কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কল্যাণ লাভের গুরুত্বপূর্ণ চারটি উপদেশ

post title will place here

[১৩ শা‘বান, ১৪৪৫ হি. মোতাবেক ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ মদীনা মুনাওয়ারার আল-মাসজিদুল হারামে (মসজিদে নববী) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খ ড. আহমাদ বিন তালেব বিন হামীদ হাফিযাহুল্লাহ। উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]

প্রথমখুৎবা

যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই। আমরা কেবল তাঁরই প্রশংসা করি এবং তাঁর কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের নফসের খারাবি ও আমলের মন্দ দিক থেকে আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে হেদায়াত দান করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ হেদায়াত করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নবী ও মহান নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। হে আল্লাহ! আপনি আপনার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ, ছাহাবী ও তাঁর অনুসারীদের উপর ছালাত ও সালাম অবতীর্ণ করুন।

আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ﴾ ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো যেমনভাবে তাঁকে ভয় করা উচিত। আর তোমরা মুসলিম না হয়ে কখনো মরো না’ (আলে ইমরান, /১০২)। মহান আল্লাহ বলেন,﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا﴾ ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা হতে তদীয় সহধর্মিণী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের উভয় হতে বহু নর ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। সেই আল্লাহকে ভয় করো যাঁর নামের দোহাই দিয়ে তোমরা একে অপরকে যাচ্ঞা করো এবং আত্মীয়-জ্ঞাতিদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করো। নিশ্চয় আল্লাহই তত্ত্বাবধানকারী’ (আন-নিসা, /)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا - يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا﴾ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজগুলোকে শুদ্ধ করে দিবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই এক মহাসাফল্য অর্জন করল’ (আল-আহযাব, ৩৩/৭০-৭১)

অতঃপর, নিশ্চয়ই চিরসত্য কালাম হলো আল্লাহর কালাম। আর সর্বোত্তম হেদায়াত হলো মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত হেদায়াত। সর্বনিকৃষ্ট কাজ হলো দ্বীনের মধ্যে বিদআতের প্রচলন করা। আর প্রত্যেক বিদআত হচ্ছে পথভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক পথভ্রষ্টতা জাহান্নামের দিকে ধাবিত করে।

হে মুমিনগণ! আপনারা জেনে রাখুন যে, নিশ্চয় চারটি জিনিস বান্দার জন্য অধিক উপকারী। সেগুলো হলো— (১) তাওহীদের স্বীকৃতির মাধ্যমে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা, আনুগত্যের সাথে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করা এবং শিরক ও শিরককারীদের থেকে দূরে থাকা। (২) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে বিনয়ী হওয়া এবং তাঁর কাছে নিজেকে মুখাপেক্ষী করা। (৩) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতি সুধারণা রাখা। (৪) একমাত্র তাঁর কাছেই তওবা করা, যদিও বান্দা দিনে ৭০ বার পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে; তবুও তার কাছেই ক্ষমার জন্য প্রত্যাবর্তন করবে।

আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের অর্থ হলো তাঁর জগৎ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত বিষয়ে ইহকালের প্রশান্তি, পরকালে মহাঅনুগ্রহ অর্জন এবং তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে শরীক স্থাপন থেকে বেঁচে থাকা। বান্দা কীভাবে আল্লাহর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, যে বিষয়ে তাঁর সাথে বান্দার কোনো শরীকানা নেই। বরং বান্দা নিজেকে তাঁর রাজ্যে রেখে কল্পনা করলে দেখবে যে, সে তাঁর বিশাল রাজত্বের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র এবং এর বিশাল সৃষ্টির মাঝে সে অতি নগণ্য একজন। তিনি বান্দাকে পরিচালনা করেন যেভাবে তিনি সৃষ্টিজগৎ পরিচালনা করেন। কাজেই বান্দা কোনোভাবেই দাসত্ব থেকে বের হয়ে প্রভুত্বের গুণ দাবি করতে পারে না। কেননা জগৎ নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাচনের ক্ষমতার দাবি করা অন্তরের কাবীরা গুনাহের শামিল। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ مَا كَانَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ سُبْحَانَ اللَّهِ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾ ‘আর আপনার রব যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন এবং যা ইচ্ছে মনোনীত করেন, এতে ওদের কোনো হাত নেই। আল্লাহ পবিত্ৰ, মহান এবং তারা যা শরীক করে তা থেকে তিনি ঊর্ধ্বে!’ (আল-ক্বাছাছ, ২৮/৬৮)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে বিনয়ী হওয়া এবং তাঁর কাছে নিজেকে মুখাপেক্ষী করার অর্থ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত নাযিল হওয়া, বিপদাপদ দূরীকরণ, তাঁর অনুগ্রহের পোশাকে নিজেকে আবৃতকরণ এবং বালা-মুছীবত থেকে সুরক্ষা লাভ করা। এর প্রতিদানস্বরূপ উত্তম অভিভাবক মহান আল্লাহ বান্দার উপর থেকে ক্ষতি প্রতিরোধ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন দানের দায়িত্ব নেন। এটাই শ্রেষ্ঠ দ্বার ও সরল পথ। কুফরী অবস্থাতেও তাঁর কাছে কেউ বিনয়ী ও মুখাপেক্ষী হলে যেখানে সুফল পায়, সেখানে ঈমানের সাথে এটা করলে ব্যক্তি সুফল পাবে না এটা কি হতে পারে?! আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যখন তোমাদেরকে সমুদ্রে বিপদ স্পর্শ করে, তখন তিনি ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাকো, তারা (তোমাদের মন থেকে) হারিয়ে যায়; অতঃপর তিনি যখন তোমাদেরকে রক্ষা করে স্থলে আনেন, তখন তোমরা বিমুখ হয়ে যাও। আর মানুষ তো খুব অকৃতজ্ঞ’ (আল-ইসরা, ১৭/৬৭)। আর এটাই একমাত্র দরজা, যা আল্লাহ তাঁর নিজের ও বান্দাদের মাঝে স্থির করেছেন। যে তাঁর অভিমুখী হয় তার উপর অনুগ্রহের ধারা বর্ষিত হয়, তাঁর দরজায় যে দণ্ডায়মান হয় তার উপর ধারাবাহিকভাবে নেয়ামতরাজি আগমন করে এবং যে সেই দরজা দিয়ে তাঁর নিকট প্রবেশ করে সে প্রকৃত অনুগ্রহ লাভ করে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,﴿فَلَوْلَا إِذْ جَاءَهُمْ بَأْسُنَا تَضَرَّعُوا﴾ ‘সুতরাং যখন আমাদের শাস্তি তাদের উপর আপতিত হলো, তখন তারা কেন বিনীত হলো না? কিন্তু তাদের হৃদয় নিষ্ঠুর হয়েছিল এবং তারা যা করছিল শয়তান তা তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল’ (আল-আনআম, ৬/৪৩)

আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখার অর্থ হলো, যাকে আল্লাহ তাআলা এটা দান করেছেন সে কতই না সৌভাগ্যবান! যে ব্যক্তি এটা লাভ করেছে সে কল্যাণের কোনো কিছুই হারায়নি। আর যে ব্যক্তি এটা হারিয়েছে সে কল্যাণের কোনো কিছুই পায়নি। আপনি সুধারণার চেয়ে নিজের জন্য অধিক উপকারী ও গ্রহণযোগ্য কোনো ওযর-ই আল্লাহর নিকট পাবেন না। আপনি এটার চেয়ে আল্লাহর দিকে অধিক পথ প্রদর্শনকারী ও দিক-নির্দেশনা দানকারী অন্য কোনো বিষয় পাবেন না। এটা আপনাকে আল্লাহ সম্পর্কে সে শিক্ষাই দিবে, যা তিনি আপনার সাথে করতে চান। এটি এমন সুসংবাদ দিবে, যা চোখ কখনো অবলোকন করেনি এবং ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহর মধ্যে হাদীছে কুদসীতে এর বর্ণনা এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি সেইরূপই, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে’।[1]

بارَك اللهُ لي ولكم في القرآن العظيم، ونفعني وإيَّاكم بما فيه من الآياتِ والذِّكْرِ الحكيمِ، ونفَعَنا بهدي سيد المرسلين وقوله القويم...

দ্বিতীয়খুৎবা

যাবতীয় প্রশংসা বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই। যিনি পরম দয়ালু ও মেহেরবান। আমি আমার রবের দেওয়া প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি এবং আমি তাঁর পরিপূর্ণ গুণকীর্তন করছি যেভাবে তিনি নিজেকে গুণান্বিত করেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই, তিনি মুত্তাক্বীদের অভিভাবক। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আমাদের নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এবং ছবরকারীদের ইমাম। হে আল্লাহ! আমাদের নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল ছাহাবীদের উপর দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ করুন। আল্লাহ তাআলার বাণী,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ﴾ ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো’ (আত-তাওবা, ৯/১১৯)

আপনারা জেনে রাখুন! নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে বারবার তওবা করা সকল পদমর্যাদা ও সম্মান লাভের মূল। যে এটা হারায় তার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই আর যে তা পায় তার হারানোর কিছু নেই। এটা দৃশ্যমান ও গোপন সমস্ত কল্যাণের চাবিকাঠি, মর্যাদার উৎস এবং বেলায়েত অর্জনের মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা তওবা না করাকে যুলুম বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন,﴿وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾ ‘আর যারা তওবা করে না, তারাই তো যালেম’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১১)। তওবা করা নবী-রাসূল, ছিদ্দীক-ওলী, সৎকর্মশীল-তাক্বওয়াবান, পথভ্রষ্ট পাপাচারী এবং দুর্ভাগা কাফের সকলের জন্যই জরুরী। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ﴾ ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো’ (আন-নিসা, ৪/১)। অতএব, তওবা করা ও অনুতপ্ত হওয়ার মাধ্যমে তাঁর প্রতি তাক্বওয়া অবলম্বন করুন। অসৎকর্মশীলদের তওবা অসৎকর্ম পরিত্যাগের মাধ্যমে হবে আর সৎকর্মশীলদের তওবা সৎকর্ম চালু রাখার মাধ্যমে হবে। তওবা নিয়মিতভাবে হোক অথবা অনিয়মিতভাবে হোক উভয়টি চালু রাখাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’ (আন-নূর, ২৪/৩১)

মোটকথা হলো, যাকে অল্প কিছু উপকৃত করে না, তাকে বেশি কিছুও উপকৃত করে না। আর যে ইশারায় উপকৃত হতে পারে না, সে স্পষ্ট বাক্য ব্যবহারেও উপকৃত হয় না। যদি আল্লাহ আপনাকে বুঝ দান করেন, তাহলে আপনার শোনা বন্ধ হবে না এবং উপকৃত হতেও সময় লাগবে না।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৪০৫।

Magazine