপনার বাহুকে অবনমিত করুন’ (আল-হিজর, ১৫/৮৮)।
আব্দুর রহমান সা‘দী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘দুনিয়ার প্রতি বিমোহিত হয়ে আপনার দৃষ্টি প্রসারিত করবেন না। দুনিয়ার সুস্বাদু খাদ্য, সুপেয় পানীয়, জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক, নয়নাভিরাম অট্টালিকা ও সুন্দরী নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে বারবার দেখবেন না। কারণ, এসবই পার্থিব জীবনের বাহ্যিক সৌন্দর্য, যার প্রতি কেবল প্রতারিত, কল্যাণ বঞ্চিত ও পথহারা ব্যক্তিরাই আসক্ত হয় এবং একে তাদের উপভোগের লক্ষ্যবস্তু বানায়। তারা পরকাল থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে দুনিয়ার চাকচিক্য ও সৌন্দর্য উপভোগে মত্ত থাকে। বস্তুত, এরাই অপরাধী সম্প্রদায়। এই চাকচিক্য ও সৌন্দর্য খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। একটা সময় যখন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, তখন দুনিয়া তার আসক্ত ও প্রেমিককে হত্যা করে। ফলে এরা প্রচণ্ড অনুতপ্ত হয় এবং খুব অনুশোচিত হয়। তবে তখন অনুতাপ বা অনুশোচনা তার কোনো উপকারে আসে না’।[10]
হাদীছটিতে যেসব বিষয় বর্জন করতে বলা হয়েছে তা হলো— অনর্থক বাক্যালাপ ও অপ্রয়োজনীয় কথোপকথন। কারণ, এগুলো জিহ্বার আক্রমণের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। এই হাদীছের অন্য বর্ণনায় এই অর্থটি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অনর্থক আলোচনা হতে বিরত থাকাই একজন মুসলিমের ইসলামকে সুন্দর করে’।[11]
আমরা অনেক ছাহাবীর জীবনী থেকে জানতে পারি যে, তাঁরা যখন ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তখনই তাঁদের মধ্যে উত্তম ইসলামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এই অর্থে যে, তাঁরা তাঁদের ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ আর বিশুদ্ধ করেছেন। তাই তাঁদের মধ্যে দ্বিধা, দুর্বলতা এবং কপটতা প্রবেশ করতে পারেনি। যাতে তাঁরা তাদের দলভুক্ত না হন, যাদের হৃদয়ে ব্যাধি, ঈমানে দুর্বলতা ও কপটতা আছে।
যারা অনর্থক আলোচনা বর্জন করে, তাদের প্রশংসায় আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ﴾ ‘(মুমিন তো তারাই) যারা অনর্থক বিষয় থেকে বিরত থাকে’ (আল-মুমিনূন, ২৩/৩)। কেননা, যে ব্যক্তি অনর্থক আলোচনা থেকে জিহ্বাকে সংযত রাখে, তিনি এমন পদস্খলন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন, যা আল্লাহ তাআলা অপছন্দ করেন এবং যাতে তিনি অসন্তুষ্ট হন। আর তিনি জিহ্বাকে সমালোচনা ও পরচর্চা থেকে রক্ষা করেন। এজন্য শরীআত কুরআন ও হাদীছের বহু জায়গায় নীরবতাকে আঁকড়ে ধরতে বলেছেন। তবে আল্লাহর যিকির, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ এর অন্তর্ভুক্ত নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ﴾ ‘তাদের অধিকাংশ আলোচনায় কোনো কল্যাণ নেই তবে দানের নির্দেশ, সৎকাজের আদেশ ও মানুষের মাঝে সংশোধন করা ব্যতীত’ (আন-নিসা, ৪/১১৪)।
অতএব, একজন ব্যক্তির সুন্দর ইসলাম বলতে তাঁর ইসলামকে সংশোধন করা এবং তাঁর ঈমানকে পূর্ণাঙ্গ করা বুঝায়। তাই প্রশ্ন হলো— তাঁর ইসলাম সংশোধন ও পূর্ণাঙ্গ করার উপায় কী? এর উত্তর হলো— বেশ কতগুলো উপায়ে একে সংশোধন করা যায়। তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো— অর্থবহ বা কল্যাণকর নয় এমন কিছু বর্জন করা। হাদীছে বর্ণিত শব্দ ‘অর্থবহ বা কল্যাণকর নয়’ এর বাহ্যিক অভিব্যক্তি সাধারণ তথা সকল বিষয়কে শামিল করে। সুতরাং হৃদয়ের সাথে, জিহ্বার সাথে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত।
হৃদয় হচ্ছে মানবদেহের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাই একে খারাপ চিন্তা, মন্দ পরিকল্পনা এবং দূষিত ইচ্ছা থেকে রক্ষা করা দরকার। নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষা এবং সন্দেহপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখা প্রয়োজন। অর্থাৎ অনর্থক কাজ, অপ্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনা এবং নিষ্ফল কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। যে ব্যক্তি তার চিন্তাভাবনাকে কলুষিত করে এবং ইচ্ছাকে দূষিত করে, সে ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে আর ভাবে সেই একমাত্র আল্লাহর অনুগত বান্দা। অথবা চিন্তা করে যে এক খণ্ড জমি বিক্রি করে লাভবান হয়েছে। তারপর এভাবে জমি কিনতে কিনতে সে এক সময় মিলিয়নিয়ার বা বিলিয়নিয়ার হয়ে যাওয়ার লোভে পতিত হয়। এটি এমন দূষিত চিন্তাভাবনা, যা তার দুনিয়া বা আখেরাত কোথাও উপকারে আসে না। এটি এমন ব্যর্থদের চিন্তাভাবনা, যারা কাজ না করে বসে থাকে আর স্বপ্ন দেখে যে, সে এই হবে, ঐ হবে। সে দুনিয়া বা পরকাল কোনো স্থানের জন্যই অর্থবহ আমল করে যেতে পারে না। ফলে এটাই তার হৃদয়কে উদ্বিগ্ন করে তোলে।
অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে এমন কিছুতে ব্যস্ত রাখা যার কোনো স্বার্থকতা নেই। অর্থাৎ যা দুনিয়া বা পরকাল কোথাও তার কোনো উপকারে আসে না। এমনটা খুব কম দেখা গেছে যে, বান্দা নানান হারাম কাজে ব্যস্ত, তা সত্ত্বেও তিনি অনর্থক কাজে জড়াননি। আর এমন ঘটানও খুব কম দেখা গেছে যে, বান্দা অবাধ দর্শনে মত্ত, ভূরিভোজে মগ্ন, ভালোমন্দের বাছবিচার ছাড়া অবাধ মেলামেশায় ব্যস্ত অথচ তিনি অনর্থক কোনো কিছুতে সংযুক্ত হননি। এসবই অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে হয়।
যদি কোনো ব্যক্তি এমন জিনিসের দিকে তাকায়, যা দেখা তার জন্য বৈধ নয়, তবে এটি তার অনর্থক কাজে জড়ানো হিসেবে গণ্য হবে। এটি হয়তো এমন মনোরম চিত্র বা এমন কিছু পড়া, যা দেখা বৈধ নয় কিংবা এমন কিছু, যা কুপ্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলে বা মনের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে। এটি জিহ্বার সাথেও সম্পর্কিত। আর তা হলো মানুষের এমন বিষয় নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকা, যার কোনো অর্থ নেই। যেমন: পরনিন্দা করা, সমালোচনা করা, মানুষের সম্ভ্রম নিয়ে সমালোচনা করা, অপ্রয়োজনে প্রশ্ন করা এবং অতিরিক্ত কথা বলা।
জনৈক পণ্ডিত বলেছেন, ‘পার্থিব জীবনে প্রশস্ত জীবন পদ্ধতি অবলম্বন মানেই অনর্থক বা নিষ্প্রয়োজন কিছুতে জড়িয়ে যাওয়া। কারণ, সে এখান থেকে এমন কিছু পায়, যা তাকে অভাবমুক্ত বানিয়ে দেয়। তাই সে নিজে, তার পরিবার ও সন্তানকে মানুষের প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে মনে করে। সে স্বর্ণ-রৌপ্য ও মুণি-মুক্তা ইত্যাদি আহরণ করে তার জীবনের গতিপথকে সুগম করে। সে রঙীন জীবন লাভের স্বপ্নে নিরন্তর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। অথচ তাকে এজন্য সৃষ্টি করা হয়নি। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ - حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ - كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ﴾ ‘প্রাচুর্য অর্জনের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রেখেছে। যে পর্যন্ত না তোমরা কবরে উপনীত হও। তোমরা শীঘ্রই (এর পরিণতি সম্পর্কে) জানতে পারবে’ (আত-তাকাছুর, ১০২/১-৩)। যখন তাকে কবরে রাখা হবে, তখন সে জানবে যে, এই তাড়াহুড়ো, ব্যস্ততা ও প্রশস্ততার অনুসন্ধান ছিল প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুর পেছনে ছুটা। একেই বলা হয় অনর্থক বা নিষ্প্রয়োজনের পেছনে ছুটা। এটা পরকালের জন্য প্রস্তুতির আলোকে হতে হবে। এর অর্থ এই নয় যে, সম্পূর্ণ দুনিয়াবিমুখ হতে হবে বা পরকালকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে হবে’।
‘যার কোনো অর্থ নেই’ এমন বাক্য বলতে কী বোঝায়? এই বাক্যের উপকারিতা কী? এই বাক্য দুনিয়া ও আখেরাতে কী উপকার বয়ে আনবে? কিন্তু মানুষের উপর যখন কোনো কাজ কষ্টসাধ্য হয়, তখন সে এমন কাজে ব্যস্ত হয়, যা তার কোনো উপকারে আসে না। যখন কোনো ব্যক্তি প্রতারিত হয়, তখন সে অন্যকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এমন সময় মানুষ নিজেকে ভুলে যায় এবং সে নিজেকে সংশোধন করে না আর তার দোষত্রুটি শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে না। সে আল্লাহপ্রদত্ত শক্তিকে অন্যের দোষত্রুটি, পদস্খলন ও ভুলভ্রান্তি খোঁজার কাজে ব্যবহার করে। তখন সে প্রশ্ন করে, সে ওটা কেন করেছে এবং ওটা কেন করেনি? তার নিজেকে এবং নিজের কাজকে পাপ উপার্জনের কাজে ব্যবহার করা উচিত হবে না।
এই নির্দেশনা জেনে রাখা উচিত যে, অনর্থক বা অপ্রয়োজনীয় কিছু বর্জনের ক্ষেত্রে নিখুঁত বিধিমালা হলো সেটাই, যা শরীআত অনুমোদন দিয়েছে। এখানে প্রবৃত্তি বা কল্পনাপ্রসূত কোনো মতামতের স্থান নেই। এজন্যই মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনর্থক কোনো কিছুর বর্জনকে ব্যক্তির সুন্দর ইসলামের নিদর্শন বলে অভিহিত করেছেন। কেননা কিছু মানুষ এমন কিছু কাজ বর্জন করে, যেগুলো আদায়ে শরীআত উৎসাহিত করেছে। অথচ এগুলোকে তারা অন্যের উপর অযাচিত হস্তক্ষেপ মনে করে। উক্ত অজুহাতকে পুঁজি করে তারা সদুপদেশ প্রদান এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের মতো আল্লাহ তাআলার নির্দেশ থেকে বিরত থাকে। এক্ষেত্রে তাদের একমাত্র যুক্তি হলো, অন্যের ব্যক্তিত্বকে সম্মান দেওয়া। এসবই শরীআতকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এবং আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হেদায়াত থেকে দূরে থাকার কৌশল। কেননা, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনর্থক কাজকর্ম বর্জন করতেন। এ সত্ত্বেও তিনি উপদেশ ও পথপ্রদর্শনের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। তিনি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ চলমান রেখেছেন। দেশে ও প্রবাসে সর্বাবস্থায় তিনি আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন করতে এ মহান দায়িত্ব পালন অব্যাহত রেখেছেন।
মোদ্দাকথা: উক্ত হাদীছে সময়ের অপচয় রোধে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কল্যাণ অর্জনের প্রতিযোগিতা এবং সৎকর্ম উপার্জনের সাধনা ব্যতীত অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্র বা অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়। অনর্থক বিষয় বর্জন ব্যক্তিকে আত্মার পরিশোধন এবং আমল সম্পাদনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। সময়ের যথাযথ ব্যবহারে আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। তিনি যেন আমাদের অতিরিক্ত ভোগবিলাস এবং আরাম-আয়েশ থেকে রক্ষা করেন- আমীন!
মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল
প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।
[1]. তিরমিযী, হা/২৩১৭, হাদীছ ছহীহ; ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৭৬।
[2]. আল-জাওয়াহিরুল লুলুইয়্যাহ, শারহুল আরবাঈন আন-নাবাবিয়্যা, পৃ. ১২৩।
[3]. জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১/২০৭।
[4]. সুয়ূত্বী, তানবীরুল হাওয়ালিক, ৩/৯৬।
[5]. তামহীদ, ৯/১৯৯; শারহুয যারকানী আলা মুওয়াত্ত্বা মালেক, ৪/৩১৭।
[6]. ফাতহুল মুবীন, পৃ. ১২৮।
[7]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিক্বীন, ২/২২।
[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৬৪।
[9]. আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক, কিতাবু ফাছলিল খিতাব ফী যুহদি ওয়ার রাক্বায়েক্ব, পৃ. ৯৩৮; তারিখু দিমাশক, ৩২/৪৫৯-৪৬১।
[10]. সূরা ত্ব-হার ১৩১ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[11]. আহমাদ, হা/১৭৩২।