[১৪৪২ হিজরী মোতাবেক ২০২১ সাল। পবিত্র হজ্জের আরাফার খুৎবা প্রদান শায়খবান্দারইবনুআব্দুলআযীযবালীলা(হাফি.)।উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহীর সম্মানিত মুহাদ্দিছ ও ‘আল-ইতিছাম গবেষণা পর্ষদ’-এর গবেষণা সহকারী শায়খ আখতারুজ্জামান বিন মতিউর রহমান। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি মহাধনী ও পরমদাতা। সর্বব্যাপী দয়া ও মহা করুণার মালিক। তিনি যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখান। আমরা তার অবিরত নেআমতরাজি ও কল্যাণের সপ্রশংস কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি ব্যতীত সত্য কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তার উপর, তার পরিবার-পরিজনের উপর এবং সকল ছাহাবীর উপর রহমত বর্ষণ করুন।
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর সকল আদেশ মান্য করো, তাহলে তোমরা মহাসফলতা অর্জন করবে এবং তোমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে সফলতা লাভ করতে পারবে। তিনি বলেছেন, ﴿وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ﴾ ‘আর উত্তম পরিণাম মুত্তাক্বীদের জন্যই’ (আল-ক্বাছাছ, ২৮/২৮)। তিনি আরো বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন যারা পরহেযগার এবং সৎকর্মপরায়ণ’ (আন-নাহল, ১৬/১২৮)। তিনি আরো বলেছেন, ‘নিশ্চয় যে তাক্বওয়া অবলম্বন করে ও ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহ সেইরূপ সৎকর্মপরায়ণদের শ্রমফল নষ্ট করেন না’ (আন-নাহল, ১৬/১২৮)। সকল ক্ষেত্রে ইহসান[1] বা নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আদেশ দিয়ে বলেন, ﴿إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى﴾ ‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, নিষ্ঠা এবং আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন’ (আন-নাহল, ১৮/৯০)। সুতরাং একজন বান্দা আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে ইহসান করবেন।
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যেন তাঁকে দেখছ। যদি তাকে না দেখ অর্থাৎ এমন অনুভূতি সৃষ্টি না হয় তাহলে মনে মনে ভাববে তিনি তোমাকে দেখছেন’।[2]
সবচেয়ে বড় ইহসান হলো তাওহীদের ক্ষেত্রে ইহসান করা। আর তা হচ্ছে ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক সাব্যস্ত করা। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَمَنْ يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى وَإِلَى اللَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ﴾ ‘যে ব্যক্তি সৎকর্মপরায়ণ হয়ে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে, সত্যিকারার্থে সে এক মজবুত হাতল ধারণ করে। আর যাবতীয় কাজের পরিণাম আল্লাহর অধীনে’ (লুক্বমান, ৩১/২২)। তিনি আরো বলেন, ﴿بَلَى مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِنْدَ رَبِّهِ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ﴾ ‘হ্যাঁ, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করেছে এবং সৎকর্মশীল হয়েছে, ফলত তার জন্য তার প্রতিপালকের নিকট প্রতিদান রয়েছে এবং তাদের জন্য কোনো আশঙ্কা নেই ও তারা চিন্তিতও হবে না’ (আল-বাক্বারা, ২/১১২)। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করা যাবে না। আল্লাহ ব্যতীত কারো জন্য ছালাত আদায় করা যাবে না। আল্লাহ ব্যতীত কারো নিকট কিছু প্রার্থনা করা যাবে না। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমার রব আদেশ করছেন, তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে’ (আল-ইসরা, ১৭/২৩)। তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয় মসজিদসমূহ একমাত্র আল্লাহর জন্য। সুতরাং আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে ডেকো না’ (আল-জিন, ৭২/১৮)। তিনি আরো বলেন, ‘সুতরাং তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করো এবং কুরবানী করো’ (আল-কাওছার, ১০৮/২)। এটা তাওহীদের সাক্ষ্যর দাবি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য মা‘বূদ নেই।
এর সাথে সম্পর্কিত আরেকটি বিষয় হলো- এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। এই সাক্ষ্যের দাবি হলো- রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশসমূহ মান্য করতে হবে, তার ভবিষ্যৎ সংবাদসমূহ বিশ্বাস করতে হবে। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নিয়ে এসেছেন তা ব্যতীত অন্য কোনো ইবাদত বা আমল করা যাবে না। কেননা, আল্লাহ দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। সুতরাং দ্বীনের মধ্যে কোনো বিদআত বৃদ্ধি করার প্রয়োজন নেই। আরাফার দিন যে আয়াত নাযিল হয়েছিল তাতে মহান আল্লাহ বলেন, ﴿الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا﴾ ‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেআমত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (আল-মায়েদা, ৫/৩)।
ইবাদতের ক্ষেত্রে ইহসানের অন্যান্য দিক হলো- (১) প্রতিদিন সময়মতো পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ছালাতের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী ছালাতের ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সাথে দাঁড়াও’ (আল-বাক্বারা, ২/২৩৮)। (২) যাকাত প্রদান করা। মহান আল্লাহ বলেন,﴿وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالَّذِينَ هُمْ بِآيَاتِنَا يُؤْمِنُونَ﴾ ‘আর আমার অনুগ্রহ তো প্রত্যেক বস্তুতে পরিব্যাপ্ত। সুতরাং আমি তা (অনুগ্রহ) তাদের জন্য নির্ধারণ করব, যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় ও আমার নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করে’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৫৬)। (৩) রামাযানের ছিয়াম পালন করা। মহান আল্লাহ বলেন, ﴿فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ﴾ ‘কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসের ছিয়াম রাখে’ (আল-বাক্বারা, ৮৫)। (৪) বায়তুল্লাহ ত্বওয়াফ করা। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا﴾ ‘মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের হজ্জ করা তার অবশ্য কর্তব্য’ (আলে ইমরান, ৩/৯৭)।
ইহসানের আরেকটি দিক হলো- পালনকর্তা ও উপাস্য হিসাবে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করা, ঈমান আনয়ন করা তাঁর ফেরেশতামণ্ডলীর প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর সকল রাসূলের প্রতি, আখেরাত দিবসের প্রতি এবং বিশ্বাস স্থাপন করা তাক্বদীরের ভালো-মন্দের প্রতি। আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত তাক্বদীর কার্যকর হবে এবং তাঁর সিদ্ধান্ত অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। তিনি মহাপবিত্র। তিনি তাঁর বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং বিভিন্ন প্রকারের নেআমত দান করেছেন। তিনি মানবজাতিকে আদম আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যমে অস্তিত্ব দান করেছেন এবং সকল প্রকারের কল্যাণ দ্বারা পরিব্যাপ্ত করেছেন এবং সকল কিছুর উপর তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাহলে কোন যুক্তিতে বান্দা তাঁর রবের ইবাদতে ইহসান অবলম্বন করবে না? মহান আল্লাহ বলেন, ﴿أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً﴾ ‘তোমরা কি দেখ না আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেআমতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন?’ (লুক্বমান, ৩১/২০)। তিনি আরো বলেন, ‘আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে’ (আত্ব-ত্বীন, ৯৫/৫)। তিনি আরো বলেন,﴿فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ﴾ ‘নিপূণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত কল্যাণময়’ (আল-মুমিনূন, ২৩/১৪)। তিনি আরো বলেন, ‘যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে উত্তমরূপে সৃজন করেছেন। আর মাটি হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে। অতঃপর তিনি তাকে সুগঠিত করেছেন, তাতে রূহ সঞ্চার করেছেন এবং তোমাদের দিয়েছেন চোখ, কান ও অন্তর। তোমরা অতিসামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (আস-সাজদা, ৩২/৭-৯)। বান্দার প্রতি তাঁর আরো একটি দয়া হলো, তিনি তাদের প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন এবং মানবজাতির হেদায়াতের জন্য রাসূল প্রেরণ করেছেন। যেমন তিনি মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,﴿لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ﴾ ‘আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে নিজেদের মধ্য হতে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর আয়াতগুলো তাদের নিকট তেলাওয়াত করে তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদের কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেন। এর অবশ্যই তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিল’ (আলে ইমরান, ৩/১৬৪)। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ নাযিল করেছেন, উত্তম বাণী সম্বলিত এমন এক গ্রন্থ, যাতে পারস্পরিক সাদৃশ্যপূর্ণ একই কথা নানাভাবে বারবার বলা হয়েছে। এর ফলে যারা স্বীয় পালনকর্তাকে ভয় করে তাদের শরীরের পশম খাড়া হয়ে যায়। অতঃপর তাদের দেহ-মন আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়ে যায়। এটিই আল্লাহর নির্দেশ। এর মাধ্যমে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন’ (আয-যুমার, ৩৯/২৩)।
আল্লাহ মানুষকে যে সকল বিষয়ে আদেশ করেছেন তার মধ্য হতে একটি হলো- আল্লাহর সৃষ্টিজীবের প্রতি দয়া দেখানো। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ﴾ ‘তুমি অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে ভালোবাসেন না’ (আল-ক্বছাছ, ২৮/৭৭)। সুতরাং মানুষ তার সাথে সম্পর্কিত সকলের প্রতি অনুগ্রহ করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, আত্মীয় ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। নিশ্চয় আল্লাহ আত্মম্ভরী দাম্ভিককে ভালোবাসেন না’ (আন-নিসা, ৪/৩৬)।
ইহসানের আরেকটি দিক হলো সন্তানকে সুশিক্ষা দেওয়া এবং সামাজিক সম্পর্ক ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া। সুতরাং স্বামীরা নিজ স্ত্রী এবং তালাকপ্রাপ্তাদের মাঝে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে এবং স্ত্রীগণও নিজ স্বামীর হক্ব আদায় করবে। তালাকপ্রাপ্তা নারীদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘(ক্ষতিপূরণস্বরূপ) খরচ প্রদানের ব্যবস্থা করবে। এটি সৎকর্মশীল লোকেদের পক্ষে (অবশ্য) কর্তব্য’ (আল-বাক্বারা, ২/২৩৬)। তিনি আরো বলেন, অতঃপর স্ত্রীকে হয় বিধিসম্মতভাবে রাখবে অথবা সদ্ভাবে বিদায় দেবে’ (আল-বাক্বারা, ২/২২৯)। তিনি আরো বলেন, ‘যদি তোমরা উত্তম কাজ কর এবং সংযমশীল হও, তাহলে তোমরা যা কর, আল্লাহ তার খবর রাখেন’ (আন-নিসা, ৪/১২৮)।
ইসলামী শরীআত দুর্বল, ও ইয়াতীমদের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠার আদেশ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ন্যায়সংগতপন্থা ব্যতীত ইয়াতীমদের ধনসম্পদের কাছেও যেয়ো না’ (আল-আন‘আম, ৬/১৫২)। ইসলামী শরীআত অধীন ব্যক্তি, শ্রমিক ও কর্মচারীদের প্রতিও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং তাদের প্রতি দয়া করার আদেশ করেছেন। কাজে নিয়োগ করার সময় কৃত ওয়াদা পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا﴾ ‘তোমরা প্রতিশ্রুতি পূরণ করো। কেননা প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসিত হতে হবে’ (আল-ইসরা, ১৭/৩৪)। তিনি আরো বলেন, ‘হে ইমানদারগণ তোমরা তোমাদের কৃত ওয়াদা পূর্ণ করো’ (আল-মায়েদা, ৫/১)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তারা (কর্মচারীরা) তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। তোমরা তাদের উপর সাধ্যাতীত কোনো কাজ চাপিয়ে দেবে না। যদি দাও তাহলে এ কাজে তাদের সাহায্য করো’।[3]
ইহসানের আরেকটি প্রকার হলো- মানুষের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং দেশ প্রতিরক্ষায় কাজ করা এবং মানুষকে তাদের কাজ-কর্ম নিরাপদে সম্পাদন করার সুযোগ সৃষ্টি করা। তাদের সম্পদ ও রক্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নাগরিকের কর্তব্য হলো রাষ্ট্রীয় সকল নিয়মকানুন মেনে চলা এবং শরীআত বহির্ভূত আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নেতার আনুগত্য করা। মানুষের অধিকার আদায় করা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করা, অন্যদের কষ্ট না দেওয়া, সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হতে বিরত থাকা। পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা হতে বাধা প্রদান করা।
একজন মুসলিম চতুষ্পদ জন্তু এবং জড় বস্তুর প্রতিও ইহসান করবে। যেমন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের উপর ইহসান অত্যাবশ্যক করেছেন। অতএব যখন হত্যা করবে, করুণার সাথে হত্যা করবে। যখন যবেহ করবে তখন করুণার সাথে যবেহ করবে। এ জন্য ছুরি ধারালো করে নিবে এবং যবেহের পশুকে প্রশান্তি দিবে’।[4]
মুসলিম হিসাবে একজন মানুষ পরিবেশ রক্ষায় আগ্রহী হবে এবং পরিবেশ নষ্ট করা হতে বিরত থাকবে। পৃথিবীতে যারা বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায় আল্লাহ তাদের অভিশাপ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে এবং শস্যক্ষেত্র ও (জীবজন্তুর) বংশ নিপাতের চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ বিপর্যয় দাঙ্গাহাঙ্গামা পছন্দ করেন না’ (আল-বাক্বারা, ২/২০৫)। বরং একজন মুসলিম অপর মুসলিমের সাথে এমনকি অমুসলিমের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘আহার্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে অন্ন দান করে’ (আল-ইনসান, ৭৬/৮)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘আপনি সর্বদা তাদের কোনো না কোনো প্রতারণা সম্পর্কে অবগত হতে থাকেন, তাদের অল্প কয়েকজন ছাড়া। অতএব, আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং মার্জনা করুন। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন’ (আল-মায়েদা, ৫/১৩)। এমনকি যার সাথে শত্রুতা আছে তার প্রতিও অনুগ্রহ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা মন্দকে প্রতিহত করো উত্তম পন্থায়। তাহলে যাদের সাথে তোমার শত্রুতা রয়েছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধু। এ চরিত্রের অধিকারী তারাই হয় যারা ধৈর্যশীল। এ চরিত্রের অধিকারী তারাই হয় যারা মহাভাগ্যবান’ (ফুছছিলাত, ৪১/৩৪-৩৫)। সম্পদ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যায্যভাবে আদান-প্রদান করাও ইহসানের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণরূপে মাপো এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওযন করো, এটাই উত্তম ও পরিণামে উৎকৃষ্ট’ (আল-আনআম, ৬/১৫২)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘এমন কে আছে যে, আল্লাহকে উত্তম কর্য দিবে? অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন’ (আল-বাক্বারা, ২/২৪৫)।
ইহসানের আরেকটি প্রকার হলো- মানুষের সাথে উত্তম ও সুন্দর ভাষায় কথা বলা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের সাথে সদালাপ করবে’ (আল-বাক্বারা, ২/৮৩)। তিনি আরো বলেন, ‘আর আমার বান্দাদেরকে বলো, তারা যেন এমন কথা বলে, যা অতি সুন্দর। নিশ্চয় শয়তান তাদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করতে চায়। নিশ্চয় শয়তান মানুষের স্পষ্ট শত্রু’ (আল-ইসরা, ১৭/৫৩)।
ইহসানের আরেকটি প্রকার হলো- (১) যথাসাধ্য সকল ক্ষেত্রে ইনছাফের সাথে কাজ করা, যেমন আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে ইহসান করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করো এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক করো। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হেদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভালো করেই জানেন’ (আন-নাহল, ১৬/১২৫)। তিনি আরো বলেন, ‘আর তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্ক করো না’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৪৬)। (২) অভিবাদন ও অভ্যর্থনার ক্ষেত্রে ইহসান করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তোমরা সম্ভাষিত হও তখন তোমরাও তা হতে শ্রেষ্ঠতর সম্ভাষণ করো অথবা ওটাই প্রত্যর্পণ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী’ (আন-নিসা, ৪/৮৬)।
মানুষের প্রতি ইহসানের আরেকটি প্রকার হলো- কেউ কষ্ট দিলে ধৈর্যধারণ করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি ধৈর্যধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা ইহসানকারীদের প্রতিদান নষ্ট করেন না’ (হূদ, ১১/১১৫)। মুমিনের গুণ হচ্ছে, সে উৎকৃষ্ট কথা ও কর্মের অনুসরণ করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শুনে আর এর উত্তমগুলো মেনে চলে, তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন। আর ওরাই হলো জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন’ (আয-যুমার, ৩৯/১৮)। কেননা পৃথিবীতে মুমিনদের প্রতিযোগিতার জায়গায় হচ্ছে ইহসান। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য- কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল’ (আল-মুলক, ৬৭/২)। তিনি আরো বলেন, ‘আর তিনিই আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে, আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপর, যাতে তিনি পরীক্ষা করেন, কে তোমাদের মধ্যে আমলে সর্বোত্তম। আর তুমি যদি বল, ‘মৃত্যুর পর নিশ্চয় তোমাদের পুনরুজ্জীবিত করা হবে’, তবে কাফেররা অবশ্যই বলবে, ‘এতো শুধুই স্পষ্ট জাদু’ (হূদ, ১১/৭)। তিনি আরো বলেন, ‘পৃথিবীর উপর যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে ওর শোভনীয় করেছি মানুষকে এই পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্যে কর্মে কে শ্রেষ্ঠ?’ (আল-কাহফ, ১৮/৭)। নিশ্চয় যে আল্লাহর বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ করে সে মূলত নিজের প্রতি অনুগ্রহ করল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ভালো কাজ করলে নিজেদের কল্যাণের জন্যই তা করবে’ (আল-ইসরা, ১৭/৭)। এটা আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভের উপায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কল্যাণকর কাজ করে যাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ কল্যাণকারীদেরকে ভালবাসেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৫)। তিনি আরো বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ কল্যাণকারীদের সাথে আছেন’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৬৯)। তিনি আরো বলেন, ‘উত্তম আমলকারীদেরকে সুসংবাদ দাও’ (আল-হজ্জ, ২২/৩৭)। তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর দয়া উত্তম আমলকারীদের নিকটবর্তী’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৫৬)। সুতরাং যারা সকলক্ষেত্রে ইহসানের পথ অবলম্বন করে তাদের জন্য সুসংবাদ হলো- তাদের প্রতিদান বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে তার ইসলামে নিষ্ঠাবান হয় তার কৃত প্রত্যেকটি নেক কাজের বিনিময়ে ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত ছওয়াব লেখা হয়’। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে সৎ কাজ নিয়ে এসেছে, তার জন্য হবে তার ১০ গুণ’ (আল-আনআম, ৬/১৬০)।
বান্দার প্রতি আল্লাহর আরেকটি অনুগ্রহ হলো- তিনি তাদের জন্য তওবার দরজা খুলে রেখেছেন তাদের পাপ ক্ষমা করার জন্য। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় সৎ আমল মন্দ আমলকে দূরীভূত করে দেয়’ (আন-নামল, ২৭/১১)। ইহসানকারীর প্রশংসা ও গুণাবলির ব্যাপারে শরীআতে যা বর্ণিত হয়েছে তা অতি উত্তম। এই জন্যই ইহসান অস্বীকারকারীকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভর্ৎসনা করেছেন।
খুৎবার শেষাংশে খত্বীব বানদার বালীলা বর্তমান বিশ্বব্যাপী করোনার দুর্যোগ মুহূর্তে হাজীদের সকল প্রকারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হজ্জ পালনের ব্যবস্থা করা এবং হাজীদের সকল প্রকার নিরাপত্তার মাধ্যমে হজ্জকার্য সম্পাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখায় বর্তমান বাদশা ও দায়িত্বশীলদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বিশেষ দু‘আ করেন। তিনি হাজীদেরকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পদ্ধতি অনুযায়ী হজ্জ পালনের নির্দেশ দেন। সকল হাজীদেরকে তাদের আত্মীয়স্বজন, দেশবাসীসহ বিশ্বের সকল মুসলিমের জন্য দু‘আ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কেননা আল্লাহ তাআলা আরাফার দিনে যত সংখ্যক মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন তত সংখ্যক আর কোনো দিন মুক্তি দেন না। তারা মহান আল্লাহর এত নিকটবর্তী হয়ে যান যে, মহান আল্লাহ তাদের বিষয়ে ফেরেশতামণ্ডলীর নিকট গর্ব করেন। অতঃপর আরাফার সম্মানিত খত্বীব হজ্জের নিয়মকানুন সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করেন। পরিশেষে বিশ্ববাসীর জন্য দু‘আ করেন এবং খুৎবা শেষ করেন।
[1]. ইহসান হলো- ‘ইবাদতসহ যাবতীয় কাজ এমন অনুভূতি নিয়ে করা যেন আল্লাহকে সামনেই রয়েছেন।’ এমন অনুভূতি থাকলে তার দ্বারা দুর্নীতি, অন্যায় ও পাপকর্ম সংঘটিত হওয়া অসম্ভব।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৭৭৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৮।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/ ২৫৪৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৬১।
[4]. মিশকাত, হা/৪০৭৩।