[৮ শা‘বান, ১৪৪৬ হি. মোতাবেক ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ মদীনা মুনাওয়ারার আল-মাসজিদুল হারামে (মসজিদে নববী) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খড. ছালাহ বিন মুহাম্মাদ আল-বুদাইর হাফিযাহুল্লাহ। উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
প্রথমখুৎবা
যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহর জন্য, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করে যথাযথভাবে তা নির্ধারণ করেছেন এবং যিনি বালা-মুছীবত ও পরীক্ষাকে সতর্কীকরণ, আল্লাহর স্মরণ, গুনাহ মোচন ও পরিশুদ্ধতা অর্জনের মাধ্যম করেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নবী ও নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, যিনি তাঁর রবের পক্ষ থেকে সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী এবং আল্লাহর আদেশে তাঁর পথে আহ্বানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে প্রেরিত হয়েছেন। অতএব, মহান আল্লাহ তাঁর উপর, তাঁর পরিবার, তাঁর উজ্জ্বল মুখাবয়ব এবং বিশুদ্ধ যবান ও মহৎ হৃদয়ের অধিকারী ছাহাবীদের ওপর অগণিত দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ করুন।
অতঃপর, হে মুসলিমগণ! আপনারা আল্লাহভীতি অবলম্বন করুন, কেননা আল্লাহভীতি দ্বারা হৃদয় সকল অপবিত্রতা ও খারাপ বিষয় থেকে পবিত্র হয় এবং অন্তর সকল মন্দ ও ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করো এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে কোনো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০২)।
হে মুসলিমগণ! এই দুনিয়া দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদের অভয়ারণ্য, যেখানে বিপর্যয় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এখানে দুঃখ-বেদনা বারবার ফিরে আসে। এর যন্ত্রণার কাছে প্রশস্ত আকাশও সংকীর্ণ মনে হয়, এ যেন হৃদয়কে দগ্ধ করে এবং এর বেদনা মন ও শরীরকে ভেঙে ফেলে। আমরা প্রতিদিন দেখছি একজন প্রস্থানকারীকে বিদায় জানাতে, একজন শারীরিকভাবে দুর্বল ও ভেঙে পড়া মানুষকে তার কাছের আত্মীয়কে হারাতে এবং প্রিয়জনের বিচ্ছেদে ব্যথিত হতে। বস্তুত যে ব্যক্তি দুনিয়াতে চিন্তামুক্ত জীবন প্রত্যাশা করে, সে আসলে অসম্ভব কিছু প্রত্যাশা করে। প্রকৃতপক্ষে সময় কখনোই দুঃখের ছোবল বা ভয়ের আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদেরকে তোমাদের ধনসম্পদ আর তোমাদের নিজ জীবন সম্পর্কে পরীক্ষা করা হবে’ (আলে ইমরান, ৩/১৮৬)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি প্রকাশ করে দেই তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদকারী ও ধৈর্যশীল এবং আমি তোমাদের কথা-কাজ পরীক্ষা করে নেব’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/৩১)।
অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর সিদ্ধান্ত এবং তাক্বদীরের ওপর ঈমান রাখে, তার জন্য বালা-মুছীবত থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হয়ে যায়। পৃথিবীতে কিছুই আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছার বাইরে ঘটে না। সকল নির্দেশ পূর্বনির্ধারিত এবং আল্লাহর পরিকল্পনা মাফিক ঘটে।
এমনকি চলার পথে কেউ সামান্য কাঁটার আঘাত বা রক্তক্ষরণ বা ক্ষুদ্র আঘাত পেলেও তা সবই আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্য ও পূর্বনির্ধারিত ফয়সালার অংশ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যমীনে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যে এমন কোনো মুছীবত আপতিত হয় না, যা আমি সংঘটিত করার পূর্বে কিতাবে লিপিবদ্ধ রাখি না। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ। যাতে তোমরা আফসোস না করো তার উপর, যা তোমাদের থেকে হারিয়ে গেছে এবং তোমরা উৎফুল্ল না হও, তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার কারণে। আর আল্লাহ কোনো উদ্ধত ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না (আল-হাদীদ, ৫৭/২২-২৩)।
হে মুসলিমগণ! আপনারা যুগের দুর্বিপাককে খুব গুরুতর মনে করবেন না, কঠিন বিপদেও ভেঙে পড়বেন না। সংকটকালকে দীর্ঘ মনে করবেন না এবং ঘোর বিপদেও হতাশ হবেন না। মনে রাখবেন! যত কঠিন বিপদই আসুক না কেন, তা চিরস্থায়ী নয়। নিশ্চয়ই কষ্টের পর স্বস্তি আসে, পরাজয়ের পর আসে বিজয় আর অস্থিরতার পর আসে শান্তি, যেভাবে বৃষ্টির পর দেখা দেয় নির্মল স্বচ্ছ আকাশ। চূড়ান্ত সংকটের পরেই আল্লাহর রহমত নেমে আসে। যখন বিপদ চরমে পৌঁছে, তখনই নেমে আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রশান্তি। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন না, বিষণ্নতাকে সঙ্গী করবেন না, হতাশায় বন্দি হবেন না, দুশিন্তার গোলামীতে নিজেকে আবদ্ধ করবেন না। কারণ দুশ্চিন্তার বিষক্রিয়া চিন্তাভাবনাকে বিভ্রান্ত করে ও জীবনকে সংকুচিত করে ফেলে।
কাজেই অতীতের হারিয়ে যাওয়া কিছু নিয়ে অতিরিক্ত অনুশোচনা করে নিজেকে অতিমাত্রায় বিষাদ, আফসোস ও দুঃখের মধ্যে ফেলবেন না। বিপর্যয় ও যন্ত্রণার স্মৃতি স্মরণে অতিরঞ্জন করবেন না। কারণ অতিরিক্ত দুঃখ মনের শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়, হৃদয়কে ভেঙে চুরমার করে দেয় আর দেহকে নিঃশেষ করে ফেলে।
কতক ব্যক্তি তো এমন আছে যে, তারা সন্তান বা পিতা-মাতাকে হারানোর কারণে বিষাদে এমনভাবে কান্না করতে থাকে, যা তার শক্তি ফুরিয়ে যাওয়া ও অস্তিত্ব বিলীন না হওয়া পর্যন্ত চলতেই থাকে। অতএব, আপনার মনকে সেই সমস্ত বিষয়ে ব্যস্ত করবেন না, যা আপনার থেকে চলে গেছে বা দূরে সরে গেছে। আপনার ভাগ্যে যা লেখা ছিল না এমন কোনো অতীতের দুঃখ, আক্ষেপ ও অনুশোচনায় নিজের জীবনকে ধ্বংস করবেন না।
হে আহত ও বিমর্ষ হৃদয়! প্রত্যেক বিপদ ও সমস্যায় ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ পাঠ করুন। কারণ এটি দুঃখ ও উদ্বেগের উপশমকারী এবং শোকাহতদের জন্য সান্ত্বনার বাণী। মহান আল্লাহ এই ‘ইন্নালিল্লাহ...’-কে বিপদগ্রস্তদের জন্য আশ্রয়স্থল এবং পরীক্ষায় নিপতিত ব্যক্তিদের জন্য একটি প্রতিরক্ষা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। যারা ধৈর্যধারণ করে এবং তা পাঠ করে, তাদের ধৈর্যধারণ ও আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে মহান আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় ক্ষমা ও রহমতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তোমাদেরকে অবশ্যই পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। আর আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদেরকে। যারা তাদের উপর বিপদ আসলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই আর নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের উপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও রহমত এবং তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৫-১৫৭)।
উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘কোনো মুসলিমের ওপর যখন কোনো বিপদ আসে এবং সে আল্লাহর নির্দেশ মেনে বলে, আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাব। হে আল্লাহ! আমাকে এ মুছীবতের বিনিময় দান করুন এবং এর চেয়ে উত্তম বস্তু দান করুন। তাহলে আল্লাহ তাকে তার মুছীবতের বিনিময় দান করবেন এবং তাকে এর চেয়ে উত্তম বস্তু দান করবেন’।[1]
হে বিষাদগ্রস্ত ও ব্যথিত হৃদয়! ধৈর্য হলো মুমিনের জন্য ঢাল এবং আল্লাহর উপর ভরসাকারীর জন্য দুর্গস্বরূপ। তাই ধৈর্য ধরুন এমন বিপদের ওপর, যা আপনাকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং যার কঠিন পরীক্ষা আপনাকে অবসাদগ্রস্ত করেছে। ভাগ্যের মিষ্টতা ও তিক্ততা উভয়ই সহ্য করতে শিখুন এবং কঠিন ও তীব্রতর পরীক্ষাকে ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করুন। কোনো মানুষেরই সারাজীবন শান্তিতে কাটেনি আর কোনো জীবিত ব্যক্তির জন্যও সুখ চিরস্থায়ী হয়নি। যে ব্যক্তি নিজের মনকে ধৈর্যের জন্য প্রস্তুত করে, সে কষ্টের তীব্রতা অনুভব করে না। যে ব্যক্তি তিক্ত কষ্ট সহ্য করে, বিপদ-মুছীবতের বোঝা বহন করে এবং আল্লাহর অবধারিত কঠিন পরীক্ষাগুলোতে ধৈর্যধারণ করে, তাকে এর বিনিময়ে অবিরাম ছওয়াব দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কেবল ধৈর্যশীলদেরকেই তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেওয়া হবে কোনো হিসাব ছাড়াই’ (আয-যুমার, ৩৯/১০)।
হে আল্লাহর বান্দা! সুদৃঢ় বিশ্বাসের মাধ্যমে আপনার দুশ্চিন্তার ভাবনাগুলো ঝেড়ে ফেলুন। কারণ দৃঢ় বিশ্বাস আশাকে প্রশস্ত করে, অন্তরকে প্রশান্ত করে আর অন্তরকে স্বস্তি দেয়। আপনার ওপর আপতিত বিপদ ও ঘটমান বিপর্যয়গুলো সহজভাবে গ্রহণ করুন। কারণ আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখা, তাঁকে ডাকা, তাঁর শরণাপন্ন হওয়া এবং অধিক পরিমাণে তাঁর যিকির করা জমে থাকা দুঃখ, প্রবল উদ্বেগ, অস্থিরতা সৃষ্টিকারী ভয়, গভীর বিষণ্নতা ও জ্বলন্ত অনুশোচনা দূর করে দেয়। আমরা কেবল আল্লাহর কাছেই আশা রাখি, তাঁর দয়ার মাধ্যমেই মুক্তি চাই। কতই না বড় বিপদ তাঁর অপার দয়ায় দূরীভূত হয়েছে! কত তীব্র সংকট আল্লাহর রহমতে প্রশান্তিতে পরিণত হয়েছে! কত দুঃখ তাঁর অনুগ্রহ ও করুণায় লাঘব হয়েছে! কত কঠিন দুঃখ-বেদনা তিনি তাঁর অশেষ দয়া ও কল্যাণে মুছে দিয়েছেন! কাজেই আপনি সকল কাজে পরম দয়ালু আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, তাঁর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখুন এবং তাঁর ফয়সালার ওপর ধৈর্যধারণ করুন।
হে মুসলিমগণ! মনের দুঃখ লাঘব করা, হৃদয়কে আনন্দ দেওয়া, কষ্ট থেকে মুক্তি খোঁজা, আহত অন্তরকে শক্তিশালী করা, মন্দ চিন্তা ও উদ্বেগ মোকাবিলা করা একটি শারঈ ও বুদ্ধিবৃত্তিক দাবি। কারণ লুকানো দুঃখ-যন্ত্রণা হৃদয়কে দুর্বল করে দেয়, ইচ্ছাশক্তিকে হ্রাস করে, ক্লান্তি সৃষ্টি করে, জীবনকে বিপর্যস্ত করে, কল্যাণের পথ রুদ্ধ করে দেয় এবং সঠিক পথ অনুসরণের জন্য চলতে থাকা ব্যক্তিদের গতিতে বাধা সৃষ্টি করে।
কুরআন তেলাওয়াত অন্তরকে শান্তি দেয়, বিপদাপদ থেকে মুক্তির পথ তৈরি করে এবং এর মাধ্যমে দুর্দিনের যন্ত্রণা কমে যায়। সৎ ও কল্যাণকামী বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করা শরীরের জন্য স্বাস্থ্যকর এবং মনোবেদনা থেকে মুক্তির অন্যতম মাধ্যম।
দুঃখের উত্তাপ এবং কষ্টকে হালকা করার অন্যতম মাধ্যম হলো, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি জানবে যে, তার যা কিছু ক্ষতি হয়েছে বা তার উপর যে বিপদ এসেছে, তার চেয়ে বড় ও কঠিন বিপদ থেকে সে রক্ষা পেয়েছে। তাকে এটাও জানতে হবে যে, নবী-রাসূল ও সৎকর্মশীল বান্দারাও জীবনে কোনো না কোনো সময়ে বিপদাপদ ও পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন।
পরিপূর্ণ সান্ত্বনা লাভের উপায় হলো, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি বিশ্বাস করবে যে, যেসব যন্ত্রণা, রোগ ও বিপদ তাকে আক্রমণ করছে, তা তার গুনাহকে মোচন করে দেয়। কেননা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো ঈমানদার ব্যক্তি এমন কোনো ব্যথা-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, দুঃখ ভোগ করে, এমনকি দুর্ভাবনা পর্যন্ত; যার বিনিময়ে তার কোনো গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’।[2] ফযল বিন সাহল বলেছেন, রোগ-ব্যাধির মধ্যে এমন কিছু কল্যাণ নিহিত রয়েছে, যা বুদ্ধিমান মানুষের অজানা থাকা উচিত নয়। এগুলো হলো পাপ মাফ হওয়া, ধৈর্যের পুরস্কার লাভের সুযোগ, গাফলতি থেকে জাগরণ, সুস্থতার সময় আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ, তওবায় উদ্যোগী হওয়া এবং দান-ছাদাক্বায় উৎসাহিত হওয়া।
অতএব, যে ব্যক্তি নিজের মন ও জিহ্বাকে অসন্তোষ ও বিমুখতা থেকে সংযত রাখে, তাকে তার চোখের অশ্রু, হৃদয়ের চিন্তা এবং বুকের ব্যথার জন্য পাকড়াও করা হবে না। বরং নিন্দা, দোষ ও পাপ হলো সেই ব্যক্তির জন্য, যে ব্যক্তি বুক চাপড়ায়, আর্তনাদ করে শোক প্রকাশ করে, অসন্তুষ্ট হয় এবং সত্য থেকে বিমুখ থাকে। কেননা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যারা (মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশে) গণ্ডে চপেটাঘাত করে, জামার বক্ষ বিচ্ছিন্ন করে এবং জাহেলী যুগের মতো চিৎকার করে; তারা আমাদের দলভুক্ত নয়’।[3]
আল্লাহ আমাকে ও আপনাদেরকে ক্ষমা ও সুস্থতা দান করেছেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন। আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা কিছু পেলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, বিপদে পড়লে ধৈর্যধারণ করে এবং পাপ করলে তওবা করে।
أقول ما تسمعون وأستغفر الله فاستغفروه، ويا فوز المستغفرين.
দ্বিতীয় খুৎবা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি তাঁর অপার দয়ায় আশ্রয় প্রত্যাশীকে আশ্রয় দেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। তিনি স্বীয় অনুগ্রহের মাধ্যমে তাদের আরোগ্য দান করেন, যারা অসুস্থতার কারণে নিরাশ হয়ে পড়েছিল। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নবী ও সর্দার মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। যে তাকে অনুসরণ করে, সে হেদায়াতের পথে থাকে আর যে তাঁর অবাধ্য হয়, সে গোমরাহী ও ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত হয়। আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর উপর, তাঁর পরিবার ও ছাহাবীদের উপর।
হে মুসলিমগণ! বিপদগ্রস্তদের সান্ত্বনা দেওয়া, তাদের নিকট শোকপ্রকাশ করা এবং তাদেরকে সমবেদনা জানানো মহৎ ও উত্তম কাজ। অতএব, আপনি সকল শোকাহতকে সান্ত্বনা দিন, আহত হৃদয়গুলোতে শক্তির সঞ্চার করুন, দুঃখী ও মর্মাহতদের প্রতি সহানুভূতি দেখান, তাদের উৎসাহিত করুন, ধৈর্যধারণ করতে বলুন, তাদের মনোবল বৃদ্ধি করুন এবং তাদের সহায়তা করুন।
উসামা ইবনু যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক সময় আমরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো এক কন্যার পক্ষ থেকে একজন সংবাদবাহক এসে তাঁকে জানাল যে, তাঁর কন্যার পুত্রের মৃত্যুযন্ত্রণা আরম্ভ হয়েছে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদবাহককে বলে দিলেন, ‘তুমি ফিরে যাও এবং তাকে জানিয়ে দাও, আল্লাহ যা নিয়ে নিয়েছেন এবং তিনি যা দিয়ে রেখেছেন সবকিছুরই তিনি মালিক। তাঁর কাছে প্রতিটি জিনিসের মেয়াদ সুনির্ধারিত। সুতরাং তাকে গিয়ে ছবর করতে এবং প্রতিদানের আশা রাখতে বলো’। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কন্যা পুনরায় সংবাদবাহককে পাঠালেন। সে এসে বলল, আপনাকে তার কাছে যাওয়ার জন্য তিনি কসম দিয়ে বলেছেন। এরপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাওয়ার জন্য দাঁড়ালেন, তাঁর সঙ্গে সা‘দ ইবনু উবাদা ও মুআয ইবনু জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-ও দাঁড়িয়ে গেলেন। এরপর শিশুটিকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে দেওয়া হলো। তখন শিশুটির শ্বাস এমনভাবে ক্ষীণ হয়ে আসছিল, যেন তা একটি মশকে রয়েছে। তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চোখ সিক্ত হয়ে গেল। সা‘দ ইবনু উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (এটা কী?) তিনি বললেন, ‘এটিই রহমত বা দয়া-মায়া, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তরে তিনি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। বস্তুত আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা দয়ালু আল্লাহ তাদের প্রতিই দয়া প্রদর্শন করে থাকেন’।[4]
হে আল্লাহ! আমাদের ফিলিস্তীনী ভাইবোনদেরকে দখলদার যালেমদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করুন এবং মাসজিদুল আক্বছাকে দখলদার অভিশপ্ত ইয়াহূদীদের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করুন- আমীন!
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৯১৮।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৭২।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/১২৯৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৩।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩৭৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৯২৩।