[২২ জুমাদাল উলা, ১৪৪৪ হি. মোতাবেক ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২ মদীনা মুনাওয়ারার আল-মাসজিদুল হারামে (মসজিদে নববী) জুমআর খুৎবা প্রদান করেনশায়খখালেদআল-মুহান্না হাফিযাহুল্লাহ।উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
প্রথমখুৎবা
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই। আমরা তাঁর প্রশংসা জ্ঞাপন করছি এবং একমাত্র তাঁর কাছেই সাহায্য ও ক্ষমা চাই। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের অন্তরের খারাবি ও বদ আমল থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আল্লাহ যাকে হেদায়াত দেন তাকে কেউ পথভ্রষ্টকারী নেই। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন, তাকে কেউ হেদায়াতকারী নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নাই, তিনি একক এবং তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তার ও তার পরিবারবর্গের উপর দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন।
অতঃপর, হে আল্লাহর বান্দাগণ! যেভাবে একটি দেহ খাবার ও পানীয় ছাড়া বাঁচে না, তেমনিভাবে রূহ তার খোরাক ব্যতীত বাঁচতে পারে না; আর আত্মার খোরাক হলো তার সৃষ্টিকর্তার যিকির করা। ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ স্বীয় ‘আছ-ছহীহা’-এর মধ্যে প্রখ্যাত ছাহাবী আবূ মুসা আল-আশআরী রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে আল্লাহর যিকির করে আর যে যিকির করে না, উভয়ের উদাহরণ মৃত ও জীবন্ত মানুষের মতো’।[1] অতঃপর স্বীয় রবের যিকিরকারীর জীবনই প্রকৃত জীবন। কেননা এই জীবন ব্যক্তির মৃত্যু ও দেহের বিনাশের পরও বেঁচে থাকে; যেহেতু রূহ নিঃশেষ হয়ে যায় না, বরং তা দেহ থেকে আলামে বারযাখে স্থানান্তরিত হয় মাত্র।
হে মুসলিমগণ! অন্তরের জন্য আল্লাহর যিকিরের গুরুত্ব চাষাবাদের জন্য পানির গুরুত্বের অনুরূপ। আল্লাহর যিকির না করলে মানুষের অন্তরও একসময় চতুষ্পদ জন্তুর জীবন ও অন্তরের মতো হয়ে যায়। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَالَّذِينَ كَفَرُوا يَتَمَتَّعُونَ وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَهُمْ﴾ ‘আর যারা কাফের, তারা ভোগবিলাসে মত্ত থাকে এবং চতুষ্পদ জন্তুর মতো আহার করে। তাদের বাসস্থান জাহান্নাম’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/১২)।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! কখনো অন্তরে উদাসীনতা ও পাপের মরিচা পড়ে যায়; যার নিরাময় হলো আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার ও তাঁর যিকির করা। আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে বিপদাপদ দূরীভূত হয় এবং বালা-মুছীবত হালকা হয়। এর মাধ্যমে অন্তরের উজ্জ্বলতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হয় এবং যখন হৃদয় রোগাক্রান্ত হয় তখন এটাই তার ওষুধ।
জেনে রাখুন! সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অধিক ফযীলতপূর্ণ একটি যিকির হলো, বিশ্বপ্রতিপালকের তাসবীহ পাঠ করা। কেননা সর্বোত্তম স্থানে ফেরেশতাগণও যিকির করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَتَرَى الْمَلَائِكَةَ حَافِّينَ مِنْ حَوْلِ الْعَرْشِ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ﴾ ‘আপনি ফেরেশতাগণকে দেখবেন, তারা আরশের চারপাশ ঘিরে তাদের পালনকর্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছে’ (আয-যুমার, ৩৯/৭৫)।
এটিই ছোট বড় সকল সৃষ্টির যিকির; আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে সমস্ত কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এছাড়া এমন কিছু নেই যা তার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। নিশ্চয় তিনি অতিসহনশীল ও ক্ষমাপরায়ণ’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/ ৪৪)।
বিপদাপদ ও দুর্যোগ মোকাবেলায় বান্দার জন্য আল্লাহর যিকিরই একমাত্র অবলম্বন। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَذَا النُّونِ إِذْ ذَهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَنْ لَنْ نَقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ - فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنْجِي الْمُؤْمِنِينَ﴾ ‘আর মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন যখন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, অতঃপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাঁকে ধৃত করতে পারব না। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহ্বান করলেন, তুমি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই; তুমি নির্দোষ আমি গুনাহগার। অতঃপর আমি তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনিভাবে বিশ্ববাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি’ (আল-আম্বিয়া, ২১/৮৭-৮৮)। বিশিষ্ট ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যখনই কোন নবী বিপদগ্রস্ত হয়েছেন, তখনই তিনি তাসবীহ পাঠের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন’।
তাসবীহ হচ্ছে সিজদাকারীদের শ্রেষ্ঠ যিকির। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بها خَرُّوا سُجَّدًا وَسَبَّحُوا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ﴾ ‘কেবল তারাই আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান আনে, যারা আয়াতসমূহ দ্বারা উপদেশপ্রাপ্ত হয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং অহংকারমুক্ত হয়ে তাদের পালনকর্তার সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করে’ (আস-সাজদাহ, ৩২/১৫)। এটি অসীম দয়ালু আল্লাহ তাআলার নিকটে প্রিয় যিকির এবং এর মাধ্যমেই মীযানের পাল্লা ভারী হবে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,كَلِمَتَانِ خَفِيفَتَانِ عَلَى اللِّسَانِ ثَقِيلَتَانِ فِى الْمِيزَانِ حَبِيبَتَانِ إِلَى الرَّحْمَنِ سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيمِ ‘দুটি বাক্য এমন যা মুখে উচ্চারণ করা অতি সহজ, পাল্লায় অতি ভারী, আর আল্লাহর নিকট অতি প্রিয়। তা হলো— সুবহানাল্লাহিল আযীম, সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহ’।[2]
এটা এমন যিকির যা ফযীলতের দিকে থেকে অন্যান্য সকল যিকিরের উপর প্রণিধানযোগ্য। উম্মুল মুমিনীন জুয়াইরিয়্যাহ বিনতে হারিস রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভোরবেলা ফজরের ছালাত আদায় করে তার নিকট থেকে বের হলেন। ঐ সময় তিনি ছালাতের স্থানে বসা ছিলেন। এরপর তিনি চাশতের পরে ফিরে আসলেন। এমতাবস্থায়ও তিনি উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি বললেন, আমি তোমাকে যে অবস্থায় ছেড়ে গিয়েছিলাম তুমি সে অবস্থায়ই আছ?। তিনি বললেন, হ্যাঁ। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমার নিকট হতে রওনার পর চারটি কালেমাহ তিনবার পড়েছি। আজকে তুমি এ পর্যন্ত যা বলেছ তার সাথে ওযন করা হলে এ কালেমাহ চারটির ওযনই ভারী হবে। কালেমাহগুলো এই— ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহি ‘আদাদা খলক্বিহি ওয়া রিযা নাফসিহি ওয়াযিনাতা আরশিহি ওয়া মিদাদা কালেমাতিহি’।[3]
তাসবীহ পাঠের আরেকটি ফযীলত হলো, আল্লাহ তাআলা এটাকে জান্নাতে তাঁর প্রিয় বান্দাদের যিকির হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। এটা পাঠের স্বয়ংক্রিয় সক্ষমতা তাদেরকে দেওয়া হবে যেমনভাবে দুনিয়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের সক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,﴿يَأْكُلُ أَهْلُ الْجَنَّةِ فِيهَا وَيَشْرَبُونَ وَلَا يَمْتَخِطُونَ وَلَا يَتَغَوَّطُونَ وَلَا يَبُولُونَ إِنَّمَا طَعَامُهُمْ جُشَاءٌ رَشْحٌ كَرَشْحِ الْمِسْكِ وَيُلْهَمُونَ التَّسْبِيحَ وَالتَّحْمِيدَ كَمَا يُلْهَمُونَ النَّفَسَ﴾ ‘জান্নাতবাসীগণ তথায় পানাহার করবে। তবে তারা সেখানে প্রস্রাব-পায়খানা করবে না এবং নাকও ঝাড়বে না। তাদের এই ভক্ষণকৃত খাদ্য ঢেকুরের মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাদের শরীরের ঘাম মিশকের ন্যায় সুঘ্ৰাণ বিচ্ছুরিত করবে। তাসবীহ ও তাহমীদের যোগ্যতা তাদের অন্তঃকরণে এভাবে দেওয়া হবে যেমনিভাবে মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করে থাকে’।[4]
জান্নাতে এর অধিবাসীরা কোনো কিছুর প্রয়োজন অনুভব করলে তারা তাসবীহর মাধ্যমে তা কামনা করবেন এবং তখনই তা পেয়ে যাবেন। তাদের অবস্থা আল্লাহ তাআলা এভাবে বর্ণনা করেছেন,﴿دَعْوَاهُمْ فِيهَا سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَتَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ﴾ ‘সেখানে তাদের ধ্বনী হবে, “সুবহানাকাল্লাহুম্মা” অর্থাৎ ‘হে আপনি মহান ও পবিত্র!’ এবং সেখানে তাদের অভিবাদন হবে, ‘সালাম’ (ইউনুস, ১০/১০)। সুফইয়ান ছাওরী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তারা যখন কিছু কামনা করবে তখন বলবে, “সুবহানাকা আল্লাহুম্মা”। ফলে তারা তা পেয়ে যাবে’। এ জাতীয় কথা আব্দুল মালেক ইবনু জুরাইজ রহিমাহুল্লাহ থেকেও বর্ণিত হয়েছে।
তাসবীহ হলো মুমিনের সকাল-সন্ধ্যার রূহের খোরাক। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿فَسُبْحَانَ اللَّهِ حِينَ تُمْسُونَ وَحِينَ تُصْبِحُونَ﴾ ‘অতএব, তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো সন্ধ্যায় ও প্রভাতে’ (আর-রূম, ৩০/১৭)।
রবের নিকট অধিক প্রতিদান লাভ ও গুনাহ মোচনের জন্য তাদের অন্যতম মাধ্যম হলো তাসবীহ পাঠ। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত বিশিষ্ট ছাহাবী সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে (বসা) ছিলাম। তখন তিনি বললেন, তোমাদের মাঝে কেউ কি প্রতিদিন ১ হাজার পুণ্য হাছিল করতে অপারগ হয়ে যাবে? তখন সেখানে বসে থাকাদের মধ্য থেকে এক প্রশ্নকারী প্রশ্ন করল, আমাদের কেউ কীভাবে ১ হাজার পুণ্য হাছিল করবে? তিনি বললেন, সে ১০০ তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) পাঠ করলে তার জন্য ১ হাজার পুণ্য লেখা হবে’।[5] আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ قَالَ سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ فِي يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ حُطَّتْ خَطَايَاهُ وَإِنْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْرِ ‘আর যে লোক দিনে ১০০ বার “সুবহানাল্লহি ওয়াবিহামদিহী”। অর্থাৎ ‘আমি আল্লাহর সপ্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করছি’ পাঠ করবে, তার সমস্ত পাপ মিটিয়ে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার সমপরিমাণ হয়’।[6]
তাসবীহ হলো রবের কাছে বান্দার সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম এবং তাঁর শরীআত ও নির্দেশ পালনের অন্যতম উপকরণ। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَمِنْ آنَاءِ اللَّيْلِ فَسَبِّحْ وَأَطْرَافَ النَّهَارِ لَعَلَّكَ تَرْضَى﴾ ‘অতঃপর তাসবীহ পাঠ করো রাতের কিছু অংশে ও দিনের প্রান্তসমূহে, যাতে তুমি সন্তুষ্ট হতে পার’ (ত্বো-হা, ২০/১৩০)। এটা অন্তরে প্রশস্ততা তৈরি ও তা থেকে সংকীর্ণতা দূরীভূত হওয়ার মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُولُونَ - فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُنْ مِنَ السَّاجِدِينَ﴾ ‘আমি জানি যে আপনি তাদের কথাবর্তায় হতোদ্যম হয়ে পড়েন। অতএব, আপনি পালনকর্তার সৌন্দর্য স্মরণ করুন এবং সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান’ (আল-হিজর, ১৫/৯৭-৯৮)।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! তাসবীহ হলো, যেসব গুণ আল্লাহর সম্মান, পবিত্রতা ও মহত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং মুশরেকরা যেসব গুণে তাঁকে গুণান্বিত করে তা থেকে আল্লাহকে মুক্ত ঘোষণা করা। ঐ ব্যক্তির অবাধ্যতার ন্যায় অবাধ্যতা হতে আল্লাহকে মুক্ত রাখা, যে মহান আল্লাহর সম্মানের পরোয়া করে না ও তাঁকে ভয়ও করে না।
তাসবীহ হলো, বান্দার পক্ষ থেকে অপারগতা ও অজ্ঞতার স্বীকারোক্তি প্রদান; রবের কাছে আনুগত্য প্রকাশ এবং তাঁর পূর্ণাঙ্গ ইলম ও হিকমতের স্বীকৃতি। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ - قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ﴾ ‘আর আল্লাহ তাআলা শেখালেন আদমকে সমস্ত বস্তুসামগ্রীর নাম। তারপর সে সমস্ত বস্তুসামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্য হয়ে থাক। তারা বলল, তুমি পবিত্র! আমরা কোনো কিছুই জানি না, তবে তুমি যা আমাদেরকে শিখিয়েছ (সেগুলো ব্যতীত) নিশ্চয় তুমিই প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, হিকমতওয়ালা’ (আল-বাক্বারা, ২/৩১-৩২)।
এটা কুরআনের অধিকাংশ আয়াতে ‘হামদ’ তথা প্রশংসার সাথে সংযুক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ﴿فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ﴾ ‘কাজেই আপনি আপনার রবের সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করুন’ (আল-হিজর, ১৫/৯৮)। তিনি আরও ইরশাদ করেন,﴿وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ الْغُرُوبِ﴾ ‘আর আপনার রবের সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করুন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে’ (ক্বাফ, ৫০/৩৯)। এজন্য কুরআনের ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অধিকাংশ তাসবীহই হামদসহ ছিল।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! অধিক পরিমাণে তাসবীহ পাঠের সক্ষমতা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি এক বিশাল অনুগ্রহ ও সম্মান। তা দুটি কারণে হয়ে থাকে— (১) তাসবীহ পাঠের ফযীলত ও তার বিরাট প্রতিদান সম্পর্কে বান্দার জ্ঞাত হওয়া এবং (২) ইহকালে ও পরকালে আল্লাহর মহান সৃষ্টি, পরিচালনা ও নেয়ামতরাজি সম্পর্কে বান্দার গবেষণা করা। হে মুসলিমগণ! আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, সর্বদা আমাদের রবের তাসবীহ পাঠ করা, এসব তাসবীহর অর্থ জানা, ফযীলত অনুধাবন করা ও ছওয়াবের প্রত্যাশা করা। যাতে আমাদের রূহ প্রশান্তি লাভ করে, অন্তর প্রফুল্ল হয় এবং আল্লাহর নিকট মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
আল্লাহ আমাকে ও আপনাদেরকে তাঁর কিতাব ও নবীর সুন্নাহর মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন।
দ্বিতীয়খুৎবা
الحمد لله الذي جعل ذكره حياة للقلوب، وسببًا لتفريج الكروب، ووسيلةً لنَيْل المطلوب، وأُصلِّي وأُسلِّم على عبده ورسوله سيدنا وإمامنا محمد بن عبد الله، أكثر عباد الله لربه ذكرًا، وأعلاهم عنده شرفًا وقدرًا. أما بعدُ:
বেশি বেশি আল্লাহর যিকিরের মধ্যে অগণিত সুফল রয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটি আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তির উপায়। বিশিষ্ট ছাহাবী মুআয ইবনু জাবাল রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘কোনো মানুষের জন্য আল্লাহর যিকিরের চেয়ে উত্তম কোন আমল নাই, যা তাকে মহামহিম আল্লাহর শাস্তি থেকে রেহাই দিতে পারে’।[7]
বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করার আরো সুফল হলো, যিকিরকারী বান্দার সাথে আল্লাহ থাকেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ﴿فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ﴾ ‘কাজেই তোমরা আমার যিকির করো, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫২)। হাদীছে কুদসীতে এসেছে, ‘আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, আমি সে রকমই, যে রকম বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি বান্দার সঙ্গে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে’।[8] সুতরাং তাকবীর, তাহলীল, তাসবীহ, তাহমীদ ও ইস্তেগফারকারী বান্দার সাথে আল্লাহ থাকেন; তাকে হেফাযত, সাহায্য, রক্ষা ও সহযোগিতা করেন। আর যিকিরের পরিমাণের উপর ভিত্তি করেই সাহায্য-সহযোগিতা আসে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক অনুযায়ী সে প্রতিদান পেয়ে থাকে।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! জুমআর দিন একটি সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। আর এদিনে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রতি বেশি বেশি ছালাত ও সালাম পাঠের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, হে আল্লাহ! আপনি পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের সর্দার, রাসূলগণের নেতা, মুত্তাক্বীদের ইমামের উপর দরূদ, সালাম এবং বরকত নাযিল করুন। হে আল্লাহ! আপনি তাঁর পরিবারবর্গ এবং হেদায়াতের পথপ্রদর্শক ও আঁধার রাতের আলোকবর্তিকা তুল্য তাঁর ছাহাবীদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন। হে আল্লাহ! আপনি ইসলাম ও মুসলিমদের সম্মানিত করুন এবং শিরক ও মুশরেকদের অপদস্থ করুন। আপনার মুমিন বান্দাদেরকে সাহায্য করুন— হে মহাশক্তিধর ও পরাক্রমশালী আল্লাহ।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা আল্লাহকে স্মরণ করুন তিনিও আপনাদেরকে স্মরণ করবেন এবং তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করুন, বিনিময়ে তিনি আপনাদের নেয়ামতকে বৃদ্ধি করে দিবেন। আপনারা আপনাদের নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীকে স্মরণে রাখবেন, ‘তোমাদের চেয়ে নিম্নস্তরের লোকদের প্রতি দৃষ্টি দাও। তোমাদের চেয়ে উঁচুস্তরের লোকদের দিকে দৃষ্টি দিয়ো না; কেননা আল্লাহর নেয়ামতকে তুচ্ছ না ভাবার এটাই উত্তম পন্থা’। অতঃপর “আর আল্লাহর যিকিরই সর্বোত্তম। তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত” (আল-আনকাবূত, ২৯/৪৫)।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪০৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৭৯।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৪।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭২৬।
[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৩৫।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৮।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯১।
[7]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৭৯০।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৪০৫; তিরমিযী, হা/৩৬০৩।