[৪জুমাদাল আখেরাহ, ১৪৪৩ হি. মোতাবেক ৭ জানুয়ারি, ২০২২। মদীনামুনাওয়ারারমসজিদেনববীতে জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খ আব্দুল বারী আছ-ছুবায়তী হাফিযাহুল্লাহ।উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহীর সম্মানিত সিনিয়র শিক্ষক শায়খ মাহবূবুর রহমান মাদানী। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
প্রথমখুৎবা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি দেশ ও বান্দাকে সাহায্য করেন। যাঁর রহমত কামনা করে উপত্যকা, পাহাড়-পর্বত নিম্নভূমি। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক তাঁর কোনো শরীক নেই। যিনি বলেন,وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلِ أَنْ يُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ مِنْ قَبْلِهِ لَمُبْلِسِينَ - فَانْظُرْ إِلَى آثَارِ رَحْمَتِ اللَّهِ كَيْفَ يُحْيِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا إِنَّ ذَلِكَ لَمُحْيِ الْمَوْتَى وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘যদিও ইতোপূর্বে তাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণের পূর্বে তারা ছিল চরমভাবে হতাশ। অতএব আল্লাহর রহমতের ফল দেখে নাও, কীভাবে তিনি ভূমিকে তার মৃত্যুর পর জীবিত করেন’ (আর-রূম, ৩০/৪৯-৫০)। আমি আরো সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আমাদের নেতা, আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। তার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বান্দার অন্তরগুলোকে উদ্ধার করেন। দরূদ বর্ষিত হোক তাঁর প্রতি, তাঁর পরিবার ও তাঁর ছাহাবীদের প্রতি, যারা ইতিহাস লিখেছেন পরিচ্ছন্ন কালি দ্বারা।
অতঃপর, আমি আপনাদের সকলকে সেই সাথে নিজেকেও আল্লাহভীরুতার উপদেশ দিচ্ছি, যার মাধ্যমে আর্তচিৎকারের দিন রক্ষা পাওয়া যাবে। হে আল্লাহর বান্দা! প্রত্যেক কাল বা যুগের রয়েছে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য। যার মাধ্যমে এক যুগ অন্য থেকে আলাদা হয়ে যায়। বর্তমান সময়ে মানুষজাতি শৈল্পিক ও প্রযুক্তির বিশ্বে ব্যাপক অগ্রসর হয়েছে। দূরত্ব কাছে এসেছে, অনেক কঠিন ও কষ্টের জিনিস হালকা হয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৌঁছা সহজ হয়েছে এবং বস্তুগত জীবন বিভিন্ন লক্ষ্য পানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু তা আত্মার তীব্র পিপাসা মিটায়নি, দুনিয়াপ্রত্যাশীকে পরিতৃপ্ত করেনি, যা তার প্রকৃতিগত স্বভাব, যার উপর আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন। ফলে আত্মা কাঁপছে ও অন্তর কঠিন হয়েছে। নির্ভরশীলতা, দৃঢ়বিশ্বাস ও সন্তুষ্টির তাৎপর্য সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। অন্তরে অনুপ্রবেশ করেছে চিন্তা ও অস্থিরতা এবং তার উপর তাঁবু গেড়েছে বিষণ্নতা। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, চিন্তা ও অস্থিরতা এই যুগের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। আর এটা তাড়া করছে চাকরি, সন্তানাদি, সুস্থতা ও জীবিকার ব্যাপারে ভয়ের দিকে ।
ইসলাম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, চিন্তা ও অস্থিরতার চিকিৎসা করেছে এবং এমন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যা উক্ত থাবায় পতিত হওয়া থেকে উদ্ধার করবে এবং তার ছিদ্রপথ বন্ধ করে দিবে। মানুষের জীবন উৎকণ্ঠা ও চিন্তা হতে মুক্ত নয়। তাকে প্রত্যেক যাত্রায় কষ্ট ভোগ করতে হবে এবং অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي كَبَدٍ ‘নিঃসন্দেহে আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে’ (আল-বালাদ, ৯০/৪)। এমনকি নবীগণকেও তাদের চলার পথে বিভিন্ন প্রকার দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। তাদের মধ্যে কাউকে অসুস্থতা দ্বারা, কাউকে অভাব দিয়ে, কাউকে প্রিয়জনকে হারানোর মধ্য দিয়ে, কাউকে বিতাড়িত করে পরীক্ষা করা হয়েছে। আর আমাদের নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সকল প্রকার বালা-মুছীবত দ্বারা পরীক্ষা করা হয়েছে। তাই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لَقَدْ أُوذِيتُ فِي اللَّهِ وَمَا يُؤْذَى أَحَدٌ وَلَقَدْ أُخِفْتُ فِي اللَّهِ وَمَا يُخَافُ أَحَدٌ، وَلَقَدْ أَتَتْ عَلَيَّ ثَالِثَةٌ وَمَا لِي وَلِبِلَالٍ طَعَامٌ يَأْكُلُهُ ذُو كَبِدٍ إِلَّا مَا وَارَى إِبْطُ بِلَالٍ ‘আল্লাহর পথে আমাকে যতটা কষ্ট দেওয়া ও নির্যাতন করা হয়েছে, অপর কাউকে সেরূপ নির্যাতন করা হয়নি এবং আমাকে আল্লাহর পথে যতটা ভীত-সন্ত্রস্ত করা হয়েছে, অপর কাউকে সেরূপ ভীত-সন্ত্রস্ত করা হয়নি। আমার ও বেলালের উপর দিয়ে তিন তিনটি রাত এমনভাবে অতিবাহিত হয়েছে যে, বেলালের বগলের নিচে দাবিয়ে রাখা সামান্য খাদ্য ছাড়া এমন কোনো খাদ্য ছিল না, যা কোনো প্রাণী খেতে পারে’।[1] এত বিপদ ও কষ্ট সত্ত্বেও তার অন্তরে দুশ্চিন্তা প্রবেশ করতে পারেনি। তিনি অস্থিরতা অনুভব করেননি। কেননা তিনি মহান আল্লাহর প্রতিপালনে লালিতপালিত হয়েছেন। তিনি তাকে শিক্ষা দিয়েছেন, তাই তিনি শিখেছেন। তিনি প্রশস্ত অন্তর নিয়ে জীবনযাপন করেছেন। আল্লাহ বলেন,أَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَ ‘আমি কি তোমার বক্ষদেশকে প্রসারিত করে দেইনি? সূরার শেষে আল্লাহ বলেন,فَإِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبْ - وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ ‘কাজেই তুমি যখনই অবসর পাবে, ইবাদতের কঠোর শ্রমে লেগে যাবে। আর তোমার রবের প্রতি গভীরভাবে মনোযোগ দিবে’ (আলাম নাশরাহ, ৯৪/১, ৭-৮)।
দুশ্চিন্তা-বিষণ্নতা ও উৎকণ্ঠা দূর করার উপায়সমূহ : উৎকণ্ঠা ব্যাধির অধিকতর ফলদায়ক ওষুধ হলো ইবাদতের মুক্তাঙ্গনে জীবন পরিচালনা করা, বিভিন্ন প্রকার আনুগত্য কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা এবং ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করা। যেমন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হিজরতকালীন সময়ের ঘটনা— যখন তিনি তার সফরসঙ্গী আবূ বকর রযিয়াল্লাহু আনহু-কে সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হলেন। এদিকে পদব্রজী ও অশ্বারোহী শত্রুরা তলোওয়ার উন্মুক্ত করে সর্বত্র তার খোঁজ করে ফিরছে। তারা আশ্রয়স্থল হিসেবে পাহাড়ের গুহা বেছে নেন। শত্রুরা গুহার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলে আবূ বকর রযিয়াল্লাহু আনহু চিন্তিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের কেউ যদি পা উচিয়ে দেখে, তবে আমাদের দেখতে পাবে। কিন্তু সে সময়েও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন পাহাড়ের মতো অনড়, অটল ও নিশ্চিন্ত। তাই তাঁর সঙ্গীকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, যে দুজনের সাথে আল্লাহ তৃতীয় হিসেবে আছেন, তাদের ব্যাপারে তোমার কী ধারণা? কাজেই বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ তো আমাদের সাথে আছেন।[2]
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাজ ও কথার মাধ্যমে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, কীভাবে দুঃখ, চিন্তা ও উৎকণ্ঠা দূর হবে। তিনি বেলাল রযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন, يَا بِلَالُ أَقِمِ الصَّلَاةَ أَرِحْنَا بِهَا ‘হে বিলাল! ছালাত ক্বায়েম করো, আমরা এর মাধ্যমে স্বস্তি লাভ করতে পারব’।[3] কোনো বিষয় তাঁকে গুরুতর করলে তিনি ছালাত আদায় করতেন। কারণ ছালাতে বিষণ্ন ব্যক্তি তার রবের কাছে সংগোপনে বলতে পারে। আর আল্লাহ তাআলা প্রার্থনাকারীর দু‘আ কবুল করেন। আল্লাহ বলেন,أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاءَ الْأَرْضِ أَإِلَهٌ مَعَ اللَّهِ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ ‘কে তিনি, যিনি (নিরুপায়ের) আর্তের আহ্বানে সাড়া দেন, যখন সে তাঁকে ডাকে এবং বিপদ-আপদ দূরীভূত করেন এবং কে তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেন? আল্লাহর সাথে অন্য কোনো মা‘বূদ আছে কি? তোমরা উপদেশ অতি সামন্যই গ্রহণ করে থাকো’ (আন-নামল, ২৭/৬২)।
আর কীভাবে বিষণ্ন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট দু‘আ করা হতে অমনোযোগী হতে পারে, যিনি দুর্দশাগ্রস্তদের আশ্রয়স্থল ও দুশ্চিন্তা বিদূরকারী। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلَا رَادَّ لِفَضْلِهِ يُصِيبُ بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَهُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ ‘আল্লাহ যদি তোমাকে কষ্ট দিতে চান, তাহলে তিনি ছাড়া তা দূর করার কেউ নেই। আর আল্লাহ যদি তোমার কল্যাণ করতে চান, তাহলে তাঁর অনুগ্রহ প্রতিরোধক কেউ নেই। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ দিয়ে ধন্য করেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু’ (ইউনুস, ১০/১০৭)। আনাস ইবনু মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি দু‘আ করতেন,اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الهَمِّ وَالحَزَنِ وَالعَجْزِ وَالكَسَلِ وَالبُخْلِ وَالجُبْنِ وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَال অর্থ. ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি চিন্তাভাবনা, অপারগতা, অলসতা, কৃপণতা, কাপুরুষতা, অধিক ঋণ এবং দুষ্ট লোকের প্রাধান্য থেকে’।[4]
আর যে ব্যক্তি অনিচ্ছায় নয়, বরং স্বেচ্ছায় জীবনের উৎকণ্ঠার উপর ধৈর্যধারণ করবে এবং ছওয়াবের আশা করবে, তার উপর যে বিপদ এসেছিল আল্লাহ তার মিনিময়ে তাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন। মহান আল্লাহ বলেন,الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ - أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ ‘নিশ্চয় যারা বিপদকালে বলে থাকে, আমরা আল্লাহরই আর আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। এদের প্রতি রয়েছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে অনুগ্রহ ও করুণা আর এরাই হেদায়াতপ্রাপ্ত’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৬-১৫৭)।
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীর উপর দরূদ পাঠ করাকে যিকির হিসেবে পরিণত করে তিনি তাঁর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উম্মতকে সম্মানিত করেছেন। আর এই যিকিরকে চিন্তা-উৎকন্ঠা থেকে পরিত্রাণের উপায় ও সুরক্ষা বানিয়েছেন। উবাই ইবনু কা‘ব রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো আপনার উপর অধিকহারে দরূদ পাঠ করি। আপনার জন্য দরূদ পাঠের কতটুকু সময় খরচ করব? তিনি বলেন, তুমি যতক্ষণ ইচ্ছা কর। হাদীছের শেষ অংশে উবাই রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাহলে আমার পুরো সময়টাই আপনার উপর দরূদ পাঠে কাটিয়ে দিব? তিনি বললেন, ‘তাহলে তোমার চিন্তা ও কষ্টের জন্য তা যথেষ্ট হবে এবং তোমার পাপসমূহ ক্ষমা করা হবে’।[5]
আর পরকালের চিন্তা অন্তরকে প্রশস্ত করে এবং আত্মাকে প্রশান্ত করে দেয়। আনাস ইবনু মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ كَانَتِ الآخِرَةُ هَمَّهُ جَعَلَ اللَّهُ غِنَاهُ فِي قَلْبِهِ وَجَمَعَ لَهُ شَمْلَهُ وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِيَ رَاغِمَةٌ ‘যে ব্যক্তির একমাত্র চিন্তার বিষয় হবে পরকাল, আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তির অন্তরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন এবং তার যাবতীয় বিচ্ছিন্ন কাজ একত্রিত করে সুসংযত করে দিবেন, তখন তার নিকট দুনিয়াটা নগণ্য দেখা দিবে’।[6] আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ جَعَلَ الْهُمُومَ هَمًّا وَاحِدًا هَمَّ آخِرَتِهِ كَفَاهُ اللَّهُ هَمَّ دُنْيَاهُ وَمَنْ تَشَعَّبَتْ بِهِ الْهُمُومُ فِي أَحْوَالِ الدُّنْيَا لَمْ يُبَالِ اللَّهُ فِي أَيِّ أَوْدِيَتِهَا هَلَكَ ‘যে ব্যক্তি তার সমস্ত চিন্তাকে একই চিন্তায় অর্থাৎ পরকালের চিন্তায় কেন্দ্রীভূত করেছে, আল্লাহ তার দুনিয়ার চিন্তার জন্য যথেষ্ট। অপর দিকে, যে ব্যক্তি যাবতীয় পার্থিব চিন্তায় নিমগ্ন থাকবে, সে যে কোনো উন্মুক্ত মাঠে ধ্বংস হোক, তাতে আল্লাহর কিছু আসে যায় না’।[7]
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য কুরআন ও সুন্নাহতে বরকত দান করুন। আর তাতে যে পথনির্দেশনা ও বিবরণ রয়েছে, তা দ্বারা আমাদের উপকার প্রদান করুন। আর আমি নিজের ও আপনাদের এবং সকল মুসলিমের জন্য সকল প্রকার গুনাহ ও পাপ হতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। নিশ্চয় তিনি তওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল।
দ্বিতীয় খুৎবা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, শুরুতে ও শেষে সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য এবং তিনিই আশ্রয়স্থল। আর আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। যিনি বলেন, وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى- وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَى ‘আর এই যে, মানুষ তাই পায়, যা সে চেষ্টা করে। আর এই যে, তার প্রচেষ্টার ফল শীঘ্রই দেখা যাবে’ (আন-নাজম, ৫৩/৩৯-৪০)। আমি আরো সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আমাদের নেতা, আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাআলা শান্তি বর্ষণ করুন তার প্রতি এবং তার পরিবার ও তার ছাহাবীগণের প্রতি।
অতঃপর, আমি আপনাদের সকলকে সেই সাথে নিজেকেও আল্লাহভীরুতার উপদেশ দিচ্ছি। আর যে জিনিস দুশ্চিন্তা দূর করবে এবং অন্তরে প্রশান্তি আনবে তা হলো :
১. আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَا يُصِيبُ المُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلاَ وَصَبٍ وَلاَ هَمٍّ وَلاَ حُزْنٍ وَلاَ أَذًى وَلاَ غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا إِلَّا كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ ‘মুসলিম ব্যক্তির উপর যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফুটে, এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন’।[8]
২. গরীব-অসহায়দেরকে দান ও ছাদাক্বা এবং বিপদগ্রস্তদের বিপদ দূর করা : কারণ যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের বিপদ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাআলা তার বিপদ-কষ্ট দূর করবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ রাতে ও দিনে, প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ব্যয় করে থাকে, তাদের জন্য সেই দানের ছওয়াব তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না’ (আল-বাক্বারা, ২/২৭৪)।
পরিশেষে সম্মানিত খত্বীব রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি দরূদ পড়ার জন্য সকলকে উৎসাহ প্রদান করে কুরআনের একটি আয়াত পাঠ করেন, যার অর্থ হলো— নিশ্চয় আল্লাহ নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও নবীর জন্য দু‘আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। হে বিশ্বাসীগণ! তোমরাও নবীর উপর দরূদ পড়ো এবং তাঁর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাভরে সালাম জানাও (আল-আহযাব, ৩৩/৫৬)। এরপর দরূদে ইবরাহীম পাঠ করেন এবং চার খলীফার জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেন। অতঃপর সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য আল্লাহর নিকট শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে খুৎবা শেষ করেন।
[1]. তিরমিযী, হা/২৪৭২; ইবনু মাজাহ, হা/১৫১, হাদীছ ছহীহ।
[2]. সূরা আত-তওবা, ৯/৪০; ছহীহ বুখারী, হা/১৭৭।
[3]. আবূ দাঊদ, হা/৪৯৮৫, হাদীছ ছহীহ।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/২৮৯৩।
[5]. তিরমিযী, হা/২৪৫৭, হাদীছ হাসান।
[6]. তিরমিযী, হা/২৪৬৫, হাদীছ ছহীহ।
[7]. ইবনু মাজাহ, হা/২৫৭, হাদীছ হাসান।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৪১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৭৩।