কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের উপায়

post title will place here

[১৫ শা‘বান, ১৪৪ হি. মোতাবেক ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ মদীনা মুনাওয়ারার আল-মাসজিদুল হারামে (মসজিদে নববী) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খড. খালেদ আল-মাহনা হাফিযাহুল্লাহউক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]

প্রথমখুৎবা

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি ‘পাপ ক্ষমাকারী, তওবা কবুলকারী, কঠোর আযাবদাতা, অনুগ্রহ বর্ষণকারী। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন’ (গাফির, ৪০/)। দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে প্রেরিত আমাদের নবী, ইমাম ও নেতা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি। তাঁর বংশধরদের উপর, সমস্ত ছাহাবী ও মহান অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের উপরও শান্তি অবতীর্ণ হোক।

অতঃপর, হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা মহান আল্লাহকে ভয় করে চলুন। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা সে দিনের ভয় করো, যে দিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে সে যা উপার্জন করেছে, তা পুরোপুরি দেওয়া হবে। আর তাদের উপর যুলম করা হবে না’ (আল-বাকারা, ২/২৮১)

হে মুসলিমগণ! যখন মহান আল্লাহ আদি পিতা আদম আলাইহিস সালাম-কে সৃষ্টি করলেন এবং তাঁর থেকে হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করলেন, তখন তাদেরকে তাঁকে রব, সৃষ্টিকর্তা ও এক ইলাহ হিসেবে মেনে নেওয়ার জ্ঞানসহ সৃষ্টি করলেন। একমাত্র তিনিই সর্বোচ্চ সম্মান ও ভালোবাসা লাভের উপযুক্ত আর তাদেরকে ও তাদের বংশধরকে সৃষ্টি করেছেন দুঃখ-কষ্ট, আদেশ-নিষেধ ও ভালোমন্দের দ্বারা পরীক্ষা করার জন্য। সেই সুমহান সত্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, যিনি আত্মাগুলোকে সৃষ্টি করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন। তিনি এগুলোর মধ্যে রেখেছেন গতি ও ইচ্ছাশক্তি, অভিপ্রায় ও সংকল্প, ভালোবাসা ও ঘৃণা এবং পরিবর্তন ও প্রভাবিত হওয়ার ক্ষমতা। মহাজ্ঞানী ও মহান সৃষ্টিকর্তা অবগত আছেন যে, তাঁর বান্দার নফসসমূহ যদিও কল্যাণ ও সুন্দরের উপরে তৈরিকৃত; কিন্তু তা মন্দের ইচ্ছা থেকে মুক্ত নয়, যখন তা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়। অন্তরের রয়েছে আনুগত্যের প্রতি অগ্রসর হওয়া ও পাপ কাজ থেকে পিছপা হওয়ার প্রবণতা। তার রয়েছে ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ এবং মন্দ কাজের প্রতি ইচ্ছা।

আর মহান আল্লাহ পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু। তিনি পরম ক্ষমাশীল ও তওবা কবুলকারী। মাখলূক্ব সৃষ্টির পর আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে লিপিবদ্ধ করলেন এবং তা (সেই লিপি) তাঁর কাছে আরশের উপরে রয়েছে। তা হলো, ‘আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রাধান্য লাভ করবে’।[1]

নিশ্চয়ই তাঁর অগাধ ও বিস্তৃত দয়া সকল সৃষ্টির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। যার প্রভাব আসমান ও যমীনব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করেছে। তার মধ্যে একটি হলো তিনি তাঁর নিজ দয়ায় তাঁর তাওহীদপন্থি মুসলিম বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। কারণ তিনি পরম ক্ষমাশীল। এ কারণে তিনি নিজেকে ‘গফূর’, ‘গাফফার’ ও ‘গাফির’ বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁর ক্ষমা এমন যে, তা পাপগুলোকে এমনভাবে আড়াল করে দেয়, যাতে পাপীরা তাদের পাপের কারণে দুনিয়া ও আখেরাতে অপমানিত না হয়। সেই সাথে তাদের পাপ মুছে ফেলা হয় এবং তাদের শাস্তি ক্ষমা করা হয়, যতক্ষণ না সেই পাপ কুফর বা বড় শিরক পর্যায়ে পৌঁছায়। কারণ শিরকের গুনাহ কখনও ক্ষমা করা হয় না। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন’ (আন-নিসা, ৪/৪৮)। আর সেই ইচ্ছার অন্তর্ভুক্ত বিষয় হলো পাপ থেকে ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করা।

হে আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয় ইস্তিগফার হলো ক্ষমাপ্রাপ্তির মূল কারণ ও ভিত্তি এবং সবচেয়ে বড় উপায়। এ জন্যই মহান আল্লাহ তাঁর সর্বোত্তম সৃষ্টিকে ইস্তিগফারের আদেশ দিয়েছেন, যাতে তাঁর উম্মত তা অনুসরণ করে। আর তিনি তাওহীদের জ্ঞানার্জনের নির্দেশের পরেই ইস্তিগফারের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব, জেনে রাখো! নিঃসন্দেহে আল্লাহ ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মুমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/১৯)

নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আল্লাহর ক্ষমার প্রতি অগ্রগামীদের শিরোমণি এবং আল্লাহর কাছে ইস্তিগফারকারী বান্দাদের মধ্যে আল্লাহকে অধিক ভয়কারী। হাদীছে এসেছে, প্রতিটি মজলিসে হিসাব করে দেখা গেছে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত মজলিস হতে উঠে যাওয়ার আগে ১০০ বার বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দাও এবং আমার তওবা গ্রহণ করো। কারণ তুমিই তওবা কবুলকারী, ক্ষমাকারী’।[2] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সম্পর্কে বলতেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি প্রত্যহ আল্লাহর কাছে ৭০ বারেরও বেশি ইস্তিগফার ও তওবা করে থাকি’।[3]

ইস্তিগফারের ফযীলত ও মর্যাদার বড় প্রমাণ হলো, আল্লাহ তাআলা তাঁর সম্মানিত ফেরেশতাদেরকে মুমিন বান্দাদের জন্য ইস্তিগফারের ইলহাম করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আরশকে ধারণ করে এবং যারা এর চারপাশে রয়েছে, তারা তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করে এবং তাঁর প্রতি ঈমান রাখে। আর মুমিনদের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলে যে, হে আমাদের রব! আপনি রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সবকিছুকে পরিব্যাপ্ত করে রয়েছেন। অতএব, যারা তওবা করে এবং আপনার পথ অনুসরণ করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন আর জাহান্নামের আযাব থেকে আপনি তাদেরকে রক্ষা করুন’ (গাফির, ৪০/৭)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ যতক্ষণ পর্যন্ত ছালাতের স্থানে বসে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতারা তার জন্য এই বলে দু‘আ করতে থাকবে যে, হে আল্লাহ! তার প্রতি দয়া করো, হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা করো, তুমি তার তওবা কবুল করো, যতক্ষণ না সে অপরকে কষ্ট দেয় এবং অপবিত্র না হয়’।[4]

ইস্তিগফারের ফযীলত হলো আল্লাহ তাআলা ইস্তিগফারের সাথে দিন-রাত ও জীবনকে অতিবাহিত করার নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর মুত্তাক্বী বান্দাদের প্রশংসা করে এবং জান্নাতুন নাঈম নির্ধারিত হবে এমন কর্মের বর্ণনা দিয়ে ইরশাদ করেছেন, ‘রাতের সামান্য অংশই তারা ঘুমিয়ে কাটাত আর রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকত’ (আয-যারিয়াত, ৫১/১৭-১৮)। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সারাজীবন ধরে ইস্তিগফার করার নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে আর তুমি লোকদেরকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে দাখিল হতে দেখবে, তখন তুমি তোমার রবের সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করো এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় তিনি তওবা কবুলকারী’ (আন-না, ১১০/১-৩)। এজন্য নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁর পবিত্র যবান থেকে সর্বশেষ উচ্চারিত বাণী ছিল, ‘হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করো, আমার প্রতি দয়া করো আর আমাকে মহান বন্ধুর সঙ্গে মিলিত করো’।[5]

আর ইস্তিগফারের ফযীলত ও বান্দার জন্য ইস্তিগফারের প্রবল প্রয়োজনীয়তা থাকার কারণে মুত্তাক্বীদের ইমাম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে শিখিয়েছেন যে, তারা যেন ইস্তিগফারের মাধ্যমেই (দিনের কাজ) শুরু করে এবং তা দিয়েই শেষ করে। সায়্যিদুল ইস্তিগফার হলো বান্দার এ দু‘আ পড়া, ‘হে আল্লাহ! তুমিই আমার প্রতিপালক। তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের উপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নেয়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। কারণ তুমি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারবে না’।[6]

এই বরকতময় নববী দু‘আতে এমন সমস্ত উপাদান রয়েছে, যা ইস্তিগফার কবুল হওয়ার বড় কারণ। এতে আল্লাহর কাছে তাঁর তাওহীদে রুবূবিয়্যাহ ও উলূহিয়্যাহর স্বীকৃতি, তাঁর প্রতি বান্দার সম্পূর্ণ আনুগত্য ও বিনয়, আল্লাহর নেয়ামতের স্বীকারোক্তি, বান্দার নিজের পাপের স্বীকৃতি এবং আল্লাহর ক্ষমার প্রতি চূড়ান্ত নির্ভরতার মধ্যস্থতায় ইস্তিগফার করা হয়েছে। কেননা একমাত্র তিনিই ক্ষমা করার যোগ্য এবং এটি তাঁর রুবূবিয়্যাহর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটি কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট, অন্য কারও জন্য নয়।

যখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি এবং এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ছালাতে পড়ার জন্য একটি দু‘আ জানতে চাইলেন, তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শিখিয়ে দিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি নিজের উপর অধিক যুলম করেছি। আপনি ছাড়া সে অপরাধ ক্ষমা করার কেউ নেই। আপনার পক্ষ থেকে আমাকে তা ক্ষমা করে দিন এবং আমার উপর রহমত বর্ষণ করুন। নিশ্চই আপনি ক্ষমাশীল ও দয়াশীল’।[7]

এই বরকতময় ইস্তিগফারের দু‘আটি সায়্যিদুল ইস্তিগফারের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তবে পার্থক্য হলো এই দু‘আটি বান্দার নিজের নফসের প্রতি কৃত যুলমের স্বীকারোক্তি দিয়ে শুরু হয়েছে। কেননা নিজের নফসের উপর যুলম করা কাবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। মানুষের ফিতরাত হলো আল্লাহকে ভালোবাসা ও তাঁকে মহিমান্বিত করা। কিন্তু যখন মানুষ গুনাহ করে, তখন সে তার ফিতরাতের বিপরীতে চলে যায় এবং নিজেকে দুনিয়া ও আখেরাতের শাস্তির সম্মুখীন করে।

এই দু‘আটিতে বান্দার গুনাহের স্বীকারোক্তি, আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন এবং তাঁর গুণাবলির মাধ্যমে তাওয়াসসুল বা মধ্যস্থতা করা হয়েছে। এটি আল্লাহর পরিচয় লাভকারী ব্যক্তিদের দু‘আ। এর মর্যাদা ও প্রতিদান অনেক বেশি, যা ইঙ্গিত করে যে, দু‘আকারী নিজের ভুল সম্পর্কে সচেতন এবং সে তার পাপের জন্য অনুতপ্ত। তার অন্তর নত হয়েছে এবং যাবতীয় অহংকার তার অন্তর থেকে দূর হয়েছে। এটি এমন দু‘আ, যা কবুল হওয়ার আশা করা যায় এবং যার মাধ্যমে দু‘আকারী আল্লাহর ক্ষমার শীতল পরশ লাভ করতে পারে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে কিংবা নিজের প্রতি যুলম করবে, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, সে আল্লাহকে পাবে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আন-নিসা, ৪/১১০)

যখন তাওহীদ ইস্তিগফারের সাথে মিলিত হয়, তখন বান্দার জন্য অমুখাপেক্ষিতা ও সৌভাগ্য লাভ করা সহজ হয় এবং তার সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যায়। আর আল্লাহ ছাড়া কোনো ক্ষমতা ও শক্তি নেই।

ইস্তিগফারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় মহান প্রতিপালক তাঁর বান্দাদেরকে ইস্তিগফারের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর বলুন, হে আমার প্রতিপালক! ক্ষমা করুন এবং দয়া করুন, আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু’ (আল-মুমিনূন, ২৩/১১৮)। কাজেই বান্দা সর্বদা তার আমল কবুল হওয়ার কামনা করে। সে তার আমলের ত্রুটি নিয়ে শঙ্কিত থাকে। সে সবসময় আশঙ্কায় থাকে যে, তার কৃত আমল আল্লাহর কাছে কবুল হচ্ছে তো? সে আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করে, যাতে তার আমল ত্রুটিমুক্ত থাকে। এজন্য ইসলামী শরীআতে ছালাত শেষে তিনবার ইস্তিগফার করার বিধান রাখা হয়েছে।

ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন ও দৃঢ় সংকল্পের অধিকারীরা ইবাদতের পর সর্বদা বেশি বেশি ইস্তিগফার করেন। কারণ তারা নিজেদের ত্রুটিবিচ্যুতি ও আল্লাহর মাহাত্ম্য ও তাঁর মহিমান্বিত সত্তার সাথে উপযুক্ত হক্ব পরিপূর্ণভাবে আদায় করতে না পারার বাস্তবতা উপলব্ধি করেন। একইভাবে বান্দা যখন কোনো না কোনো পাপ করেই থাকে, তখন সে এর শাস্তিকে ভয় পায়। তাই সে আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করে, যেন আল্লাহ তার পাপসমূহ মুছে দেন এবং তা গোপন রাখেন।

অতএব, হে আল্লাহর বান্দাগণ! ইস্তিগফার হলো গুনাহের জন্য অনুতাপ ও আল্লাহর হক্বের প্রতি অবহেলা করার জন্য অন্তরের লুকানো অনুশোচনা।

 أقول قولي هذا وأستغفر الله العظيم لي ولكم.

দ্বিতীয় খুৎবা

সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যা তার সত্তার জন্য উপযুক্ত। দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক তাঁর বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের উপর।

অতঃপর, হে আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয়ই ইস্তিগফার সর্বোত্তম সৎকর্ম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতগুলোর একটি, যার দ্বারা বান্দাগণ উত্তম পুরস্কার লাভ করে এবং তাদের থেকে কঠিন শাস্তি দূর হয়।

বান্দা বড়ই নিঃস্ব এবং গুনাহগার। যদি তার প্রতি আল্লাহর ক্ষমা না থাকত, তাহলে সে তার পাপের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পেত না। কেননা সকল বিপদ-আপদের মূল কারণ হলো বান্দাদের পাপ এবং এই বিপদ দূর করার একমাত্র উপায় হলো আল্লাহর ক্ষমা লাভ করা। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহ এমন নন যে, তাদেরকে আযাব দিবেন এ অবস্থায় যে, তুমি তাদের মাঝে বিদ্যমান এবং আল্লাহ তাদেরকে আযাব দানকারী নন এমতাবস্থায় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করছে’ (আল-আনফাল, ৮/৩৩)। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, তাদের মধ্যে দুটি নিরাপত্তার মাধ্যম ছিল— আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ইস্তিগফার। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু ইস্তিগফার এখনো রয়ে গেছে’।[8]

হে মুসলিমগণ! ইস্তিগফার হলো বরকত লাভের এক মহান মাধ্যম। যাকে ইস্তিগফারের পথ দেখানো হয়েছে, তার দরজায় কল্যাণের বহর এসে উপস্থিত হয়েছে এবং দুঃখ-কষ্ট ও হতাশা সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। কেননা পাপ যখন দুঃখ-কষ্ট, সংকট ও বিপদ-আপদের কারণ হয়; তখন ইস্তিগফার সেসব থেকে মুক্তির উপায় হয়ে দাঁড়ায় এবং বান্দার জন্য কষ্টকর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে প্রশান্তি, সমাধান, সুস্থতা ও রিযিক্বের পথ উন্মুক্ত হয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর বলেছি, তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন আর তোমাদেরকে ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দিবেন আর দিবেন নদীনালা’ (সূরা নূহ, ৭১/১০-১২)

হে আল্লাহর বান্দাগণ! যেমন আল্লাহর কাছে দু‘আর মাধ্যমে ক্ষমা চাওয়া হয়, তেমনি ক্ষমা লাভের জন্য কিছু সৎ আমলও রয়েছে, যা তাঁর ক্ষমা লাভের বড় মাধ্যম। এ কারণেই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রবের কাছে সেই সব আমলের জন্য দু‘আ করেছেন, যা তাঁর দয়া ও ক্ষমা লাভের আবশ্যকীয় মাধ্যম। এগুলো হলো নেক আমল ও আনুগত্যের কাজ। এমন সব সৎ আমল, যা গুনাহ মাফ হওয়া নিশ্চিত করে এবং যা বান্দার তওবা সঠিক হওয়া ও সততার সাথে আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার উপর প্রমাণ করে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যারা আমার আয়াতসমূহের উপর ঈমান আনে, তারা যখন তোমার কাছে আসে; তখন তুমি বলো, তোমাদের উপর সালাম। তোমাদের রব তাঁর নিজের উপর লিখে নিয়েছেন দয়া। নিশ্চয় যে তোমাদের মধ্যে থেকে না জেনে খারাপ কাজ করে, তারপর তওবা করে এবং শুধরে নেয়; তবে তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আল-আনআম, ৬/৫৪)

হে আল্লাহ! আপনিই আমাদের উত্তম অভিভাবক। অতএব, আমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনিই তো পরম ক্ষমাশীল!


 [1]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৫১।

 [2]. তিরমিযী, হা/৩৪৩৪।

 [3]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩০৭।

 [4]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৪৯।

 [5]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৭৪।

 [6]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩০৬।

 [7]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৩৪।

 [8]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৯০৩৭।

Magazine