কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

দুনিয়াবী সংশোধন ও পরকালীন সৌভাগ্য অর্জনের মাধ্যমে সফলতা লাভের উপদেশসমূহ

[৩০যুলহিজ্জাহ, ১৪৪৩ হি. মোতাবেক ২৯ জুলাই, ২০২২। মদীনা মুনাওয়ারার আল-মাসজিদুল হারামে (মসজিদে নববী) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খ আব্দুল মুহসিন ইবনু মুহাম্মাদ আল-ক্বাসেম হাফিযাহুল্লাহউক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচ-ডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]

প্রথমখুৎবা

সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর কাছে সাহায্য ও ক্ষমা চাই। তাঁর কাছেই আমাদের আত্মার অনিষ্ট হতে এবং খারাপ আমল থেকে আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে হেদায়াত দেন, কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না, আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন, কেউ তাকে হেদায়াত দান করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো মা‘বূদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। দরূদ ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও ছাহাবীদর উপর।

অতঃপর, হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা আল্লাহকে যথাযথ ভয় করুন এবং গোপনে ও নির্জনে তাঁকেই ভয় করে চলুন।

হে মুসলিম সম্প্রদায়! আল্লাহ তাআলা এ পার্থিব জীবনকে বান্দাদের জন্য পরীক্ষাগার বানিয়েছেন। তারা এই জীবনের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে চিরস্থায়ী গৃহের দিকে ধাবমান। এই দুনিয়া আমলকারীদের কর্মক্ষেত্র ও ইবাদতকারীদের জন্য ব্যবসাস্থল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন ‍মৃত্যু ও জীবন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম’ (আল-মুলক, ৬৭/২)

অতএব, যে ব্যক্তি উত্তম আমল করবে সে সফলকাম ও ছওয়াবের অধিকারী হবে। আর যে ব্যক্তি খারাপ ও ত্রুটিযুক্ত আমল করবে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং শাস্তির অংশীদার হবে।

আল্লাহ তাআলার মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য হলো, তারা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে। তিনি তাদের নিজেদের ও চারপাশে বিভিন্ন নিদর্শন স্থাপন, রাসূলগণকে প্রেরণ ও কিতাবসমূহ অবতরণের মাধ্যমে তাঁর এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তাদেরকে সহযোগিতা করেছেন। যার মাধ্যমে তাদের উপর প্রমাণ সাব্যস্ত হয়েছে এবং তাদের নিকট দলীল সুস্পষ্ট হয়েছে। তিনি প্রতিটি বান্দার জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং তিনি তার জ্ঞানের মাধ্যমে প্রত্যেকের জন্য একটি বয়সসীমা লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। সুতরাং বান্দার এই দুনিয়াবী জীবন হলো সাক্ষাতের পূর্বেই তার রবের উদ্দেশ্যে আমল ও পরিশ্রম করার সময়কাল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানুষ! তোমার রব পর্যন্ত (পৌঁছতে) অবশ্যই তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাৎ পাবে’ (আল-ইনশিক্বাক্ব, ৮৪/৬)

আখেরাতের তুলনায় এই দুনিয়া খুবই সংক্ষিপ্ত। একজন বান্দা যত বয়সই প্রাপ্ত হোক না কেন তার একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে, যেখানে তাকে অবশ্যই পৌঁছতে হবে। প্রকৃতপক্ষে বয়সের বৃদ্ধি মানে বয়সের কমতি এবং মৃত্যুর নিকটবর্তী হওয়া। অধিকাংশ মানুষই তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে উদাসীন, ফলে দুনিয়ার চাকচিক্য ও ফেতনা তাদেরকে মোহচ্ছন্ন করে রাখে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অধিক (পার্থিব) সুখ সম্ভোগ লাভের মোহ তোমাদেরকে (অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে) ভুলিয়ে রেখেছে। এমনকি (এ অবস্থাতেই) তোমরা কবরে এসে পড়’ (আত-তাকাছুর, ১০২/১-২)

এই কারণে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের অসংখ্য জায়গায় সময়, সময়ের বিভিন্ন অংশ ও স্তরের আলোচনা করেছেন; বান্দাদেরকে জীবনের বিভিন্ন পরিবর্তন ও দ্রুত নিঃশেষের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। এজন্য আল্লাহ তাআলা রাত, দিন, সূর্য, চন্দ্র, পূর্বাহ্ণের প্রথম প্রহর, ফজর ও আছরের শপথ করেছেন। আর সূর্য ও চন্দ্রের গতিময়তায় সময়ের পরিসমাপ্তি ও অবস্থার পরিবর্তনের বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর চাঁদের জন্য আমরা নির্দিষ্ট করেছি বিভিন্ন মনযিল; অবশেষে সেটা শুষ্ক বাঁকা, পুরোনো খেজুর শাখার আকারে ফিরে যায়। সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া এবং রাতের পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রমকারী হওয়া। আর প্ৰত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে সাতার কাটে’ (ইয়াসিন, ৩৬/৩৯-৪০)

আর বান্দার জীবন থেকে শেষ হয়ে যাওয়া প্রতিটি বছর বরং প্রতিটি দিনই তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রত্যেক শুরুরই শেষ আছে।

নতুন বছরের ফজর উদিত হয়ে নফসকে একথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সুযোগ এখনো বিদ্যমান আছে এবং আশা ও প্রত্যাশাও এখনো বিরাজমান। আর জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের কর্মের পরিণতি ও জীবনের ফলাফল সম্পর্কে সেরূপ হিসাব রাখে, যেরূপ সে তার ব্যবসা-বাণিজ্যের লাভ-ক্ষতির হিসাব রাখে। জীবন হলো প্রতিটি সৃষ্টিজীবের মূল চালিকাশক্তি এবং তার সরঞ্জাম হলো সুস্থতা ও শক্তি-সামর্থ্য। অথচ এ দুটি বিষয়েই অধিকাংশ মানুষ ধোঁকায় নিপতিত।

নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দুটি নেয়ামত এমন আছে, যে দুটোর ব্যাপারে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হলো সুস্থতা ও অবসর’।[1] দুনিয়ার লাভ অর্জিত হয় সৎআমল সম্পাদন এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকার মাধ্যমে।

আদম সন্তান দীর্ঘ জীবন লাভের প্রত্যাশা করে এবং দুনিয়া ও তার মাঝে অবস্থিত ধনসম্পদ এবং ভোগ্যসামগ্রীর প্রতি লালায়িত থাকে। আর তাকে দুনিয়ার সুখস্বাচ্ছন্দ্য শেষ পরিণতি ও মৃত্যু নিকটবর্তী হওয়ার স্মরণ থেকে বিমুখ রাখে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আদম সন্তান বৃদ্ধ হয় এবং তার দুটি জিনিসি যুবক হয়; প্রাচুর্যের আকাঙ্ক্ষা ও দীর্ঘায়ু কামনা’।[2]

যে ব্যক্তি দুনিয়ার বাস্তব রূপ ও তার দ্রুত পরিসমাপ্তির বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে তার জন্য উচিত হলো, প্রতিটি কাজে অধিকতর উপকারী কাজটি সম্পাদন করা এবং সকল বিষয়ে সর্বোত্তমটি চয়ন করা। সুতরাং সে তার মূল্যবান সময়কে ব্যয় করবে পূর্ণতর উপকারী ও সর্বোচ্চ লাভজনক ক্ষেত্রে। আর সে নির্বাচন করবে সর্বোচ্চ ফযীলতপূর্ণ আমল, সর্বোত্তম নেক কাজ ও মহত্তর পুণ্য কর্মকে। আর বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিজের জন্য জান্নাত ব্যতীত অন্য কোনো বিনিময়েই সন্তুষ্ট হবে না। বরং সে তার প্রতিদান বহুগুণে বৃদ্ধি ও পাপ মোচনের প্রতি আগ্রহী হবে।

আর যে ব্যক্তি তার আমলনামা সৎকাজের মাধ্যমে বৃদ্ধি করে না, তার আমলনামার অবস্থা হ্রাস পেতে থাকে। আর যে কল্যাণের মাধ্যমে অগ্রগামী না হয় সে মন্দকাজের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে অগ্রসর হতে চায় কিংবা যে পিছিয়ে পড়তে চায় তার জন্য’। (আল-মুদ্দাছছির, ৭৪/৩৭)

জীবনে শক্তির পরে দুর্বলতার আগমন একটি আবশ্যিক রীতির অন্তর্গত, আর তারুণ্য ও যৌবনের পরে বার্ধক্যের আগমন এমন একটি বিষয় যার ব্যত্যয় কখনোই ঘটে না এবং সুস্থতার পরে অসুস্থতা এমন অবধারিত বিষয় যা এড়ানোর কোনো উপায় নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ, তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেন দুর্বলতা থেকে, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি; শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য’ (আর-রূম, ৩০/৫৪)। আর ‍দুনিয়ার শুরু ও শেষ পরিণতির উদাহরণ হলো মুষলধারে বৃষ্টির পরে উদগত শস্যক্ষেতের ন্যায়; যার সবুজাভ সতেজতা ও সৌন্দর্য তার মালিককে উৎফুল্ল করে, অতঃপর কিছুকাল পরেই তা খড়কুটায় পরিণত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা জেনে রাখো! নিশ্চয় দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা, ক্রীড়াকৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক গৰ্ব-অহংকার, ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়। এর উপমা হলো বৃষ্টি, যার উৎপন্ন শস্য-সম্ভার কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, তারপর সেগুলো শুকিয়ে যায়, ফলে আপনি ওগুলো পীতবর্ণ দেখতে পান, অবশেষে সেগুলো খড়-কুটায় পরিণত হয়’ (আল-হাদীদ, ৫৭/২০)

যে ব্যক্তি তার শ্মশ্রুতে সুভ্রতা প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ জীবন লাভ করেছে, মূলত তার নিকট মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হওয়ার বার্তা নিয়ে সতর্ককারী আগমন করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমরা কি তোমাদেরকে এত দীর্ঘ জীবন দান করিনি যে, তখন কেউ উপদেশ গ্ৰহণ করতে চাইলে উপদেশ গ্ৰহণ করতে পারত? আর তোমাদের কাছে সতর্ককারীও এসেছিল’ (ফাত্বির, ৩৭/৩৭)। ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আয়াতে উল্লিখিত ‘সতর্ককারী’ হলো বার্ধ্যক্য, আর এ উম্মতের বয়স হলো ৬০ থেকে ৭০ এর মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি ৬০ বছর পর্যন্ত হায়াত পেল দীর্ঘ অবকাশ লাভের দরুন তার ওযর পেশ করার কোনো সুযোগ নেই। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যাকে আল্লাহ দীর্ঘায়ু করেছেন এমনকি ৬০ বছরে পৌঁছিয়েছেন, তার ওযর পেশ করার সুযোগ রাখেননি’।[3] আর এজন্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পার্থিব জীবন ও এর মাঝের যৌবন ও শক্তিমত্তার গুরুত্বপূর্ণ সময় নিঃশেষ হওয়ার পূর্বেই কাজে লাগানোর ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি অবসর ও ধনাঢ্যতার বিপরীত চিত্র আসার পূর্বেই উভয় অবস্থাতে নেক আমল সম্পাদনের পথ দেখিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন ব্যক্তিকে উপদেশে দিতে গিয়ে বলেন, ‘পাঁচটি জিনিস আসার পূর্বে পাঁচটি কাজকে বিরাট সম্পদ মনে করো— (১) তোমার বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে, (২) রোগাগ্রস্ত হওয়ার পূর্বে সুস্বাস্থ্যকে, (৩) দরিদ্রতার পূর্বে অভাবমুক্ত থাকাকে, (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে হায়াতকে’।[4] অর্থাৎ সৎ আমল করা ও সময়ের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে অবসরকে কাজে লাগানো।

সুতরাং বান্দার আজকের দিনটি যেন গতকালের চেয়ে উত্তম হয় এবং আগামীকাল যেন আজকের দিনের তুলনায় কল্যাণকর হয়। আর যে ব্যক্তির উভয় দিন সমান হয়, সে ক্ষতিগ্রস্ত এবং যে ব্যক্তি সরল পথের উপর অটল থাকার পরও তা থেকে ছিটকে পড়ে সে ক্ষতিগ্রস্ত।

আখেরাতকে আবাদ করা ব্যতীত সময় নষ্ট করার মাধ্যমে বছরের দিনগুলো সবচেয়ে বেশি নিষ্ফল হয়। যে ব্যক্তি সময়ের হেফাযত করে না, সে সময় থেকে উপকৃত হতে পারে না। সময়কে আবাদ করার সর্বোত্তম পন্থা হলো— দ্বীন ও দুনিয়ার উপকারী জ্ঞান বেশি করে অর্জন করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, দিনের শুরু ও শেষ ভাগে আল্লাহর যিকির করা, হালাল উপার্জন করা, মানুষের প্রতি সদাচরণ করা।

দুনিয়াতে একই অবস্থায় থাকা অসম্ভব এবং সময় সদা পরিবর্তনশীল। এতে অবশ্যম্ভাবীভাবে বান্দার স্বচ্ছলতা ও অস্বচ্ছলতা, দারিদ্রতা ও ধনাঢ্যতা, নিরাপত্তা ও ভয়-ভীতির অবস্থার মাঝে বসবাস করা ব্যতীত কোনো উপায় নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি তোমাদেরকে অবশ্যই পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৫)

আল্লাহর উপরে যার পূর্ণ ভরসা রয়েছে, কেবল সেই ব্যক্তিই তাকে যথাযথভাবে ভয় করে। যে ব্যক্তি বঞ্চনার কষ্ট ভোগ করেছে, সেই কেবল প্রাপ্তির আনন্দ বুঝতে পারে। সুতরাং যে কোনো উন্নতি ও অবনতি, সংকীর্ণতা ও প্রশস্ততা, বৃদ্ধি ও হ্রাস এবং ভালো ও মন্দের মাঝে আল্লাহর মহৎ হিকমাহ নিহিত রয়েছে। কেবল আল্লাহর ক্ষমতার মাধ্যমেই তাক্বদীরের পরিবর্তন ঘটানো যায় এবং সর্বদা শুকরিয়া আদায় করার মাধ্যমেই তার নিকট কল্যাণ লাভ করা যায়। আর তাক্বদীরকে মেনে নেওয়া কখনোই শারঈ আমলের ক্ষেত্রে অন্তরায় তৈরি করে না।

বান্দা দুনিয়ার জীবনে পরিক্ষিত হয় শয়তানের মাধ্যমে যে তাকে কুমন্ত্রণা দেয়, নফসের মাধ্যমে যে তাকে খারাপ কাজের আদেশ করে এবং কুপ্রবৃত্তির মাধ্যমে যা তার সৎপথের রাস্তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সুতরাং বান্দার জন্য সর্বদা তওবা করা ব্যতীত কোনো পরিত্রাণ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে ফিরে এসো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’ (আন-নূর, ২৪/৩১)। তওবা এমন মহৎ একটি ইবাদত যা আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তওবাহকারীদেরকে ভালোবাসেন’ (আল-বাক্বারা, ২/২২২)

বান্দা পাপ ও উদাসীনতার অধিক নিকটবর্তী। আর ভুল করা মানুষের জন্য অবধারিত বিষয়। আর যে ত্রুটির কারণে তিরস্কার আবশ্যক তা হলো, তওবা না করা ও পাপের উপর অটল থাকা। যে ব্যক্তি কোনো পাপকাজে জড়িয়ে পড়ে সে যেন বেশি বেশি ইস্তেগফার ও সৎ আমলের মাধ্যমে তা ক্ষমা করিয়ে নেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় পুণ্য কাজ পাপকে মিটিয়ে দেয়’ (হূদ, ১১/১১৪)

বিশুদ্ধ তওবার মাধ্যমে জীবনের সমাপ্তি ঘটানোই হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওফীক্ব ও মুক্তি লাভ। সুতরাং যে আল্লাহর নিকট তাওবা করবে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। আর আল্লাহ তাআলা যার তওবা কবুল করবেন, তাকে তার পূর্বের পাপের কারণে পাকড়াও করা হবে না। যে ব্যক্তি পাপে লিপ্ত হওয়ার পর সর্বদা তওবা করে তাকে মৃত্যুর পূর্বে তওবা করার তাওফীক্ব দেওয়া হয়। আর যে গড়িমসি করে, হতে পারে তার তওবা করার পূর্বেই মৃত্যু তাকে পাকড়াও করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে; এরাই হলো সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন’ (আন-নিসা, ৪/১৭)

অতঃপর হে মুসলিমগণ! দুনিয়ার জীবনের দুটি ধাপ রয়েছে; প্রথম ধাপ তোমার দুনিয়ায় আগমনের মাধ্যমে শেষ হয়ে গেছে, আর ‍দ্বিতীয় ধাপে তুমি বর্তমানে অবস্থান করছ। এর পরিসমাপ্তি ঘটবে, যখন শুধু সূর্য উদিত হবে কিন্তু আপনি ‍মৃত্যুবরণ না করা পর্যন্ত তা অস্ত যাবে না। আবার যখন জীবিত থাকাবস্থায় সূর্য অস্ত যাবে কিন্তু আপনার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সূর্য আর উদিত হবে না। ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলতেন, ‘তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের আর অপেক্ষা করো না এবং সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার আর অপেক্ষা করো না। তোমার সুস্থতার সময় তোমার পীড়িত অবস্থার জন্য প্রস্তুতি নাও। আর তোমার জীবিত অবস্থায় তোমার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নাও’।[5]

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে রাসূল) তাদেরকে বলে দিন, পার্থিব ফায়দা সীমিত। আর আখেরাত পরহেযগারদের জন্য উত্তম। আর তোমাদের অধিকার একটি সুতা পরিমাণ ও খর্ব করা হবে না’ (আন-নিসা, ৪/৭৭)

দ্বিতীয়খুৎবা

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর নিমিত্তে, তাঁর দেওয়া অনুগ্রহের জন্য, তাঁর দান ও তাওফীক্বের জন্য তাঁর কৃতজ্ঞতা। আর তাঁর মর্যাদার বড়ত্ব প্রকাশের জন্য আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো মা‘বূদ নেই, তিনি একক তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। অসংখ্য দরূদ ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর প্রতি এবং তাঁর পরিবার ও তাঁর ছাহাবীদের প্রতি।

হে মুসলিমগণ! আল্লাহর মাস মুহাররম আপনাদের সামনে সমাগত। আল্লাহ তাআলা এই মাসকে হারাম হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং এটি হারাম মাসসমূহের মধ্যে একটি অন্যতম মাস, যে মাসগুলোকে আল্লাহ তাআলা স্বীয় কিতাবে হারাম হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং এ সময় অবাধ্যতা ও পাপাচারের মাধ্যমে নিজের নফসের উপর যুলুম করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস ১২টি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না’ (আত-তওবা, ৯/৩৬)

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রামাযানের ছিয়ামের পর সর্বোত্তম ছওম হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের ছওম’।[6] বিশেষত এই মাসের যেদিনে ছিয়াম পালন করবে তা হচ্ছে আশূরার দিন; কেননা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনে ছিয়াম পালন করেছেন এবং ছাহাবীদেরকে ছিয়াম পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ‘এটি এমন দিন, যে দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে (সমুদ্রে) ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। মূসা আলাইহিস সালাম শুকরিয়া হিসেবে এ দিন ছওম রেখেছেন’।[7]

শরীআতে বছরের প্রথম দিনের বিশেষ কোনো মর্যাদা নেই। এ বিষয়ে কোনো ফযীলত বর্ণিত হয়নি। সুতরাং এই দিনকে কোনো শারীরিক, আর্থিক বা অন্য কোনো ইবাদতের সাথে নির্দিষ্ট করা দ্বীনের মধ্যে নব আবিষ্কার ও মহান শরীআতকে এড়িয়ে যাওয়ার শামিল। অতঃপর জেনে রাখুন! আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে তাঁর নবীর উপর দরূদ ও সালাম পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

এরপর সম্মানিত খত্বীব রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার, চার খালীফা ও ছাহাবীদের উপর দরূদ এবং সালাম পাঠের পর নিজেদের ও সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য দু‘আ করে খুৎবা শেষ করেন।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১২।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪২১; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৪৭।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১৯।

[4]. আল-মুসতাদরাক লিল হাকেম, হা/৭৮৪৬; ছহীহুল জামে‘, হা/১০৭৭।

[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১৬।

[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৩।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/২০০৪; ছহীহ ‍মুসলিম, হা/১১৩০; মিশকাত, হা/২০৬৭।

Magazine