কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কল্যাণকামিতাই দ্বীন

عَنْ تَمِيمٍ الدَّارِىِّ أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ «الدِّينُ النَّصِيحَةُ» قُلْنَا لِمَنْ قَالَ «لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُولِهِ وَلأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ».

সরল অনুবাদ : তামীম আদ-দারী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,*‘আদ-দ্বীন আন-নাছীহা তথা কল্যাণকামিতাই দ্বীন’। আমরা প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! কার জন্য? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষের জন্য’।[1]

ব্যাখ্যা :

নছীহা-এর আভিধানিক অর্থ : অভিধানে নছীহাকে আল-খুলূছু اَلْخُلُوْصُ)) বা ভেজালমুক্ত হওয়া থেকে নেওয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়- নাছাহাশ শাইয়ু (نَصَحَ الشَّيُّ) এ কথা তখন বলা হয়, যখন কোনো বস্তু ভেজালমুক্ত হয়। এখান থেকেই আন-নাছেহু (اَلنَاصِحُ) তথা কল্যাণকামী এর উদ্ভব হয়েছে। যেমন বলা হয়- নাছাহাল আসালু (نَصَحَ الْعَسَلُ) মধু বিশুদ্ধ হয়েছে, একথা তখন বলা হয়, যখন মধুকে মোম থেকে পবিত্র করা হয়। প্রত্যেক বস্তুই যখন তার অবস্থান বা পরিবেশ অনুযায়ী ময়লা-আবর্জনা বা অপবিত্রতা থেকে মুক্ত হয়, তখন বলা হয় খালাছাশ শাইয়ু (خَلَصَ الشّيُّ) অর্থাৎ নাছাহাশ শাইয়ু (نَصَحَ الشَيُّ) তথা বস্তুটি নির্ভেজাল বা পরিষ্কার-পরিছন্ন হয়েছে।[2] আবার কেউ কেউ বলেছেন, নছীহা নাছহুন থেকে গৃহীত। দুটি বস্তুর সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সংশোধিত হওয়া অর্থে ব্যবহৃত হওয়া।[3] কেননা একজন মানুষ যখন আরেকজন মানুষের কল্যাণ কামনা করে, তখন সে তার সাথে মিশে যায় এবং নিজেকে তার আচরণের সাথে খাপ খাওয়ায়ে নেয় এবং সংশোধিত হয়।

ইবনু আছীর রাহিমাহুল্লাহ তাঁর নেহায়া গ্রন্থে বলেছেন, নছীহা হলো এমন একটি শব্দ, যা দিয়ে একটি বাক্যের অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে। আর এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, উপদেশদানকৃত ব্যক্তির সার্বিক কল্যাণ কামনা করা। এটি ব্যতীত অন্য কোনো শব্দ দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বাক্যের অর্থ প্রকাশ করা সম্ভব নয়।[4]

আবূ সুলায়মান আল-খাত্ত্বাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, নছীহা এমন ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ, যা উপদেশদানকৃত ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর যে কোনো তথ্যকেই অন্তর্ভুক্ত করে।

আল্লামা রাগেব আল-ইছফাহানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আরবদের কথা, ‘আমি তার জন্য আমার ভালোবাসাকে নছীহা তথা নির্জল করেছি’ থেকে শব্দটি নেওয়া হয়েছে। অথবা তাদের কথা ‘ত্বককে পরিষ্কার করা তথা ময়লা-আবর্জনা থেকে মুক্ত করা’ শব্দটি থেকে নেওয়া হয়েছে।[5] শরীরের ত্বককে যেভাবে ময়লা-আবর্জনা থেকে মুক্ত করা হয়, ঠিক তেমনিভাবে কারও কল্যাণকামিতা এবং তাকে ভালোবাসার জন্য হৃদয়কে কালিমামুক্ত করা।

নছীহা-এর পারিভাষিক অর্থ : আল্লামা রাগেব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, নছীহা হলো এমন কাজ অথবা আদেশ পালন, যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সার্বিক কল্যাণ আছে। আল্লামা জুরজানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, নছীহ হলো এমন সব বিষয়ের প্রতি আহ্বান করা, যার মধ্যে কল্যাণ আছে আর এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকা, যার মধ্যে বিপর্যয় আছে।[6]

হাদীছটির গুরুত্ব : আলোচ্য হাদীছটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাদীছটির গুরুত্ব ও তাত্পর্য প্রমাণের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এখানে নছীহা তথা কল্যাণকামিতাকেই দ্বীন বলা হয়েছে। ইসলামের প্রত্যেক বিধিবিধানই নছীহা তথা কল্যাণকর। অর্থাৎ ইসলাম একটি নছীহাভিত্তিক জীবনব্যবস্থা। একটিমাত্র বাক্য ‘কল্যাণকামিতাই দ্বীন’। এর মধ্যে ইসলামের সকল বিধিবিধান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইসলামের এমন কোনো বিধান নেই, যা এর মধ্যে নেই। যেমনভাবে আরাফার ময়দানে অবস্থানকেই হজ্জ বলে বর্ণনা করেছেন। ছালাত, ছিয়াম, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, সালাম দেওয়া ও হাসিমুখে কথা বলা ইত্যাদি সবই নছীহা। ইবনু রজব রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, হাদীছে জিবরীলে বর্ণিত ইসলাম, ঈমান ও ইহসানকে হাদীছটি অন্তর্ভুক্ত করে, যেগুলোকে দ্বীন বলে’।[7] ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ এই হাদীছের তাত্পর্য সম্পর্কে বলেছেন, এটি হলো ইসলামের ভিত্তি। আর আলেমদের একদল একথা বলেছেন যে, এটি ইসলামের এক-চতুর্থাংশ। অর্থাৎ এটি ইসলামের ঐ চারটি হাদীছের অন্যতম, যেগুলো ইসলামের সকল বিধিবিধানকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি এমন নয়। বরং এটি এককভাবে ইসলামের সকল বিধিবিধানের উত্স।[8]

নছীহা সম্পর্কে আরও কয়েকটি হাদীছ রয়েছে, যেখানে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নছীহা বা কল্যাণকামিতাকে মুমিনের জীবনের অপরিহার্য বিষয় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একজন মুসলিমের আরেকজন মুসলিমের উপর ছয়টি অধিকার রয়েছে। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কী? তিনি বললেন, ‘যখন তুমি তার (মুমিন ভাই) সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সালাম দিবে। যখন সে তোমাকে আহ্বান করে, তখন তুমি তার আহ্বানে সাড়া দিবে। যখন সে তোমার নিকট নছীহা কামনা করবে, তখন তাকে উপদেশ দিবে। যখন তার হাঁচি আসবে এবং সে আল-হামদুলিল্লাহ , তখন ইয়ারহামুকাল্লাহ বলবে। যখন সে অসুস্থ হবে, তখন তুমি তার সেবা করবে। যখন সে মৃত্যুবরণ করবে, তখন তার জানাযায় অংশগ্রহণ করবে’।[9]

অর্থাৎ যখন সে কোনো বিষয়ের কল্যাণকর অথবা অকল্যাণকর হওয়া সম্পর্কে যখন কেউ তোমার নিকট নছীহা তথা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ চায়, তখন তুমি তাকে এমন সিদ্ধান্ত দাও, যা তোমার নিজের জন্য পছন্দ কর। যদি কাজটি কল্যাণকর হয়, তবে তাকে করার জন্য উৎসাহিত করো আর যদি ক্ষতিকর হয়, তবে সতর্ক করো। আর যদি কাজটির কল্যাণকর ও অকল্যাণকর উভয়টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে তাকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দাও। কল্যাণকর ও ক্ষতিকর দিকগুলো তুলনা করে দেখাও, যাতে সে ক্ষতি থেকে বেঁচে যায়। যদি কেউ লেনদেন কিংবা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি সম্পর্কে পরামর্শ চায়, তবে তুমি তাকে এমন পরামর্শ দাও, যা তুমি নিজের জন্য পছন্দ কর। তাকে প্রতারণা করা থেকে বিরত থাকো। কারণ, প্রতারণা করলে তুমি মুসলিম থাকবে না। উল্লিখিত ক্ষেত্রে নছীহা প্রদান করা ওয়াজিব। কিন্তু নছীহার আবেদন করা হলে, নছীহা করা অপরিহার্য। এই কারণেই উক্ত হাদীছে নছীহাকে চাওয়ার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। কারণ, যখন কেউ নছীহা চায়, তখন নছীহা ফরয হয়ে যায়। জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলছেন, আমরা ছালাত ক্বায়েম, যাকাত প্রদান এবং প্রত্যেক মুসলিমের জন্য কল্যাণ কামনার উপর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে বায়আত করলাম।[10] আল্লামা আইনী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদের থেকে যেসব বিষয়ের বায়আত গ্রহণ করেছেন, তার সাথে নছীহাকে সংযুক্ত করে বুঝিয়েছেন যে, নছীহা ঐরূপ গুরুত্বপূর্ণ যেমন ছালাত ও যাকাত গুরুত্বপূর্ণ।[11]

হাদীছটির তাত্পর্য : নছীহা শুধু দ্বীনই নয়, বরং প্রত্যেক নবী-রাসূল আলাইহিস সালাম-এর একমাত্র দায়িত্ব ছিল মানুষকে নছীহার প্রতি আহ্বান করা। স্বীয় জাতিকে আল্লাহ শাস্তির ভয় প্রদর্শন এবং তাঁর ইবাদতের প্রতি আহ্বানের জন্য নবীদেরকে পাঠানো হয়েছে। এক্ষেত্রে নবীদের দৃষ্টান্তের প্রতি নযর দিলে দেখা যায়, নূহ আলাইহিস সালাম তাঁর সম্প্রদায়কে দাওয়াতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করে বলছেন, ‘আমি তোমাদের নিকট আমার প্রতিপালকের বাণী প্রচার করছি এবং তোমাদের নছীহা করছি, কিন্তু তোমরা নছীহাকারীদের পছন্দ কর না’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৭৯)

মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পূর্ববর্তী নবী-রাসূলের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। তিনি তাঁদের পদ্ধতি অনুসারে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। মানুষের প্রকৃতি ও স্বভাব অনুযায়ী তিনি দাওয়াতের ধরন পরিবর্তন বা আধুনিকীকরণ করেছেন, যা তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রম বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। জনৈক বেদুঈনের মসজিদে প্রস্রাব করার সময় তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ অবস্থান এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।[12]

আলোচ্য হাদীছে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নছীহার ক্ষেত্রগুলোর সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এখানে তিনি নছীহাকে আল্লাহ, কিতাব, রাসূল, রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তি, আলেম এবং সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।

(১) আল্লাহ তাআলার জন্য নছীহা : আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস স্থাপন করা। তাঁকে শিরক থেকে মুক্ত রাখা। তাঁর গুণাবলির ভুল ব্যাখ্যা না করা। পূর্ণতা ও মাহাত্ম্যের সব গুণে তাঁকে গুণান্বিত করা তথা যে কোনো অপূর্ণতা থেকে মুক্ত করা। তাঁর আনুগত্য করা তথা অবাধ্য আচরণ না করা। ভালোবাসা কিংবা শত্রুতা একমাত্র তাঁর জন্যই পোষণ করা। যারা তাঁর আনুগত্য করে, তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ আর যারা তাঁর অবাধ্যাচরণ করে, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা। যারা তাঁকে অস্বীকার করে, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। তাঁর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। সকল কর্মকাণ্ড একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্য সম্পাদন করা। উল্লিখিত গুণাবলির প্রতি মানুষের হৃদয়ে গভীর ভালোবাসা ও উৎসাহ তৈরি করা। দয়া ও অনুগ্রহের সাথে মানুষের প্রতি ভালো ব্যবহার করা। বিশেষ করে তাদের প্রতি যারা সর্বদা আল্লাহর ইবাদত ও স্মরণে মগ্ন থাকে।[13]

সারকথা হলো, জীবনের প্রত্যেক বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ও পরিস্থিতিতে আল্লাহ তাআলার স্মরণে মগ্ন থাকা। জিহ্বাকে আল্লাহর যিকিরে সর্বদা সতেজ রাখা। শারঈ বিধানের আলোকে জীবনযাপন করতে সর্বদা অভ্যস্ত হওয়া। ইসলামবিদ্বেষীদের প্রশ্নের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া। শরীরের প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আল্লাহর পথের আহ্বায়ক করা এবং দ্বীনের খিদমতের জন্য জীবনকে উত্সর্গ করা।

(২) আল-কুরআনের জন্য নছীহা : আল-কুরআনকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ গ্রন্থ বলে বিশ্বাস করা। এর মতো শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, রচনাশৈলী, উদ্দেশ্য নির্বাচন ইত্যাদির কোনোটাই মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এমন বিশ্বাস পোষণ করা। একে যথাযথ সম্মান, আন্তরিকতা, বিনয়ের সাথে তেলাওয়াত করা। এর প্রতিটি অক্ষর মাখরাজ ও ছিফাতসহ উচ্চারণ করা। এর অপব্যাখ্যা ও সমালোচনার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া। এতে বর্ণিত বিধানকে গভীরভাবে বিশ্বাস এবং সেই অনুযায়ী আমল করা। এর জ্ঞান, উপদেশ, শিক্ষা ও দৃষ্টান্ত অনুধাবন করার চেষ্টা করা। এর অলৌকিক ঘটনা, ব্যাপকতা, বিশেষত্ব, নাসেখ (রহিতকারী) এবং রহিত (মানসূখ) ইত্যাদি সম্পর্কে গবেষণা করা। এর জ্ঞান ও শিক্ষা মানুষের নিকট প্রচার করা।[14]

শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীন আল-কুরআনের নছীহা হিসেবে নিম্নের বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন।

(ক) বিকৃতি ও অপব্যাখ্যার কবল থেকে আল-কুরআনকে রক্ষা করা এবং এ সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা।

(খ) আল-কুরআনের প্রত্যেক ঘটনাকে বিনাদ্বিধায় ও দৃঢ়চিত্তে সত্য বলে স্বীকার করা। এর একটি তথ্যকে মিথ্যা মনে করলে আল-কুরআনের জন্য নছীহতকারী হওয়া যাবে না। এমনিভাবে এতে সন্দেহ পোষণ কিংবা এর সততার ক্ষেত্রে দ্বিধাবোধ করলে আল-কুরআনের নছীহতকারী হওয়া যাবে না।

(গ) আল-কুরআনের আদেশ অনুযায়ী আমল করা। আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য এতে যে নির্দেশনা এসেছে, তার একটিও যদি কেউ বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকে, তবে তাকে আল-কুরআনের নছীহ বলা যাবে না।

(ঘ) আল-কুরআনে যেসব বিষয় থেকে বিরত থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা থেকে বিরত থাকা। যদি কোনো ব্যক্তি এগুলোর একটি থেকে বিরত না থাকে, তবে তাকে নছীহতকারী বলা যাবে না।

(ঙ) আল-কুরআনে যে বিধান রয়েছে, তাকে সর্বোত্তম বিধান হিসেবে বিশ্বাস করা ও মেনে নেওয়া। কেননা পবিত্র কুরআনের বিধান ব্যতীত অন্য কোনো বিধান সর্বোত্তম হতে পারে না। 

(চ) আল-কুরআনের প্রত্যেকটি বর্ণ ও এর অর্থ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এসেছে বলে বিশ্বাস করা। সত্যিকার অর্থে আল্লাহ তাআলাই স্বয়ং এই বাণীর প্রচারক। জিবরীল আলাইহিস সালাম এর সকল বাণী সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে গ্রহণ করে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হৃদয়ে অবতীর্ণ করেছেন। যাতে করে তিনি সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় ভয় প্রদর্শনকারী হতে পারেন।[15]

সারকথা হলো, আল-কুরআনকে সুন্দর করে সুললিত কণ্ঠে তেলাওয়াত করা। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘তুমি সুললিত কন্ঠে আল-কুরআন তেলাওয়াত করো’ (আল-মুযযাম্মিল, ৭৩/৪)। এতে যে নিগূঢ় রহস্য রয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা করা এবং এর নির্দেশনার আলোকে নিজের জীবন গড়ে তোলা এবং মানুষকে সে অনুযায়ী আমল করার জন্য উৎসাহিত করা।

(৩) রাসূলছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য নছীহা : ইবনু রজব রাহিমাহুমুল্লাহ বলেছেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য নছীহা আল-কুরআনের জন্য নছীহার অনুরূপ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং তাঁর আনুগত্যের উপর অটল থাকা। তাঁর সুন্নাহকে বিশ্বাস এবং জীবিত করা। তাঁর আদর্শে প্রভাবিত হয়ে সুন্নাহর জ্ঞান প্রচারে অবদান রাখা। যে তাঁর কিংবা তাঁর সুন্নাহর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে, তার প্রতি শত্রুতা পোষণ করা। আর যে তাঁর কিংবা তাঁর সুন্নাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে, তার প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা। তাঁর আদর্শের আলোকে জীবন গঠন করা। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা। তাঁর পরিবার ও ছাহাবীদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা।[16]

শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীন রাহিমাহুল্লাহ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য নছীহাকে নিম্নলিখিতভাবে প্রকাশ করেছেন :

(ক) আনুগত্যকে একমাত্র তাঁর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং অন্য কারো আনুগত্য না করা। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রত্যাশা রাখে এবং আল্লাহকে[17] অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে’ (আল-আহযাব, ৩৩/২১)

(খ) তাঁকে সত্যিই আল্লাহর রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করা। তিনি কখনোই মিথ্যা বলেননি কিংবা তার পক্ষ থেকে কখনোই মিথ্যা বলা হয়নি এবং তিনি সত্যবাদী ও সত্যায়িত নবী এই বিশ্বাস করা।

(গ) তিনি যে বাণী নিয়ে এসেছেন তা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ইত্যাদি যে কালেরই হোক না কেন তা বিশ্বাস করা। 

(ঘ) তাঁর আদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা।

(ঙ) তিনি যা নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা।

(চ) বাতিলপন্থীদের ষড়যন্ত্র থেকে তাঁর শরীআতকে রক্ষা করা।

(ছ) আল্লাহ তাআলা ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিধানের মধ্যে কোনো রকম পার্থক্য না করা। অর্থাৎ আমলের ক্ষেত্রে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহকে আল্লাহর বাণীর মতো গুরুত্ব দেওয়া। কেননা সুন্নাহর মাধ্যমেই আল-কুরআনের বিধান বাস্তবায়িত হয়েছে।

(জ) আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সাহায্য করা। জীবিত থাকলে তাঁকে সঙ্গ দিয়ে কিংবা পাশে থেকে আর মৃত্যুর পর তাঁর সুন্নাহকে সমাজে বাস্তবায়ন করে সহায্য করা।[18]

মোদ্দাকথা, তিনি যে অহীর বিধান নিয়ে এসেছেন, তাকে সত্য বলে স্বীকার করা। তাঁর কোনো বিধানের রহস্য অজানা থাকলেও তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করা। তাছাড়া প্রকৃত ঈমানের দাবী হচ্ছে, তিনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এসেছে বলে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস ও স্বীকার করা। তাঁর সুন্নাত ও হেদায়াতকে ব্যবহারিক জীবনে বাস্তবায়ন করা। আর এটাই তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যের নিদর্শন।

(৪) নেতা/রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তি/আলেমের জন্য নছীহা : দ্বীন হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর নেতৃবৃন্দের জন্য নছীহা। এর দ্বারা আলেম সম্প্রদায় এবং যারা দেশের শাসকবর্গ, তাদের সকলকে সমভাবে বোঝানো হয়েছে। কারণ আলেমরা হচ্ছেন দ্বীনের নেতা আর শাসকগোষ্ঠী হচ্ছেন দুনিয়ার নেতা।

আলেমদের জন্য নছীহা হলো তাদেরকে ইলম হাছিলের উত্স মনে করা। তাদের সাহচর্য লাভের উপকারিতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। তাদের মর্যাদা এবং তাদের নিকটে ইলম অর্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা, যাতে আলেমদের প্রতি তাদের হৃদয়ে গভীর ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। আলেমদের ভুল-ভ্রান্তি এবং পদস্খলন গোপন রাখা। এগুলো মানুষের নিকট প্রকাশ করা তাদের প্রতি সবচেয়ে বড় সীমালঙ্ঘন ও শত্রুতা। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে শ্রেণিভেদ ও বৈষম্য তৈরি হয়। মানুষ যা গোপন করতে চায়, সে সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো মোটেও কাম্য নয়।

শাসকদের জন্য নছীহা হলো সত্যে ও ন্যায়ের ক্ষেত্রে তাদেরকে সহযোগিতা করা। তাদের আদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা। ভুল বা অনিয়ম হলে বিনয় ও নম্রতার সাথে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। প্রজাদের অধিকার এবং দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করা। তাদের আনুগত্য করা এবং তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করা। সাধারণ মানুষের হৃদয়ে তাদের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করা। তাদের পেছনে ছালাত আদায় করা। তাদের পরিচালিত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। তাদের নিকট ছাদাক্বার মাল পৌঁছে দেওয়া। মিথ্যা প্রশংসার মাধ্যমে তাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত না করা। তাদের জন্য সংশোধনের জন্য দু‘আ করা।[19]

(৫) সাধারণ জনগণের কল্যাণ কামনা করা : সাধারণ মানুষের জন্য তাই পছন্দ করা, যা নিজের জন্য পছন্দ করা হয়। তাদেরকে এমন পরামর্শ দেওয়া, যা তাদের জীবিকা প্রশস্ত করে এবং উত্তম চরিত্রের উপর গড়ে তোলে। ভুল পথে চললে ধৈর্য ও আন্তরিকতার সাথে তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেওয়া। ধৈর্য ও সহনশীলতার পথে চলার জন্য তাদেরকে উৎসাহিত করা। তাদের প্রতি এমন আচরণ করা, যাতে তাদের মন গলে যায় এবং তারা দুর্বল হয়ে যায়। এভাবেই মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং তারা যেন একটি শরীরের মতো হয়ে যায়, যার একটি অঙ্গ ব্যথিত বা আহত হলে পুরো শরীর ব্যথা আর অনিদ্রায় রাত্রিযাপন করে।[20]

উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতে আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নছীহা তথা কল্যাণকামিতার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। এই হাদীছের শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত হলে আমাদের মন পবিত্র হবে, পারিবারিক অশান্তি দূর হবে, সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। অফুরন্ত ভালোবাসা আর অবারিত কল্যাণে আমাদের জীবন ভরে যাবে। সুতরাং আমরা যখনই কোনো আমল বা কোনো কাজ করব, তখন অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নছীহা তথা নির্দেশনা অনুযায়ী করব। আল্লাহ তাআলা সকলকে এই হাদীছের শিক্ষা এবং আদর্শ অনুযায়ী জীবন গড়ার তাওফীক্ব দান করুন। সঠিক ও সত্য পথ খুঁজে পেতে সহায়তা করুন। আমীন! ছুম্মা আমীন!

* প্রভাষক, বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, বরিশাল।


[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৫, আবূ দাঊদ, হা/৪৯৪৪; নাসাঈ, হা/৪২০৮।

[2]. লিসানুল আরাব, ২/৬১৫।

[3]. সাইদ. নেট, আদ-দ্বীন আন-নাছীহা হাদীছের ব্যাখ্যা।

[4]. মুআন-নিহায়া

[5]. রাগেব, ৪৯৮।

[6]. আল্লামা ইবনু ফারিস এর মু‘জামু মাকাইসিল লুগা, ৫/৪৩৫।

[7]. জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১/২১০, মুয়াসসাতুল রিসালা।

[8]. আল্লামা নববী, শারহু ছহীহ মুসলিম, ২/৩৭।

[9]. ছহীহ বুখারী, হা/১২৪০; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৬২।

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/১২৪০; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৬২।

[11]. উমদাতুল ক্বারী, আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী, ১/৩২৪।

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১২৮।

[13]. আল্লামা নববী, শারহে ছহীহ মুসলিম, ২/৩৮।

[14]. আল্লামা নববী, শারহে ছহীহ মুসলিম, ২/৩৮।

[15]. শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল আরবাঈন আন-নাবাবিয়াহ, পৃ. ১১৬।

[16]. ইবনু রজব রাহিমাহুল্লাহ, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১/২৩৩।

[17]. শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল আরবাঈন আন-নাবাবিয়াহ, পৃ. ১১৭।

[18]. আল্লামা নববী, শারহে ছহীহ মুসলিম, ২/৩৮।

[19]. ইবনু রজব রাহিমাহুল্লাহ, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১/২৩৩।

Magazine